September 23, 2019

লোকরামায়ণ : বাল্মিকী ও সাধারণ মানুষ

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture
রামায়ণ গানের দল

দীপঙ্কর হালদার, গবেষক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলার দক্ষিণ বঙ্গের লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে রামায়ণ গানের চর্চা অত্যন্ত সুদীর্ঘকালের। বাল্মীকি মুনি বিভিন্ন লোক কাহিনীকে সুসংহত ভাবে লিপিবদ্ধ করে রামায়ণ রচনা করে থাকতে পারেন। যদিও তার প্রতিটি বিষয় সেই যুগে বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা অনেকেই বিশ্বাস করেন।  লোকসমাজে বাল্মীকি রামায়নের নানান কাহিনী নিয়ে এক এক রকমের রূপ দেওয়া হয়েছে। অথবা বাল্মীকির রামায়ণের আগে থেকেই এই সব লোক কাহিনী প্রচলিত হয়ে আছে। যেখানে লোককাহিনীতেও ঋষি বাল্মীকি মুনির শৈশব জীবনের চরিত্রের বহু গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। এইসব লোককাহিনীতে শৈশবে বাল্মিকীর নাম ছিল রত্নাকর। চুরি, ডাকাতি ছিল তাঁর শৈশবের পেশাগত বৃত্তি। শৈশবে সে এত মস্তবড় দস্যু ছিল যে সাধু,গুরু, মহাত্মাদেরও হত্যা করতে সে দ্বিধা বোধ করত না। চুরি ডাকাতি করে পিতা মাতা ও স্বপরিবারের ভরন পোষন করত। পথেঘাটে যে যা  স্বর্ণ, রৌপ্য, হিরে ও অন্যান্য মুল্যবান রত্ন সম্পদে সুসজ্জিত হয়ে যেত, মেরে ফেলার  ভয় দেখিয়ে সে অনায়াসে তা কেড়ে নিত। চুরি ডাকাতি করার জন্য বহু মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করত। তাঁর নর হত্যার পাপের মাত্রা এতখানি উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আসন পর্যন্ত টলে গিয়েছিল। অবশেষে তাঁকে কৃপা করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা ও নারদ এসে তাঁকে রাম নাম মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড পাপের কারণে রামনাম মন্ত্র উচ্চারণ করার মতো শক্তি বা সাধ্য তার ছিল না। অবশেষে ব্রহ্মা ভেবে নিলেন যে এভাবে তাঁর মুখ থেকে রাম নাম বলানো যাবে না। তিনি চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ করার জন্য একটি মরা বৃক্ষ দেখিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি ?

রামায়ণ পালার আসর

দস্যু রত্নাকর সহজ সরল ভাবে উত্তর দিলেন -ওটা একটা মরা গাছ।

ব্রহ্মা বুঝলেন যে ‘মরা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে তাঁর কোন অসুবিধা হচ্ছে না কারণ এরকম মরা সে প্রতিদিনই দেখে। জীবিতকে মরা বানানোর কায়দায় সে অভ্যস্ত। তাই মরা শব্দটি বার বার উচ্চারণ বা জপ করলে তাঁর মুখে এক সময় রাম নামের প্রতিধ্বনি উচ্চারিত বা ধ্বনিত হবে। আর তারপর নামের অসীম শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাঁর জীবনের স্বভাব চরিত্র সমস্ত কিছু একদিন বদলে যাবে। তখন ব্রহ্মা তাকে বারেবারে মরা কথাটি উচ্চারণ করতে বলল। রত্নাকর তাই করতে থাকল। আর তার ফলেই তার রাম নাম উচ্চারণ করা সহজ হল।

ব্রহ্মার এই গোপন রাম নামের বীজ মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার পর রত্নাকর সর্বত্র ধ্যান মগ্ন হয়ে এই নাম জপ করতে থাকল সরযুর তীরে এক কুঠিরে। দীর্ঘকাল যাবৎ এই যোগসাধনা করতে করতে তাঁর সমগ্র শরীরে বাল্মীক (উইপোকা) বাসা করে। তাঁর যোগসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে রত্নাকর থেকে বাল্মীকি নামে আখ্যায়িত করেন। সমস্ত দেহে বল্মীক বাসা করেছিল বলে, ব্রহ্মা তাঁর নাম বাল্মীকি দিয়েছিল।

