May 1, 2023

The influence of Kavi Gan on Vijay Sarkar’s songs

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Nazmul Haque and Dr. Maumita Vairagi

Abstract:

Vijay Krishna Adhikari, popularly known as ‘Pagal Vijay,’ was born in Dumdi village of Narail, Bangladesh (then Bengal). Despite facing the early loss of his parents, Vijay Sarkar’s journey unfolded through various schools, where he encountered teachers who imparted knowledge of dance, singing, acting, and, most significantly, music. His education extended up to class 10, and he briefly worked as a teacher and Naib. Vijay Sarkar’s immersion into the world of music began in 1925 when he learned poetry from Kabial Manohar Sarkar of Gopalganj. His musical prowess expanded under the guidance of Rajendranath Sarkar, and in 1929, he formed his singing group, gaining popularity as a Kabila. His lyrics and tunes, deeply rooted in Bhatiali traditions, earned him immense acclaim. Notably, his Dhua songs became a hallmark of his style. Throughout his career, Vijay Sarkar composed around 400 Sakhi Sangams and Dhua songs, with publications spanning Bangladesh and West Bengal. His performances, totalling approximately 4000 concerts, took place at prestigious institutions like Bangla Academy, Bangladesh Shilpakala Academy, and Radio-Television, where he showcased his mastery of Kabigan. He also ventured into Ramayana songs. Vijay Sarkar’s connection with luminaries like Rabindranath Tagore, Kazi Nazrul Islam, Jasimuddin, and Abbasuddin Ahmad further solidified his influence in the musical landscape. His family surname was Bairagi, but he adopted the title Adhikari, forsaking Vairagi. Vijay Sarkar, the Kabyal, left an indelible mark on the cultural tapestry of Bangladesh and West Bengal, his legacy intertwined with the rich tradition of Kavi Gan.

বিজয় সরকারের গানে কবি গানের প্রভাব 

নাজমুল হক ও ড. মৌমিতা বৈরাগী

[নাজমুল হক, সহকারী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, উদায়নারায়ণপুর মাধবীলতা মহবিদ্যালয়, হাওড়া], [ড. মৌমিতা বৈরাগী, গবেষক, রবীন্দ্রাভারতী বিশ্ববিদ্যালয়]

লোক কবি বিজয় সরকারের গানের উপর কবি গানের প্রভাব কতটা,সেই বিষয়ে আমার পত্র উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথমেই জানা দরকার কবিগান সম্পর্কে নানা তথ্যাদি। বাংলা লোকসংগীতে কবিগান একটি প্রাচীনতম ধারা । ডক্টর সুশীল কুমার দের মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় । সজনীকান্ত দাশ তার “বাংলার কবিগান ” গ্রন্থ লেখেন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সাংগীতিক প্রচলিত বিভিন্ন  ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম । ধারা গুলির নাম বহু বিচিত্র- তরজা, পাঁচালী, আখড়াই,হাফ আখড়াই,দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, কীর্তন,কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি | অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে” বলেছেন চর্যাপদের যারা কবি বা রচয়িতা বল্লাল সেনের প্রভাবে তারা আত্মগোপন করলেন | বল্লাল সেন থেকে মধ্যযুগের সময় অবধি এমনকি বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এদের কোন খবর ছিল না । তাহলে যারা কবিগান রচনা করতেন বা পরিবেশন করছেন তারা কি এই চর্যা গানের উত্তরসূরী?

