May 1, 2023

The Therapeutic Harmony: Healing Disease Through the Power of Music

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Gargi Das Bakshi

Abstract:

In the intricate tapestry of human existence, the profound impact of music on health and well-being has garnered increasing attention. This abstract explores the therapeutic potential of music in healing various diseases, transcending conventional medical approaches. As an art form with the ability to resonate deeply within the human psyche, music has proven to be a potent catalyst for physical, emotional, and mental healing. This inquiry delves into the symbiotic relationship between music and healing, shedding light on the scientific underpinnings, historical roots, and contemporary applications of music therapy. Through an interdisciplinary lens, we navigate the melodies that resonate with the body’s innate rhythms, offering a holistic perspective on how music serves as a transformative force in the journey towards wellness. From ancient rituals to modern clinical practices, this exploration aims to unravel the threads that weave the healing potential of music into the fabric of our collective well-being.

 

সংগীতে রোগ নিরাময়, ড. গার্গী দাস বকশি

রোগ নিরাময়ের সংগীতের ভূমিকা এখন সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় এবং চর্চিত বিষয় I মানুষ সংগীতে বিভিন্নভাবে সারা দেয় I তবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে মানুষের নিজস্ব পছন্দ , ব্যক্তিত্ব , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি , মানসিক স্থিতি ও রুচির ওপরে I মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সঙ্গীত বোধ থাকে I অনেক সময় হয়তো সুপ্ত অবস্থায় থাকে কিন্তু সংগীতের সুর, তাল , লয় ,ছন্দ, ভাব সবকিছুর একত্র একটি অবস্থা  যখন বিশেষ কৌশলী প্রক্রিয়ার সাহায্যে সুপ্ত সংগীত বোধকে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয় তখন সেই ব্যক্তি এক নতুন অজানা জগতের সন্ধান পায় l সেখানেই সংগীতের সার্থকতা l সংগীতের মাধ্যমে রোগ নিরাময়ে প্রথম শর্ত হলো সংগীতের সাথে মনের বন্ধুত্ব স্থাপন করা l

প্রাথমিক পর্বে আমাদের মনে একটা প্রশ্ন আসে আমরা সঙ্গীত পেলাম কিভাবে? এ বিষয়ে প্রখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট ও সঙ্গীতজ্ঞ dr. Daniel Je Levitin দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, “ ভাষা বা সংগীত কোন একটি মানুষ কোন একটি স্থানে অসময়ে আবিষ্কার করেছিল এমনটা নয়: বরং সারা পৃথিবী জুড়ে কয়েক লক্ষ বছর ধরে অনেক মানুষের প্রয়াসে ধীরে ধীরে ভাষা ও সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে l”[1] কিন্তু এই সৃষ্টির জন্য যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার মস্তিষ্ক বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে যা তাকে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে অতুলনীয় করে তুলেছে l 10 হাজার বছর আগে পৃথিবীতে সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে মানুষ ও তার গৃহপালিত পশুদের মিলিত সংখ্যা ছিল মাত্র 0.1% আর বর্তমানে তা 98% l

https://newsinside24.com/মিউজিক-থেরাপি/

অনেক দিক থেকে মানুষ দুর্বল বিশেষত শারীরিকভাবে l একটা মশার কামড়ে তার মৃত্যু হয় কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো “জ্ঞানার্জন ক্ষমতা (cognitive ability) l Dr. Levitin এর গবেষণালব্ধ মতামত হলো এই যে,

1)মানুষ চিন্তা করতে পারে এবং অন্যরা কী চিন্তা করছে তা অনুমান করতে পারে এমনকি তাদের চিন্তা ও বিশ্বাস আলাদা হতে পারে সেটা উপলব্ধি করতে পারে l

2) যে বস্তু বা বিষয় চোখের সামনেই তার সম্পর্কে ভাবতে পারে অর্থাৎ কল্পনা করতে পারে l        

