May 1, 2023

The Significance of Establishing a Musical Environment in Offices and Institutions

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Krishna Modak, Professor, SACT, Department of Music, Memory College, Memory, East Burdwan, West Bengal, India

Abstract

The influence of music on the mind is immense. Even the thinking human mind manifests its hypnotic power even in the lower animals. Mind is the driving force of the body – its thoughts, the senses like imagination, memory, desire, etc. are controlled by the influence of sound either way, it can alleviate the negative aspects of the mind and stimulate the positive aspects to make the person very strong, efficient and prosperous. Be it an office workplace or various institutions like hospitals, correctional facilities, nursing homes, restaurants, shopping malls, yoga centres, gyms, spas, ashrams, monasteries, mosques, churches, national places of worship, educational institutions everywhere. Music is a universal language that can speak to people from all walks of life. Even if you don’t know anything about music, there is an emotional response to the song’s melody. Music is rich in poetic quality and melody, rhythm attracts the mind. Soft and gentle ambient music calms the mind and can influence the mood of the surroundings. Business people also use music to look at products, buy expensive products or eat quickly. Research shows that listening to favourite music improves blood circulation, heart, health and well-being Motivation and performance.

অফিস এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সাংগীতিক পরিবেশ তৈরির গুরুত্ব ,কৃষ্ণা মোদক, এসএ সি টি, সংগীত বিভাগ, মেমারি কলেজ, মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

সারসংক্ষেপ

মনের উপর সঙ্গীতের প্রভাব অপরিসীম। চিন্তাশীল মানব মন তো বটেই এমন কি নিম্নস্তরের প্রাণী কুলেও এর সম্মোহিনী ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। মনই দেহের চালিকা শক্তি-তার চিন্তা, কল্পনা, স্মৃতি, ইচ্ছা প্রভৃতি সংবেদন গুলো যদি সুরের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তবে তা মনের নেতিবাচক দিকগুলো প্রশমিত করে ইতিবাচক দিকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে ব্যক্তি মানুষকে অনেক শক্তিশালী, দক্ষ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে সক্ষম। অফিসের কাজের জায়গা হোক অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- হাসপাতাল, সংশোধনাগার, নার্সিংহোম, রেস্তোরা, শপিং মল, যোগা-সেন্টার,  জিম,স্পা, অথবা আশ্রম, মঠ মসজিদ, চার্চ,জাতীয় ঈশ্বর উপাসনার স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র। সংগীত একটি সার্বজনীন ভাষা যা সর্বস্তরের মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। সংগীত সম্পর্কে কিছু জানা না থাকলেও গানের সুরে মানসিক প্রতিক্রিয়া হতেই থাকে।। কাব্য গুণ সমৃদ্ধ কথা ও সুর, ছন্দ, তাল মনকে আকর্ষণ করে। কোমল ও মৃদু  আবহসংগীত মনকে শান্ত করে, পারিপার্শ্বিক অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে পারে। ব্যবসায়ীরা  পন্য দ্রব্য দেখতে, দামি পণ্য কিনতে বা তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য ও সংগীত ব্যবহার করেন। গবেষণা বলছে পছন্দের সংগীত শুনলে রক্ত সঞ্চাল যথাযথ হয় এতে হার্ট সুস্থ থাকে আর সুস্থতাই উৎসাহ ও কর্ম ক্ষমতার চাবিকাঠি।

 শব্দ সংকেত :সংগীত, সুর, শরীর, মন, অনুভূতি, সুস্থতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ভূমিকা