কবিগান হলো যারা তাৎক্ষণিকভাবে যে কোন ছন্দে বা সুরে কথা বলতে পারেন, এই Oral Tradition  কেই কবিগান বলা হয়  | কবিগানের দুটি অঙ্গ- একটি লিখিত অন্যটি মৌখিক। কবিগানে দুটিই বর্তমান থাকে । কবিয়াল বিজয় সরকারের গানের ক্ষেত্রে বা পরিবেশনায় মৌখিক বা লিখিত দুটোই আছে । যাদের এই দক্ষতা থাকে তাদেরই বলা হয় কবিয়াল বা লোককবি । অনেকে আবার চারণ কবিও বলেন । কিন্তু চারণকবিরা অন্যের ছন্দ গেয়ে বেড়ান । বেশিরভাগ গবেষকরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে গুরুত্ব দিয়ে কবিয়াল শব্দটি ব্যবহার করেছেন । বলাবাহুল্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগান শব্দটি তুচ্ছ অর্থাৎ একটু হেয় প্রতিপন্ন করে ব্যবহার করতেন । আধুনিক যুগে কবিওয়ালা থেকে কবিয়াল শব্দের ব্যবহার। এই কবিয়ালরা একটি বিশেষ বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে থেকে ত্রিপদী, লঘু ত্রিপদী, চতুষ্পদী এবং পয়ার ছন্দে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্ন এবং উত্তর রচনা করতে পারেন এবং তারাই হল কবিগানের কবিয়াল । কবিগানের পরিবেশনার যাকে চাপান- উত্তর বলা হয়। বিষয় নির্ধারণ করে প্রশ্ন-উত্তরের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জনজীবনের আসরে রাতের পর রাত ধরে চলে দুই কবির লড়াই।

 কবিগানের দুটি ধারা – একটি হল পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা আর অন্যটি হলো পূর্ববঙ্গীয় ধারা । ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে  কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাবু’ সংস্কৃতির উদ্ভবের সময় বাঙালি বাবুদের চিত্ত বিনোদনার্থে যে কাম -মদ মোহ মিশ্রিত যে আসর বসতো সেখানে ঠুনকো ভাবে তারল্য রসের অবতারণা ঘটিয়ে চলতো কবিগান তার সঙ্গে বাঈজী বা নর্তকীদের নৃত্যের নগ্নতা | আর একটি হলো গ্রাম্য কেন্দ্রিক । যে কবিগানের মধ্যে থাকতো ভক্তিবাদ,যুক্তিবাদ, শাস্ত্র,দর্শন । এটাই হল পূর্ববঙ্গীয় ধারায় পরিবেশিত কবিগান । এরমধ্যে সাহিত্যের একটা রসদ আছে বলেই গবেষকরা পূর্ববঙ্গীয় ধারার কবি গান কে বেশি প্রাধান্য দেয় । শুধু তাই নয় এই লোক কবিরা সমাজ সুধারকের ভূমিকা পালন করে | আমার মুর্শিদাবাদ জেলার একজন বিখ্যাত কবিয়াল আফাজুদ্দিন সরকারের কাছ থেকে একটি গান সংগ্রহ করেছিলাম –

“স্বাধীন দেশের রাজার খেয়াল খুশির বাজার 

রেসের ঘোড়া যেনো দোড়ছে |l

দর বাড়ছে দর বাড়ছে দর বাড়ছে

ভিটামিন পটিনে পুই পালং ডাটা

গরীবে খাবে প্রচারের কি ঘটা

এদিকে মোটা রুই কাঁটা আর কালো কচি পাঠা 

কুকারেতে সিটি ছাড়ছে” | 

  ফলে শুধুমাত্র বিনোদন নয়, গ্রামীণ জনজীবন এবং সমাজ ব্যবস্থাকে সঠিক পথ দেখানোর ভূমিকায় থেকেছেন বাংলার কবিয়ালরা |

 অনেকে মনে করেন শ্রী হরিচরণ আচার্য কবিগান কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । কিন্তু বিশিষ্ট কবিয়াল মনোরঞ্জন সরকার মনে করেন যে বর্ণভেদের হেতু শ্রীহরিচরণ আচার্য কে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয় । তিনি এটাও মনে করেন যে হরিচরণ আচার্যের আগে তারকচন্দ্র সরকার কবিগান কে পরিচালিত করেন । আধুনিক কবিগানের জনক হলেন তারক চন্দ্র সরকার । শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো হরিলীলামৃত । হরিচরণ আচার্যের দুজন শ্রেষ্ঠ শিষ্য হলেন নকুল দত্ত ও রাজেন্দ্র সরকার। প্রবাদের মতো একটি ছড়া সেই সময় ভাটির দেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরত- 