3)পৃথিবীতে বিভিন্ন মৌলিক বস্তু বা বিষয় আছে তাকে প্রয়োজনমতো সংযুক্ত করে বিন্যাস বদ্ধ অর্থাৎ hierarchical order এ সাজাতে পারে l

এই তিনটি গুণ থাকার কারণে মানুষ যেটা পারলো সেটা হল সে পৃথিবী কে চিনতে পারলো এবং বর্ণনা করতে পারলো, তৈরি হলো ভাষা ও শিল্পকলা l চিত্রাংকন , ভাস্কর্য, নৃত্য ও সঙ্গীত l পৃথিবীতে 84 লক্ষ প্রাণী আছে তাদের বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট উন্নত l  অনেকেই অনেক কিছু পারে l যেমন, পাখি, ডলফিন, মৌমাছি এরা নিজেদের জীবন যাপনের উন্নত মানের সাংকেতিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে l শিম্পাঞ্জিরা যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে l বাঁদর, হনুমান দু পায়ে দাঁড়াতে পারে হাটতে পারে l এমনকি রাজহাঁস, নেকড়ে এরা জীবনসঙ্গিনী ও নির্ধারণ করতে পারেl  কিন্তু সমস্ত প্রাণিকুল যেটা পারে না মানুষ সেটা পারে, সেটি হল “শিল্পকলা”l  শিল্পকলায় সংগীতের স্থান সবার ওপরে l সংগীতের মধ্যে প্রধান উপাদান হল “ধ্বনি”l  আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা l সমস্ত ইন্দ্রিয়ের গ্রহণ ক্ষমতা আছে l কিন্তু সৃজন ক্ষমতা বা প্রকাশ ক্ষমতা নেই l চোখ আলো গ্রহণ করে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না l কান শব্দ শুনতে পারে কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনা l জিহ্বা, নাসিকা, ত্বক, সবাই স্বাদ গন্ধ স্পর্শ অনুভব করতে পারে কিন্তু নিজে তৈরি করতে পারে না l কিন্তু মানুষ ধনী উৎপাদন করতে পারে l জীবন মানেই স্পন্দন l স্পন্দন থেকে উৎসারিত হয় ধ্বনি l সৃষ্টিতত্ত্বের শুরুতেই ছিল কম্পন যা থেকে জন্ম নিল শব্দ l তাই ব্রহ্মার আরেক নাম শব্দ l জ্ঞানের রাজ্যে শব্দই একমাত্র শক্তি l শব্দকে ব্যবহার করেই প্রাণের আরাম আনা সম্ভব আবার আঘাত হানাও সম্ভব l

শব্দের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে “কম্পন” l বিজ্ঞানের ভাষায় কম্পনই শব্দের বিভিন্ন তা প্রকাশ করে l সঙ্গীত এর প্রধান উপাদান সা রে গা মা পা ধা নি এই সাতটি শুদ্ধস্বর ও পাঁচটি রে গা মা ধা নি বিকৃত স্বর এর আলাদা সুর তৈরি করে “কম্পাঙ্ক” l 1968 সালে লন্ডনে Juliet Elvin ও Prof. Olav Shirley দীর্ঘ আলোচনা করার পর এই সিদ্ধান্তে আসেন এবং নাম দেন Universal concept of music l[2] এই তথ্য অনুযায়ী

  1. মৃদু কম্পাঙ্ক যুক্ত শব্দ (low frequency) দেহ ও মনকে শান্ত করে (relaxation calmness) 600 থেকে 900 hz বিশিষ্ট কম্পাঙ্ক l 
  2. তাল (rhythm) পেশী (muscle tone) শক্ত করে l
  3. উচ্চ আওয়াজে যুক্ত (loud volume) শব্দ আক্রমণাত্মক ব্যবহার (aggressive behaviour) সৃষ্টি করে ও আত্মসংযম হানি করে l

