September 1, 2020

লোকায়ত গানে কাজী নজরুল ইসলাম

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

 ড. মৌমিতা বৈরাগী

 সাধারণভাবে মানুষ বা লোকোমুখে যা প্রচলিত  বা প্রসারিত তাই হলো লোকায়ত।যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের লোক – ভাবনা প্রাধান্য পায়। নগর বা শহরের রুক্ষ বাস্তব ও যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে অনেক দূরে, প্রকৃতির শ্যামল রূপের কোলে বেড়ে ওঠা মানব মনের অন্তস্থলের খুব সাধারন কথা এবং অতি সাদামাটা সুরে নিজের মনের ভাব প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম হলো লোকসংগীত। যার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের  হাসি কান্না দুঃখ সুখ আনন্দ, মনের আবেগময় অনুভূতি। অন্যভাবে লোকসঙ্গীত হলো গ্রামীণ জনজীবনের অন্যতম এক বিনোদন। এই বাংলা নানা ধারার  লোকগানের  সম্ভারে সমৃদ্ধ। একদিকে যেমন পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ অঞ্চলের লোকগান, লালন সাঁইজি এবং অন্যান্য পদকর্তাদের গান আবার শ্রমজীবী মানুষের শ্রম লাঘবের গান, বিভিন্ন জাতি এবং উপজাতিদের উৎসবের গান – লোকগানের এত বৈচিত্র্য  আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।

 কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের বিভিন্ন ধারার সংগীতের মধ্যে এক অন্যতম সৃষ্টি হল লোকায়ত সুরে তার গান।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত পুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র কাজী পরিবারে কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের জন্ম। বর্ধমান জেলায়  জন্মগ্রহণ করলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রভাব, পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের নান্দনিকতা কাজী সাহেবকে লোকসংগীত রচনায় প্রভাবিত করেছিল একথা বলা বাহুল। খুব ছোট বয়স থেকেই সৃষ্টির প্রেরণা তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। ‘আমরা দেখি লোকগানে নজরুলই প্রথম আদিবাসী গানের স্তর থেকে ঝুমুর ঢঙ ব্যবহার করে, বাংলা গানে ব্যতিক্রমী ধারা সৃষ্টি করেন। কয়লা খনির জীবন, নর নারীর ভালোবাসা, রাধাকৃষ্ণ প্রেমকথা, প্রাকৃতিক শোভা প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ে রচিত নজরুলের অসংখ্য গানে ঝুমুরের এই দোলা লাগানো সুর, আমাদের উদ্বেলিত করে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য একটি গান ‘চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনিঝিনি বাজে লো।’ নজরুলের ভাওয়াইয়া গান সম্পর্কে  ভাওয়াইয়া সম্্রাট আব্বাস উদ্দীন বলেছেন, ‘নদীর নাম সই কচুয়া/ মাছ মারে মা মাছুয়া/ মই নারী দিচঙ ছ্যাকাপাড়া।’ এই ভাওয়াইয়া গানটি তাঁর কণ্ঠে শুনে নজরুল লেখেন, ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা/নাচে তীরে খঞ্জনা/পাখী তো নয়/নাচে কালো আঁখি।’ নজরুল অসংখ্য পল্লী গান, ভাওয়াইয়া রচনা করেছেন’।[1]

 লোকায়ত সুরকে আশ্রয় করে কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের লোকধর্মী গান একান্তই তার মৌলিক রচনা, সুরের আশ্রয়ে কখনো ভাটিয়ালি কখনো বা ঝুমুর আবার কখনো বা ভাওয়াইয়া, লোকগানের ভিন্ন ভিন্ন ধারার সুর সম্মিলিত হয়েছে তার গানে।

 বিস্ময়কর প্রতিভা ও সাহিত্য সংগীতের নিপুন দক্ষতা নিয়ে  কাব্য সাধনার এক পর্যায়ের সংগীত সৃষ্টির কাছে ব্রতী হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নতুন কথা ও সুরের পরীক্ষার দ্বারা গড়ে তুললেন এক বিশিষ্ট ধারা, যার ভিত ছিল লোকসুর। সাংগীতিক কুশলতা ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায় দিলেন এক নতুন রূপ। যা অনন্য এবং যেখানে কাজী নজরুল ইসলামের সাংগীতিক স্বকীয়তা এবং মৌলিকত্ব  তার সৃষ্টিকে সবসময় স্বতন্ত্র করে রেখেছে। আর এই জন্যই কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের লোকায়ত সুরের গান বাংলা  সাহিত্যের ইতিহাসে