“হরি আচার্যের বাগানে দুটি ফুল একটা পাগলা রাজেন আরেকটি নকুল “।

 এই সময়কার কবিগান পরিবেশনের আগে কবিগানের অঙ্গ হিসেবে কিছু গান পরিবেশন করা হতো । এই অবিচ্ছেদ অঙ্গ গুলো হলো ডাক অর্থাৎ দেব দেবীর বন্দনা, মালসি, কৃষ্ণের সখীদের নিয়ে সুখী সংবাদ, গোষ্ঠ, বিলাপ, বসন্ত ইত্যাদি । তারপর শুরু হতো দুই কবিয়ালের বিষয় ভিত্তিক একটি লড়াই । যে বিষয়ের মধ্যে ছিল বর্ষা বসন্ত ,নারী-পুরুষ, রাধা -কৃষ্ণ, কুসংস্কার ,পণপ্রথা অর্থাৎ সামাজিক থেকে পৌরাণিক ,পৌরাণিক থেকে ইতিহাস ধর্মী বিষয় । আসলে কবিগান হলো সমাজের নানাবিধ নেতিবাচক দিক তুলে ধরে সুরে, ছন্দে, কাব্য, গীতিতে তার তার সমাধানের সূত্র জনমানসে তুলে ধরা |এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে যত পারদর্শী সে তত বড় আসরের সরকার হতেন । রাজেন্দ্র সরকার ও মনোহর সরকারের সান্নিধ্য এবং শিষ্যত্ব লাভে বিজয় সরকারের সাহিত্য ভাবনা গভীর হয়। রাজেন্দ্র সরকারের সাহিত্য জ্ঞান ছিল অপরিসীম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজেন্দ্র সরকারকে  “কবি কেশরী “উপাধি দেওয়া হয় । আর রাজেন্দ্র সরকারের গুরু ছিলেন হরিচরণ আচার্য। হরিচরণ আচার্যের একটি বিখ্যাত পদ।-

“আমার মন বাঁধা রাধা চরণে আমার ধ্যানেতে রাধিকা জ্ঞানেতে রাধিকা

রাধিকা জীয়নে মরণে….”

এই সমস্ত কবিয়ালদের হাত ধরেই ভাটি বাংলায় এলো এক মহা প্লাবন। কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী অশ্বিনী কুমার দত্তের প্রেরণায় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের মতো নকুলেশ্বর কবিগান কে পরাধীন দেশের স্বাধীনতার হাতিয়ার বানিয়ে তুললেন। আর রাজেন্দ্রনাথ প্রবেশ করলেন মানুষের অন্তর্গত ভুবনে। তখন শুধু কবি গানের লড়াই নয় মানুষ পেল নব অঙ্গে নতুন কাব্য সঙ্গীতের স্বাদ ।