মানুষ ও সংগীতের সম্পর্ক সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকেই l কারণ সংগীত মানুষের আবেগের ভাষা l বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রাচীন সাহিত্যে সংগীতের শক্তির কথা উল্লেখ করা আছে l দৈহিক ও মানসিক শক্তির উন্নতি সাধনে সংগীতের ভূমিকা অপরিসীম l উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, “ঘুম পাড়ানির গান “l কারণ আমাদের শরীর ও মনের মধ্যে একটা ছন্দ আছে l কানের কাছে কোন ছন্দময় সুর গাওয়া হয় তখন মন ও শরীর সেই ছন্দের সাথে নিজের ছন্দকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করে lফলে আমরা শিশুকে ঘুম পাড়াতে সফল হই l এই মিলিয়ে নেওয়ার কাজটা কেন হয় তার ব্যাপারে প্রথম গবেষণা করেন বিজ্ঞানী Hoygenes l 1665 খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি পরীক্ষা করেন l একটি তারের ঝোলানো দুটি পেন্ডুলাম কে কিছুটা সময়ের ব্যবধানে দুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি l আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ পরে দেখলেন যে, পেন্ডুলাম দুটো একই সঙ্গে, একই ভাবে, একই কম্পাঙ্কের দোল খাচ্ছে l এই ভাবেই বাজনার  ছন্দে একইভাবে দোল খায় আমাদের শরীর ও মন l “ঘুমপাড়ানি গান” তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ l তাই সারা বিশ্বে এর প্রচলন l

 ঘুমপাড়ানি গানের মতো শ্রমসংগীতের কথাও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক l সারাবিশ্বে শ্রমসাধ্য কাজের ক্ষেত্রে শ্রম লাঘব করবার জন্য গান প্রচলিত আছে l এর বিজ্ঞানসম্মত কারণ হলো, আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (central nervous system) আমাদের ধমনীতে একটি হরমোন (hormone) নিঃসৃত করে যেটিকে বলা হয় এনডরফিন(endorphin) l এই এনডরফিন আমাদের মনে ভালোলাগা তৈরি করে শ্রমসাধ্য কাজের কষ্টকে লাঘব করতে সাহায্য করে l

 সংগীতএর মাধ্যমে আমরা কি সত্যিই রোগ নিরাময় করতে পারি? এ প্রসঙ্গে আসার আগে খুব সংক্ষেপে একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করা প্রয়োজন l সেটি হল, ভারতীয় সংগীতের ঐশ্বরিক ক্ষমতা l তার প্রধান কারণ হলো ভারতীয় রাগ সংগীতের “নমনীয়তা” প্রতিটি রাগের মধ্যে একটি নিজস্ব আবেগ আছে তাকে সুন্দর করে তালে- ছন্দে – ভাষায় এমনভাবে রূপায়িত করা যায় যা শ্রোতা নিজের ভাব-ভাবনার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে l আমরা ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস পরলে অনেক ঘটনার কথা জানতে পারি যা প্রাথমিকভাবে অলৌকিক লাগলেও পরবর্তীকালে যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে বিচার করলে অনেকাংশে সত্য ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় l আমরা খুব সহজেই একটা কথা বলি ও শুনি “সাধনা শ্রেষ্ঠ পথে হলো সংগীত”l কারণ গানের মধ্য দিয়েই মনের যে তিনটি স্তর থাকে –

  1. Cognition বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান l
  2. Affection or feeling আবেগ বা অনুভূতি l
  3. Conation বা ইচ্ছা ……তাকে একত্রে অনুভব করা সম্ভব l উপরিউক্ত তিনটি স্তরের আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলেই মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে l গানের মাধ্যমে কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব l শরীর ও মন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত l শরীর খারাপ হলে মন খারাপ হয় আবার মন খারাপ হলে শরীর খারাপ হয় l

