May 1, 2023

Preservation of Folk Drama: Importance and Necessity

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Srabani Sen

Abstract:
Folk drama, an integral part of cultural heritage, serves as a reflection of a community’s traditions, beliefs, and social dynamics. As societies undergo rapid modernization and globalization, there is an urgent need to recognize the significance of preserving folk drama forms. This abstract explores the importance and necessity of safeguarding folk drama, emphasizing its role in fostering cultural identity, sustaining community bonds, and providing a platform for artistic expression. The preservation of folk drama is crucial for maintaining cultural diversity and preventing the loss of unique artistic traditions. These traditional performances often encapsulate historical narratives, moral lessons, and rituals that have been passed down through generations. Through the enactment of folk dramas, communities connect with their roots and transmit shared values, ensuring the continuity of cultural practices. Additionally, folk drama serves as a powerful medium for community engagement, bringing people together through shared storytelling and performance. These cultural events foster a sense of belonging and unity, promoting social cohesion and mutual understanding. Preserving folk drama is, therefore, essential for sustaining the social fabric of communities and strengthening intergenerational bonds. Furthermore, folk drama provides a canvas for artistic expression, allowing local talents to showcase their creativity and skills. The unique aesthetics, music, and dance forms associated with folk drama contribute to the rich tapestry of global performing arts. By preserving these traditions, societies can maintain a diverse cultural landscape and offer future generations a glimpse into the artistic ingenuity of their ancestors. In conclusion, the preservation of folk drama is not merely a matter of conserving historical artefacts; it is a dynamic effort to safeguard the cultural heartbeat of communities. Recognizing the importance and necessity of preserving folk drama is vital for promoting cultural diversity, community resilience, and artistic expression in the face of modern challenges. Initiatives focused on documentation, education, and sustainable practices can play a pivotal role in ensuring the longevity of these invaluable cultural treasures.

লোকনাট্যের সংরক্ষণ : গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ড.শ্রাবণী সেন

আ্যসোসিয়েট প্রফেসর, সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709

Folklore শব্দ থেকে লোকসংস্কৃতি কথাটা এসেছে। Folk শব্দের অর্থ  People in general, তার সঙ্গে Lore যুক্ত হয়ে দাঁড়ায়  ‘Study of the common peoples traditions’. অর্থাৎ এই লোক অর্থে সমাজের অতি সাধারণ স্তরের জনমণ্ডলী বোঝায়। বলা যায় ফোকলোর অনুন্নত গ্রামীণ জনসমাজের সংস্কৃতি চর্চা। এই জনসমাজ সাধারণ জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত, সংহত জীবনে বিশ্বাসী। ইংরজী ‘folklore’ শব্দটিতে folk বা লোক বলতে গ্রাম্য, ঐতিহ্যবাহী পল্লী জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, এবং ‘lore’ বলতে verbal Art (বা oral literature) তথা মৌখিক শিল্প যেমন – সাহিত্য, সংগীত, নাটক, লোকপ্রথা, ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা, গাথা প্রভৃতিকে বোঝায় । লোকনাট্য লোকসংস্কৃতির একটি অঙ্গ। লোকসমাজের সামগ্রিক জীবনযাপনের ধারাবাহিত সৃষ্টি প্রয়াস লোকসংস্কৃতিতে প্রকাশিত হয়। শুধু লোকসমাজের নাচ, গান, অভিনয়ই লোকসংস্কৃতির মধ্যে পড়ে তা নয়, সংহত মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারণের খুঁটি-নাটি এবং তাদের চারুকলা-কারুকলা, সষ্টশীল মনের ও মননের সমগ্র অংশই লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত। এক অর্থে লোকসংস্কৃতি হল একটি সংহত সমাজের জীবনচর্যা, যে সংস্কৃতি হারানো অতীতের মূলে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়, বিবর্তনের ধারায় চলমান কালের সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। বলা যায় লোকসংস্কৃতি চর্চা একটি জাতির আত্মানুসন্ধানের বড় দিক।

