May 1, 2023

Begum Akhtarji’s Timeless Bengali Raga Pradhan Songs: An Analytical Survey

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Pratyusha Roy

Abstract:

This analytical survey delves into the enduring legacy of Begum Akhtarji, the legendary Indian classical vocalist, focusing specifically on her timeless renditions of Bengali Raga Pradhan songs. Begum Akhtar’s profound mastery of classical music, combined with her emotive and soul-stirring renditions, has left an indelible mark on the cultural tapestry of India. The research employs a multidimensional analytical approach, exploring the intricate nuances of Begum Akhtarji’s interpretations of Bengali Raga Pradhan compositions. The study incorporates historical, musical, and cultural perspectives to provide a comprehensive understanding of the evolution and significance of these timeless renditions. Through an exploration of the distinctive features of Bengali Raga Pradhan and an in-depth analysis of Begum Akhtarji’s interpretative style, the research seeks to unravel the intricate interplay of melody, emotion, and cultural context. Special attention is given to the unique elements that distinguish Begum Akhtarji’s renditions, showcasing her ability to seamlessly blend classical traditions with a deep understanding of the emotive nuances embedded in the lyrics. The study also delves into the socio-cultural impact of Begum Akhtarji’s renditions, examining their role in preserving and promoting the rich heritage of Bengali music. By examining archival recordings, scholarly writings, and expert commentaries, this research sheds light on the transformative influence of Begum Akhtarji’s contributions to the genre. In conclusion, this analytical survey serves as a tribute to Begum Akhtarji’s unparalleled artistry and aims to contribute to a deeper appreciation of her timeless renditions of Bengali Raga Pradhan songs. By unravelling the intricacies of her musical expressions, this research invites scholars, musicians, and enthusiasts to explore the profound cultural resonance of Begum Akhtarji’s contributions to the world of classical music.

বেগম আখতারজির কালজয়ী বাংলা রাগপ্রধান গান: একটি বিশ্লেষণাত্মক সমীক্ষা

প্রত্যুষা রায়, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী

সারসংক্ষেপ

সুরের নক্ষত্রদের চমকে প্রজ্ব্যলিত হয়েছে বাংলা রাগপ্রধান গানের জগত। বিবর্তনের ধারা বয়ে এনেছে প্রতিনিয়ত নতুনকে। বিংশ শতাব্দীর সুনামধন্য শিল্পী বিদূষি বেগম আখতারজির কিছু বাংলা রাগপ্রধান গান এই ধারায় জুটিয়েছে স্বর্ণমুকুট। আখতারজির এই গানগুলি বাংলা রাগপ্রধান  গানে যেন এক অন্য ঘরাণার সৃষ্টি করেছে, যার মোহনীয়তা আজও বর্তমান। উক্ত সমীক্ষায় এই বাংলা রাগপ্রধান গানগুলির জনপ্রিয়তার সূদুরপ্রসারী প্রভাবের সাথে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ রাগ,তাল,ভাব রস ও কথার গুরুত্ত্বসহ কিছুক্ষেত্রে গানের বিশেষ বিশেষ সৌন্দর্য্যের জায়গাগুলির স্বরলিপি প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হল।

সাংকেতিক শব্দগুচ্ছ– বাংলা রাগপ্রধান গান, বেগম আখতার , কালজয়ী, জোছনা।

ভূমিকা

রাগপ্রধান গানের জগতে একটি নক্ষত্র আজও বর্তমান রয়েছে। তিনি হলেন বিদূষী বেগম আখতার। বিংশ শতাব্দির এই চিরন্তন শিল্পীর কিছু কিছু বাংলা রাগপ্রধান গানের জনপ্রিয়তা গগনচুম্বি। এর মোহনীয়তা যেন ফুরায়েও ফুরোতেই চায়না।  কিন্তু কেন এই জনপ্রিয়তা? বিবর্তনের ধারায় হয়তো এমন বহু কালজয়ী সৃষ্টিরা ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু এমন কিছু রাগপ্রধান গানের ছোঁয়া আজও মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাবে জন্ম হলেও বাংলা রাগপ্রধান গানগুলি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্মগত অভ্যাসগুলি বর্জন করে স্বকীয় রূপেই চীরকাল পরিবেশিত হয়েছ। এমনই কিছু কালজয়ী সৃষ্টিদের মধ্যে কয়েকটি হল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরারোপিত ও পুলক ব্যানার্জীর কথার মালায় গাঁথা ” ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে “ গানটি। রবি গুহ মজুমদারের সুরারোপিত ও কথায় , আখতারজীর সুর মূর্ছনায় সমৃদ্ধ আরও একটি গান “ চুপি চুপি চলে না গিয়ে।” অপূর্ব মায়া জুড়োনো এই সৃষ্টিগুলির শেষ না হওয়া সু্র যেন বেজে যায় কানে বারবার। আখতারজীর কন্ঠের কিছু বাংলা রাগপ্রধান গানের মধ্যে সব কয়টিই বিশেষ, তবুও সাধ্যানুযায়ী কয়েকটি গানের বিশ্লেষণ করা হলো এই সমীক্ষাটিতে।

