May 1, 2023

New Experiments in the Application of Rabindra Sangeet in Film Modernity (Post Copyright Episode)

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Pratiti Pramanik De
Gobardanga Hindu College
Music Dept.

Abstract :
Film is a young and modern industry.  This opened up a huge field of interesting possibilities for new composers.  The use of music started from the first stage of film exhibition (1885). It acts as a huge weapon in the film apart from connecting the music as well.  Through music we try to express the image’s message in a parallel way on another huge level. Our main focus in the film is vocal music.  And Rabindra Sangeet is the best example in this regard. The relevance of Rabindranath’s songs is therefore eternal.  But the change that can be noticed today is the attempt to make Rabindra Sangeet more contemporary with the passage of time.  As a result, its acceptance has increased and it has become easier to reach people, especially the younger generation. Rabindrasangeet will continue to fill Bengali films in many different ways with songs, sounds and creations in the future.

Key notes : Film, Rabindrasangeet, New generation, contemporary. 

চলচ্চিত্রের আধুনিকতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা (উত্তর কপিরাইট পর্ব)

ডঃ প্রতীতি প্রামণিক দে, গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ,সঙ্গীত বিভাগ

         সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্টের উৎকর্ষসাধন। কোনস্থানের মানুষের আচার ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, শিক্ষাদীক্ষা, ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হ্য, তাই সংস্কৃতি। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা সাহিত্য বা সংগীত যাই হোক না কেন তার প্রধান স্বরূপটি হল নন্দনতত্ত্ব। এবং এই নন্দনতত্ত্বর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রকাশ।শিল্পী যে উপলব্ধি নিয়ে তাঁর শিল্পসৃষ্টি করেছেন সেই প্রকাশিত রূপ হুবহু একই উপলব্ধিতে দর্শক বা শ্রোতার কাছে সবসময় গ্রহণীয় হয় না। দর্শক বা শ্রোতা তাঁর নিজস্ব উপলব্ধিরও কিছুটা মিশ্রণ ঘটান। রবীন্দ্রনাথ নামটি ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালির মনে প্রানে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে প্রতিটিক্ষণে প্রবহমান। নামটির সাথেই কোথাও গভীর উপলব্ধি জড়িয়ে থাকে । ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। তবে এক্ষেত্রে বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গী, চেতনা ও উপলব্ধির বিশেষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এর একটি বিশেষ কারণও আছে – ২০০১ সালে কপিরাইট উঠে যাওয়া। বিশ শতকে সংস্কৃতি বা চলচ্চিত্র জগতে রবীন্দ্রসৃষ্টিকে যখন সম্পূর্ণ প্রকৃত ভাবে কাজে লাগানো হত সেখানে কিছুটা রবীন্দ্রভাবনার সরাসরি প্রভাব পড়ত। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকটি বিচার করলে দেখা যায় স্বরলিপি নির্দেশ অনুসারে পালন করে সঙ্গীতগুলি পরিবেশিত হত। তার ফলে গায়নশৈলী, বাচনভঙ্গি এমনকি সর্বাঙ্গীণভাবে গানটির ভাবও ফুটে উঠত সহজে। তারসঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের প্রয়োগ হত খুব পরিমার্জিতভাবে। একই বিষয় পরিলক্ষিত হয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রসাহিত্য অবলম্বনে যে চলচ্চিত্র ২০০১ সালের আগে পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল সেইগুলি নিরীক্ষণের মাধ্যমেই দর্শকের সাহিত্য পড়া হয়ে যেত। খুব বেশি পরিবর্তন করা হত না। যদিও সাহিত্য ও চলচ্চিত্র উভয়ের ভাষা সম্পূর্ণ পৃথক। প্রকাশের ক্ষেত্রে মূল গল্পের পরিবর্তন না করলেও দৃশ্যমান্যতার অনেক পরিবর্তন করতে হয় দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।

