September 1, 2020

মণিপুরী নৃত্যশৈলীতে একক নৃত্যের পুনর্নবীকরণ

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Rinki Mahato, Ph.D. Scholar, Sangeet Bhawan, Bisva-Bharati University

রাজা পামহৈবার রাজত্বকাল থেকেই মনিপুরের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা বলা যেতে পারে। রাজা পামহৈবা শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমভাবশ্রিত বৈষ্ণবধর্মের দ্বারা বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে মনিপুরের পুরানো সকল ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মগ্রন্থ নিশ্চিহ্ন করবার প্রবাসে লিপ্ত হন। পুরানো সকল ধর্মীয় পুঁথি ও প্রামণ্য নথিপত্র অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা হয়, এবং সকল জনসাধারণকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হবার নির্দেশ জারি করা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার শরণে সকল মণিপুরীবাসীকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হতে একপ্রকার বাধ্য করা হয় এবং ইতিপূর্বে মনিপুরের সাধারণ মানুষ যে শৈব ধর্মের উপাসনায় রত ছিলেন সেই শৈব ধর্মকে কোণঠাসা তথা নিষিদ্ধ করে তোলে হয়। ধীরে ধীরে শিব-পার্বতীর পরিবর্তে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ প্রধান আরাধ্য দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। এইভাবেই ধর্মীয় পালা বদলের পটভূমিকায় ক্রমে রাজা পামহৈবার পৌত্র মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ মনিপুরের রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ ছিলেন বৈষ্ণবধর্মের প্রচারক। তাঁর সময়ে বৈষ্ণবধর্ম মনিপুরের জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়। শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর আত্মমগ্ন প্রেমরসাশ্রিত বৈষ্ণবধর্মের সূচনা হয় মনিপুরের জনজীবনে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ ছিলেন মনিপুরের সে ধর্ম প্লাবনের মহান পুরুষ। বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মীয় টানা-পোড়েনের পটভূমিকায় প্রেমরসাশ্রিত বৈষ্ণবধর্মে আত্মমগ্ন শ্রীকৃষ্ণ-সাধক মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বিভিন্ন প্রকার প্রচার ঘটনাবহুল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ১৭৭৯ সালে ১১ই কার্ত্তিক পূর্ণিমা তিথিতে মনিপুরে মহারাস উৎসবের সূচনা করেন। মনিপুরের সংস্কৃতি বিপ্লবে যা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র পাঁচদিন ব্যাপী উৎসবের মধ্য দিয়ে মনিপুরে মহারাসের সূচনা হয়। তাঁর রাজত্বকালে এবং তাঁর পরবর্তীতে অন্যান্য রাজাদের রাজত্বকালে বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য রাসলীলা গুলির এবং বিভিন্ন প্রকারের মণিপুরী নৃত্যধারার প্রবর্তন ঘটে। মণিপুরী নৃত্যধারার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস। প্রথম অধ্যায়ে বিষাদ রূপে আলোচিত হবার কারণে আলোচ্য অধ্যায়ে সে বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত প্রয়োজন হীন।

ঐতিহ্য ও ধর্মীয় পালা পরিবর্তনের পটভূমিকার মধ্যেও মনিপুরবাসীর আপন ও ধর্মের প্রতি অটল আস্থার প্রতিফলন স্বরূপ রাসলীলার পাশাপাশি পুরানো ধর্ম সংস্কৃতির নিদর্শন লাইহারাওবা উৎসব এবং নৃত্য আজও মনিপুরে সমান ভাবে সংঘটিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বা সংঘাত সংস্কৃতির সে ধর্মময় ধারাকে পরিবর্তন বা হ্রাস করে তোলে নি।

মণিপুরী সংস্কৃতি তথা রাসলীলা বা অন্যান্য মণিপুরী নৃত্যধারার উপাদান সংগ্রহের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় মণিপুরের সংস্কৃতির উপাদান গুলি মূলত সংগৃহীত হয়েছে মণিপুরবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বিশিষ্ট ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহ থেকে। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল–প্রাচীন মৈথিলী ভাষায় রচিত গ্রন্থ “লাইথেক লাইকা জগোই”, সংস্কৃতে রচিত “সংগীত দামোদর” এবং “সংগীত সংগ্রহ”। এছাড়াও আছে “শ্রীকৃষ্ণরস সংগীত সংগ্রহ”, এবং মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রচিত “গোবিন্দ সংগীত লীলা বিলাস”, প্রভৃতি গ্রন্থ। তবে উল্লিখিত গ্রন্থ গুলি থেকে সংগৃহীত উপাদান ভরতমুনি রচিত নাট্যশাস্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং নাট্যশাস্ত্রে বিধান অনুসারেই গৃহীত। এই গ্রন্থগুলি ব্যতীত  অন্যান্য যে সকল উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি থেকে মণিপুরী সঙ্গীত ও নৃত্যের উপাদান গৃহীত হয়েছে সে গুলি-“নারদ প্রণীত পঞ্চমসার সংহিত, রায়শেখর ও শশীশেখর প্রণীত নায়িকারত্নমালা, পীতাম্বর দাস প্রণীত রাসমঞ্জরী, রূপ গোস্বামী প্রনীত ঊজ্জ্বলীলমণি, কবি কর্নপুরের আনন্দ-বৃন্দাবন চম্পূ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রণীত কৃষ্ণভাবনামৃতম কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখিত গোবিন্দলীলামৃতম, শাঈদেব প্রণীত সংগীত-রত্নাকর এবং জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দ”[১] ।এছাড়া আছে ভাগবত।