সংগীতের মৌলিক তত্ত্বটি হলো নাদ, আর শ্রবণযোগ্য সুললিত নাদ-ধ্বনি ই  হলো সংগীত। অশ্রুত আদি ওঙ্কার ধ্বনিতে পরিবেষ্টিত বিশ্ব ও তার সকল জড় ও চেতন পদার্থ। কান পাতলেই সর্বব্যাপী এই ধ্বনিরই সুশ্রাব্য প্রকাশ দেখি প্রকৃতিতে—সুউচ্চ পাহাড়ের বুক চিরে ঝরে পড়া ঝর্নার ঝর ঝর শব্দে, বাতাসের শন শন বা ঝিরঝির শব্দে বয়ে চলায়, কুলকুল শব্দে তরঙ্গ তুলে নদীর এগিয়ে চলায়, পাখির কলতানে, ভ্রমরের গুঞ্জনে, পাতার মর্মর ধ্বনিতে, বৃষ্টির রিম ঝিম ঝরে পড়া, এক অবিরাম সুর ও ছন্দের আবহ সংগীত প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হয়ে চলেছে এই বিশ্ব সংসারে। ঋতু পরিবর্তনের নির্দিষ্ট ছন্দ, তার সাথে বিচিত্র ফুলের ফুটে ওঠা। বিভিন্ন ফলের সম্ভারে অবনত বৃক্ষরাজি। নতুন পাতার অঙ্কুরিত হবার বা সময় হলে খসে পড়ার সজীব হিল্লোল। আকাশে মেঘের সঞ্চালন অথবা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার ছন্দ। নিয়ত হয়ে চলা এই সুর ও ছন্দের প্রভাব সকল সচেতন ও জড় বস্তুকে  ছুঁয়ে যায়। তার হর্ষ-বিষাদ, স্তব্ধতা-চঞ্চলতা , স্থিরতা-অস্থিরতা, আশা– হতাশা সকল অনুভূতির বিভিন্ন প্রকাশ, শরীর ও মনের ভারসাম্য রক্ষায় অবিরাম ঘটে চলে প্রকৃতি সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ আবহ-সংগীতের অনিবার্য প্রভাব। তাই দেখা যায় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অনেক বেশিহয়, তাই স্বাভাবিক ভাবে এঁদের কর্মক্ষমতাও বেশি। একথা বিজ্ঞান ও স্বীকার করে।

মনের উপর সংগীতের প্রভাব

 সংগীত হলো সাতটি স্বরের উপর লীলায়িত সুরের সমষ্টি, ছন্দোবদ্ধ তাল, লয় সমন্বিত ও ভাবের ভাষা তৈরিতে সক্ষম। অনুভবের সাথে সংগীতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। শাস্ত্রীয় সংগীতে যেসব রাগ রাগিনী আছে তাদেরও শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য স্বরূপেই ভাবের রঙে মনকে রঞ্জিত করা ও বিভিন্ন রসের সঞ্চার করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-“বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেখানেই গানের প্রভাব, বাক্য যাহা বলিতে পারেনা গান তাহাই বলে -সুর আপনার আবেদন অনায়াসে প্রচার করিতে পারে– সেইখানেই সংগীতের উৎকর্ষ‘’[1]

 মনের উপর সঙ্গীতের প্রভাব অপরিসীম,  মন  শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মত স্থূল নয়, তাকে ধরা যায় না বা বাইরে থেকে শুশ্রুষা করা যায় না। দেহের মধ্যে অবস্থিত এই সূক্ষ্ম অনুভূতিকে সংগীতের সূক্ষ্ম ভাব সঞ্চারের ক্ষমতা দ্বারাই  নিয়ন্ত্রিত করতে বা পোষণ করতে পারা সম্ভব। মনের চিন্তা, কল্পনা, ইচ্ছা প্রভৃতি সংবেদন গুলো যদি সুরের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিতহয় তবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে শারীরিক সুস্থতা ও নিশ্চিত করা সম্ভব। সংগীতের প্রভাবে মনের নেতিবাচক ভাবনা গুলো প্রশমিত হয়ে ইতিবাচক ভাবনা উদ্বুদ্ধ হলে ইচ্ছা শক্তিকে দৃঢ়, অধিক কর্ম সক্ষম ও মেজাজকে উন্নত করা সম্ভব। আর এই সক্ষমতাই ব্যবহারিক জীবনের মান কর্মস্থলে নিজের দক্ষতা অনেকাংশে বাড়াতে পারে।