        চলচ্চিত্র হল একটি তরুণ ও আধুনিক শিল্প। এটি নতুন সুরকারদের জন্য আকর্ষণীয় সম্ভাবনার বিরাট বিরাট ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিল। যদিও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর প্রথম পর্ব থেকেই (১৮৮৫) সঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল তথাপি চলচ্চিত্র শিল্পের অঙ্গ হিসাবে নিজের জায়গা করে নিতে এর অনেকটা সময় লেগেছিল। জনপ্রিয় প্রমোদ মাধ্যমগুলির সঙ্গে পরিচিতি থাকার সুবাদে প্রথম দিককার চলচ্চিত্রকারেরা সহজাতগুনে বুঝতে পে্রেছিলেন সঙ্গীতের সংযোজনে চলচ্চিত্র উপকৃত হবে। ক্রমান্বয়ে এটাও বোঝা গেল ছবির সঙ্গে সঙ্গীতকে পাশাপাশি সংযুক্ত করা ছাড়াও ছবিতে এটি একটি বিপুল অস্ত্র হিসাবে কাজ করে। সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমরা অপর একটি বিশাল স্তরে সমান্তরালভাবে ছবির বক্তব্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। যেমন সমস্ত সঙ্গীতের বিশাল ছকটিকে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে তবে সুরটিকে প্রথমে বসানো হয়। গোড়াতেই পরিচয়লিপিতে সমস্ত ছবির একটা ওভারটিউন তৈরি করার চেষ্টা, তারপর বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন মন্তব্যের জন্য বিশেষ বিশেষ সুর বা কম্পোজিশন আসে। পরিণতিতে সেই বিশেষ সুরটিই বক্তব্যের দ্যোতকরূপে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা ভেবেও সুর তৈরি করা হয়। সঙ্গীত অত্যন্ত সংকেতবহ। সেই সংকেত স্বাভাবিকভাবেই চিত্রস্রষ্টার। কাজেই তা ব্যবহৃত হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তার পিছনে একটা সচেতন নকশা থাকে।

            আমাদের ছবির নিজস্ব রূপটাই ভারতীয় ছবির প্রাণ। অর্থাৎ যে ধরণের ছবিই হোক না কেন আমরা সবার আগে জানতে চাই ভাল গান আছে কি না। ভাল গান বলতে ভাল কথা ও ভাল সুর সমৃদ্ধ, তার সাথে থাকবে কথা ও সুরের সাযুজ্য। এব্যাপারে রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ মানা যায়। সঙ্গীত পরিচালকের কাজ শুধু একটা কি দুটো গানে ভাল সুর দিতে পারা নয়, সঠিক জায়গায় সঠিক আবহসঙ্গীত তৈরি করে তোলাও তাঁর দায়িত্ব। যে সুরব্যাঞ্জনা গোটা কাহিনীকে ধরে রাখবে পিছন থেকে; কাহিনীর কাঠামোর কাজ করবে আবহসঙ্গীত। সঙ্গীত পরিচালক সবসময় একটা স্বাধীনতা চান যা চিত্রপরিচালকের পক্ষে সবসময় দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সঙ্গীতের আবেদন ছবিকে ছাপিয়ে নয়, ছবির প্রয়োজনে, সহযোগিতায়। অতিরিক্ত সঙ্গীতের প্রয়োগে সূক্ষ্মভাবে ছবির নান্দনিক দিকটি ব্যাহত হয়। তবে ছবিতে ভালো সুরারোপ করতে গেলে সঙ্গীত পরিচালকদেরও অবশ্যই সঙ্গীত বুঝতে হবে। সব সঙ্গীত সবার জন্য হতে পারে না, এক এক রকমের গান বা যন্ত্রসঙ্গীত এক একরকমের শ্রেণীকে এক একভাবে নাড়া দেয়। তাই সঙ্গীতের চলচ্চিত্রে প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বভাবতই কাহিনীর আবেদনের কথা মনে রেখে সুররচনা করতে হবে। অন্যথায় সেটি গুরুচন্ডালি দোষে দুষ্ট হবে। বেশীরভাগ সঙ্গীত পরিচালকেরাই এই কারণে কোন একটি রাস্তা বেছে নেন। হয় তাঁরা চলচ্চিত্রের গতিশীলতার প্রতি নজর রেখে মানানসই একটা সুর করেন, অথবা সংলাপে যা বলা সম্ভব নয় তা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। দুইক্ষেত্রেই গান সাধারণভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।  ফিল্মমিউজিক আসলে অ্যাপ্লায়েড মিউজিক, আলাদাভাবে তার চিত্তাকর্ষক হবার দায় নেই। সংলাপ, গতি ও শব্দময়তার অনুষঙ্গে যখন সঙ্গীত আসে তখন এই ধারণা অনেকাংশে ফলপ্রসূ হয়, কিন্ত ঘটনা পরম্পরার ওপর গুরুত্ব আরোপ, আবেগের মাত্রাবৃদ্ধি বা সংলাপের পরিবর্ত হিসাবে যখন সঙ্গীত আসে তখন দৃশ্যের বাইরেও তা রসানুভূতি জাগাতে পারে। ছবিতে আমাদের প্রধান অবলম্বন কণ্ঠসঙ্গীত। সেখানে বাজনা থাকে গানের পিছনে, গানকে আঘাত করে না। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আমরা জীবনে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করি, আর তাঁর রচিত গানের সম্ভারে সমৃদ্ধ হই। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক-গায়িকাদের একযোগে দুটি মূল্যবান দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রথমতঃ দীর্ঘ সাধনায় এবং গভীর অনুশীলনে তাকে রবীন্দ্র-মনস্ক হতেই হয়, তা না হলে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবরূপে নিমগ্ন হওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়তঃ গানের মধ্যে সঞ্চারিত কবিহৃদয়ের বিশেষ ভাবটিকে নিজের হৃদয়ভাবের সঙ্গে সঞ্জীবিত করে শ্রোতার মর্মমূলে প্রেরণ করা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পীরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। খুব সাধারণ দুটি শব্দ বর্তমানকালে অতিপ্রচলিত –