‘নাট্যশিল্পের’ উদ্ভব ও প্রচলন লোকঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমাজ-সংস্কৃতির উপযুক্ত ভিত্তি ও পরিবেশ থাকলে লোকসংস্কৃতির যে কোন ধারার বিকাশ ঘটা স্বাভাবিক। লোকসমাজ সামাজিক একাত্মবোধ ও আত্মান্বেষণের তাগিদে জীবনকে নানাভাব ও রূপে প্রকাশ করে, আনন্দ পায়। জীবনের সঙ্গে এই অনুভবের যোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রাণের আবেগ থেকে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে বৈষয়িক ও ভাবগত আদান-প্রদান করতে বাধ্য। সামাজিক মানুষের জীবনের নানা সমস্যা ও সংকটকে শিল্পে রূপায়িত করতে  ভাষা, রঙ, রেখা, সুর ইত্যাদি নানা উপাদানের প্রয়োজন । নাটকে জীবনের কোন নির্বাচিত অংশ চলাফেরা ও বিন্যাসের মাধ্যমে অনুকৃত হয়ে থাকে। নাট্যের সঙ্গে ভাষা, সুর, নট, মঞ্চ, বাদ্য, কুশীলব ইত্যাদির অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাই নাট্যের ভিত্তিরূপে জীবনবৃত্তের অনুকারী একটি ভাষারূপ নির্মিত হয়। আবার মানুষের মনের আনন্দ ও স্ফূর্তি তার স্বর, দেহের দোলাও ভাবভঙ্গিমায় মুক্তি পায়। এটাই অভিনয়ের গোড়ার কথা, লোকসমাজে এই ধারা সামাজিক আনন্দ মূর্তিতে ধরা দেয়। নাচ, গান বাজনার সঙ্গে সমবেত ভঙ্গি ও সরবতায় লোকনাট্যের উদ্ভব। লোকসাহিত্যের মত লোকনাট্যেও যুগধারার পরির্তনের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিক, কাহিনী, চরিত্র পরিবেশ নৈপুণ্য সবই বদলায়। কারণ লোকসংস্কৃতি গতিশীল, জনসাধারণের তথা লোকসমাজ-মানসের জীবন ও জীবনের রঙ পাল্টালে লোকনাট্যের আঙ্গিকও স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে যায়।  এ প্রসঙ্গে ড. লাউরি বলেছেন –‘‘Folklore has no master form, it is changing and changing.’’১ তাই লোকনাট্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায় – ‘‘যখন লোকসমাজ তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের জীবনের চাওয়া না পাওয়া, মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে – এককথায় তাদের সুখ দুঃখময় জীবনকে তাদের মত করে সংলাপ এবং অভিনয় ক্রিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে রূপায়িত করে তখনই তা ‘লোকনাট্য’ হয়ে ওঠে।

বলা যায় লোকসংস্কৃতির অভিকরণ শিল্পে লোকনাটকগুলো আমাদের সামাজিক সম্পদ। পৃথিবীর যে কোন ভাষার নাটক হল চলমান সমাজের দর্পণ কিংবা অতীতের প্রতিফলন। গ্রামীণ লোকনাট্যগুলোর মধ্যে আলকাপ, লেটোগান,  খনগান ,মৈষালবন্ধুর পালা, পালাটিয়া, গম্ভীরা, চোরচুরণীর পালা, গাজন, বোলান, কুশগান, বিষহরি পালা বিশেষ জনপ্রিয়। অন্য নাটকের সাথে লোকনাটকগুলোর চরিত্র, বৈচিত্র্য, তার ইতিহাস এবং সামাজিক মূল্য একেবারে বিপরীতমুখী বলা চলে। কারণ লোকনাটকগুলোর রচয়িতা, কুশীলব ও অন্যান্যরা হয়ে থাকে গ্রামীণ সমাজের নিম্ন বর্ণের দরিদ্রতম নিরক্ষর মানুষ। অঞ্চলভেদে  এদের ভাষা, আচার-আচরণ, বিশ্বাস আলাদা হলেও কোন একটা জায়গায় এরা এক ও ঐক্যবদ্ধ। অর্থাৎ মিল-অমিলের মধ্য একটা বন্ধন ও সংহতি লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ জনসমাজের পরিচয়, তার পূর্ব ইতিহাস লোকনাটকগুলোতে বিস্তৃত হয়ে আছে। প্রাচীন অবক্ষয়িত সমাজের  বহু অনাবিষ্কৃত বিষয় এই নাটকগুলোর  বিশ্লেষণে প্রকাশিত হতে পারে এবং সেই কারণেই লোকনাটকগুলোর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সংরক্ষণ না করলে আগামী প্রজন্মে সঙ্গে আমাদের এই গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পরিচয়ের সূত্র ক্রমান্বয়ে ছিন্ন হয়ে যাবে। অতএব সংরক্ষণই হল ভবিষ্যতের দলিল এবং ইতিহাস। যুগের তাগিদে লোকনাট্য পরিবর্তনশীল হলেও এর সুস্পষ্ট কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়-