এই সকল প্রাচীন ও মহামূল্যবান গ্রন্থাদি থেকে সংগৃহীত উপাদান এবং তারসাথে মনিপুরের জনজীবনের বিশ্বাস ও লোকগাথা আশ্রয়ে উদ্ভূত নৃত্যধারায় মূলত দলগত নৃত্যেরই রূপ পরিলক্ষিত হয়। মনিপুরের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ধারা অনুসারে অথবা মণিপুরের রাজাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় যে মণিপুরী নৃত্যধারা মূলত দলগত উপস্থাপনার প্রয়াস পেয়ে এসেছে।

বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক জীবনযাত্রায় বিভিন্ন প্রতিকূলতার প্রেক্ষিতে প্রয়োজন হয়েছে সেই দলগত নৃত্যধারায় পর্যালোচনার এবং পুনর্নবিকরন পর্বের। বর্তমান সময়ে দলগত নৃত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম বাঁধার কারণ হয়ে দাড়ায় বহু সংখ্যক শিল্পী সমন্বয়ে একটি সাংস্কৃতিক দলকে বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। জনসাধারণের মনে মণিপুরী নৃত্যকলার গ্রহণীয়তা বা জনপ্রিয়তা সর্বজন জ্ঞাত কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এহেন জনপ্রিয় শিল্পকলা উপস্থাপনার প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বহুসংখ্যক শিল্পী সমন্বয়ের একটি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করবার মত পৃষ্ঠপোষক বা তহবিলের সঙ্কুলান, কারণ যে কোনও ধারার সংস্কৃতিকে বিস্তৃত পরিসরে উন্মুক্ত করতে গেলে প্রয়োজন তাঁর নিরন্তর বিকাশের তথা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা। আর সেই বিকাশের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার অর্থ হল তার মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা। বলা-বাহুল্য দলগত শিল্পকলা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সেই মঞ্চায়নের সম্ভাবনাটি ব্যাহত হয়। বহুসংখ্যক শিল্পীর একটি দলের সাজ-সজ্জা, পোশাক-আশাক, তাদের  এক স্থান হতে আরেক স্থানে যাওয়া বা থাকার ব্যবস্থা সকল বিষয়েই অত্যন্ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এই ধরনের শিল্পকলা উপস্থাপনের কারণে প্রয়োজনীয় অর্থবল ও লোকবলের অভাব বহু ক্ষেত্রেই তার উপস্থাপনের প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এরসঙ্গে জড়িয়ে থাকে শিল্পীগনকে দেওয়া সাম্মানিকের বিষয়টিও। কারণ শিল্পীদের উপার্জনের দিকটিও কোনও ভাবেই অবহেলিত হতে পারে না। জীবন ও জীবিকার দিকটি শিল্পীদের শিল্পকলা উপস্থাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। মণিপুরী নৃত্যধারায় যেহেতু দলগত শিল্প উপস্থাপনার দিকটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সে কারণে মণিপুরী নৃত্যধারা বা মণিপুরী নৃত্যশিল্পীদের এই সকল বাধা গুলির সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। এই কারণেই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারত সংস্কৃতির অন্যতম গৌরবময় উপাদান মণিপুরী নৃত্যকলার দেশে ও বিদেশে প্রচার-প্রসার এবং ভবিষ্যতের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা একান্ত আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে মণিপুরী নৃত্যকলার একক উপস্থাপন দলগত মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনার সেই সকল বাঁধা গুলি কাটিয়ে ওঠার অন্যতম উপায় হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যধারায় ন্যায় মণিপুরী নৃত্যধারারও একক উপস্থাপনার উপযোগিতা, সম্ভাবনা এবং পন্থা নির্ধারণের দিকটি খতিয়ে দেখবার আন্তরিক চাহিদায়  এই গবেষণার অবতারণা। সেই সঙ্গে এই নৃত্যধারার বিশুদ্ধ রূপটি তার সঙ্গে ভারত সংস্কৃতির গভীরতর সাত্ত্বিক ও নান্দনিক ঐতিহ্যময়তা বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের নতুনত্বর দিক উন্মোচনের প্রচেষ্টায় এই অন্বেষণ।

আমাদের দেশের প্রাচীন ধ্রুপদী নৃত্যধারা গুলির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখাযায় বর্তমানে এই নৃত্যধারা গুলিতে যে একক নৃত্য উপস্থাপনার পরম্পরা বা ধারা প্রচলিত সেই রূপটি কিন্তু বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মধ্যে দিয়ে আত্ম প্রকাশ করেছে। শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা গুলির এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে কালের গতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত করে তোলবার প্রেষ্ঠায়। “বর্তমানে ভারতনাট্যম অনুষ্ঠান বলতে সাধারণ ভাবে আল্লা রিপু, যতিস্বরম, শব্দম, বর্নম, পদম, তিল্লানা-এইগুলিই প্রচলিত। কিন্তু এই ধারাগুলি বহুপরে ভারতনাট্যম নৃত্যপদ্ধতিতর সংযোজিত হয়েছে। সাদিরনাট্যম, ভগবতমেলা নাটক, কুরুভাঞ্জি ও কুচিপুড়ি-এই চার পদ্ধতিতেই পূর্বে ভারতনাট্যম প্রচলিত ছিল।

ভারতনাট্যম নৃত্যের শুদ্ধ মৌলিক রূপ সাদিরনাট্যম। বহু শতাব্দী ধরে মন্দিরে ও রাজদরবারে দেবদাসীদের দ্বারা এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হত। সাদিরনাট্যম, দাসীঅট্যম, চিন্নমেলন, ভোগমেলম, তাঞ্জোরী নাচ প্রভৃতি বিভিন্ন মানে এই নৃত্যধারা বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়”।[২]