ভারতবর্ষের বাইরেও সঙ্গীত সম্পর্কে এমন ধারনা আছে l মিশরে “মেডিকেল পেপেরি অফ ইজিপ্ট “1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ গ্রীক ইতিহাসে এর উল্লেখ আছে l গ্রীসের দেবতা Asklepios এবং পরবর্তীকালে রোমান স্বাস্থ্য দেবতা  Askulapios রোগ নিরাময় পদ্ধতির অনুগামীরা সংগীতে যে রোগ নিরাময় শক্তি আছে সেটা বিশ্বাস করতেন l এমনকি পিথাগোরাস সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নির্দিষ্ট সংগীত পদ্ধতি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন l একটি জাতির নীতিগত মান বজায় রাখার জন্য সংগীতের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ – একথা প্লেটো মনে করতেন l রোমে শিক্ষালয়ে যে Quadrivium পাঠ্যক্রমের ব্যবস্থা ছিল তার অন্যতম বিষয় ছিল সঙ্গীত l আমাদের দেশেও সঙ্গীত এমন কিছু ভূমিকা বহুদিন ধরেই পালন করে চলেছে l আমরা সংগীতের মাধ্যমে নিজেদের অজান্তেই বহু জটিল বিষয়কে সহজেই জানতে পারি l এই ধারা বহন করছে কীর্তন, যাত্রাপালা, নাটক, জলসা ইত্যাদি সঙ্গীত প্রধান অনুষ্ঠান l

1940 সালে মনস্তত্ত্ববিদ Everest thayar gayston[3] তিনি “মিউজিক থেরাপি” প্রথম নির্দিষ্টভাবে সুসংবদ্ধ করেন এবং সমাজে এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা করেন lঠিক সেইসময়ই সরকারি হসপিটাল সাইক্রিয়াটিস্ট ও মিউজিক থেরাপিস্ট Era M, Alt Shuler এবং Willem Van D Wall[4] মিউজিক থেরাপি কে ব্যবহার করতে শুরু করেন l Willem Van D Wall  প্রথম মিউজিক থেরাপি পদ্ধতির বই লেখেন “Music in Institutions” 1936 সালে l 1944 সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রথম মিউজিক থেরাপি বিষয়ে একাডেমিক প্রোগ্রাম শুরু হয় l

রোগ সারাতে মিউজিক থেরাপি

এইভাবে মিউজিক থেরাপির পথ চলা শুরু হয় l পরবর্তীকালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাপদ্ধতি রূপে প্রতিষ্ঠা পায় l মিউজিক থেরাপি বর্তমানে আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী কোর্স পরানো হচ্ছে l 1983 সালের সরকারিভাবে মিউজিক থেরাপি প্রতিষ্টিত হয় এবং যাদের শংসাপত্র না থাকলে আমেরিকায় মিউজিক থেরাপিকে পেশাগত ভাবে ব্যবহার করা যায় না l

মিউজিক থেরাপির প্রয়োগ কিভাবে দেওয়া সম্ভব; প্রথমত রোগী সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে অর্থাৎ Active participation দ্বিতীয়তঃ Passive participation নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণ l বিদেশে যেভাবে মিউজিকের যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় ভারতবর্ষে এখনো ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না l কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ ধারা আছে যেখানে সংগীতের বিভিন্ন স্বরে বিভিন্ন রস ও ভাবের  সমন্বয় রয়েছে l  প্রতিটি রাগ নির্দিষ্ট ভাব  সৃষ্টি করে এবং প্রকৃত গায়ক তার  গায়নশৈলীর মাধ্যমে শ্রোতার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারে l ফলে রাগের মধ্য দিয়ে শ্রোতার মনে উদ্দীপনা, উত্তেজনা, বিষাদ, শান্তি, করুণা প্রভৃতি অনুভূতির সঞ্চার হয় lএই অনুভূতি আবেগ ই হল ভাব বা রস l