১। লোকনাট্য একটি সরল শিল্পমাধ্যম।

২। গণসংযোগ লোকনাট্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৩। লোকশিক্ষার কাজেও লোকনাট্য বড়ভূমিকা পালন করে।

৪। গ্রামীণ লোকসমাজই নাটকের রচয়িতা, অভিনেতা, দর্শক।

৫। লোকনাট্য গীতিপ্রধান ও নৃত্যবহুল।

৬। বাঁধা রঙ্গমঞ্চ থাকে না, দর্শক, অভিনেতা সমান্তরাল ভূমিতে অভিনয় করে।

৭। আঞ্চলিক পটভূমি, ঐতিহ্য ও কথ্যভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

৮। মঞ্চসজ্জা, আলোকসজ্জা সাদামাটা হয়।

৯। প্রথমে লোকনাট্যে ধর্মীয় ব্যাপার প্রাধান্য পেলেও বর্তমান সমাজিক, আঞ্চলিক নানা সমস্যার 

    কথা লোকনাট্যে উঠে আসছে।

১০। লোকবাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

১১। লোকনাট্যের বিষয় প্রতিবছর বদলে যায়।

প্রখ্যাত লোকশ্রুতিবিদ্ ড. আশুতোষ  ভট্টাচার্য মনে করেন- ‘‘গ্রামীণ সমাজে জনসাধরণের জীবন অবলম্বন করে যে নাটকধর্মী রচনা মুখে মুখে রচিত হয়, মুখে মুখে প্রচারিত হয়, তাই ‘লোকনাট্য’। বেশিরভাগ লোকনাট্য ধর্মীয় কোন উৎসব বা পূজাপার্বনকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হলেও জনমনরঞ্জনের জন্য ও লোকশিক্ষা দেবার কারণে পৌরাণিক ঐতিহ্য বা বন্দনাকে সমাজের নানাদিককেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। আবার এমন অনেক লোকনাট্য আছে যাদের সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই, একান্তভাবেই তা সামাজিক লোকনাট্য। এ প্রসঙ্গে আলকাপ, লেটো, খন-পাঁচালী, রঙপাঁচালীর নাম করা যায় –