যোগ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার পর মুনিবর রামায়ণ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। লোককাহিনী অনুযায়ী রত্নাকরের জন্ম প্রকৃত পক্ষে সত্য যুগে অর্থাৎ ১০০০ থেকে ৫০০০ অব্দে। কিন্তু তিনি যোগ সাধনার বলে বলীয়ান হয়ে পরবর্তীকালে ত্রেতা যুগ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন । কারন শৈশবের চুরি, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি লীলা থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে লব কুশ কে মানুষ করা পর্যন্ত বাল্মীকি চরিত্রের পরিচয় আমরা রামায়নে অতি সহজেই দেখতে পাই। মানুষের বিশ্বাসে বিজ্ঞান মিলিয়ে যায়। সেখানে কী সত্য কী মিথ্যা তা জানার অবকাশ থাকেনা। সাধারণ মানুষ বিশ্বাসেই সেই আনন্দ খুঁজে পায়। তারা সত্যের জন্য মোটেই সচেষ্ট নন। তাই গবেষকের সত্য সবসময় দূরেই থেকে যায়। বিশ্বাসেই রাম দেবতা, বিশ্বাসেই বাল্মিকীর আয়ুস্কাল লক্ষাধিক বছর। আর মানুষ একশ বছরেই শেষ।

বাল্মীকি রামায়ণ ও অদ্ভুত রামায়নে  যুগের পরমায়ু ও যুগের মানবদের পরমায়ু নির্ধারণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। বলা হয়েছে সত্য যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক সতেরো লক্ষ আঠাশ হাজার বছর , সেখানে মানুষের পরমায়ু ছিল এক লক্ষ বছর, ত্রেতা যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বছর, মানুষের পরমায়ু ছিল আনুমানিক দশ হাজার বছর , দ্বাপর যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর , মানুষের পরমায়ু ছিল আনুমানিক এক হাজার বছর, অবশেষে এই কলি যুগের পরমায়ু নির্ধারন হয় চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর ও মানুষের আয়ুস্কাল অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য মাত্র একশো বছর।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিনাঞ্চলে রামায়ণ গানের মূল বিষয়বস্তু

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত। । যে দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ মানুষ সমগ্র বিংশ শতকে ও তৎপূর্ব সময়রেখায় পৌরাণিক কাহিনী বিচিত্র অজস্র সামাজিক পালাগানের প্রতি বিমোহিত হয়েছিল। লোক সমাজের অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ সঙ্গীত চর্চার গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিরক্ষর লৌকিক সমাজের বেশিরভাগ মানুষের হৃদয়ের আঙ্গিকতা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গাম্ভীর্য কালোয়াতি আলাপ, বিস্তার, বন্দিশ ও তানের  বেড়াজালে সীমাবদ্ধতার পরিবর্তে লোক সঙ্গীতের উন্মুক্ত সুরে বিমুগ্ধ হয়েছে। তাই যুগে যুগে তারা লোক সঙ্গীতের নানান সঙ্গীত শৈলীগুলিকে বুকে আঁকড়ে ধরে তার সুমধুর সুরের প্লাবনে সর্বত্র ভেসে আসছে।

তৎকালে  যেসমস্ত পৌরাণিক, সামাজিক ও মাঙ্গলিক পালাগান গুলি বিশেষ জনপ্রিয়তার শিখর প্রান্তে  হাত বাড়িয়েছিল তার মধ‍্যে সহজ সরল বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠিত রামায়ন গান এক সর্বকালজয়ী, শ্রেষ্ঠ লোক পালাগানের দাবি রাখে।  সুদীর্ঘকাল পূর্ব থেকে সমগ্র বিংশ শতাব্দী ধরে দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার ক‍্যানিং, বারুইপুর, সোনারপুর, কাকদ্বীপ, নামখানা, সাগরদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, মগরাহাট, উস্থি, গোসাবা, জয়নগর, কুলতলি, বাসন্তী, মন্দিরবাজার, কুলপি থানার অঞ্চলভুক্ত গ্রামগুলির বেশিরভাগ মানুষ রামায়ন পালাগানের প্রতি সবচেয়ে বেশী খুবই বিমুগ্ধ ও বিমর্ষতা লাভ করেছিল। সমগ্র বিংশ শতাব্দী ধরে রামায়ন গানের পালাগান গুলি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিল। যদিও বর্তমানে সেই ধারাপাতে আজ সম্পূর্ন ভাটা পড়ে গিয়েছে। পণ্ডিত অনাথবন্ধু অধিকারী মহাশয়ের সুচতুর গায়নে ও তার কলমের লিখনে পৌরাণিক পালাগানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রামায়ন গান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তার লেখনীর কাব‍্যছন্দে রামায়ন গানের মূল বিষয়বস্তুর স্পষ্টতই এক সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়।