“মিউজিক  থেরাপি” এই শব্দটির উৎপত্তি পাশ্চাত্যে l যদিও থেরাপি শব্দটি ইংরেজি হলেও মূল উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Therapeutes থেকে l যার অর্থ হলো মেডিকেল এটেনডেন্ট বা  চিকিৎসক l চিকিৎসার দুটো দিক আছে একটি হলো Cure অপরটি হলো Relief l  ব্যাধি দু প্রকার শরীরে এবং মনে l অর্থাৎ ফিজিক্যাল এন্ড সাইকোলজিকাল l দেহের রোগ সারানোর অনেক পদ্ধতি আছে l কিন্তু মনের রোগ সারানোর পদ্ধতি থাকলেও কিছুটা ভিন্ন প্রয়োগ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয় l এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন দেহের ব্যাধির  কারণেও কিন্তু মনের ব্যাধি হয় l কারণ রোগের কষ্টকে নির্মূল করার পদ্ধতি একেক সময় এমন পর্যায়ে যায় তখন তার সাথে বোঝাপড়া করতে না পেরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে l এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার অন্যতম পথই হলো মিউজিক থেরাপি l

পাশ্চাত্যে মিউজিক থেরাপি কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন আমেরিকার Paul Nordof ও Clive Robins,  Mary Pristley, Helen Bony, Kenneth Brassia, Joseph Moreno প্রভৃতি l এরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন সেখানে মূলত অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, মেন্টাল রেটার্ডেশন, সেরিব্রাল পালসি ইত্যাদি মানসিক ও দৈহিক প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক ফলদায়ী প্রভাব ফেলে l এছাড়া স্ট্রেস, ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি যথেষ্ট ফলদায়ী  প্রভাব ফেলেছে l এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে শুধুমাত্র অসুস্থ নয় সুস্থ মানুষের জন্য সঙ্গীত অত্যন্ত জরুরি মাধ্যম l  সঠিকভাবে নিয়মিত সঙ্গীত শ্রবণে মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তি অত্যন্ত সুচারুরূপে ভারসাম্য রক্ষা করে l

এবার আসা যাক কিভাবে সংগীতের প্রয়োগ সম্ভব l ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আগেও বলেছি ভারতীয় সংগীতের ভাব ও রস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, সেই ভাব কে স্মরণে রেখে প্রয়োগ করতে হবে l যেমন স্বাভাবিক ভাবেই যদি মনের প্রশান্তি আনার জন্য কোন রাগ শুনতে হয় সেক্ষেত্রে ভৈরব, ললিত, যোগিয়া, তৌরি, দরবারী, পূরবী ইত্যাদি রাগের স্বরসঙ্গতি খুবই কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করে l কারণ এই প্রতিটি রাগের শুদ্ধ ও বিকৃত স্বর এর প্রয়োগ এবং রসসঞ্চয়ক বৈশিষ্ট্য মনকে স্বস্তি প্রদান করে l উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী রাগ যেমন বাহার, পিলু , হংসধ্বনি, মল্লার, বসন্ত, বেহাগ,ইত্যাদি l এই ধরনের রাগ গুলিতে যে ধরনের স্বরসঙ্গতি ব্যবহার করা হয় তাতে সঠিক ছন্দ লয় এবং সঠিক সময়ে গায়লে বাজালে ইপ্সিত ফল পাওয়া সম্ভব l

প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন  রাগসংগীত এর ব্যবহার কন্ঠে এবং যন্ত্রে দু’ভাবেই করা সম্ভব l এক্ষেত্রে যিনি শুনবেন তার মানসিক ভালোলাগা মন্দ লাগা কে গুরুত্ব দিতে হবে l যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা তাই ব্যক্তির মন কে বুঝে তার আচার-আচরণ কে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবে সংগীতের প্রয়োগ করতে হবে l উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী স্বস্তিদায়ক রাগরাগিণী বলে যেগুলিকে সাধারণভাবে ভাবা হয় ব্যক্তিবিশেষের তা পরিবর্তিত হতেই পারে l পরিবেশ-পরিস্থিতি , ব্যক্তিত্ব, মনন, চিন্তন সবকিছুর ওপর নির্ভর করে সঙ্গীত প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব l