‘আলকাপ’ মুর্শিদাবাদ ও সন্নিহিত জেলাসমূহের লোকনাট্য। ‘আল’ শব্দের  নানান অর্থ – কণ্টক, সীমানা, হুল এবং ‘কাপ’ শব্দের উৎপত্তি কপাট্য যার অর্থ ছদ্মবেশ বা কৌতুক। ‘আলকাপের’ মধ্যে তীক্ষ্ণ হুল ফোটানো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই প্রাধান্য ‘আলকাপ’ লোকনাট্যে আসর বন্দনা, বৈঠকী গান, ছড়াগান, কাপ, পালা – পাঁচটি আঙ্গিক পাই। সরস্বতী-কালী দেবতাদের বন্দনায় আসর বন্দনা শুরু হয়ে বৈঠকী গানে দর্শকদের গীতিরসের পিপাসা মেটানো, ছড়াগানে রঙ্গ-ব্যঙ্গ, উক্তি-প্রুত্যুক্তিমূলক গান,কাপ অংশে হালকা চটুল বিষয় এবং পালা অংশে বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা- সম্প্রীতিবোধ, নারীনির্যাতন, নিরক্ষরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতি উঠে আসে।আলকাপের অভিনয়ে ওস্তাদ বা ছড়াদার থাকে, আর থাকে ছোকরা, কপ্যা, সাধারণ বাজনদার প্রমুখ। যিনি ছড়া কাটেন এবং কাপ ও পালা রচনা করেন তাকে ছড়াদার বা মাস্টার বলা হয়। ‘কপ্যা’ রা দৈহিক অঙ্গভঙ্গি, মজার গান, হাস্যরসাত্মক সংলাপ বলে আসর মাতায়। নারীবেশে পুরুষ অভিনেতারা হয় ছোকরা। চরিত্র অনুযায়ী পোশাক পড়ার রীতি আছে। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে করতাল, ঢোল, ফুলোট বাঁশি, হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হয়।পায়। আলকাপ অভিনয়ের নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। এই লোকনাট্য মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূমের কোথাও কোথাও,রাজশাহী, দিনাজপুরের কিছু কিছু স্থানে অভিনীত হয়।পালার প্রারম্ভে গাওয়া হয় নারায়ণের স্তুতি –

বন্দি প্রভু নারায়ণ অখিলের পতি

  যাহার চরণ সেবে কমলা সরস্বতী।

তারপর শুরু হয় আখ্যান –সুরে- সংলাপে পালাগানে। পালাগানের বিষয়-অবাধ্য পুত্র সুন্দরী স্ত্রীর কথায় পিতা মাতাকে নিয়ে যায় নদীতে ডুবিয়ে মারতে-

পিতা পথে যেতে যেতে গায়-

  বুঢ়হা পিতা বলে দয়া নাই কি তোর শরীরে

বউয়ের কথায় একেবারে গেলি তুই ভুইলে

        গোপাল রে,

মাতা গায় –

পেটে তোকে ধরেছিলাম গোপাল রে

দশ মাস দশ দিন ধরে রেখেছিলাম কষ্ট করে

কত অন্ন সিদ্ধ খেয়ে

তোর মুখখানা চেয়ে

এত কষ্টের দানা খাওয়াইয়াছিলাম তোকে।……২

গ্রামীণ হাস্যরসাত্মক ছোট নাটক ‘লেটো’।  নাটুয়া শব্দ থেকে নেটো>লেটো হয়েছে। নাটুয়া শব্দের মূল অর্থ নাট্যশিল্পী বা রঙ্গপ্রিয় ব্যক্তি।প্রাচীনযুগে নাট শব্দার্থের বিবর্তন হয়ে লেটো হয়েছে। ‘লেটো’ শব্দের মূল অর্থ ‘নড়াচড়া’ বা ‘অঙ্গচালনা’। লেটোগানও নড়াচড়া বা অঙ্গ সঞ্চালন করেই অভিনয় করা হয়। গ্রামীণ কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের প্রণয়ের নানা দিক রঙ্গ-ব্যঙ্গের সমন্বয়ে লেটোগানে উঠে আসে। এই লোকনাট্যের একটা স্বাভাবিক সমাজ-ভিত্তি ছিল। গ্রামবাসীরা মূলত প্রত্যেক সপ্তাহে লেটোগান উপভোগ করে। তাৎক্ষণিক সংলাপ, গান, নাচ ও অভিনয়ের মাধ্যমে লোকনাট্য নাট্যরূপ পায়। বর্ধমান জেলাকে কেন্দ্র করে প্রায় সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে লেটোর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।একসময় বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী, নদীয়ায় এ গানের জনপ্রিয়তা থাকলেও আধুনিক নাগরিক জীবনযাত্রার প্রভাবে ভিডিও সংস্কৃতি গ্রামে-গঞ্জে অনুপ্রবিষ্ট হবার ফলে ক্রমে ক্রমে লেটোগানের স্রোতধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এখানেও সংলাপগুলো গানের মত গেয়ে ও নেচে চরিত্রেরা অভিনয় করে থাকেন। লেটোর শিল্পীরা সহজাত ক্ষমতায় দক্ষ চরিত্রাভিনেতা রূপে বিখ্যাত হয়। লেটোয় বৈচিত্র্যপূর্ণ সাজ-পোশাকের ব্যবহার হয়। জেলে দম্পতির ঘরে অন্নাভাব দেখা দেওয়ায় জেলেনী তাঁর স্বামীকে মাছ ধরতে পাঠায় উপার্জনের আশায়।  গানে উঠে আসে করুণ আর্তি –