 আলাদা করে স্থান করে নিয়েছে।

               কাজি সাহেবের প্রাথমিক পর্যায়ের রচিত গান হলো  লেটো গান, এই গানের মধ্যে দিয়েই বালক কবির স্বভাব কবিত্বের স্বতঃস্ফূর্ততা প্রথম প্রকাশিত হয়। লেটো হল রাঢ় অঞ্চলের পালাধর্মী লোকগান। গ্রামের উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এই পালার রস আস্বাদন করতে আসতেন তাই একে মিশ্র সংস্কৃতির একটি আকর্ষণীয় গীত এবং নৃত্য বহুল জনপ্রিয় শিল্প শৈলী বলা যায়। ‘মকতব, মাযার ও মসজিদ-জীবনের পর নজরুল  রাঢ় বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক  লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। ঐসব লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে  পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ও লেটোদল থেকেই শুরু হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল  লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি’।[2]

 কাজী সাহেব বাল্যকাল থেকেই এই লেটো দলের খুদে মাস্টার থেকেছেন লোক জীবনের অন্দরমহলে। এই লেটো প্রসঙ্গে কবি রচিত একটি বন্দনা গীতি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যে গানটি কিশোর কবি আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করে আসরে উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে পরিবেশন করতেন—

‘সর্ব প্রথম বন্দনা গাই, তোমারী ওগো বারি তালা।
তার পরে দরুদ পড়ি মোহাম্মদ সাল্লে আলা॥
সকল পীর আর দেবতা কুলে,
সকল গুরুর চরণ মুলে,
সালাম জানাই হস্ত তুলে,
দোওয়া কর তোমরা সবে, হয় যেন গো মুখ উজলা॥ …..’[3]

 আবার কখনো গাইতেন —-

‘বুঝলাম নাথ এতদিনে, যুবকের ছলনা হে।

কোথা শিখিলে এ প্রণয়, আমারে বল না হে॥

তোমার হিয়া কঠিন অতি,

জান না শ্যাম প্রেমের রীতি,

তাই নিভালে প্রণয় বাতি, আর বাতি জ্বলে না হে॥ …’[4]

 আবার কখনো আসরে প্রতিপক্ষকে বিব্রত করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ইংরেজী -বাংলা মিশ্রিত লেটো গান —-

 ‘ওহে ছড়াদার , ওহে  that পাল্লাদার

    মস্ত বড় Mad

    চেহারাটাও Monkey Like

    দেখতে ভেরি Cad…’

 শুধুমাত্র ইংরেজি বাংলায় নয়  নিজ রচনায় উর্দু ফারসি শব্দ মিশিয়েও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছেন লেটো গানকে –

     ‘ Monkey লড়বে বাবরকা সাথ

       ইয়ে বড় তাজ্জব কি বাত

       জানে না ও ছোট হলেও

       হামভি Lion Lad…’

 কাজী সাহেব পশ্চিমবাংলার মানুষ হলেও তার বাউন্ডুলে জীবন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গের নদীর স্রোতে। নদীমাতৃক দেশ পূর্ববঙ্গের প্রধান লোকসংগীত ভাটিয়ালির সুরে বাংলা গান রচনার কাজে ব্রতী হয়ে তিনি রচনা করেছেন বহু ভাটিয়ালি পর্যায়ের গান–

  ‘ আমার গহীন জলের নদী…’

   ‘পদ্মার ঢেউরে – মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা রে…’

      ‘গাঙের জোয়ার এলো ফিরে, তুমি এলে কই…’

       ‘এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে এইতো নদীর খেলা…’ উল্লেখিত এই গানগুলো ছাড়া আরও ভাটিয়ালি পর্যায়ের গান বাংলা গানের ইতিহাসকে  সমৃদ্ধ করেছে।

   লোকসংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন সাহেবের কন্ঠে একটি প্রচলিত ভাওয়াইয়া গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজী সাহেব রচনা করেন ভাওয়াইয়া পর্যায়ের গান —-

  ‘ নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা…. ‘

 ‘ পদ্মা দিঘির ধারে ধারে ওই…’