নৃত্য,সঙ্গীত ও বাদ্য এই তিন ধারার শিল্পকলাই ভারতীয় সংস্কৃতির আঙিনায় ক্রমে সঙ্গীত নামে পরিচিত। অর্থাৎ ভারত সংস্কৃতির পরিভাষায় নৃত্য, গীত ও বাদ্য এই তিন ধারার শিল্পকলাকে একত্রে সঙ্গীত নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং এই সঙ্গীত ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনের ঊর্ধ্বে উঠে দেব-সাধনার অঙ্গ তথা পন্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের সাধন সংস্কৃতি তার সেই গৌরবময় অর্চনার মাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে নিম্ন স্খলিত হয়ে পরে যা আমাদের দেশে মুসলিম রাজত্বকালে তার গতিপথ হারিয়ে ফেলে পূজার্চনার মাধ্যম থেকে আনন্দ উল্লাস ও প্রমোদের উপকরণে পরিণত হয়। নৃত্য ও নর্তকীরা সম্ভোগের বস্তুতে পরিণত হন। ভারতের নৃত্যধারা তার গৌরবময় অবস্থান থেকে লাঞ্ছনার ও অসম্মানের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা ওড়িশি নৃত্য ও সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করেছে। কালক্রমে সমাজ সংস্কারকদের হাত ধরে নবজাগরণের পথে পুনরায় তার হৃতগৌরব উদ্ধার করে সমগ্র জগতের সম্মুখে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠটি করতে এবং ভারত সংস্কৃতির গৌরববৃদ্ধি করতে সার্থক হয়েছে। এক্ষেত্রেও রূপটি বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান রূপটি ধারণ করেছে। ওড়িশি নৃত্যকলাতেও একক নৃত্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনের পদ্ধতিটি প্রকাশ হয়েছে।

“But soon, the ‘maharis’ who danced in the temple faded out of the picture. Then, by the 19th century the ‘nachunis’ also disappeared. We were fighting for our independence from British rule. The British did not understand these customs. India was also seeking progress and looking towards the West for a more universal education pattern. This resulted in some intolerance for old systems and those that held back, society, especially women. However, thie ‘gotipua community survived. And it was from this community, that the return of Odissi as a dance form took place. They had a system of training and items. And although it is rave to see the original ‘qotipua dances now, the style you do see and recognise as Odissi is based on ‘that’ system.

The people who revived the dying art of Odissi, put it together by looking closely at the

Seulpture carved on the walls of temples in Orissa, by looking at some old texts like the ‘Abhinaye Chandrika’ and lastly by the technique used by the little gotipua boys.

The items you see today are the ‘batu’-which is made up of seulpture poses are to be seen in the temple seulptures. Next, is the ‘pallavi’, which is ‘bringing to life’ of the swaras or notes in the music. When an Odissi dancer does a ‘pallavi’, you can actually ‘see’ the music with yours eyes! Every musical pattern is made’ visual’. The asthapadi’ is a must in an

Odissi performance. These are verses from the ‘Gita – Govind’ – the love poem of Jayadeva. ‘Moksha’ is a concluding item and here the dancer pays homage to god, to the ‘guru’ and to the ‘sabha’ or audience, before ending her programme”. [৩]

আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যধারাগুলির মধ্যে অন্যমত জনপ্রিয় নৃত্যধারা হল কত্থক।  মূলত উ ও পশ্চিম ভারতে এই নৃত্যধারা উৎপত্তি ও বিস্তার। এই নৃত্যেরও ভাবধারার পরিবর্তনের ইতিহাসটি অত্যন্ত ভিন্ন। বৈষ্ণব দর্শন ও ইসলামিক সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সহবস্থান এই নৃত্যধারার আঙ্গীকে পরিলক্ষিত হয়। বৈদিক যুগ থেকে যাত্রা শুরু করে হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজ শাসনকালে এই নৃত্যধারা বহু পরিবর্তন ও সংমিশ্রণের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটি বিচিত্র রূপ গ্রহণ করেছে। কত্থক নৃত্যের শুদ্ধ রূপটি মূলত বৈষ্ণব ভাবধারা উদ্ভূত। এবং মন্দির ও ধর্মানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই এই নৃত্যের গতিধারাটি প্রবাহিত ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন এই নৃত্যধারার প্রাণপুরুষ। স্বামী হরিদাস, সুরদাস, গোবিন্দ স্বামী প্রভৃতি ভক্তকবি ও সুরসাধকদের সঙ্গীত অবলম্বনেই এই নৃত্যধারা বিকশিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মুসলমান রাজত্বকালে মন্দির থেকে রাজদরবারে আর্বিভাবের সাথে সাথে এই নৃত্যধারার ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। যদিও একথা অনস্বীকার্য যে শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম সম্রাটরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। তথাপি একথা গৌণ রাখবার বিষয় নয় যে মুসলিম আমলেই আমাদের সংস্কৃতির গতিপথ অবনত হয়েছে। বিশেষত কত্থক নৃত্যধারা তথা নৃত্যশিল্পীকুল। আমাদের দেশের নর্তকী-গন নাচনে-ওয়ালীতে পরিবর্তিত হয়েছে মুসলিম সম্রাটদের ভোগ-বিলাসের কুরুচিকর দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে। ফলস্বরূপ দেবার্চনার অঙ্গস্বরূপ নৃত্যধারা পরিণত হয়েছে প্রমোদ বিলাসের উপকরণে এবং সম্ভ্রান্ত নর্তকী সম্প্রদায় করুণ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে সম্ভোগের উপাদানে পরিণত হয়েছেন। মন্দিরের ধর্মপ্রাণ, ত্যাগ-সংযমী জীবনের অধিকারী নৃত্যশিল্পীরা ঠাঁই নিতে বাধা হয়েছেন রাজদরবারের প্রমোদ ভবনে বা আমির ওমারোহদের কোঠির অলিন্দে।