‘‘ ও জেলে তুই গেলি সাগরে,

আমি একলা থাকি ঘরে রে,

আমার মন সুখ নাই রে,

ও তুই ঘরে ফিরে আয় রে,

         ও জেলো তোর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে।।’’…৩

উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর প্রভৃতি জেলার বিখ্যাত লোকনাট্য খন গান। ‘খন’ শব্দের অর্থ খনন করা বা বিদীর্ণ করা। খন গানের বিষয়বস্তু অনৈতিক প্রণয় কথাকে গান ও সংলাপের মাধ্যমে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। অবৈধ প্রণয় প্রাধান্য পেলেও সামাজিক নানাদিক খন গানে  তুলে  ধরা হয়। খনগান বিভিন্ন এলাকায়– ‘শরী গান’, ‘খন-পাঁচালী’, ‘রঙপাঁচালী’, ‘জংলাগান’ বিভিন্ন নামে পরিচিত।পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করে। সাজসজ্জা ও পোশাক পরিচ্ছদ অতি সাধারণ মানের হলেও নারীচরিত্র ও জোকার চরিত্রের সাজ পোষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় লোকনাট্য ‘মৈষালবন্ধুর পালা’। পেটের তাগিদে যুবতী স্ত্রীকে ছেড়ে মৈষালকে মহিষ চড়ানোর কাজ নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী বিরহে কাতর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নদীর প্রান্তে মোষ ছেড়ে দিয়ে মৈষাল প্রণয়ীকে দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। প্রেম-বিরহের সুন্দর ছবিই  মৈষালবন্ধুর পালায় উঠে আসে।

উত্তরবঙ্গের আরএকটি গ্রামীণ লোকনাট্য ‘পালাটিয়া’র পালাতে গ্রামীণ জীবনের বা লোকচরিত্রের কাহিনী থাকলেও, এই লোকনাট্যের কাহিনী কল্পনার মধ্যে রূপকথা, প্রণয়াখ্যান থাকে। এর উপস্থাপন রীতি একান্তভাবেই গ্রাম্য। এর কাহিনী, গান, গদ্যসংলাপ আগে থেকেই রচিত হয়। বিষয়বস্তুতে প্রেমের বিভিন্ন দিক – বিচ্ছেদ, নৈরাশ্য উঠে আসে। জীবনের গভীরতম দিককে তুলে ধরার জন্য এই লোকনাট্যের চিরন্তন মূল্য আছে।

বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি স্থানের একটি পরিচিত লোকনাট্য ‘বোলান’। এতে ধর্মের আবরণ থাকলেও প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজ ও মানুষ। শোভাযাত্রার মাধ্যমে পথ চলতে চলতে এই লোকনাট্যটি অভিনীত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা সবই স্থান পায় এই লোকনাট্যে।

কুশগান লৌকিক সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে যেতে না পারায় ক্রমে তা অবলুপ্ত হয়ে যেতে বসলেও এখনও কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রংপুর, অখণ্ড দিনাজপুরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে।কুশগানে ধর্মীয় প্রাধান্য ও পৌরাণিক কথকতাই প্রাধান্য পায় বেশি।

চৈত্র সংক্রান্তিতে বর্ধমান, বাঁকড়া, বীরভূম, হুগলীর একটি পরিচিত লোকউৎসব গাজন। শিবকে কেন্দ্র করে এই উৎসব হলেও শিব, নন্দী-ভৃঙ্গি এবং বিভিন্ন সংদারদের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের নানা বিষয়ই কৌতুককর সংলাপ ও অঙ্গভঙ্গির মধ্যে উঠে আসে। নারীনির্যাতনের নানা চিত্র যেমন থাকে, তেমনি প্রণয়ঘটিত নানা ব্যাপার, নেতাদের ভণ্ডামি – সবই উঠে আসে বাস্তবচিত কৌতুককর সংলাপের মাধ্যমে। শিবপূজার সঙ্গে যুক্ত গাজন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ছো-নাচ লোকনাট্য সমাজে বহুল প্রচলি।