১) বিশুদ্ধ  রবীন্দ্রসঙ্গীত

২) বাণিজ্যিক রবীন্দ্রসঙ্গীত

এই নামকরণের ইঙ্গিত অস্পষ্ট নয়। বর্তমানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই রূপান্তরকরণের আবশ্যিকতা ব্যাখ্যা করে বলা যায় যুগধর্মের প্রবণতা অনুসারে শ্রোতাসমাজের দাবি মেটানো শিল্পীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেহেতু আধুনিক মানুষের রুচিবদল ঘটেছে অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মে, সেহেতু শিল্পসংস্কৃতির জগতে বিবর্তন আসবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

‘Theory of Film’ গ্রন্থে S. Kracaure বলেছেন –

   ‘Film images affect primarily the spectator’s senses, engaging him physiologically  

   before he is in the position to respond intellectually’.[1]

সিনেমা সঙ্গীতের প্রতীকী প্রয়োগ। রাগরাগিণী বা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিময়তার সংকেত। সমান্তরাল সঙ্গীতের প্রয়োগ, মাল্টিলেয়ারড মিউজিক, গানের কলির আভাস দিয়ে ব্যাঞ্জনা আনবার প্রয়াস, সঙ্গীতের গাঠনিক ট্রিটমেন্ট বা শর্তসাপেক্ষ রিফ্লেক্সের প্ররোচনা অর্থাৎ মেধা এবং পরিশীলিত সাংস্কৃতিকবোধের কাছে যার আবেদন, সাধারণ দর্শকের কাছে তা কতখানি গ্রহণযোগ্য অনুমানের বিষয়। বরং বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে বলা যায়, সিনেমা-সঙ্গীতের যথার্থ রসগ্রহণের জন্য দর্শকের যথেষ্ট শিক্ষাবোধ জরুরী। রবীন্দ্রনাথ নামে বাঙালির মনে প্রথমেই যেটা মনে আসে তা হল তাঁর বিপুল গানের সম্ভার। মোট ২,২৩২টি গান লিখেছেন তিনি। প্রেম, আনন্দ, দুঃখ, রাগ, অভিমান, হতাশা, জন্ম, মৃত্যু মানুষের প্রতিটি আবেগ, অনুভূতি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে ধরা দেয়। আবার জীবনে চলার পথে প্রেরণাও দেয়। তাঁর এক একটি পর্যায়ের গান আমাদের মনের এক একটি জানালা খুলে দেয়। প্রেম পর্যায়ের গান আমাদের ভালবাসতে শেখায়, প্রকৃতি পর্যায়ের গানে প্রকৃতির রূপ আমাদের মুগ্ধ করে আর পূজা পর্যায়ের গান আমাদের ঈশ্বরকে আপন করতে শেখায়। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রাসঙ্গিকতা তাই চিরন্তন। কিন্তু বর্তমানে যে জিনিসটায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তা হল সময়ের সাথে সাথে গান পরিবেশনের ধরণে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আরও বেশী যুগোপযোগী করে তোলার চেষ্টা। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে এবং তারও সহজে মানুষের কাছে পৌঁছোতে পেরেছে, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে পরিচালকরা কবির গানকে ছবির মর্মকথা রূপায়ণে বিশেষ তাৎপর্যবাহী করে তোলেন, কারণ আজও তাঁর রচিত গান বড়ই আধুনিক। আগামী যুগেও বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি এইভাবেই তাঁর গান, শব্দ ও সৃষ্টি দিয়ে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে ভরিয়ে রাখবেন। সাধারণত চলচ্চিত্রে দুভাবে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার হয় –