তিনি এ প্রসঙ্গে কাব‍্য ছন্দে সুন্দর ভাবে একটি কলম দিলেন ;

“আদি কান্ডে রামের জন্ম, বিবাহ সীতার।

অযোধ্যাতে বনবাস ত্যাজি রাজ্যভার।।

অরন্য কান্ডেতে গেল পঞ্চবটি বন।

সুযোগ পেয়ে সীতা মায়ের হরিল রাবন।।

কিস্কিন্ধা কান্ডেতে হইল সুগ্রীব মিলন।

বহু ভক্ত উদ্ধারিল রাম প্রান ধন।।

সুন্দরা কান্ডেতে হইল সাগর বন্ধন।

লঙ্কাকান্ডে রাখিল রাম রাবনেরি রণ।।

উত্তরা কান্ডেতে হল সপ্ত কান্ড হল শেষ।

জনম দুঃখীনি সীতার পাতালে প্রবেশ।।

এই সুধামাখা সপ্ত কান্ড রামায়ণ।

মহামুনি বাল্মীকি তা করেন রচন।।“

রামায়ণ গান পরিবেশনের সময়, আসর, সাজসরঞ্জাম

সমগ্র বিংশ শতক ধরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে অন‍্যান‍্য  সামাজিক, পৌরাণিক পালাগানের ন‍্যায় রামায়ন গান অত‍্যন্ত ব‍্যাপক ভাবে যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সেকথা দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজের ইতিহাস অধ‍্যায়ন করলে স্পষ্ট জানা যায়। ভক্তি ও রসামৃতে সমৃদ্ধ এই রামায়ণ পালাগানের প্রতিটি পৌরানিক বিষয়বস্তু একথা কারো অজানা নয় । মনোমুগ্ধকর তার সুর ও বিভিন্ন চরিত্রে যাদুকরী অভিনয়ের গভীর যুগলবন্দীতে ভরপুর রামায়ন পালার সপ্তকাণ্ডের প্রতিটি কান্ড। তাই শুরু থেকে বোধহয় রামায়ন গানের সুমধুর সুর ও তালের প্রতি নিরক্ষর লৌকিক সমাজের হৃদয়ের অভ‍্যন্তরে এক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল। শুধু তাই নয় আঞ্চলিক শিল্পীদের দ্বারা তার পরিবেশন কৌশল ও এক অদ্ভুদপূর্ব সুন্দর মানসিকতার পুনঃজন্ম দিতে পেরেছিল।  নিকটবর্তী জেলে, মৌলে, বাউলে থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, ব‍্যবসায়ী ও দিনমজুরদের নিত‍্যুই হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রমের মধ‍্যে দিয়েও তারা দিনের অন্তরালে শুধুমাত্র একটু সমাজিক, পৌরাণিক পালাগানের মধ‍্যে তারা মানসিক শান্তি লাভ করে আসে। জীবনে সুখ সমৃদ্ধির সম্পূর্ণ ভার ঈশ্বরে তথা দৈব শক্তির পায়ে উৎসর্গ করে নিজদের মনপ্রাণ কে সমর্পণ করে এসেছে নানান লোক দেবতার শ্রীচরণ পাদপদ্মে। সেই দৈব শক্তির আশীষ কে মাথায় নিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের পথ চলা শুরু হয়। তখন অনুষ্ঠিত হয় নানান শৈলীর পালাগান। শুধুমাত্র রামায়ন গান নয় তৎকালে ডাকনাম, কবিগান, তরজা, বাউল, যাত্রাপালা থেকে শুরু করে মনসা শীতলা ও বনবিবির পাঁচালী ,ভক্তিগীতি, হরিনাম সংকীর্তন অত‍্যন্ত জনপ্রিয় সঙ্গীতশৈলী রূপে লোক সামাজে অধিষ্ঠিত হয়।

অধিকাংশ পৌরাণিক, মাঙ্গলিক পালাগানগুলি রাত্রি প্রথম প্রহর থেকে অনুষ্ঠিত হওয়ার রীতি রিয়াজের প্রচলন ছিল। রামায়ন পালাগানও এই সুনির্দিষ্ট সময়কালেই পরিবেশিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘ কাল যাবৎ ধরে। জীবিকার তাগিদে প্রতিটি মানুষের দিনের অধিকাংশ সময় নানান কর্মসূত্রে ব‍্যাস্ততার মধ্যে কাটে বলে তাই সন্ধ‍্যার পর থেকে রামায়ন গানের আসর গুলি বসার রীতি রিয়াজ ছিল। প্রতিটি পালাগান রাত্রি দ্বিতীয় ও সর্বোচ্চ তৃতীয় প্রহরে পরিসমাপ্তি করা হতো।