মুসলমান আমলে কত্থক নৃত্যধারা পারসীয় ভাবধারার প্রভাবে তার গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে বহুলাংশে। সম্রাট বা আমির ওমারোহদের মনোরঞ্জনের প্রেক্ষিতে কত্থক নৃত্যধারায় মূলত একক উপস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ পছন্দসই নর্তকী গনকে তখন বাদশা, সম্রাটদের সম্ভোগের আশ মেটাবার উপকরণে পরিণত হতে একপ্রকার বাধ্য করা হত। তাই একক উপস্থাপনাই হয়ত নবাব, বাদশী, সম্রাটদের অধিক পছন্দের ছিল।

এরপরে ধীরে ধীরে ঊন-বিংশ শতকের নবজাগরণের আলোকে এবং ইংরেজ শাসনকালের আবসানে কত্থক নৃত্যধারা বর্তমান আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। তবে নৃত্যের একক উপস্থাপনার রীতিটি প্রবাহমানতা পেয়ে এসেছে।

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দেশের কেরালা প্রদেশের কথাকলি নৃত্যধারা এবং মনিপুর প্রদেশের মণিপুরী নৃত্যশৈলী মুসলিম প্রভাব বা ইংরেজ শাসন দ্বারা ততোখানি বিঘ্নিত হতে পারেনি। ফলত এই দুই শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা শেষ পর্যন্ত তাদের বিশুদ্ধ রূপখানি বজায় রেখে চলেছে। সামান্য যে পরিবর্তন তাতে সংযোগ হয়েছে তা তাদের পরিপার্শ্বিক ও গঠনগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সাপেক্ষ। তবে এই দুই ধারার শৈলীতে এখনও দলগত উপস্থাপনার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। যেহেতু কথাকলি নৃত্যের বিশদ আলোচনা আমার গবেষণার আলোচ্য বিষয় নয় সে কারণে আমার গবেষণা মণিপুরী নৃত্যধারা সম্পর্কিত আলোচনাকে কেন্দ্র করেই অগ্রসর হতে থাকবে।

মণিপুরী নৃত্যধারায় একক নৃত্য মঞ্চায়নের পথটি সুগম করা বা সুপ্রতোষ্ঠিত করবার একান্ত প্রচেষ্টায় এই গবেষণার অবতারণা। এই কাজটি যেমন খুব সহজ বিষয় নয় অপরপক্ষে এটি নিতান্তই বিধি বর্হিভূত, গর্হিত এবং অসম্ভব কোনও কল্পনা মাত্রই নয়। তবে কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ একথা অনস্বীকার্য। সেই কারণে দরকার এই নৃত্যধারার গতিপ্রকৃতিকে যথার্থ রূপে অনুধাবন করবার। যাতে একক নৃত্য হিসেবে উপস্থাপিত হবার অবকাশে মণিপুরী নৃত্যধারার গভীরতর ধর্মীয় ও সাত্ত্বিক রূপটির সাথে সাথে তার বাহ্যিক রূপ ও পরিকাঠামোগত বৈশিষ্ট্যাবলীর কোন হানি না ঘটে। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানিয়ে নিয়ে বিভিন্ন প্রকার গ্রহণ-বর্জন রীতি-নীতির মধ্যে দিয়ে গিয়েও উদবর্তনে ভাস্বর হয়ে ওঠার মাধ্যমেই একটি শিল্পধারা তার আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।

মণিপুরী নৃত্য শৈলীতে একক নৃত্যের পুনর্নবীকরণ বিষয়ে প্রথিতযশা শিল্পীদের প্রতিবেদনে বর্তমান প্রেক্ষিতে গবেষিকার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা-

মণিপুরী নৃত্য ধারার পরম্পরাগত উপস্থাপনার বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করলে আমরা দেখি একটি দলগত নৃত্যধারা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ, মূলত একটি নৃত্যনাট্যের আঙ্গিক বা পরিকাঠামোর আদলে, সেখানে এই নৃত্য ধারা তার সামগ্রিক উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে যেন এক অপূর্ব পুষ্পস্তবকের ন্যায় সৌন্দর্য মণ্ডিত রূপ দর্শকের হৃদয় কে ভক্তি ও আনন্দে ভরে তোলে এবং এক সুন্দর অনুভবের জগতের সাথে জারিত করে তোলে। মণিপুরী একক নৃত্যের কথা বলতে হলে প্রথমেই যে মানুষের কথা স্মরণে আসে তিনি হলেন মাইস্নাম গুরু আমুবী সিং। পরবর্তীকালে বহু গুরুদের মাধ্যমে এই একক নৃত্যের প্রচার ও প্রসার লাভ সম্ভবপর হয়। গুরু বিপিন সিং একক নৃত্যের প্রচারের মাধ্যমে মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সৃষ্টি করেছিলেন বললে বোধহয় ভুল হবেনা।

বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায় এই দলগত ধারাকে একক উপস্থাপনার সম্ভাবনার দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখবার পর তার রূপের প্রকাশ এভাবেও ব্যক্ত হতে পারে যে-পুষ্পস্তবক এর মধ্যে থেকে একটি ফুলকে পৃথক করে যদি উপস্থাপনা করা হয় বা প্রতিষ্ঠা করা হয় সে ক্ষেত্রে সমগ্র পুষ্পস্তবকের উপস্থাপন  সুযোগ না থাকলেও, অন্তত তাঁর একটি ফুলের সৌরভে ও সৌন্দর্যের পরিস্ফুটনে সমগ্র পুষ্পস্তবকের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যাবলী ফুটে ওঠায় অধিকতর গ্রহণীয় হয়ে  নতুন পথের সন্ধান খুঁজে পায় এবং বহুল অনুশীলনের ক্ষেত্রে উপযোগী করে তোলে। মনিপুরের এই একক নৃত্যের উপস্থাপন হিসেবে বলা যায় যে সপ্তসুরের সুমিতির মধ্যে থেকে কোন একটি বিশেষ স্বরের প্রয়োজনীয়তা। যেমন তুলনা করা যায় রামধনুর সাতটি রঙের সাথে। সাতটি রঙের মধ্যে থেকে প্রত্যেকটি রঙের পৃথক বৈশিষ্ট্যের, অস্তিত্বের ও প্রয়োজন অনুসারে তার প্রয়োগের সম্ভাবনা গুলিকেও খতিয়ে দেখা। আবার উদাহরণ হিসাবে ছাতিম পাতার উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন প্রত্যেকটি পাতার পৃথক পৃথক অস্তিত্বের প্রেক্ষিতেও তাদের অবস্থান কিন্তু একটিমাত্র বৃত্তের উপরেই, তাসত্ত্বেও ছাতিম পাতা সমগোত্রীয় উদ্ভিদকুলের সকল গুণাবলী সম্বলিত হয়েই কিন্তু উদ্ভিদ রাজ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে।

নৃত্যনাট্যের উপর গঠিত মণিপুরী রাস লীলা কিংবা লাইহরাওবা অনুষ্ঠান সেইরকমই মণিপুরী নৃত্য ধারার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে তথাপি মণিপুরী নৃত্য নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ এর পথ একক নৃত্য। পরম্পরা গত ভাবে মণিপুরী নৃত্য ধারার দলগত উপস্থাপনের ঐতিহ্য বিবর্তনের সাপেক্ষে এককভাবে মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনের সঙ্গে তুলনা করে একটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি উদাহরণ সহযোগে বলা যেতে পারে-

বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা

যে জায়গায় চোখে নতুন-দেখার দেখা

অবাক আলোর লিপি যে বহিয়া আনে”(৪)

অর্থাৎ উদ্ধৃতি অংশটিতে কবিগুরু অনেকের মধ্যে বা বহুর মধ্যে পৃথকভাবে আত্মপ্রকাশের মধ্যে একটি একক উপস্থিতি গৌরবময় এক অনন্য বৈশিষ্ট্য দীপ্তিমান প্রকাশ রূপকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে তার নতুনত্বর দ্যোতনার সকল সম্ভাব্য দিকগুলি খাতিয়ে দেখবার। এক্ষেত্রে এই উপমার মাঝের ও শেষের চরণ দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে মণিপুরী নৃত্যের একক উপস্থাপনার ভাবনাটি এই নৃত্য ধারা সম্পর্কে হয়তো একটি নতুন ভাবনা দিগন্ত উন্মোচন সক্ষম হবে আর সেই কারণে এই কথাটি অধিক প্রত্যয় এর সাথে প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন বলে বোধ করি।

একক মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনার বিষয়টির প্রতি নজর রেখে এখানে বিশেষ কতগুলি উপাদানের উল্লেখ করা যেতে পারে-

  • নৃত্য উপাদান
  • দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা
  • পোশাক

নৃত্যের উপাদান বলতে উল্লেখ করা যেতে পারে মহারাজ ভাগ্য চন্দ্রের দ্বারা রাসলীলার প্রারম্ভের সময় থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে মণিপুরী নৃত্য ধারার উপাদান সংগৃহীত হয়ে আসছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল-

  • প্রাচীন মৈথিলী ভাষায় রচিত গ্রন্থ লাইথেক লাইকা জগোই। যেটি সম্প্রতি মৈতৈ ভাষায়  প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীন মণিপুরী সংস্কৃতি মৈথিলী ভাষায় রচিত সংগীত সে সময়ে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ছিল।
  • মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র রচিত গ্রন্থ “গোবিন্দ সংগীত লিলাবিলাস”।
  • শ্রীকৃষ্ণ রস সংগীত সংগ্রহ
  • সংস্কৃত ভাষায় রচিত “সঙ্গীত দামোদর”।
  • সংস্কৃতি ভাষায় রচিত মণিপুরী সংগীত ও সংস্কৃতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল “সঙ্গীত সংগ্রহ”।
  • জয়দেব রচিত “গীতগোবিন্দ”।

এ ছাড়াও বহু সংখ্যক ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে মণিপুরী সাংস্কৃতিক ধারার উপাদান সংগ্রহীত হয়েছে। সম্প্রতি কালে মণিপুরী নৃত্য কে অধিক মাত্রায় জনপ্রিয় করে তোলবার প্রয়াসে বহুসংখ্যক শিল্পীগণ এককভাবে মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনে ব্রতী হয়েছেন। জনসম্মুখে এর গ্রহণীয়তাকেও মান্যতা দেওয়া হয়। বর্তমানকালে বিভিন্ন মঞ্চানুষ্ঠানে দর্শকদের পরিতৃপ্তি কে সমীক্ষা করে বলা যায় শিল্পী দ্বারা মণিপুরী নৃত্যের একক উপস্থাপনাতেও দর্শকরা উদার আহ্বান জানায়। এই সকল বিষয়গুলো বিবেচনা সাপেক্ষে হয়তো বলা যায় মণিপুরী নৃত্যের দলগত পরিবেশনের পাশাপাশি মণিপুরী নৃত্যের একক উপস্থাপনার দিকটিও এই নৃত্যধারার প্রচার-প্রসারে এবং একটি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয়তা অর্জনের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে উঠবে।