বিশ্ববরেণ্য  কালোত্তীর্ন দার্শনিক প্লেটো বলেছেন– ‘’সংগীত একাধারে দেহ, মন ও আত্মার মহৌষধ। সংগীত আনন্দ বর্ধক, আত্মার পোষক, শিক্ষার সহায়ক এবং রোগ নিরাময়ক’’। শুধু মানুষ নয় প্রকৃতি তথা জীবজন্তুর ওপর সংগীতের প্রভাব অপরিসীম তা আজ বিজ্ঞানসম্মত। স্বামী বিবেকানন্দ সংগীতের অন্তর্নিহিত ভাব উন্মোচন করতে গিয়ে বলেছেন-“মনুষ্য মনের উপর সঙ্গীতের প্রচণ্ড প্রভাব। উহা মুহূর্তে মনকে একাগ্র করিয়া দেয়। অতিশয় তামসিক জড় প্রকৃতি ব্যক্তিগণ-যাহারা এক মুহূর্ত মনস্থির করিতে পারেনা তাহারাও উত্তম সঙ্গীত শ্রবনে মুগ্ধ হইয়া  যায়, একাগ্র হইয়া পড়ে। এমনকি কুকুর বিড়াল প্রভৃতি পশুগন মোহিত হইয়া থাকে“।[2]

সংগীত শব্দটি সম্পর্কে সকলেই অবগত থাকলেও এ কথা সকলের জানা নেই যে সুরেলা শব্দ একজন ব্যক্তিকে সুস্থ করতে সাহায্য করে। যেটি বর্তমানে মিউজিক থেরাপি বা সংগীত চিকিৎসা নামে পরিচিত। এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা সংগীতের মাধ্যমে মনের বা চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে শারীরিক ও মানসিক উন্নতিতে সাহায্য করে। এটি একটি লক্ষ্য ভিত্তিক হস্তক্ষেপ যা  শান্ত এবং রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। মিউজিক থেরাপিতে সংগীত প্রণয়ন গান লেখা গান শোনা এবং সংগীত নিয়ে আলোচনা জড়িত  থাকে। বিশেষ করে এই ধরনের চিকিৎসা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের জন্য সহায়ক হতে পারে। এটি শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা যুক্ত মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। এই উপকারী প্রভাব গুলি অনুভব করতে ব্যক্তির সংগীত ব্যাকগ্রাউন্ড এর প্রয়োজন নেই।[3]

মিউজিক থেরাপির ইতিহাস ও তার সম্বন্ধে কিছু কথা

 মিউজিক থেরাপি বহু প্রাচীনকাল থেকে জানা ছিল, গ্রিসে অরফিক (Orphic) যুগের আমল থেকেই। অন্যদের মধ্যে পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল সঙ্গীতে রোগ নিরাময় এবং আরোগ্য করার শক্তি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। ওল্ড স্টেটমেন্টেও মিউজিক থেরাপির কথা আছে, যেখানে রাজা ডেভিড হার্প (Harp ) নামে এক তারের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রোগ নিরাময় করেছিলেন বলে বলা হয়েছে। আধুনিক ঔষধ বিদ্যার জনক হিপোক্রেটিস মানুষের চিকিৎসায় সংগীত ব্যবহার করেছিলেন। আরবি গ্রন্থাকার ইবন সিনার লেখা থেকে জানা যায় প্রাচীন মিশরে প্রসব যন্ত্রণা উপশমের জন্য সংগীতের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।

 কথিত আছে দক্ষিণ ভারতের সংগীতকার ত্যাগরাজ “বিহারী রাগে নবজীবন ধারা” গেয়ে একজন মৃত মানুষকে পুনর্জীবন দান করেছিলেন। ১৭৯২ সালে চিকিৎসক রিচার্ড ব্রাউন বিখ্যাত প্রবন্ধ মেডিসিনা মিউজিকা লিখেছিলেন, এতে ঔষধ হিসেবে সংগীতের ব্যবহার উল্লেখ আছে। তাঞ্জোরে সরস্বতী মহল লাইব্রেরীতে ডক্টর বার্নেলের পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে তাতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন রাগের ব্যবহারের বর্ণনা করা হয়েছে।