 মালদহের অদ্যের গম্ভীরা লোকনাট্যের জীবন্ত নিদর্শন। গম্ভীরা লোকনাট্যের প্রধান লক্ষ্য লোকশিক্ষা দেওয়া।  ‘গম্ভীরা’ এক ধরণের লৌকিক শিবপূজা। শিব বন্দনার পর নানা বিষয়বস্তু নিয়ে গান তৈরী হয় । ভাষা সমস্যা, ইংরেজি না শেখার কুফল, রাজনৈতিক দলাদলি গম্ভীরার বিষয়বস্তু।  গান শেষ হয় সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানের মধ্যে দিয়ে। সংলাপগুলো উপস্হিত বুদ্ধির উপর নির্ভর করেই পাত্র-পাত্রীরা তৈরী করে। অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত জনসাধারণকে গম্ভীরা পালাগানের মাধ্যমে অনায়াসে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় এবং দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণকে খুব সহজেই অবহিত করতে পারা যায়। গম্ভীরা মালদহ অঞ্চলে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। তাই গম্ভীরা গানে শিবের প্রচার করা বা তার বন্দনা করা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য হল সমকালীন মানুষের জীবনের নানাদিক ও সমাজের নানা বিষয়কে তুলে ধরা। গম্ভীরা পালাগানে দেশের নানা অভাব সংকট সম্বন্ধে অবহিত করা হয় –

     ‘‘এখন আট সেরেরও ভাও জুটে না

 দু বেলা প্যাটে তাও জুটে না

   তোর নন্দী ভিরিঙ্গী বড়হা দামড়া

              কি দিয়ে পুজবো, কহেক হামরা, শিব হে।’’……৪

আমাদের লোকনাট্যের দেশীয় ঐতিহ্য ধ্বংস হতে বসেছে। দক্ষিণ ২৪-পরগনার বনবিবির পালা, মর্শিদাবাদের আলকাপ এবং মালদহের গম্ভীরা লোকনাটকগুলোর অবস্থা শোচনীয়। পেশাগতভাবে দলগুলো বর্তমান পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক প্রক্ষাপটে নিজেদের নতুন করে কিংবা নবকলেবরে শ্রোতা বা দর্শকদের কাছে নাটকগুলো পরিবেশনে অক্ষম। নতুন আঙ্গিকে বা নতুনভাবে তৈরী করা হলে অর্থের প্রয়োজন এবং এখানেই লোকনাট্যের দলগুলো অসহায়। অন্যদিকে জীবন-জীবিকার সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত অনেক শিল্পী অন্য পেশায় বা বৃত্তিতে চলে যাওয়ায় দলগুলো ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