ক্ষেত্র সমীক্ষার নানান গবেষণার নীরিখে দেখা গেছে যে বিংশ শতাব্দীতে রামায়ন হিন্দু ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয়ে গভীর ভাবে সাড়া জাগালেও মূলত রাজবংশী, কৃষক, তিওর, ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে রামের স্থান সবচেয়ে বেশী। তাদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভক্তির ধরাপাত এওকটু বেশি গভীর। তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান অপেক্ষা বিশ্বাসেই তাদের জীবন বেশি তরঙ্গায়িত। শুধু ঈশ্বরের প্রতি যে বিনম্র শ্রদ্ধা ভক্তি তা নয় তাদের আচার আচরণ থেকে শুরু করে শিল্পীর প্রতি সামাজিক দায় দায়িত্ব কর্তব‍্য অত্যন্ত নিষ্ঠা পরায়নতার দাবি রাখে।  দেখা গেছে, হিন্দু সমাজের অন‍্যান‍্য  সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্মিত আসরের সঙ্গে এদের নির্মিত রামায়ন গানের আসরের গঠনভঙ্গি, সাজসজ্জা, আয়তন ও অন‍্যান‍্য  পরিকাঠামো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়। আসরের নির্মাণের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা ধর্মীয় শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী নির্মাণকরা হয়ে থাকে।  প্রথাগত বংশের নিয়ামানুযায়ী আসরের অস্তিত্ব রক্ষা করে রামায়ন শিল্পীদের সঙ্গীত চর্চার মানকে চূড়ান্ত পর্যায়ে মর্যাদা দিয়ে আসছে।

দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র রামায়ন শিল্পীদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, গ্রাম থেকে সুদূর গ্রামে তৎকালে রামায়ণের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। তৎকালীন সমাজের অন‍্যতম এক প্রতিষ্ঠাবান সামাজিক খ‍্যাতি সম্পন্ন  রামায়ন শিল্পী অনাথবন্ধু অধিকারীর শিষ‍্যদের থেকে জানা যায় যে ১৯৮০- ৮২ সালে পণ্ডিত অনাথবন্ধু অধিকারী মাহাশয়ের আর্থিক দক্ষিনার মানদন্ড সাতশো টাকার মতো ছিল। সেই সময় তার প্রতিষ্ঠিত শিষ‍্যদের দক্ষিনার অঙ্ক সত্তর আশি টাকার মতোই ছিল। তার উর্ধে ছিল না। তবে গানের জনপ্রিয়তা এতো বেশি প্রধান‍্য অর্জন করেছিল যে, সূদুর গ্রাম থেকে পল্লী গ্রামে গান গাইতে গাইতে শিল্পী কখন যে বৎসরান্তে এক দেড়শ পালা গান ছাড়িয়ে যেত তার হিসাব নিকাশ থাকত না। এক দেড়শ পালা গান খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ভালো খারাপ বিমিস্র এতো প্রচারের মধ‍্যে দিয়েও তবুও শিল্পীর মর্যাদা সামান্য ক্ষুন্ন হয়নি। আজকের সমাজের মতো আশঙ্কাজনক অবস্থা সেযুগে মোটেও ছিল না। আজকের সমাজের পটচিত্র কতখানি বদলে গেছে। শিল্পী ও তার সম্প্রদায়ের প্রতিটি গুণবান ব‍্যাক্তিকে সেদিন গৃহের মঙ্গলার্থে বাড়ির পুত্র বধূদের দ্বারা চরণ বিধৌত করে আঁচল দিয়ে পা দুখানি মুছিয়ে দেওয়ার রীতি রিয়াজ পর্যন্ত ছিল। আজ সেই সভ‍্যতা সম্পূর্ণ ধারিয়ে গেছে। সেই সামাজিক রীতি এখনো কমবেশী চোখে পড়ে তবে একেবারে অজ গ্রাম বাংলার দিকে। যেখানে শিক্ষা ও সভ্যতার আলো যত কম, সেখানেই বিশ্বাস আর দেবতার প্রতি শ্রদ্ধার গভীরতা তত বেশি ও অকৃত্রিম। শহরাঞ্চলে ও শহর ঘেঁষা জনপদে এই সব রীতি নীতি হারিয়ে গেছে। তবে আচরণের মধ্যে শহুরে রীতি থাকলেও ধর্মের বাঁধন এখোনো রয়েছেই।