১) ট্রাঞ্জীশান হিসাবে – কাহিনীর গতিকে ব্যাহত না করে তার ছন্দে গানকে ব্যবহার করে কাহিনীর অন্য সূত্রের উত্তরণ ঘটানো । এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ ছবিতে “বাজে করুণ সুরে’-র ব্যবহার। এছাড়া এ গানে মূল চরিত্রের বিষাদের সুরটিও ধরা পড়ে।

২) সিনেমার অলংকার হিসাবে – এমন ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট   প্রয়োগ দেখিয়েছেন তরুণ মজুমদার ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ও ‘আলো’ ছবিতে। এও উল্লেখযোগ্য ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ‘দূরে কোথাও দূরে দূরে’ গানটির ব্যবহারে তার অনবদ্য চিত্রপরিকল্পনা।      

চলচ্চিত্র শিল্পে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই আধুনিকতাই ফুটে ওঠে প্রকট হয়ে। একবিংশ শতকে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর এক বিশেষ হাওয়াবদল হয় রবীন্দ্র – নির্মিত সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। আধুনিক কিছু পরিচালক সমাজের ভালোমন্দ উভয়দিক সহজে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার কিছু সময় তা একেবারেই রাবীন্দ্রিক স্টাইল ভেঙে অতীব আধুনিক হয়ে উঠল – যা রবীন্দ্রানুরাগীদের সহজেই বিব্রত করে তুলল। যেমন একটি উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১৩ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কপিরাইট উঠে যাওয়ার সময় থেকে শুরু হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগে পুরানো সাবেকি স্টাইল ভেঙে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার। কিছু সময় যেমন তা হল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য – আরও বেশি মনের কোণে স্থান করে নিল, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হাওয়া বদল’ চলচ্চিত্রে ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতাল’ রবীন্দ্রসংগীতটি সপ্তর্ষি মূখাজ্জী ও সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে প্রয়োগ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। এই প্রয়োগ যথেষ্ট সুন্দর ও স্বচ্ছভাবেই হয়েছে।

‘প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা সৃজনপ্রত্যয়ী মন থাকে। সেই মনের জমিনে অনেককিছু খেলা করে অনেক সময় জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় অনেক সময় হয় না। প্রকাশিত সৃজনকর্মগুলো কখনো ব্যক্তির কাছেই গুরুত্ব পায় না জাতীয়ভাবে গুরুত্ব অর্জন করে। সেই সম্পর্কের সুরক্ষা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। লালন, হাছনের গান, রবীন্দ্র-নজরুলের সৃষ্টিসহ সব সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে উত্তরাধিকাররা আয় অর্জন করবে এমনটা নয় কপিরাইট আইন অনুযায়ী সৃষ্টের মৃত্যুর ৬০ বছর পেরিয়ে গেলে আর্থিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও নৈতিক অধিকার থাকবে যুগ-যুগান্তরে। এ জন্যই আর একটি রবীন্দ্রসংগীত সৃষ্টি করা সম্ভব নয়- বিষয়টি প্রগাঢ় ও গভীর ভাবনার। দেশের উন্নয়ন, শুধু আর্থিক উন্নয়ন নয়, মানবিক সূচকগুলোর পরিব্যাপ্তি প্রয়োজন- এ ক্ষেত্রে সৃজনকর্মের রক্ষাকবচ আইন ও জনসচেতনতার মাধ্যমে নিশ্চিত প্রয়োজন’।[2]  