 বাংলা লোকসংগীতের পাশাপাশি আরেকটি ধারা বাংলা গানকে  সমৃদ্ধ করেছে তা হলো বাংলার বাউল। কাজী সাহেব বাংলা দর্শনের আদর্শে বাউল সুরের রেশ রেখে প্রয়োজন মত তাতে কিছু রাগ সঙ্গীতের সুর মিশিয়ে  রচনা করেছেন বাউলধর্মী গান। নিজের সৃজনী ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখে যে গানের রস ও রূপ  আমাদের টেনে নিয়ে গেছে সেই মেঠো পথে –

  ‘ আমি বাউল হলাম ধুলির পথে

   লয়ে তোমার নাম…’

   ‘ আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল

   আমারি এই আপন দেহ…’

 আবার বাউল ধর্মী গানের পাশাপাশি দরবেশীধর্মী গানের রচনার সন্ধান মেলে, যেমন –

   ‘ চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়

 আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়…’

‘ আহার দেবেন তিনি  ও মন জিভ দিয়েছেন যিনি

 তোরে সৃষ্টি করে তোরি কাছে আছেন তিনি ঋণী  ‘

 চুরুলিয়ার অনতি দূরে সাঁওতাল পরগণা মাড়গ্রামের আদিবাসীদের মাদলের ছন্দে গ্রথিত মহুয়ার নেশা ভরা ঝুমুরের সুর কাজী সাহেবের

 লেখনির মাধ্যমে স্থান পায় বাংলা গানে, যেমন–

 ‘চুরির তালে নুড়ির মালা রিনিঝিনি বাজে… ( লো )

‘এই রাঙ্গামাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি…’

‘ গিরি মাটির দেশে গো নাই যদি আর ফিরি…’

‘ হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল…’                                         

 এছাড়াও  বেদে-বেদেনীর গান, সাপুড়ে, জিপসি, ঝাপান গানের  বিষয় বস্তু নিয়েও কাজী সাহেব গান রচনা করেছেন।

 আরো অনেক লোক আঙ্গিকের গান যেমন বিড়ি বাঁধানিদের গান, ছাদ পেটানোর গান, বিয়ের গান, ব্রত কথার গান, ঘুম পাড়ানি গান  বেঁধেছেন একের পর এক।

 ইসলামী গান রচনা করে কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলিমদের মুখের কথা ও অন্তরের ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন বাংলা গানের আধুনিক সময়ে –

‘ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…’

 এই গান রচনার মধ্য দিয়ে কাজী সাহেব তার ইসলামী গান রচনার যাত্রা শুরু করলেন। এছাড়াও মারফতি গান–

‘ আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি…’

এই রচনার মাধ্যমে  কবি মুসলিম জনজাতির সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ গড়ে দিয়ে এক লোকজীবনের ঐতিহ্য তৈরি করে গেছেন। তাই লৌকিক জীবন – সংস্কৃতি ও ইসলামী ঐতিহ্যের অনুরণনে কাজী সাহেবের ইসলামী গান অনন্য ও অমলিন।

 অবশেষে বলতেই হয় সমস্ত জনগোষ্ঠী বা লোকজীবনের মুখের কথা ও অন্তরের ভাবনাকে সাহিত্য ও সংগীতে এক অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন বলেই  কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে   সাধারণ মানুষের অনেক কাছাকাছি এবং অন্তরের অন্তঃস্থলে  বিরাজমান। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যতদিন ‘সৃষ্টি’ র প্রতি মানুষের আকর্ষণ এবং আনুগত্য থাকবে ততদিন কাজী সাহেবের সৃষ্টি কালজয়ী হয়ে থাকবে।

 ভীষণ রকম ভাবে বিস্মৃত হই খুব অল্প সময়ের মধ্য দিয়ে তার সৃষ্টিতে এত বৈচিত্র রেখে গেছেন, আমার মনে হয় এক বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

তথ্যসূত্র


[1] https://www.kalchitro.net/literature-culture/article/2577

[2] https://bn.banglapedia.org/index.php/ইসলাম,_কাজী_নজরুল  

[3] https://poetnazrul.com/index.php?r=site/lyrics_det&id=2839

[4] https://poetnazrul.com/index.php?r=site/lyrics_det&id=2888