আমি দক্ষিন চব্বিশপরগনা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে কিছু রামায়ন গান সংগ্রহ করে সেগুলির তাৎপর্য ব্যখ্যা করেছি। এখানে লক্ষনের শক্তিশেল নিয়ে একটি পালার কয়েকটি গানের উল্লেখ করেছি।

দশ মাথায় দশ মনি , জ্বলছে যেন দিন মনি , রণ সাজে সাজিলো রাবন।

জয় শিব শম্ভু বলে , ধনু্র্বান হাতে তোলে , কুড়ি হাতে বলয় কঙ্কন।।

পুত্র শোকে পাগল হল ,  ধনুর্বান হাতে নিল , রথের উপর উঠিল রাবন।

রামায়ণে যেভাবে রাম, সীতা ও রাবনের বিষয়বস্তু বর্ণিত রয়েছে এখানে বর্ননার সঙ্গে তার পরিচয় একটু ভিন্ন স্বাদের কথা অনুভব করায়। সাধারনের দৃষ্টির আড়াল থেকে রাবনের এক অসাধারন রূপ মাধুর্যের বর্ননা করা হয়েছে এই গানে। রামানুজ লক্ষনের বানে প্রিয় বীর পুত্র ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর ঘটনায় রাবন শোকে দুঃখে পাগল হয়েছে ঠিকই কিন্তু রণ সাজে সুসজ্জিত হয়ে প্রতিশোধের জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছে তার ব‍্যাথিত মনপ্রাণ। আর সেই রণের সুসজ্জিত বেশভূষা গানের কাব‍্যিক ছন্দে সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার দশ মাথায় একটা দুটো নয় দশ মনির মুকুট দিয়ে সুসজ্জিত। আর প্রতিটি মনির উজ্জ্বলতা দিনের আলোর মতো যেন ঝলমল করছে।

রাক্ষস কূলাধিপতি রাবন যে শুধুমাত্র লঙ্কা রাজ‍্যের কূলাধিপতি ছিলেন ঠিক তেমনটা নয়। একাধারে তিনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিলেন। তাই তাকে সেযুগে ত্রিকালদর্শী পণ্ডিত বলা হত। তিনি আপনার দিব‍্যদৃষ্টিতে সুস্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে দৈব শক্তির কাছে তার পরাজয় সুনিশ্চিত। তা সত্বেও সে যুগাবতার রাম লক্ষনের সঙ্গে ধনুর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য অনড়। গানের পটচিত্রে শ্রেষ্ঠ বীর, পরাক্রমীদের ন‍্যায় সে মহাযোদ্ধার সাজে সুসজ্জিত হয়েছে মৃত পুত্রের নামে শপথ করে। রামানুজ লক্ষণকে সে আজ শক্তিশেল বানে নিধন করার জন্য।

বাজে রণ দামামা রণ দামামা। রাবনের রণে বাজে রণ দামামা।।

বাজে রণ দামামা রণ দামামা। লক্ষ লক্ষ শঙ্খ বাজে রণ দামামা।।

ঝাঁঝরি কাঁকরি বাজে বাজে দামামা।।গানের এই পটচিত্রে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে রাম রাবনের যুদ্ধ শীঘ্রই আসন্ন। তাই রণের সুমঙ্গল ধ্বনিতে মুখরিত সমগ্র স্বর্ন লঙ্কার আকাশ বাতাস। যুদ্ধের পুণ্য লগ্নে কখনো শৃঙ্গা বাজছে, দামামা বাজছে, ঝাঁই-ঝাঁঝরি বাজছে, আবার কখনো বা মঙ্গল শঙ্খের পবিত্র ধ্বনিতে শিহরিত হচ্ছে উভয় পক্ষের বীর সৈনিকদের শিরা উপশিরা। এই গানের মধ্যে দিয়ে আমরা বাহ‍্যিক জগতে সুর ও অসুরদের মধ‍্যে এক মহাযুদ্ধের প্রলয়ঙ্করী ভয়াবহ পরিণতির এক রূপমাধূর্য অনুভব করি। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ  রামায়ণ শিল্পীরা বাস্তব সমাজের ভিত্তিকে শক্তিশালী দৃঢ়, সুন্দর ও সুপ্রতীভ করার জন্য একটু ভিন্ন স্বাদের মধ‍্যে দিয়ে এই গানের ব‍্যাখ‍্যা করে শ্রোতাদের অনুভব করতেন। শিল্পীরা বলেন রাম রাবনের যুদ্ধের এই পটচিত্র থেকে আমদের প্রতি প্রত‍্যেকের বাস্তবিক জীবনের কিছু শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা, দান, ক্ষমা, ধৈর্য, সংযমশীলতা, আধ‍্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ বিকাশাদি প্রতিটি বিষয় শুভ শক্তির প্রতীক স্বরূপ। এগুলি ভগবান শ্রীরামের সৈন্য স্বরূপ। অন‍্যদিকে কাম, ক্রোধ, স্ত্রীআসক্তি, পরস্ত্রীকাতরতা, লোভ, মায়া, মোহ, সঞ্চয়প্রবৃত্তি, স্বার্থ, কুপ্রবৃত্তি, কু মনো-বাসনা, মদ, মাৎসর্য‍্য ও উগ্রতা ইত‍্যাদি অশুভ শক্তির প্রতীক। বাস্তবে এরাই রাবনের অনুচর স্বরূপ। তাই রামায়ণে রাম রাবনের যুদ্ধের পুণ্য ক্ষনে শিল্পী আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শুভ শক্তির সঙ্গে অশুভ শক্তির লড়াইয়ের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন।