বেগম আখতারজীর গীত কয়েকটি রাগপ্রধান গানের বিশ্লেষণ

সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ

কথা – পুলক ব্যানার্জী

শিল্পী – বেগম আখতার

ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে

কুঞ্জে এখনো কুহু কূজনে মাতে।

                           নাই যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি

 সুরেরই আঘাত দিও এ মধুরাতে    

অবহেলা নয় প্রিয় ,চাহ যদি ব্যথা দিও      

অশ্রু-মাধুরী আনো, এ আঁখিপাতে।।

রাগ নায়কি কানাড়া অঙ্গের উপর এই রাগপ্রধান গানটির চমকই প্রসিদ্ধ করেছে কথাশিল্পী,

সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পীকে।

যে ভাবনা নিয়েই গানটি রচনা হোক না কেন আখতারজীর কন্ঠে গায়নের পর তা পুরোপুরি ঠুমরী

আঙ্গিক মনে হচ্ছে ।

রাগ [1]নায়কি কানাড়ার বিবরণ

 ঠাট – কাফি

বাদি – মধ্যম

সম্বাদী – ষড়জ

জাতি – ষাড়ব-ষাড়ব বা অন্য মতে ষাড়ব – বক্র।

পরিবেশনের সময় – মধ্যরাত্রি

আরোহনঃ  সা, রে জ্ঞ, ম প, ণি প, র্সা

অবোরহণঃ র্সা, প ণি প, ম প, জ্ঞ ম, রে সা।

গানের সুরের ওপর রাগের প্রভাব

সুরের জাদু, বাণীর মোহনীয়তা ও রাগের ছোঁয়ায়  কালজয়ী এই গানের কথার প্রারম্ভেই যে সুর মূর্ছনা -ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে…………………

ঝাঁপতালে নিবদ্ধ এই রাগপ্রধান গানের প্রথম লাইনের মধ্যে দিয়েই কানাড়া অঙ্গের প্রভাব মিলেছে । এরপর যে আলাপের মূর্ছনা ,তা যেন কোন হারিয়ে যাওয়া অমূল্য জিনিসকে প্রাণপণে আটকে রাখার প্রচেষ্টা। কথার যাদু, সুরের মায়া এবং গায়কীর ঐশ্বর্য্যে এমনটাই প্রতিফলিত হচ্ছে।  গানের দ্বিতীয় লাইন ,”কুঞ্জে এখনো” …………

গানের প্রত্যেকটি কথা এবং তার গায়কী যেন এক একটি মণিমাণিক্য। ভাবে রসে মিলে একাকার স্থায়ীর পরে অন্তরার পঙক্তিগুলি, যা ব্যাখ্যা করার দুঃসাহস বোধহয় চরম ভালোলাগা থেকেই ।  অন্তরার দ্বিতীয় লাইনের মধ্যে যে সৌন্দর্য্য তা বোধহয় ভাষায় ব্যক্ত করা খুব কঠিন। “ সুরেরই আঘাত “ কথাটির মধ্যে যে ভাব ব্যক্ত হয়েছে,  তা যেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে থেকে যাবে।

স্থায়ী ও অন্তরার পরের অংশ অর্থাৎ সঞ্চারীর মনমুগ্ধকর এই গান কানাড়া অঙ্গের প্রায় নিংড়ে নেওয়া কম্পোজিশন বললেও ভুল হবেনা।