 কার্লাইল বলেছেন –“সংগীত  এক ধরনের অস্পষ্ট অতলস্পর্শী ভাষা যা আমাদের অসীমের প্রান্তে নিয়ে যায় আর এক মুহূর্তের জন্য কল্পনার সুযোগ করে দেয়।“ সংগীত মূলত কম্পন উৎপাদনকারী শব্দ বা নাদের সমষ্টি যা বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে চালিত হয়ে মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। সংগীত রত্নাকরে শারংদেব বলেছেন একজন জীবন্ত প্রাণী যে কোন ধরনের যন্ত্রে  আঘাত করে সর্বদাই  ‘আহত নাদ` বা সংগীত উৎপন্ন করে। সংগীত হচ্ছে বিভিন্ন রাগের আকারে একটা বল বা বিশ্বগত শক্তি।[4]

 বৈদিক যুগের ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সামগ ঋষিরা গানের সুরে পরিবেশন করতেন যা সামবেদ নামে পরিচিত। এই সামবেদই ভারতীয় সংগীতের মূলাধার। এর থেকেই গান্ধর্ব সংগীত ও তার থেকে  ক্লাসিক্যাল গানের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বেদের কঠিন সংস্কৃত শ্লোক, গীতা, উপনিষদের গভীর জ্ঞানের বাণী  সুর ও ছন্দের মাধ্যমে পাঠ করতে শোনা যায়। এতে শব্দ দিয়ে রচিত প্রগাঢ়  জ্ঞানের মন্ত্র শক্তি আপামর জন-সাধারণের মনে গ্রহণ যোগ্যতা বাড়িয়েছে। সহজেই মানুষের মনকে স্পর্শ করতে পেরেছে। মন্ত্রের ভাব গম্ভীর রূপটি মানুষকে শ্রদ্ধাবনত করতে সমর্থ হয়েছে। এদেশে সঙ্গীত রীতির মুখ্য স্তম্ভ রাগ সংগীত, আর রাগ সংগীতের জন্ম এই ভারতবর্ষে। বিভিন্ন রাগের বিভিন্ন রূপ যা মনে বিচিত্র আবেগে সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাগ পরিবেশনের যে নিয়ম, ঋতু অনুযায়ী পৃথক পৃথক রাগ যেমন বর্ষায় মেঘ ও মল্লার, বসন্তে রাগ বসন্ত, শরতে বাহার, গ্রীষ্মে দীপক,  ইত্যাদি বিভিন্ন রাগের ভাব ও রসের প্রকাশ ভিন্ন। আজকের মিউজিক থেরাপির আধুনিক চিকিৎসায়  প্রয়োগ করা হচ্ছে সংগীতের এই মেজাজ তৈরীর ক্ষমতাকে। কেবল রাগ সংগীত নয়, বিভিন্ন ধারার সংগীত যেমন-কাব্য সঙ্গীত,  লোকসংগীত, ভক্তিমূলক, আধুনিক, প্রভৃতি সকল সংগীতেরই মনের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষমতা আছে।[5]