শোনরে পবন নন্দন আমার দাদারে বোলো। রণ স্থলের মাঝে লক্ষন জীবন হারাইল।।

আমি মরলাম রণস্থলে , দাদা মরিবে শোকানলে। মরন কালে দাদার সঙ্গে দেখা নাহি হল।।

বলো পবন নন্দন দাদারে বোলো। রণ স্থলের মাঝে লক্ষন জীবন হারাইলাম।।

রামায়ন পালার এই দৃশ্যে রাবনের শক্তিশেল বানের শিকার রামানুজ লক্ষন। লক্ষন কর্তৃক মেঘনাদের অহেতুক হত‍্যায় রাবন আপন পুত্র শোকে পাগল হয়ে শত্রুপক্ষের নায়ক রামের হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য একদিকে যেমন সীতা হরন করেছে অন‍্যদিকে রামের সহোদর ভাই লক্ষনকেও বানে নিধন করেছে।  রামায়নের অন‍্যতম এক প্রিয় চরিত্র লক্ষনের মৃত‍্যুর পুণ্য লগ্নকে শিল্পী গানের মধ‍্যে দিয়ে এইভাগে রঘুবংশের এক বেদনাদায়ক করুন ভাবকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রয়াস হয়ে এসেছেন। এই গানের পটচিত্রে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, রণস্থলে রাবনের শক্তিশেল বানের আঘাতে লক্ষন ধরাশয়ী হয়ে মৃত্যুর কাতর শয‍্যায় শায়িত হয়। এমতাবস্থায় লক্ষন অনুনয় বিনয় করে পবন নন্দন হনুমানের সন্নিকটে যুদ্ধের সমস্ত ঘটনাবলী তার দাদা রামকে বলার জন্য অনুরোধ করছে। তার মৃত্যুর পুণ‍্যক্ষনে সে এও বুঝে ফেলেছে যে তার এই মৃত্যুর শোকে, দুঃখে মূহ‍্যমান হয়ে বোধ হয় তার তার দাদা শ্রী রাম চন্দ্রেরও মৃত্যু হতে পারে।   