গানের ভাব ও রসঃ-

যে কোনো সংগীতের ভাব ও রস গায়নের দাড়াই ব্যক্ত হয়। রচয়িতা হয়তো যে ভাব নিয়ে রচনা করেন ,সঙ্গীতশিল্পী তার গায়নের মাধ্যমে তাতে অন্য রসসঞ্চার করেন। বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত এই রাগপ্রধান গানের কথা ও সুর অনুযায়ী একাধিক রসের সঞ্চার দেখা যায়। যদিও এই বিষয় সম্বন্ধে প্রত্যেকের ভিন্ন অনুভূতি হতেই পারে। “ ফিরায়ে দিও না মোরে শুন্য হাতে, কুঞ্জে এখনো কুহু কুজনে মাতে।” এখানে গানের কথা এবং বেগম আখতারজির অনবদ্য গায়কির মাধ্যমে করুণভাবে মিনতির দ্বারা বিরহ ভাব ফুটে উঠেছে ।

“ নাও যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি”..………………….

 এই লাইনে শিল্পী তাঁর গায়কীর মাধ্যমে শৃঙ্গার রসের সঞ্চার ঘটিয়েছেন। সবশেষে শ্রোতাদের অনুভূতি অনুযায়ী বিশেষ কয়েকটি রস ও ভাবের সঞ্চার ঘটাতেই পারে এই গান। সব মিলিয়ে এই শিল্পীর গায়নের মাধ্যমে যে অনুভূতির সঞ্চার হয় তা সেভাবে ব্যক্ত করা কঠিন হলেও কিছুক্ষেত্রে করুন আবার বিরহ আবার কখনো শৃঙ্গার রসের ধারা শ্রোতার মনকে ভাবিয়ে তোলে। রাগপ্রধান গানের জগতে আরও একটি কালজয়ী সৃষ্টির দিকে যদি হাত বাড়াই তবে আরও একটি গানকে তুলে না ধরলে বোধহয় এই সমীক্ষা অপূর্ণই থেকে যাবে ।

গান – জোছনা করেছে আড়ি

শিল্পী – বেগম আখতার

সঙ্গীত পরিচালক – রবি গুহ মজুমদার

গীতিকার –  রবি গুহ মজুমদার

জোছনা করেছে আড়ি

আসেনা আমার বাড়ি।

গলি দিয়ে চলে যায়

লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি।

চেয়ে চেয়ে পথ তারি, হিয়া মোর হয় ভারি

রূপের মধুর মোহ

বলোনা কি করে ছাড়ি[2]।।

রবি গুহ মজুমদারের পরিচালনায় ও সুরে , বিদূষি বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত “ জোছনা করেছে আড়ি ” গানটি বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে আন্দোলন তুলেছে তার ঢেউ বহুদূরগামী। সূত্রে জানা যায় ১৯৭২ সালে রবি গুহ মজুমদারের হাতে লেখা ও সুরের মালায় গাঁথা হয় এই গানটি। কতটা অধ্যাবসায় ও গভীরতা সহ গাইলে এমন প্রসিদ্ধি পাওয়া যায় তা বোধহয় অকল্পনীয়। তবে প্রসিদ্ধ হবার এই শ্রেয় কার? রচয়িতার নাকি শিল্পীর গায়কীর ? নাকি সবকিছু অতিক্রম করে এই প্রসিদ্ধির শ্রেয় শ্রোতার উপরেই ? এই বিতর্কমূলক প্রশ্নের বেড়াজাল অতিক্রম করা বোধহয় খুব জটিল । তুলনাহীন এই গায়কীর গভীরতা ব্যক্ত করার অর্থ হল কোনো সমুদ্রের মধ্যে থেকে এক কণা বালু তুলে নেওয়া। তবুও সমীক্ষাটি সমাপ্ত করার জন্য এবং আগামী প্রজন্মকে এইসব সৃষ্টিগুলির গুরুত্ব বোঝাবার জন্য এই গানের রাগ, ভাব ও রস এছাড়াও কথার গুরুত্ব সম্মন্ধে বিশ্লেষণ করা হল। রাগ পিলুর উপর সুরারোপিত “ জোছনা করেছে আড়ি “ গানটির সমগ্র জুড়েই রয়েছে এক শুধুই তৃপ্তি।