সংগীতের নমুনা নির্বাচনে শুধু সুর নয় ভাষার প্রতি সমান দৃষ্টি প্রয়োজন l বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের গান যে প্রভাব ফেলবে একজন দক্ষিণ ভারতীয় ব্যক্তির কাছে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না l রোগের প্রতিবন্ধকতাকে সারাতে না পারলেও রোগের সাথে রোগীর মানসিক বোঝাপড়া করতে সংগীত অত্যন্ত কার্যকরী l কারণ সংগীতের মাধ্যমে যেকোনো মানুষের মনে জ্ঞান গ্রহণের ক্ষমতা, আবেগ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় l

এতো গেল কিছু তথ্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা l কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে সঙ্গীত কিভাবে কাজ করে তার দু একটি উদাহরণ l এই ঘটনা গুলি সত্যি এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা l নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে মিউজিক থেরাপি প্রয়োগ হয়নি কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ মনে আশার আলো দেখিয়েছে — সংগীত পারে নিরাময় প্রদান করতে l

ঘটনা 1

 আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এক দিদি l যিনি কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছেন l  প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা হওয়ার পরে ভালো হয়ে উঠেছিলেন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন l কিন্তু এক বছর পরে আবার অসুস্থ হন l এবারে তার কষ্ট অনেক বেড়েছে , মনের জোরে লড়াই করছেন l আমি মাঝে মাঝে যেতাম তার কাছে গান শোনাতে l এমনি একদিন বর্ষাকাল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যের মুখে আকাশ একরাশ কালো মেঘ নিয়ে থমকে আছে l আমি গান ধরলাম “মেঘ ছায়ে সজল বায়ে” গানটি দিদি শুয়ে শুয়ে শুনছিলেন, যখন সঞ্চারী গেয়ে আভোগ ধরেছি আস্তে আস্তে দিদি  উঠে বসলেন, চোখ দিয়ে জল পড়ছে , কিন্তু মুখে হাসি l গান শেষ হতেই বললেন “জানি ফিরবো না কিন্তু জীবন তো চির শূন্য হয়নি রিক্ত হয়নি আমার কাজ আমি করেছি সেখানেই আমি বেঁচে থাকব l রবীন্দ্রনাথ কি মনে ভেবে গান বেঁধেছিলেন জানিনা, যিনি শুনলেন তিনি নিজেকে ওই সুরে ভাষায় বেঁধে ফেললেন নিজের মত করে l

ঘটনা 2

 আমার পরিচিত একজন দিদি l যিনি নিজে গান গাইতেন বলা ভালো গান নিয়ে বাঁচতেন’ l ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ,  কিডনির সমস্যা সবকিছু নিয়েই তিনি বেশ জর্জরিত l করোনাকালীন সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন l  সেরিব্রাল অ্যাটাক হলো হাসপাতালে ভর্তি হলেন, অনেক ডাক্তারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও দিদি সুস্থ হচ্ছিলেন না l সবচেয়ে যেটা সমস্যা হলো দিদি খুব অস্থির হয়ে পড়ছিলেন, কোন ভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না l  একদিন তার ছেলে তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গুনগুন করে গান গাইছিলেন,  অদ্ভুতভাবে দিদির অস্থিরতা অনেক কমলো l ডাক্তারের পরামর্শে ছেলে রোজ তাকে গান শোনাতো।  অনেক শান্ত হলেন দিদি l হয়তো নিজের পরিণতিকে মেনে নিতে পারছিলেন না তাই অস্থির হয়ে পড়তেন l ক্রমশ দিদি নিজের সমস্যার সাথে বোঝাপড়া করতে আরম্ভ করলেন l অনেক ওষুধ অনেক কথা অনেক পরামর্শ যা পারলো না সঙ্গীত তা পারলো l

ঘটনা 3

শরতকালের সুন্দর সকাল l দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে l কিছু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে আমরা আয়োজন করেছি বসে আঁকো l না, প্রতিযোগিতা নয়, রঙের সাথে নিজেদের বন্ধুত্ব করাই প্রধান উদ্দেশ্য l