ওঠরে লক্ষন, সুমিত্রা নন্দন। ডাকরে দাদা বলে,জুড়াবে জীবন।।

অযোধ্যাতে গেলে জিজ্ঞাসিবেন মাতা।একা এলে রাম লক্ষন আমার কোথা।।

কি বলে বুঝাব ,মায়ে প্রবোধ দিব।কি বলে সন্তোষিব দুঃখিটারে জীবন।।

দেশে হারাই পিতা ,বনে হারাই সীতা।রণে হারাই আমি প্রাণের ভাই লক্ষন ।।

গানের এই ভাগের বর্ণনায় সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে ভাই লক্ষনের প্রতি রামের অকৃত্রিম, গভীর ও নিগূঢ় ভাতৃত্ব প্রেম। দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণায় মেজ রানী কৈকেয়ী নিজের গর্ভজাত সন্তান ভরতকে সূর্য বংশের রাজা করার উদগ্র নেশায় রঘুবংশের বড়ছেলে রামকে দিয়ে ছিল চৌদ্দ বছরের বনবাস। মেজ রানীর এই সিদ্ধান্তে রাজা দশরথ পাগলের ন‍্যায় হয়ে গেলেও বীর পুত্র রামচন্দ্র সৎ মায়ের দেওয়া এই সিদ্ধান্তকে মাথায় করে বরন করে নেন। সহজ সরল রাম স্বেচ্ছায় রাজত্ব ছেড়ে বনবাসে যাওয়ার ক্ষনে সুমিত্রা নন্দন লক্ষনও দাদার সঙ্গে বনে যাওয়ার জন‍্য অটল অনড় ভাবে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে। রামের শত নিষেধাজ্ঞা সেদিন লক্ষনকে আটকাতে পারেনি। রাম এমতাবস্থায় নিরূপায় হয়ে সুমিত্রা জননীকে কথা দিয়েছিল যে শত বিপদ আপদ ও  দুঃখ কষ্টে লক্ষনের পাশে  থাকবে এবং তাকে রক্ষা করবে। বনের সামান্য তরুলতার কাঁটার আঁচড় পর্যন্ত তার গায়ে লাগতে দেবেনা।  রামানুজ লক্ষন যখন দুষ্টু রাবনের শক্তিশেল বানের দ্বারা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীরে অজ্ঞান অবস্থায় ধূলায় লুটিয়ে পড়েছিল তখন সেই অবস্থা দেখা মাত্র রামের হৃদয়খানি সকরুণ ব‍্যাথায় ও বেদনায় ভরে উঠেছিল। আজ এই মহা বিপদের দিনে সুমিত্রা মাতাকে দেওয়া কথা তার বারবার মনে পড়ছে। স্নেহের প্রিয় ভাই লক্ষন আর ইহলোকে নেই এই কথা মনে পরতেই তার বাহ্যিক বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। কৈকেয়ী কর্তৃক রামের বনবাসের খবরে মর্মাহত হয়ে তার কিছুদিনের মধ‍্যে রাজা দশরথ মারা গেলে অন্তর্যামী রাম একথা হৃদয়ান্তরে জেনে ফেলেন। আবার বনবাসে রাবনের ও তার নিশাচর দের ছলনায় তার প্রিয় পত্নী সীতাকেও সে বনমধ‍্যে হারায়। আবার এই গভীর শোকের মধ‍্যেও সে লক্ষনকেও হারিয়েছে। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ গুলো একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষ হলে সে যখন অযোধ‍্যায় ফিরবে তখন কনিষ্ঠ মাতা সুমিত্রা কে সে কি জবাব দেবে। তাই করুন কণ্ঠে ভাই লক্ষনকে পুনঃজীবিত হওয়ার জন‍্য অনুরোধ করছে গানের মধ‍্যে দিয়ে।

আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, কাঁদে বনলতা। নিস্ঠুর রাবন বুঝল না হায় রামের মনের ব্যাথা।।

নল কাঁদে, নীল কাঁদে, কাঁদে হনুমান।মস্তকে হাত দিয়ে কাঁদে মন্ত্রী জাম্বুবান।।

নদ কাঁদে, নদী কাঁদে, কাঁদে সর্বজন।রামচন্দ্র বসে কাঁদে কোলেতে লক্ষন।।

গানের এই পটচিত্রে আমরা দেখতে পাই রামের ভাই লক্ষনের অকাল মৃত্যুতে শোকাকুল আকাশ, বাতাস, বনের লতাপাতা, নদ, নদী, পাহাড়, পর্বত ও রামভক্ত হনুমান বানরদের হৃদয়খানি। অর্ধাঙ্গিনী সীতার অকাল বিয়োগে রাম যতখানি না ব‍্যাথা পেয়েছে তার চেয়ে শতাধিক বেশী ব‍্যাথায় ব‍্যাথিত হয়েছে রাবনের শক্তিশেল বানে ক্ষতবিক্ষত লক্ষনের অকাল মৃত্যুতে। যে লক্ষন তাদের যুগল মূর্তি কে আজীবন পিতামাতার মতো ভালোবেসে পূজা করে এসেছে।

নীল বর্ণ ফল ফুল, পিঙ্গল বর্ন পাতা।রক্ত বর্ণ ডাঁটা তার স্বর্ণ বর্ণ লতা।।২

গন্ধ মাদন পর্বতে আছে মহানদী।তার কূলে আছে সে মহা ঔষধী।।

রামের ভাতৃত্ববোধের প্রেমের বন্ধন বোধহয় স্বয়ং স্রষ্টার হৃদয়ে করুণা ও দয়ামায়ার সৃষ্টি করেছিল। গানের এই পটচিত্রে আমরা কিস্কিন্দার বানরদের নিঃস্বার্থ সাহায্যের এক সুন্দর মূহুর্ত কে অনুভব করতে পারি। সীতা উদ্ধারের পথ সুগম করার জন্য রাম বানর দলের দুই অধিপতি বলিরাজ ও সুগ্রীপের মধ্যে রামচন্দ্র সুগ্রিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে গোপন ভাবে বান নিক্ষেপ করে বলিরাজকে হত‍্যা করেন। সুগ্রীপ বানরদের রাজা স্বরূপ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সেই বানর দলের একজন বয়োঃবৃদ্ধ বানর ছিলেন যিনি সারাটি জীবন কবিরাজি ঔষধের চর্চায় নিজেকে সর্বত্র ধ‍্যানমগ্ন রাখতেন। নাম তার সুষেন বদ‍্যি।  