একসময় মলদহ জেলার গাজোল এবং দুইদিনাজপুরে খনগান পালা জনপ্রিয় খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই আঙ্গিকটির কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি। বর্তমানে শিল্পীদের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা যায়। কীভাবে আঙ্গিকটিকে রক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা সুদূর প্রসারী নয়। বস্তুত পক্ষে আশা-নিরাশার দোলাচলে দলগুলো ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দু থেকে তিনটি দল আপ্রাণ চেষ্টায় তাদের দল নাটক বা পালাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আগে জেলায় এক একটি লোকনাট্যের দল তিন থেকে চারটি  অনুষ্ঠান করত, বর্তমানে এক থেকে দুটি দল অনুষ্ঠান করার সুযোগ পায়। বস্তুতক্ষে বনবিবির পালা, আলকাপ, গম্ভীরার মত দলগুলোও অস্তিত্বের সংকটে বেঁচে আছে। তিনটি ছাড়া অন্য লোকনাটকগুলোর অবস্হা সন্তোষজনক নয়। মেলা, উৎসব অথবা পার্বণে এইসব দলগুলো  অনুষ্ঠান করে থাকে। বছরের অন্যকোন সময়ে অনুষ্ঠান না থাকায়  জীবিকার অন্বেষণে দলের শিল্পীরা হতাশায় বাধ্য হয়েই অন্য পেশার সন্ধানে চলে যাচ্ছে। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র লোকনাট্যের প্রসারে কাজ করে চলেছে। উত্তরবঙ্গের তিনটি জনপ্রিয় লোকনাট্য  দোতারা, কুশান এবং পালাটিয়ার দল আছে। স্থানীয়ভাবে তারা অনুষ্ঠান করে থাকে। দক্ষিণবঙ্গে বারোমাস্যা এবং উত্তরবঙ্গের  মালদায় ডোমনির দল আছে। বর্তমানে এই আঙ্গিকগুলোর অবস্থা আজ বিপন্ন। উত্তরবঙ্গের লোকনাট্যগুলোর মধ্যে খনগান পালা, দোতারা, পালাটিয়া, চোরচুরণীর পালা, কুশগান, হালুয়া-হালুয়ানির সংবাদ দলগুলোর লোকনাট্যগুলো বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এই লোকনাটকের কুশীলবরা বেশীরভাগ পালিয়া এবং দেশিয়া – এরা রাজবংশীদের বংশধর, তাদের সংখ্যা সামাজিক বিবর্তনে কমে আসায় ভবিষ্যতে মূল নাটকের সন্ধান পাওয়াও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, যদি তার লিখিত রূপ না থাকে।

    লোকনাটকগুলোর সংরক্ষণের রূপরেখা

 1. জেলাভিত্তিক নাটকগুলোর বিভাজন করা প্রয়োজন।

 2. প্রত্যেক নাটকের অতীতের খ্যাতিমান শিল্পীদের পরিচয় সংগ্রহ করতে হবে। সম্ভব হলে            

   শিল্পীদের আলোকচিত্র নিতে হবে।

3. উত্তরবঙ্গের লোকনাটক, পালগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন।

4. লোকনাটকগুলোর আর একটি অন্যতম সম্পদ সংগীতাংশ। আলকাপ, গম্ভীরার গান আলাদাভাবে শুনতে পাওয়া গেলেও খনগান, বোলানের গান সেরকমভাবে শোনা যায় না। সেইজন্য লোকনাটকের গানগুলো স্বতন্ত্রভাবে টেপরেকর্ডে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

5. দূরদর্শনের বেসরকারি চ্যানেল আলকাপ, গম্ভীরার চিত্রগ্রহণ করছে। এছাড়া লোকসংস্কৃতির গবেষকদের ক্ষেত্রসমীক্ষায় বিস্তৃত তথ্য যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়। কয়েকটি জেলায় লোকসংস্কৃতি সংস্থা তৈরী হয়েছে। কোন কোন জায়গায় তা লোকসংস্কৃতি পরিষদ বা আকাডেমি নামে কাজ করছে।

লোকনাট্য সমাজের স্বচ্ছন্দ সৃষ্টি। লোকনাট্যের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা আছে। সমাজ ও নীতিশিক্ষার এমন সরল মাধ্যম আর নেই। তাই লোকনাট্যের সংরক্ষণের কাজ আরও ব্যাপক হলে লোকনাট্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বেড়ে যাবে।

তথ্যসূত্র

১। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-১১

২। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য- পৃঃ- ৫৯

৩। লোকঐতিহ্যের দর্পণে- পৃঃ-৪৬

৪। লোকঐতিহ্যের দর্পণে- পৃঃ-৫২

সহায়ক গ্রন্হ

১। মণি বর্ধন- বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য।

২। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম খণ্ড।

৩। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য – বাংলার লোকনাট্য সমীক্ষা।

৪। মানস মজুমদার – লোকঐতিহ্যের দর্পণে।

৫। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসংস্কৃতি।

৬। দিলীপ ঘোষ – বাংলার লোকনাট্য আলকাপ।

৭। শিশির মজুমদার – উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য।