সবার হাতে রং এর বাক্স আর সাদা কাগজ l মনের ইচ্ছা যা খুশি রাখার আহ্বানl পরিবেশ সুন্দর করার জন্য মাই কে বাচ্ছে রবি শংকরের সেতার l আমরা দেখছি ওদের বোঝার চেষ্টা করছি l অনেকেই আঁকছে আবার আঁকিবুকি কাটছে l  কিন্তু একটি ছেলে খুব অস্থির l সে আঁকছে না  এবং আমাকে খুব বিরক্ত করছে l কাছে গিয়ে জানতে চাইতে ওর মা বলল ও সঙ্গীত পছন্দ করেনা l বাজনার আওয়াজটা নিতে পারছে না l আমরা একটু আওয়াজ টা কমিয়ে দিলাম l যেহেতু আমি সংগীতের ছাত্রী তাই বারবার ওর দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল l “সংগীত পছন্দ করেনা”এই শব্দগুলি ভাবাচ্ছিলো l একটু পরে দেখলাম খুব জোরে জোরে হাত নাড়ছে l আমি খুব কিছু না ভেবেই শ্বেতা টি বন্ধ করে দ্রুতলয়ের একটি তবলার ক্যাসেট চালিয়ে দিলাম l খুব আশ্চর্য রকম ভাবে একটু পরে ধীরে ধীরে সে অনেকটা শান্ত হলো l

ঘটনা 4

আমার পরিচিত এক দাদা l ঘুমের ওষুধ খেতেন l নয়তো তার ঘুম আসত না l তাকে একজন ডাক্তার পরামর্শ দেন ঘুমোতে যাবার আগে তার পছন্দমতো গান শুনতে l তিনি সে কথা শুনে গান শোনেন এবং বর্তমানে তিনি ওষুধ ছাড়াই ঘুমোতে পারেন l

উপরিউক্ত ঘটনাগুলি একেবারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা l কিন্তু সংগীতের সুর- তাল- লয় সহযোগে সৃষ্ট একটি ভাবজাগতিক অবস্থা তৈরি হয় তা আমাদের অনুভূতি লক্ষ্যে একটি বিস্ময়কর আলোড়ন সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে —-একথা অনস্বীকার্য l তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে আবেগের উদ্রেক হয় তা একান্তভাবেই ধারণশক্তির উপর নির্ভর করে l একই সঙ্গীত ব্যক্তিবিশেষে আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলে l

মিউজিক থেরাপি নিয়ে এখনো অনেক গবেষণা করার দরকার আছে কিন্তু যা হয়েছে তা এখনও অনেকেই মানষিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না l তবে শেষ করব আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ Dr. Armond Trusoe একটি উদ্ধৃতি দিয়ে

“সবথেকে মন্দ বিজ্ঞানী তিনি যিনি  শিল্পী নন, সবথেকে মন্দ শিল্পী তিনি যিনি বিজ্ঞানী নন l প্রাচীনকালে, চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল শিল্প; তার স্থান ছিল কবিতা ও চিত্রকলার পাশে l আজ অনেকে অংক শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার পাশে রেখে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন l”[5]

তথ্যসূত্র


[1] dr. Daniel Je Levitin- Levitin, Daniel J. 1957- | Encyclopedia.com  

[2] Juliet Elvin ও Prof. Olav Shirley- https://www.academia.edu/33665612/Music_Therapy

[3] Everest thayar gayston- https://www.jstor.org/stable/3345004

[4] Era M, Alt Shuler এবং Willem Van D Wall- https://www.researchgate.net/publication/341912327_Prescribing_Sound_Willem_Van_de_Wall_and_the_Carceral_Origins_of_American_Music_Therapy

[5] Dr. Armond Trusoe- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3190445/

সহায়ক গ্রন্থ

তাঁত ঘর একুশ শতক – কলকাতা বইমেলা 1-2-2015

বাংলা সঙ্গীত মেলা স্মারকগ্রন্থ 1414

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সঙ্গীত মেলা বিশেষ সংখ্যা – এপ্রিল 2005