নিম্নে অভিনয়ের মূল পটদৃশ্যের সামান্য অংশ বর্ননা করা হল ; লক্ষনের ধরাশায়ী দেহখানি যখন স্থির, নিশ্চল, মৃতপ্রায়। তার ওই চাঁদ বদন ও দেহটাকে দেখে শ্রী রামচন্দ্র যখন নীরবে রোদন করে চলছেন তখন রামের এহেন করুণ অবস্থায় সুষেন বদ‍্যি নিজেকে আর স্থির না রাখতে পেরে প্রভু শ্রী রামের সন্নিকটে এসে প্রণাম করে বললেন –সুষেন :- প্রভু ঠাকুর লক্ষনের জীবন পুনঃজীবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি কাল প্রাতের পূর্বে ওর ওষ্ঠ বদনে মৃত সঞ্জিবনী (বিশল‍্যকরুনী) তরুলতার রসামৃত তথা মহামৃত দেওয়া যায়। তবে ঠাকুর লক্ষন আবার পুনঃজীবন লাভ করতে পারে।

রামচন্দ্র – তবে কোথায় আছে সেই বিশল‍্যকরুনী তরুলতা। যে তরুলতার রসামৃতে আমার ভাইয়ের প্রান বাঁচে। (ব‍্যাকুল ভাবে) বলো বলো সুষেন আর চুপ থেকো না।

সুষেন – কিন্তু, কিন্তু সে মহৌষধ তো যত্রতত্র পাওয়া যায় না প্রভু। গন্ধমাদন পর্বতে সেই মহৌষধীর সম্ভার রয়েছে। যে ঔষধিতে লক্ষন ঠাকুরের প্রাণ বাঁচতে পারে। যেখানে যেতে  একযুগ সময় লাগে। একদিনের মধ‍্যে কে পারবে সেই অসাধ‍্য সাধন করতে। কাল প্রাতের পূর্বে ওই মহৌষধ না আনতে পারলে লক্ষন ঠাকুরের আর প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

প্রভু শ্রীরামচন্দ্র আবার পুনরায় নীরবে রোদন করতে শুরু করলে হনুমান তা সহ‍্য করতে না পেরে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে এসে বলল – আমি যাব সেই গন্ধমাদন পর্বতে। যেখানে আছে সেই ঠাকুর লক্ষনের প্রানে বাঁচার অমূল্য মহৌষধ। যাত্রা কালে পবন নন্দন হনুমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েও রওনা হন, যে যদি আমি এই কাজে সফল হয়ে ফিরতে পারি তবে শ্রীরামচন্দ্র ও আমার এইসব আত্মীয় স্বজনদের সন্নিকটে এই মুখ আমি আবার দেখাবো। আর যদি ব‍্যর্থ হই তবে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে প্রাণ বিসর্জন করব। হনুমানের যাত্রার প্রাগ মূহুর্তে কবিরাজ সুষেন বদ‍্যি এই গানের মধ‍্যে দিয়ে মৃত সঞ্জিবনী তরুলতার রূপ মাধূর্যের গঠন বর্ননা হনুমানকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝাচ্ছেন। এভাবে সধারণ লোকসমাজের মর্ম বেদনা, ভাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় বহন করছে এইসব লোক রামায়নে। সাধারণ মানুষ বাল্মিকী শ্লোক বা তার আভিজাত্যের পরোয়া করেনা। নিজের কল্পনায় সত্যকে নিজের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে নেয়। সেখানে তার হৃদয়বোধ ও বিবেকের তাড়না অনেক গভীর। সহজ সরল গ্রাম্য জীবন তাই এখনো এই ভাতৃত্বকে সন্মান দেয়। এখনো পরষ্পরের দুঃখে বেদনায় পরষ্পরের পাশে থাকে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র

১। সাক্ষাৎকার – রেখারানী হালদার, পূর্ব কড়ামনুরাজ, মগরাহাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

২। সাক্ষাৎকার – গৌরী হালদার-পূর্ব কামারপুকুরিয়া, মগরাহাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।