 মিউজিক থেরাপি এক ধরনের অভিব্যক্তি পূর্ণ আর্ট। একটি ব্যক্তির শারীরিক, মনস্তাত্বিক এবং সামাজিক কল্যাণ বজায় রাখার জন্য সংগীত ব্যবহার করে। তাছাড়াও এর মধ্যে বিস্তৃত ক্রিয়া-কলাপজড়িত যেমন গান শোনা গান করা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো। বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে মিউজিক থেরাপি হল থেরাপিওটিক সম্পর্কের মধ্যে স্বতন্ত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগীত হস্তক্ষেপের ক্লিনিক্যাল ও প্রমাণ ভিত্তিক ব্যবহার। প্রধানত এটি বিশ্বাসযোগ্য পেশাদার দ্বারা সঞ্চালিত। যিনি একটি অনুমোদিত সংগীত থেরাপি প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছেন। মিউজিক থেরাপি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষাগত লক্ষ্যপূরণ করতে পারে। যেমন সুস্থতা প্রচার, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, ব্যথা উপশম, অনুভূতি প্রকাশ, স্মৃতিশক্তি বাড়ানো সামাজিক যোগাযোগ উন্নত করা, শারীরিক পুনর্বাসনের প্রচার করা। ফল স্বরূপ এটি প্রায়শই অফিস, হাসপাতাল, পুনর্বাসনকেন্দ্র, স্কুল, সংশোধনাগার, নার্সিংহোম, ধর্মশালা, যোগা সেন্টার, রেস্তোরাঁ, শপিং মল এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়।

মিউজিক থেরাপির বিভিন্ন ধরন

 সংগীত থেরাপি দু ভাবে হয়—একটি সক্রিয় ও অপরটি নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় প্রক্রিয়ায় যেখানে গ্রাহক সংগীত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আর নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়ায় যার মধ্যে গান শোনা বা সাড়া  দেওয়া  জড়িত। কোন কোন ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সংমিশ্রণে সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয়  উভয়  মিথক্রিয়ায়  জড়িত থাকে। প্রচলিত কয়েকটি থেরাপি:

  1. বিশ্লেষণাত্মকথেরাপি,  2) বেননসানথেরাপি, 3) জ্ঞানীয়-আচরণগত থেরাপি( CBT), 

4) কমিউনিটি  থেরাপি, 5) নর্ডফ-রবিন্স  থেরাপি, 6) নির্দেশিত চিত্র এবং সংগীত (জিআইএম ) এর বনি পদ্ধতি, 7) ভোকাল  সাইকোথেরাপি।[6]

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর সংগীতের প্রভাব

 মানুষের জীবনে সংগীতের প্রভাব  বিজ্ঞান স্বীকৃত। স্নায়ুবিজ্ঞানে সংগীতের প্রভাব বৃদ্ধিতে নিউরো মিউজিকোলজি নামে গবেষণা শাখার উদ্ভব হয়েছে। এতে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের উপর সংগীতের প্রভাব কিভাবে সাড়া দেয় তাই সন্ধান করা হয়।[7]

মস্তিষ্কে বিভিন্ন লোব আছে–ফ্রন্টাল  লোব, প্যারিটাল  লোব, অক্সিপিটাল  লোব, টেম্পোরাল  লোব , সেরিবেলাম পেশী,  ব্রেনস্টেম এইসব অংশ  একত্রে কাজ করে মানুষের একাগ্রতা, স্মৃতি, চিন্তার প্রকাশ, আশপাশের স্থানিক সচেতনতা, ভারসাম্য রক্ষা, শ্রবন শক্তি প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর। সংগীত একই সময়ে মস্তিষ্কের সমস্ত এলাকায় প্রভাব ফেলতে পারে। এই ক্ষেত্রগুলিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে সংগীত থেরাপি অন্যান্য নিরাময়  প্রক্রিয়া  গুলিকে শক্তিশালী করতে পারে। যার মধ্যে অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া হৃদস্পন্দন এবং রক্ত প্রবাহ, চিন্তা ভাবনা, মনে রাখার অনুভূতি  গুলোকে স্বাস্থ্যকর  উপায়ে অনুভব করা এবং প্রক্রিয়াকরণ, কথা বলা ও শোনা, শারীরিক সমন্বয় এবং হাঁটাচলা এসবই ওষুধের পাশাপাশি সংগীতের ব্যবহার চিকিৎসাকে ব্যাপক উন্নত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে  মিউজিক বিভিন্ন সিস্টেমে প্রভাব ফেলতে পারে।