মণিপুরী-নৃত্যের একক উপস্থাপনের পথকে সুগম করে তোলবার প্রচেষ্টায় কতগুলি নৃত্যের কথা উল্লেখ করা যায়। সেগুলি পরম্পরাগত মণিপুরী নৃত্য ধারার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তাকে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই নৃত্য গুলি ‘গীতগোবিন্দ’ বা পরম্পরাগত ভাবে মণিপুরী নৃত্য ধারার অথবা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থাবলী থেকেই নিয়ে নৃত্য নির্মিতি করা হয়েছে, যেগুলি শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্য ধারায় বহু আগে থেকে গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন নৃত্য গুরু দ্বারা। যেমন শ্রীরাধা কৃষ্ণের রাগ অনুরাগ সম্বলিত লীলার কাহিনী বিবৃত পদ “ধীর সমীরে যমুনার তীরে”। শ্রীকৃষ্ণের গাঁথা বিবৃতি পদ “শ্রীত কমল কুচ মণ্ডল”। “হরি রিহ মুগ্ধ বধূ নিকরেন” পদে অপরূপ বর্ণনা পাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেব মহাত্মের। তেমনি “লোলিত বরন লোলিত বদন” পদে শ্রীকৃষ্ণের রূপের বর্ণনা এক অপূর্ব উদাহরণ খুঁজে পাই। “নাচত মৃদঙ্গ” পদটিতে শ্রীকৃষ্ণ নর্তন উপস্থাপনের জন্য উপযুক্ত বলা যায়। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য এই যে উল্লেখিত সকল পদগুলি কেবল তাণ্ডব আঙ্গিকে রচিত নয়। সে ক্ষেত্রে একক নৃত্য শিল্পীর পক্ষে একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ তাণ্ডব আঙ্গিকের নৃত্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়ার অসুবিধা বা বাধা দূরিভূত হতে পারে।

পরম্পরাগত ভাবে মণিপুরী নৃত্য ধারার বহু নৃত্যকে একক নৃত্য উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রচেষ্টায় শামিল করা হয়ে থাকে। যেমন-“দশাবতার”, ”প্রবন্দ্ধ নর্তন”, “তানুম”,” গৌরাঙ্গ বন্দনা”, “নীলকমল দল শ্যাম”, “কৃষ্ণ বিরহ”, “রাধা নর্তন” ইত্যাদি। উপস্থিত করা যেতে পারে “শ্রীকৃষ্ণ অভিসার” বা “শ্রীরাধা অভিসার” “শ্রীকৃষ্ণ নর্তন”। উপাদান গ্রহণ করা যেতে পারে “নায়িকা ভেদের” আখ্যানকে অবলম্বন করে। একক নৃত্য উপস্থাপনায় মন্দিরা চলোম বা করতাল চলোম নৃত্যও হতে পারে, যদিও এই নৃত্য সমবেত নৃত্য হিসাবেই উপস্থিত হয়ে আসার রীতি, তবুও বিবর্তনের ধারা বয়ে এবং স্বয়ী বৈশিষ্ট্যকে বিঘ্নিত না করে এই ধরনের নৃত্য একক উপস্থাপনের মাধ্যমে হয়তো মণিপুরী নৃত্য ধারার বহুল অনুশীলনের পথ প্রশস্ত করা যাবে। এই কারণেই “পুংচলোম” নৃত্য টিকেও একক প্রদর্শনীর কথা ও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কারণ পুং চলোম নৃত্য মণিপুরী নৃত্য ধারার এক অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্য উপাদান যার জনপ্রিয়তা সমগ্র বিশ্বব্যাপী। এছাড়াও আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থাদি যেমন রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি থেকেও বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বন করেও একক মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনার উপকরণ সংগৃহীত হতে পারে।

সকল প্রথিতযশা মণিপুরী নৃত্য গুরুদের বক্তব্য স্মরণ রেখে বলা যায় একক নৃত্য একটি নির্দিষ্ট ক্রোম থাকা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে শিল্পী একক নৃত্য উপস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান বা ধারণা রাখতে পারবে। এটি প্রথম অবস্থায় গুরু বিপিন সিংহ রাসের ক্রমানুযায়ী নৃত্য গুলিকে সাজাতেন এবং পরবর্তীকালে সকল গুরুর পক্ষ থেকেই এই বিষয়ে একই মন্তব্য শোনা যায়। অর্থাৎ প্রণাম দিয়ে নৃত্যের সূচনা ও প্রার্থনা দিয়ে নৃত্যের সমাপ্তি। সে ক্ষেত্রে একক নৃত্যশিল্পীকে সেভাবেই নৃত্যের উপাদানগুলি সাজাতে হবে। মণিপুরী নৃত্যের সকল গুরু বহু একক নৃত্য নির্মিতি করেছেন। সেগুলো থেকে নৃত্য গুলি নিয়ে বা পুরানো গ্রন্থ থেকে পদ নিয়ে নতুনভাবে নৃত্য নির্মিতি করে মঞ্চ উপস্থাপনা করা যেতেই পারে। উপস্থাপনার সময়সীমা ও পোশাকের পরিবর্তনকে স্মরণে রেখে নৃত্য পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে কোনভাবেই দর্শকদের কাছে সেটি অপ্রাসঙ্গিক না হয়ে ওঠে। দর্শক  সুন্দরকে কিংবা একজন পরিপূর্ণ শিল্পীকে চিরকাল আহ্বান জানায়। আর বলা যেতে পারে একজন শিল্পী গড়ে ওঠে দর্শকের গ্রহণীয়তার উপর ভিত্তি করেই। তাই দর্শকের চাহিদা স্মরণ করেই শিল্পীকে নৃত্য পরিকল্পনা রচনা করতে হবে।