 ইদানীংকালে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার, অন্য সুরের সাথে  কবির গান মিশিয়ে নতুন গান সৃষ্টিকে ঘিরে শিল্পীর গানের গায়কী নিয়ে নানা বিতর্ক চলমান। কবির জন্মসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে, তাঁর গল্প, উপন্যাস, ছাড়াও জীবননির্ভর কল্পকাহিনী (কাদম্বরী) নিয়েও ছবি হয়েছে, কিন্তু সেসব ছবি কতখানি দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নতুন শতাব্দীর সূচনায় কিছু কিছু দিকপাল শিল্পী নতুনভাবে চলচ্চিত্রকে তুলে ধরলেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, প্রভাত রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা সমাজের ভালোমন্দ উভয় দিকটিই অত্যন্ত সহজে দর্শকের সামনে তুলে ধরলেন। অনেক না বলা কথা জানা অথচ না জানা বিষয়বস্তু ক্রমশই প্রকাশ হতে লাগল চলচ্চিত্রের ভাষায়। শুধুই গল্প নয় রবিন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও রদবদল হতে থাকল। যখন কপিরাইট উঠে গেল তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলির প্রয়োগ নিয়ে যন্ত্রানুসঙ্গ বা কন্ঠসঙ্গীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে পুরনো সাবেকি স্টাইল ভেঙে নতুনভাবে প্রয়োগের পরীক্ষানিরীকগের। কিছুসময় তা যেমন হল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য – আরও বেশী করে মনের মধ্যে স্থান করে নিল, আবার কিছুসময় তা একেবারেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাবেকি স্টাইল ভেঙে অতীব আধুনিক হয়ে উঠল – রবীন্দ্রানুরাগীদের বিব্রতই করে তুলল। যেমন – ‘দ্য বং কানেকশন’ ছবিতে নচিকেতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে পরিচালক অঞ্জন দত্ত  ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটির সাথে ঊলালা ঊলালা জুড়ে দিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। 

            রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর একধরণের আধুনিকীকরণ চলছে ব্যান্ড মিউজিক ও চলচ্চিত্রে বিপুল পরিমাণ অনাবশ্যক রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে। অদ্ভুত একটা আধুনিকতা গ্রাস করছে বর্তমান সমাজকে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিশ্রী ও বিকৃত করে অনেক গানই আজ পরিবেশন করা হয়। তবে এটা একটা স্রোতের মত। সেই স্রোতটা চলে যাবে। আমাদের চারপাশে যারা রবীন্দ্রসনগীতের সাধনা করছেন তারা ঠিকই তা ধরে রাখবেন। সঙ্গীতের প্রায় সব শাখাতেই  মূল একটা বিশুদ্ধ রূপ থাকে। যুগের পরিবর্তনে শ্রোতার পরিবর্তনে সেটার পরিবর্তন হয় সত্যি কিন্তু তার মানে এই নয় পরিবর্তন মানেই সবসময় ভাল। ফিউশন বা মিশ্রণ সবসময়ই একটি পরীক্ষণীয় বিষয় কিন্তু তার ফলাফল যে পজিটিভ বা গ্রহণযোগ্য হতেই হবে এমনটা নয়। রাগসঙ্গীত চর্চায় যেমন বিশুদ্ধ ধারাটিই শুনতে ভাল লাগে রবিন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও কিছুটা তাই। কিন্তু তা বলে এই নয় যে আমি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে, যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকীকরণ করতে চান তারা এর মূল বিষয়টির সাথে ঠিক কতটা পরিচিত আর সম্পৃক্ত সেটা জানার অধিকার অবশ্যই শ্রোতার আছে। শ্রোতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে তাকে সবসময় আধুনিক হতে হবে এমনটা নয়, পরীক্ষানিরীক্ষা হোক কিন্তু পরীক্ষকের যোগ্যতাও এক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্ট।