গানের সুরের উপর রাগের প্রভাব

এই গান কাফী ঠাটের রাগ পিলুর উপর আধারিত। পিলু রাগ সাধারণত ঠুমরী ও দাদরা কম্পোজিশন গুলির উপরেই বেশি শুনতে পাওয়া যায়। পিলু রাগের মুখ্য অঙ্গগুলি হলঃ  ম প জ্ঞ ম, ধ প, ণ ধ প, নি ধ, র্সা অর্থাৎ আরোহনে শুদ্ধ নিষাদ এবং অবোরহণে কোমল নিষাদের প্রয়োগ। গানের শুরুতেই যে ছোট্ট আলাপ আখতারজির কন্ঠে আমরা শুনতে পাই……………

আহা, গানের শুরুতেই এমন ভাব; যেন এক মহাসমুদ্র। যাকে পাড়ি দেওয়ার সাধ্যি কারোর নেই। গানের প্রথম লাইনটি –  “ জোছনা করেছে আড়ি ,আসেনা আমার বাড়ি।”

এ শুধুই কন্ঠের খেলা। সুরের যাদু ও বাণীর মোহনীয়তাতো আছেই, তার উপর রাগের প্রাধান্য, সবটা মিলেমিশে যেন এক অন্য রূপ ধারন করেছে। প্রথম দুই লাইন গাইবার পর আখতারজির কন্ঠে যে ছোট্ট আলাপ , শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষায় যাকে বলে বোল আলাপ। এর একটু স্বরলিপি করার চেষ্টা করছি। যদিও গায়কীর কোনো স্বরলিপি হয়তো হয় না , তবুও এই সকল অমূল্য সম্পদগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লেখনির মাধ্যমে রেখে যাওয়ার সামান্য প্রচেষ্টামাত্র।

কি অপূর্ব ; এ যেন এক নতুন স্বাদ, যা আগে কখনোও শোনা যায়নি। ঠুমরী অঙ্গের এই গানের বিশেষ কাজগুলি মাদকতায় ভরা। “ লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি “- কি ভাবনা,কি লেখনি। এই গান কোনো যাদুর থেকে কম কিছুই নয়। অন্তরার দিকে কয়েকটি লাইনের দিকে যদি বিশেষ নজর দিই – “ রূপের মধুর মোহ, বলোনা কি করে ছাড়ি “ – যেহেতু ঠুমরী অঙ্গের গান তাই সঠিকভাবে রাগের শুদ্ধতা বজায় রাখা যায় না স্বাভাবিক ভাবেই। এমনিতেই পিলু রাগে অন্যান্য রাগের ছায়াপাত ঘটে, তাই একে সংকীর্ণ জাতির রাগ বলে। অন্তরার দ্বিতীয় লাইন “ রূপের মধূর মোহ “ – “ রূপের “ শুরুতেই শুদ্ধ গান্ধার ব্যবহৃত হয়েছে। সবশেষে বলতে পারি এই গান নেশা ধরায়, এই গানের প্রতিটি লাইন যেন হৃদয়কে এক নৈষর্গিক সুষমা উপলব্ধ করায়।

গানের ভাব ও রস

গানের কথানুযায়ী “জোছনা করেছে আড়ি , আসেনা আমার বাড়ি “,গানের প্রথম পংক্তিতেই একটু হলেও অভিমানে ভরা আবদার, যার রূপকল্প বোঝায় – জোছনা আড়ি করেছে,জোছনা অর্থাৎ চাঁদের আলো। সে আমার বাড়ি আসে না, রূপোলি শাড়ি লুটিয়ে চলে যায় গলি দিয়ে। এইখানে কবির মনের ভাব ও সঙ্গীত শিল্পীর গায়কীর ভাব মিশিয়ে যদি বলি তাহলে এই মনের ভাব বড্ড করুণ। “ আসেনা আমার বাড়ি , গলি দিয়ে চলে যায় “– অর্থাৎ গানের কথানুযায়ী স্বর ও সুর শ্রষ্ঠা শ্রী রবি গুহ মজুমদারের এই আক্ষেপ প্রকাশের কারন হল, তাঁর বাড়িতে জোছনার না আসা ।