রাজেন্দ্র সরকার এবং মনোহর সরকারের যোগ্যতম শীর্ষ হলেন এক সম্পূর্ণ সংহত কাব্য সঙ্গীতের  ভান্ডারী কবিয়াল বিজয় সরকার । সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়েই এক বিধিদত্ত সুরেলা কন্ঠের পরিবেশনায় উপস্থিত দর্শক মন্ডলীকে সম্মোহিত করার অধিকারী ছিলেন বিজয় অধিকারী সরকার। ডক্টর উপেন বিশ্বাস তার “বিজয় গীতিমালা” গ্রন্থে এই কবিকে বাংলার চারণ – কবি,সম্রাট কবি সুধাকার, আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । বিভিন্ন ছন্দে পরিবেশিত সুর মিশ্রিত বক্তব্যের থেকে বিজয় সরকারের পরিবেশিত গান শুনতে দর্শকরা বেশি পছন্দ করতেন, তার সৃষ্টি গীতিতে থাকতো বাংলার বিচ্ছেদী ভাটিয়ালি,কীর্তন সুরের স্পর্শ । পূর্ববঙ্গীয় ধারায়  হরিচরণ আচার্যের আগে তারক গোসাইয়ের বাবা কাশীনাথ থেকে আনন্দ সরকার পরিবেশিত গানগুলো রাগরাগিণীর ধারায় প্রচলিত ছিল । বিজয় সরকারের পূর্বসূরী এই সমস্ত কবিয়ালদের সৃষ্ট রাগরাগিনী মিশ্রিত গান উত্তরসূরী কবিয়াল বিজয় সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করবে এটা বলাই বাহুল্য । এই সমস্ত কবিয়ালদের গানের ভাব তাদের শব্দ চয়ন বিজয় সরকারকে  প্রভাবিত করেছে  অন্যদিকে তার সৃষ্টি কাব্য -গীতির ক্ষেত্রে একটা মৌলিক ভাবনা তার গানে বার বার প্রকাশ পেয়েছে । একটা স্বতন্ত্র ধর্মী কাব্যগীতি তিনি রচনা করেছেন যেখানে প্রায় ২০০০ গান লিপিবদ্ধ আছে। বিজয় সরকারের গানে অনেক মিশ্র রাগের ব্যবহারও আমরা পাই । লোক কবি বিজয় গীতিতে একদিকে যেমন আছে লোকায়ত সুরের নানা ধারা, কীর্তন সুরের আঙ্গিক অন্যদিকে প্রাক কবিদের গানেরপ্রভাব- এই দুয়ের মিশ্রণ থেকেই এক মৌলিক ভাবনার ভান্ডারী হলেন বিজয় সরকার । শুধুমাত্র একজন কবিয়াল হিসেবে আমরা তাকে সীমাবদ্ধ করবো না। সেই সময়ের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, সেই সময়ের সামাজিক অবস্থার ছবি, তাঁর গানে বার বার উঠে এসেছে ।

” বকুলতলার ঘাটেরে আমি কেন বা আইলাম মধুমতির কূলে

কেন বা আইলাম কেনো বা নাইলাম

 কেন বা চাইলাম রে মুখ তুলে…”

 সমবেত নারীকন্ঠের বিচ্ছেদী মাধুর্য -ভরা কল্পকাহিনীর সুর এই গানে বর্তমান |  এই রকম অনেক গান আছে লোক আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারার সুরে পুষ্ট  | আসলে লোকগানের সবটাই বাহিরয়ানা, তাই লোকায়ত সুরের সমাবেশ বা সমন্বয় ঘটে নানা ধারার লোকগানে | বিজগীতির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি ।

      “বৈরাগী তোর পয়সা নাইরে পকেটে

এ তোরা সাধনায় যাবি চন্দ্রালোকে

আমরা যাব রকেটে “।

লোককবি বিজয় সরকারের একটি ব্যতিক্রমধর্মী গীতি  যেখানে একটা ব্যঙ্গত্মক এবং শ্লেষ স্পষ্ট |

কোনো সময় আমার মনে হয় না বাংলা গানের ইতিহাসে স্থান পাওয়া যে কোন গীতিকারের থেকে তার গানের বিষয় বস্তু, কাব্য কোনো অংশে কম | তুল্যমূল্য বিচার করার শ্রেয় নয় আর এই যোগ্যতাও আমার নেই তবুও আমার মনে হয়, বিজয় সরকারের গানের সঠিক মূল্যায়ন বেশির গবেষকরা করেননি | প্রশ্ন, উনি শুধু মাত্র লোককবি কিংবা নিম্নবর্গের মানুষ বলেই কি সাদরে তার গান গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটা অন্তরায় তৈরী হয়েছে ?

     একজন কবিয়াল হয়েও লোক গানের সব ধারার সুর তার গানের পরতে পরতে স্পষ্ট | 

“আষাঢ়ের কোন ভেজা পথে এলো

এলো আবার দুরন্ত শ্রাবণ

আমার এমনি দিনে মনের কূলে লেগেছে ভাঙ্গন…..”

 যেখানে ভাটিয়ালি গানের গতি প্রবাহমান।

   “আমার মনে মেনেছে

 আমার জানে জেনেছে

তুমি আসবে না  তো

নয়নে ছাড়ে না তো এ পথ চাওয়া….”