              একের পর এক শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন, কিন্তু সেসব গানে রাবীন্দ্রিক ভাব কতটা থাকছে সে বিষয়ে বিস্ময় থেকেই যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় নতুন ধাঁচের যন্ত্রানুসঙ্গ। কোথাও আবার গানের বাণী বদলে যায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষঙ্গটুকুই থাকে, হারিয়ে যায় তার নিজস্বতা। যা কিছু ধ্রুপদী তার রিমেক হয়না। সেই সূত্র ধরে রবীন্দ্রসংগীতেও রিমেকের প্রয়োজন নেই, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য তাঁর বাণীর যে গভীরতা তার রিমেক করার দুঃসাহস হয়ত কারোর নেই। তবে কিছুক্ষেত্রে এমন উদাহরণ পাওয়া যায়, যাতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে নতুন কিছু সৃজন হচ্ছে। এ ধরণের উদ্যোগের তবু একটা অর্থ থাকে, যা রবীন্দ্রসংগীতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে আধুনিক সময়ের সাথে জুড়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ –

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে,

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে,

বুক ধুক-পুক চাঁদপানা মুখ

চিলেকোঠা থেকে হাসছে,

মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায়ে

তা-থই তা-থই বরষা,

কাক ভেজা মন জল থইথই

রাত্তির হোল ফরসা,

আমি তুমি আজ একাকার হয়ে

মিশেছি আলোর বৃত্তে,

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে ..

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে।।[3]

অমিত সেন পরিচালিত ‘নটবর নট আউট’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত প্রিচাল্ক দেবজ্যেতি মিশ্র সুন্দরভাবে দুটি গানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

             একজন গীতিকার যখন গান লেখেন তখন তিনি আশা করেন যে তাঁর গানের কথা বা উচ্চারণের বিকৃতি ঘ্টবে না। ঠিক একইভাবে একজন সুরকার যখন সুর সৃষ্টি করেন তিনিও আশা করেন যে তাঁর সৃষ্ট গান সুর, তাল, লয়, ব্যাকরণ ও গায়কি মেনেই গীত হবে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর নিজস্ব গানের ব্যাকরণ অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে জোর দিয়ে গেছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যাপারেও বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখতে বলেছেন। গানের ব্যাকরণ বৈজ্ঞানিক সূত্রের মতোই অপরিবর্তনীয়। সেটা ঠিক রেখে যদি আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করা হয় তবে কোন সমস্যা নেই।

              শিল্পের নান্দনিকতার সঙ্গে শিল্পের সার্বিকতার দিকটিও আমাদের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। সেক্ষেত্রে শিল্পের সার্থকতা বজায় রাখতে গিয়ে আধুনিকতম চিন্তার ফসল ফলালে বোধহয় গুরুচন্ডালি দোষ হয় না। শিল্পের নান্দনিকতাকে বাদ দিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করাও শিল্পের একটি সার্থক রূপ। বিনোদন বা মনোরঞ্জনকে কখনোও উপেক্ষা করা যায় না। রবিন্দ্রনাথ প্রাদেশিকতার থেকেও অনেক বেশী সার্বজনীন। তিনি নিজেও তাই চেয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর জীবিত অবস্থায় বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী বা চিত্রপরিচালকদের প্রয়োজন অনুসারে তাঁর লেখার পরিবর্তন করতে মত দিয়েছিলেন। তিনি কখনই বলেননি ‘চল নিয়মমতে’, পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন ‘ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও’। সেই কারণেই কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে তাঁর গান অনেক বেশী সমাদৃত ভারতে এবং ভারতের বাইরে। তাঁর গাঙ্কে বর্তমানে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত করা হচ্ছে। এই আধুনিকতাকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে বর্তমান প্রজন্ম সংস্কৃতির পরিশ্রুতকরণের মাধ্যমে এক সতেজ নিষ্ঠাবান পৃথিবী তৈরি করবে এই আশা রাখা যায় ।

তথ্যসূত্র :

[1] Oxford University Press, New York, 1974, page – 158

[2] https://www.jugantor.com/todays-paper/literature-magazine/414629/কপিরাইট-নতুন-আইন

[3] https://www.gdn8.com/2015/03/megher-palok-lyrics-shreya-ghosal.html