মণিপুরী নৃত্যের একক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তার পোশাক সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা রাখা। অন্যান্য ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ধারায় পুরুষ ও মহিলা শিল্পী গনের জন্য নৃত্যের পোশাক মোটামুটিভাবে নির্ধারিত থাকে বলা যেতে পারে। একটি বিশেষ ধারার পোশাকেই শিল্পীরা মঞ্চে অবতীর্ণ হন। সে ক্ষেত্রে মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্য কলায় মণিপুরী নৃত্যের বিভিন্ন ধারার নৃত্য অনুসারে তার পোশাকটিও হয় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। যেমন-রাসলীলার পোশাক অন্য ধরনের আবার লাইহরাওবা নৃত্যের পোশাক অন্য প্রকার। এই একই হিসাবে মাইবা, মাইবী, পুংচলোম, মন্দিরা চলোম প্রভৃতি বিভিন্ন ধারার নৃত্যের পোশাকের বৈচিত্র্য দেখা যায়। বিভিন্ন ধারার নৃত্যের পোশাক এর বিভিন্ন তার কারণে একজন শিল্পীর ভিন্ন ভিন্ন ধারার মণিপুরী নৃত্য একইসঙ্গে ক্রমান্বয়ে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পোশাক প্রধান বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেকারণে মণিপুরী নৃত্য ধারার মঞ্চে একক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে পোশাকের কিছু সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করলে বোধহয় সেই সমস্যা থেকে কিছুটা সমাধান পাওয়া যেতে পারে। যেমন-শিল্পীর পোশাকের সৌন্দর্য রক্ষার তে পোশাকের বিভিন্ন জায়গায় সেলাই করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে সেলাই এর পরিবর্তে যদি সেফটিপিন ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটি বেশি সুবিধাজনক পোশাক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। মহিলা শিল্পীদের ক্ষেত্রে পোশাক পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মণিপুরী আঙ্গিকে লাস্য ও তাণ্ডব দুই ধরনের আঙ্গিক উপস্থিত। সেক্ষেত্রে লাস্য আঙ্গিকের পোশাকে আমরা ফানেক বা কুমিনের ব্যবহার লক্ষ্য করি এবং তাণ্ডব আঙ্গিকে ফৈজম বা ধুতির ব্যবহার দেখে থাকি। শিল্পী প্রথমে লাস্য আঙ্গিকের নৃত্য উপস্থাপন করতে পারে, সেটি করলে মহিলা শিল্পী ফানেকের অভ্যন্তরে ধুতি পরিধান করলে কিছুটা সময় সে বাঁচাতে পারবে।এছাড়াও দড়ির বদলে যদি ভেলক্র ব্যবহার করা হয় তবে পোশাকের পরিবর্তনে অনেক সুবিধা হবে বলে মনে করা যায়। ব্লাউজে চেনের বদলে ভেলক্র ব্যবহারে ব্লাউজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সুবিধা হতে পারে। যে সকল প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পীরা একক নৃত্য করেছেন বা করছেন তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই এই পথ নিদর্শন। তাদের এত বছরের মঞ্চের অভিজ্ঞতা পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের এই মন্তব্য। আমরা যদি লক্ষ্য করি গুরু বিপিন সিং বা কলাবতী দেবী “মণিপুরী নর্তনালয়ের” শিল্পীদের দিকে তাহলে দেখা যায় শিল্পীরা ফৈজম বা ধুতির ওপরে ওড়না বা ইনেফির ব্যবহার করেন এবং মাথায় অলংকার হিসাবে ঝাঁপার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তাণ্ডব আঙ্গিকের নৃত্যের ক্ষেত্রে তারা খোপায় ব্যবহৃত অলংকার ব্যবহার করেন না, কিন্তু কপালে মাঙটিকা এবং কানের টানা পরিধান করতে তাদের দেখা যায়। এই পোশাকের কথা উল্লেখ করার কারণ হেতু বলা যায় পোশাক পরিবর্তনের সমস্যার দিকে লক্ষ্য রেখে এই পোশাকের কথাও সর্বসমক্ষে আনা দরকার এক্ষেত্রে শিল্পী লাস্য আঙ্গিকের নৃত্যে মাথায় অলংকার পরিধান করবে এবং তাণ্ডব আঙ্গিকে মাথায় কয়েৎ বা শ্রীকৃষ্ণের চূড়া ধারণ করতে পারে, সেটি অবশ্যই শিল্পীর নির্বাচিত উপাদানের উপর নির্ভর করছে। এই পোশাকের ধারণার মাধ্যমেও একটি পথ হতে পারে পোশাক পরিবর্তনের সমস্যাকে কিছুটা দূরীভূত করার। তবে একথা সত্য যে মণিপুরী নৃত্যের বৈচিত্র্য তার পোশাকে। মণিপুরী নৃত্য নিয়ে পড়াশোনা কালে শিল্পী পোশাক সম্বন্ধে সকল জ্ঞান অর্জন করে কিংবা উপস্থাপনার মাধ্যমে ও তার প্রভাব সম্বন্ধে ধারণা জন্মায়।একক নৃত্য পরিবেশনায় শিল্পীর যে পোশাক পরিবর্তনের অক্ষমতা সেটি দূরীভূত হতে পারে সঠিক পোশাক নির্বাচন করার জ্ঞানের মাধ্যমে। যেকোনো শিল্পী গড়ে ওঠার পেছনে থাকে গুরুর স্নেহভরা আশীর্বাদ এবং তার সাথে থাকে গুরু-শিষ্যের অক্লান্ত পরিশ্রম। তাই এই সকল বিষয়ে শিল্পী কে অভিহিত করাতে পারে একজন গুরুই।গবেষণাকালে বহু গুরুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে পেরেছি যার মাধ্যমে এই সকল ধারণাগুলি জনসম্মুখে আনতে পারার সৌভাগ্য গবেষিকার  হয়েছে। যে সকল তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সে সকল তথ্য মূল্যায়ন পর্বে এটি মনে হয় যে মণিপুরী নৃত্য দলগত প্রধান নৃত্য হলেও এটি সক্ষম ভাবে একক নৃত্য হিসাবে পরিচিত হতে পারে জনসম্মুখে।

যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মণিপুরী নৃত্য চর্চার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সে সকল বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিল্পীদের যদি একক নৃত্য শিল্পী হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে সেটি বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে ধারণা করা যেতে পারে। সকল মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার্থীদের যদি মণিপুরী নৃত্যের পোশাক বা সেই বিষয়ের ওপর কর্মশালা আয়োজন করা যায় তাহলে পরবর্তী কালে যে সকল নৃত্যশিল্পী নিজেকে একক নৃত্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে সে সকল শিল্পীদের কাছে পোশাক কোন সমস্যার অন্তরায় সৃষ্টি করবে না। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গুলি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি একত্রিত হয়ে যদি একক নৃত্যের সুবিধার্থে একটি সঠিক নিয়মাবলী তৈরি করেন সেক্ষেত্রে একক নৃত্য শিল্পী নির্দিষ্ট বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে থাকবেন। এই সকল কর্মের জন্য প্রয়োজন সকল বয়োজ্যেষ্ঠ গুরু, প্রথিতযশা মণিপুরী শিল্পীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ,বিভিন্ন সংস্থা যারা বিভিন্ন মণিপুরী একক নৃত্য উৎসব পরিচালনা করছেন সে সকলকে একত্রিত হয়ে একটি বৈঠকের মাধ্যমে একক নৃত্যের বাঁধাধরা নিয়ম প্রতিস্থাপন করা। সে ক্ষেত্রে সকল একক নৃত্য শিল্পীদের নিয়মাবলী ও নৃত্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হতে পারে। মণিপুরী নৃত্য ঐতিহ্যবাহী এবং যে কোন নতুন পদ অনুসন্ধান কালে এটি স্মরণ রাখতে হবে যে মণিপুরী নৃত্যের ঐতিহ্য কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না সে ক্ষেত্রে নৃত্য শিল্পীদের পথ প্রদর্শনের কাজ করবে এই সকল বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামত।

পরিশেষে বলা যায় “একক মণিপুরী নৃত্য শৈলীর বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান” সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বহুগুণী মানুষের স্নেহভরা আশীর্বাদ ও ভালোবাসা প্রাপ্ত হয়েছে। প্রাপ্ত হয়েছে তাদের মণিপুরী নৃত্য বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য, তাদের প্রত্যেকটি কথা গবেষিকা কে আগামী দিনের প্রথম নিদর্শন করতে সাহায্য করবে। মণিপুরী নৃত্যের একক নৃত্যের পুনর্নবীকরণ এর মাধ্যমে একজন শিল্পী তার নৃত্যে দক্ষতা ও ক্ষমতা দর্শকদের ও বিভিন্ন প্রথিতযশা শিল্পীদের সম্মুখে তুলে ধরতে পারবে। প্রত্যেক পর্বেই বাড়বে তার নতুন অভিজ্ঞতা। মণিপুরী নৃত্যে দলগত নৃত্য যেরূপ সমাদৃত সেই রূপ সমাদৃত একক নৃত্য। তবে একটি অনুষ্ঠান একাই সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে একক নৃত্য বা solo Repertoire সে ক্ষেত্রে শিল্পীকে সচেতন হতে হবে। সঠিক পন্থা ও সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারে প্রকৃত একক নৃত্য শিল্পী। মণিপুরী নৃত্যের ভাব-গভীরতা, সংযম, ভক্তি এবং সৌন্দর্যের ভাব স্মরণ রেখেই সম্ভব মণিপুরী নৃত্য শৈলীতে একক নৃত্যের পুনর্নবীকরণ।

গ্রন্থপঞ্জী:

১। জাভেরী দর্শনা ও দেবী কলাবতি, শাস্ত্রীয় মণিপুরী নর্তন, মণিপুরী নর্তনালয় কলকাতা, ১৯৯৩, মুখবন্ধ পৃষ্ঠা: ২।

২। চট্টোপাধ্যায় গায়েত্রী, ভারতের নৃত্যকলা, করুনা প্রকাশনী, কলকাতা – ৯, ২০০৮ জুলাই, প্রথম সংস্করণ ২০০২, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৮, পঞ্চম মূদ্রণ ১৯৯৭ জুলাই, পৃষ্ঠা: ১৮৩

৩। Samson Leela, The Joy of Classical Dances of India, National Book Trust, New Delhi-70, First Reprint 2012. PP: 27-29.

৪। ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ,স্বরবিতান, উনষষ্টিতম খন্ড, প্রকাশক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়, কলকাতা- ১৭, ১৩৭১ বৈশাখ ২৫শে, পুর্নমুদ্রণ ১৪০৩ চৈত্র। পৃষ্ঠা: ৮।