 এই গানে পাই আমরা কীর্তনের এক নিজস্বতা ।

আবার সে সময়ে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তার কলম বিভিন্ন সময়ে গর্জে উঠেছে

“ছুয়ে দিলে যে গুরুর জাত কুল…”

 ইসলাম ধর্মের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা বোধ থেকে তিনি লিখেছেন,

 “নবী নামে নৌকা করো

আল্লাহ নামে পাল খাটাও বিসমিল্লাহ বলিয়া মোমিন

কুলের তরী খুলে দাও…”

 বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বিখ্যাত গান-

“১৯৭০ সালে হিমেল বাতাসে

 ৭ই ডিসেম্বর মাসে

একটি নতুন নক্ষত্র উদিল বাংলার আকাশে….”

“পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী

একদিন ভাবি নাই মনে…”

অনেকদিন ধরেই এই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে | কাল, সময় পেরিয়ে আজও এই গান গ্রামীণ মানুষদের শ্রবনে বর্তমান |

লোককবি  বিজয় সরকারের আরও একটি গানের উল্লেখ দরকার | যে গান প্রসঙ্গে স্বয়ং জসিমুদ্দিন সাহেব নিজে বলেছেন, ‘আমি সারা বছর চেষ্টা করে এক খানা বই বের করে যা না করতে পেরেছি, বিজয় সরকার পাঁচ টি কথা বলে তা করে দিয়েছে’ |

“নকসি কাঁথার মাঠেরে

সাজুর ব্যাথায় আজও কাঁদে

রুপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি….”

বিজয় সরকারের আর একটি গানের দর্শন আমার মনকে শান্ত করে, প্রসারিত করে |

“আমি জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি

আমরা বহু নামে, ধরা ধামে, কত রকমে ডাকি….”

ড. উপেন বিশ্বাস কবির এক সাক্ষাতে জানতে চেয়েছিলেন, এই গান লেখার কারণ কি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন,’ হিন্দু, খ্রিষ্ঠান, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, নানাবিধ, সাঁওতাল এরা সব ভগবানের এক এক জনের এক এক নাম | তার কোন নাম যে আসল তাতো বোঝা যায় না | এই জায়গার থেকে ঐ প্রশ্নের উদ্ভব’ |

বাংলা গানের ইতিহাসের সময়কাল দীর্ঘায়িত | ড. সুধীর চক্রবর্তী তার “গান হতে গানে ” গ্রন্থে বলেছেন, দশম থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত আটশো বছর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আসলে গানেরই ইতিহাস |চর্যাগান, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গান, জয়দেবের কোমলকান্ত পদাবলী, চন্ডিদাস – বিদ্যাপতির ভাবময় গীতি, মহাজনী পদ, নাথযোগীদের গান, রামপ্রসাদ ইত্যাদি শ্যামাবিষয়ক গান ও কালিকীর্তন এবং বাউল – ভাটিয়ালী – মুর্শিদি ইত্যাদি লোকায়তবর্গের গান – এ সবই বাংলা গানের আদি বৃতান্তের অংশ | অন্যদিকে কবিগান, আখড়াই, পাঁচালি ইত্যাদি তৎকালীন লোকচিত্তজয়ী নানা গানের ধরণ |

উনিশ শতকে বাংলা গানের রূপান্তরে পঞ্চকবির অবদান অনিস্বীকার্য | এই পঞ্চকবির বাইরে বিজয় সরকারের বিশেষ ধরণের কাব্যগীতি যার গর্ভমুলে হলো লোকসংগীত | প্রশ্ন উঠছে এ হেন একজন দার্শনিক, গীতিকার, সুগায়ক, সুরকার, কাব্য সৃষ্টিতে মৌলিক ভাবনার একজন লোককবি কে কি ষষ্ঠ কবির আসনে বসিয়ে বাংলা গানের ইতিহাস আরও সম্মৃদ্ধ করতে পারি না?

——————————————

তথ্য নির্দেশিকা

১/ ড. সুধীর চক্রবর্তী, গান হতে গানে 

২/  ড. উপেন বিশ্বাস, বিজয় গীতি -মালা

৩/ সজনীকান্ত দাশ, বাংলার কবিগান

৪/ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

৫/ শুভেন্দু মাইতি, বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী

৬/ মনোরঞ্জন সরকার, বিশিষ্ট কবিয়াল