মস্তিষ্কের তরঙ্গ:

গবেষণায় দেখা গেছে যে একটি শক্তিশালী বিট সহ সংগীত মস্তিষ্কের তরঙ্গেকে  বিটের  সাথে সুসঙ্গত করতে উদ্দীপিত করতে পারে। দ্রুত বিট তীক্ষ্ণ একাগ্রতা এবং আরো সতর্ক চিন্তাভাবনা  নিয়ে আসে এবং একটি ধীর গতি একটি শান্ত ধ্যানের অবস্থাকে উন্নীত করে। (ওয়ান  ডব্লিউ সি. কলেজ ছাত্রদের জন্য শিথিল সংগীতের ধরন এবং বৈশিষ্ট্য গুলির অধ্যায়ন। (ProcMtgsAcoust.20148,35001।doi:10.1221/1.4902001))

এছাড়াও  গবেষণায় দেখা গেছে যে সংগীত মস্তিষ্কের তরঙ্গ কার্যকলাপের স্তরে যে পরিবর্তন আনতে পারে তা মস্তিষ্ককে প্রয়োজন অনুসারে আরো সহজে গতি পরিবর্তন করতে সক্ষম  করে। যার অর্থ সংগীত ব্যক্তির মনের অবস্থার জন্য দীর্ঘস্থায়ী সুবিধা আনতে পারে এমনকি শোনা বন্ধ করে দেওয়ার পরেও।

 মিউজিক শোনা একটি ভালো মেজাজে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার একটি দ্রুত পথ হতে পারে। ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির দ্রুত উন্নতি করার চেয়েও সংগীতের সুবিধার আরো অনেক কিছু রয়েছে গবেষণায় দেখা গেছে সংগীত মানুষের শরীর এবং মানসিকতার উপর গভীর প্রভাব ফেলে(Mofredj A, Alaya S, Tassaioust K, Bahloul H, Marbet A মিউজিক থেরাপি, গুরুতর অসুস্থদের জন্য সম্ভাব্য থেরাপিউটিক সুবিধার পর্যালোচনা, জে ক্রিট কেয়ার। 2016, 35:195-199,doi:10-1016/j. Jcrc. 2016.05.021)

 সংগীত কতকগুলি রাসায়নিক  নিঃসরণে  মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে। গান-বাজনা শুনলে মস্তিষ্কে  ডোপামিন নামে এক নিউরোট্রান্সমিটারের  নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। ডোপামিন কে বলা হয়  মস্তিষ্কের  ‘ মোটিভেশন  মলিকিউল ‘ I ডোপামিন মানুষের মনে উৎসাহ সঞ্চার করে উদ্দীপনা  যোগায় মানুষের সুখানুভবে  ডোপামিনের ভূমিকা অপরিসীম। এখানে ’feel good’  বলে  একটা কথা  প্রায়ই শোনা যায়, সেই ভালো লাগার পিছনে আছে মস্তিষ্কের  রসায়ন।

 সংগীত মানুষের মুড বা মেজাজ কে প্রভাবিত করে। দেখা গেছে কঠিন সময় দুঃখের গান শুনে মন অনেক হালকা হয় যন্ত্রনার উপশম হয়  মনোরোগবিদরা একে বলে ‘ক্যাথারসিস‘। গান-বাজনা শুনলে মস্তিষ্কে  অক্সিটোসিন নামে এক হরমোনের নিঃসরণ উজ্জীবিত হয়  অক্সিটোসিন কে বলা হয় ‘ট্রাস্ট মলিকিউল’ কারণ এই  হরমোন অন্যের সঙ্গে একটা বন্ধন সৃষ্টি করে এবং অন্যের প্রতি আশ্বাস স্থাপনে সহায়ক হয়।[8]

শ্বাস এবং হার্ট রেট:

মস্তিষ্কের তরঙ্গের পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়া-কলাপে পরিবর্তন আসে। স্বায়ত্ত  শাসিত  স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত  হয় যেমন-শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন ও পরিবর্তন করা যেতে পারে সংগীতের প্রভাবে। (এলসি আরজে  থায়েরের  জে এফ, সংগীত এবং স্বায়ত্তশাসিত  স্নায়ুতন্ত্রের (dys) ফাংশন। সংগীত উপলব্ধি,  2010; 27(4), 317-326। doi:10.1525/mp. 2010.27.4.371) । এর অর্থ হতে পারে ধীর শ্বাস, ধীর স্পন্দন এবং অন্যান্য জিনিসের মধ্যে শিথিলকরণ প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করণ।

 মনের অবস্থা:

 মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে বিষন্নতা এবং উদ্বেগ কার্যকর ভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ মন ও শরীর উভয়কেই  প্রভাবিত করে এটি শারীরিক ও মানসিক উভয় উপসর্গ তৈরি করে যা এমন একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক  ভাবে কাজ করার ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। লক্ষণ গুলি হল –ব্যথা এবং যন্ত্রনা, শক্তি কমে যাওয়া, ঘুমোতে অসুবিধা, অসংগঠিত চিন্তা ক্লান্তি নিয়ন্ত্রণ  হারিয়ে ফেলা, ঘন ঘন অসুস্থতা, সংক্রমণ, অসহায়ত্বের অনুভূতি, মাথাব্যথা, বিরক্তি , নার্ভাসনেস এবং উদ্বেগ, মনোযোগ দিতে অসুবিধা, পেট খারাপ ইত্যাদি।  (ডি উইট  এম, ম্প্রুট  এ, ভ্যান  হুরেন, এস মুনেন এক্স,স্ট্যাসস  জিজে, স্ট্রেস–সম্পর্কিত ফলাফলের উপর সংগীত হস্তক্ষেপ এর প্রভাব: একটি পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং দুটি মেটা-বিশ্লেষণ। স্বাস্থ্য সাইকোল  রেভ, 2019:1-31।dio :10.1080/174371897)

স্ট্রোক, অটিজম, পার্কিনসন্স, ডিমেনশিয়া ও অ্যালজাইমার প্রভৃতি দুরারোগ্য স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি সংগীতের প্রভাব অনেকখানি। মস্তিষ্কের আঘাতে তার কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংগীত মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে পুনরায় সংগঠিত করতে, স্মৃতির উন্মেষ ঘটাতে, ভারসাম্য ও চলাফেরার মতো শারীরিক সমস্যা গুলিকে উন্নত করে (ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, মিউজিক থেরাপি, পৃ: ৪৪ )।

অফিস বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সাংগীতিক পরিবেশের গুরুত্ব

 শরীর ও মন দুয়ের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে সুস্বাস্থ্য। সার্বিক সুস্থতায় সংগীতের ভূমিকা এই প্রবন্ধে পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। বর্তমানে কোভিদ-19 এর পর মানসিক প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে  বেড়েছে। আবেগ ও আচরণগত বিকার, হতাশা, দুশ্চিন্তা, আক্রোশ ব্যাধিতে আক্রান্ত যুবসমাজ। অসম প্রতিযোগিতা, উপযুক্ত কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা, নিরাপত্তাহীনতা  মনের অস্থিরতা বাড়িয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। তাই ভালো কাজ পেতে হলে, উৎপাদন বাড়াতে হলে, অফিস বা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার চেষ্টা করছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা। অত্যধিক কাজের চাপ, একঘেয়েমি কাজের মানসিক অবসাদ দূর করতে কর্ম ক্ষেত্রে মৃদু  স্বরে  পছন্দমত কন্ঠ  সংগীত বা যন্ত্র সঙ্গীতের ব্যবহার বেড়েছে। গবেষণা বলছে পরিচিত ও পছন্দের সংগীত শুনলে কর্মীদের মনে আনন্দ বাড়ে, চাপমুক্ত হয়ে কাজ করেতে পারে এবং বেশি  সময় কাজ করার উৎসাহ  পায়। যেসব কাজ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান বুদ্ধির বেশি দরকার পড়ে, গান শুনলে সে সব কাজে ভুল কম হয়। হাসপাতলে অপারেশন  থিয়েটারে আস্তে করে গান বাজলে সার্জনদের স্ট্রেস কমে তারা অনেক দ্রুত ও নির্ভুল  ভাবে  অপারেশন করতে পারেন। যারা কুস্তিগীর যারা শারীরিক কসরৎ দেখান তারা যদি স্বল্প ঝোঁকের তালের গান শুনেন তাহলে অনেকটা চাপ মুক্ত থাকতে পারেন।[9]

 কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের চিন্তাভাবনা এবং ধ্যান ধারণার ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনতে ও কর্মচারীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দান করতে বিভিন্ন রকম সাংগীতিক অনুষ্ঠান করা হয়। কর্মীদের সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটে এইসব অনুষ্ঠানে। এতে পারস্পরিক সম্পর্কের সংযোগ বৃদ্ধি পায়।

 বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে কাজ ছাড়াও শরীর ঠিক রাখতে জিম, জুম্বা,  যোগব্যায়াম প্রভৃতি যুক্ত করা হয় সংগীতের ছন্দ ও তালের সাথে করার ব্যবস্থা থাকে।এতে একঘেয়েমি  ক্লান্তিকর মনে হয় না, কাজ গুলি মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে।  প্রার্থনা ও ধ্যান কক্ষে একাগ্রতা বৃদ্ধিতে সংগীতের ব্যবহার দেখা যায়। স্কুলের শুরুতে জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং প্রার্থনা সংগীত গাওয়া  হয় যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের চারিত্রিক মানোন্নয়ন ঘটে এবং শিক্ষা গ্রহণে একাগ্র হতে পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানগুলিতেও তাঁদের তৈরি বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান করান হয় যাতে শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়। তাঁরা ভক্তদের মনে ভাবের সঞ্চার ঘটিয়ে মানসিক স্থিরতা আনতে ও ঈশ্বরের প্রতি নিবেদনের ভাবটি আনতে সক্ষম হন। গবেষণায় দেখা গেছে বিভিন্ন সংগীতের ব্যবহারে ভোক্তাদের পণ্য ক্রয় করার বা রেস্তোরায়  খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের পরিমাপ বাড়ে-কমে।

সীমাবদ্ধতা:

 বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পছন্দের গান শুনলে  মস্তিষ্কে  বেশি রক্ত সঞ্চালন হয়, অন্যদিকে অপছন্দের গান শুনলেও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়। উচ্চস্বরে গান শুনলে শ্রবণ ক্ষমতার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। লিরিক্স যুক্ত গান অনেক সময় উৎপাদন হ্রাস করেতে পারে।

 উপসংহার:

 এক কথায় বলতে গেলে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংগীত মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে কাজে শক্তি যোগায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই সঙ্গীতে উপকৃত হতে পারে।


[1] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,  সংগীত চিন্তা, পৃ:২২

[2] সংগীত তত্ত্ব, দেবব্রত দত্ত, পৃ:  ২৬৫, ব্রতী প্রকাশনী, কলিকাতা-৭৩, ২০১১।

[3] F A Baker, N Jeanneret and M Kelaher, International Journal of Community Music, vol. 10(2), 157-169, 2017।

[4] ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, মিউজিক থেরাপি, পৃ: ১৫ -১৬

[5] ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, মিউজিক থেরাপি, পৃ: ৫৯ এবং পৃ: ৬২।           

[6] S Koelsch, A neuro-scientific perspective of Music Therapy, 2009, Wiley Online Library

[7] ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, মিউজিক থেরাপি, পৃ: ৪0

[8] মিউজিক থেরাপি, ঈশিতা  মুখোপাধ্যায়, পৃ: ৪১-৪২

[9] মিউজিক থেরাপি, ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায়,  পৃ: 43