আবার স্থায়ীর পর অন্তরার দিকে যদি নজর দিই , ‘ চেয়ে চেয়ে পথ তারি ‘ – ঠুমরীর আঙ্গিকে গীত এই গানের প্রতিটি লাইনই যেন মায়া ধরায়। কারোর পথ চেয়ে বসে থাকার যে জ্বালা, তা বিরহ ভাবের জন্ম দিয়েছে। “ হিয়া মোর হয় ভারি “- ,আহা; কি চমৎকার ভাবে ভাবের পরিবেশন, কি সৌন্দর্য্য এই রসের। বিরহের জ্বালা তো ক্ষণিকের। কিছু পরেই বিরহ ভাব শৃঙ্গার রসের জন্ম দিয়েছে পরবর্তী লাইনে- “ রূপের মধুর মোহ, বলোনা কি করে ছাড়ি “………………………………।  অর্থাৎ চেয়ে চেয়ে পথ চাওয়াতেই যে আনন্দ। এ মোহ ছাড়া যাবেনা।

গানের কথার বৈশিষ্ঠ্য

বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গুলির প্রায় সবকয়টিই আধুনিক ভাবধারায় রচিত এবং এই সব গানগুলিই আসলে রাগপ্রধান গানের প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গে শ্রী অমলেন্দু বিকাশ করচৌধুরী তাঁর একটি লেখনিতে বলেছেন-[3] “ আরও যদি আধুনিক সময়ে এগিয়ে আসি তবে চিন্ময় লাহিড়ীর ‘ রাধা বলে শুনি বাঁশরী বাজে ‘( খাম্বাজ) কিংবা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের রচনায় – তাঁর লেখা ও সুরে গাওয়া বিভিন্ন বাংলা রাগ –  ভিত্তিক গানে রাগপ্রধান গানের সার্থক উত্তরণের ছোঁয়া মিলবে। এঁরা বাংলা গানে প্রগতিপন্থীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।”

আধুনিকী প্রভাব অর্থাৎ পূর্বে যে ধরনের রাগপ্রধান গান রচনা হত, কৃষ্ণ চেতনাই ছিল তার প্রধান বিষয়বস্তু। রাধা – কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহ লীলাকে ঘিরে রচিত হত রাগপ্রধান গানগুলি। সেক্ষেত্রে বিচার করলে, বর্তমান রাগপ্রধান গানগুলির লিরিক্স এক্কেবারেই বিপরীত। তার জলন্ত উদাহরণ হিসেবে বেগম আখতারজির গানগুলিকেই ধরা যায়। বর্তমানে কবির মনের খেয়াল বা ভাবানুযায়ীই কথা বসানো হয় বাংলা রাগপ্রধান গানগুলিতে। এই প্রসঙ্গে শ্রী অমলেন্দু বিকাশ কর চৌধুরীর একটি উক্তি উল্লেখ করছি।

তিনি লিখছেন –[4]” রাগপ্রধান নামে গীত না হলেও আগেকার দিনে রাগভিত্তিক যে সমস্ত বাংলা বৈঠকী গান গাওয়া হত তার কথাগুলিতে শ্যাম, বেণু, রাধা, যমুনা, গিরিধারী, নূপুর, কদম্ব, ধেনু, অভিসার, বিরহ, রুনুঝুনু, রাই কিশোর, ললিতা, বিশাখা, কুঞ্জ, নীপশাখে, ভ্রমরা ইত্যাদি সব শব্দ এত বেশি প্রচলিত ও ব্যবহৃত হোত যে তার বাইরে রাগ-সঙ্গীত রচনা করার চিন্তা কেউই করতেন না। আধুনিক চিন্তাধারা এবং গীত-রচনা রাগসঙ্গীতে গীত-রচনার ঐ ধরনের নাগপাশ থেকে আজকের রাগপ্রধান গানকে মুক্তি দিয়েছে। “ প্রথম গানটির কথা নিয়ে একটু দৃষ্টিপাত করি।

ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে

কুঞ্জে এখনো কুহু কুজনে মাতে

                           নাই যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি

 সুরেরই আঘাত দিও ,এ মধু রাতে    

অবহেলা নয় প্রিয় ,চাহ যদি ব্যথা দিও      

অশ্রু মাধুরী এনো, এ আঁখি পাতে।। [5]

কথানুযায়ী এই গান রোমাঞ্চ জাগায়। দুজন অভিমানী বিরহীদের একে অপরের প্রতি কাতর প্রার্থনার ছবি ফুটে উঠেছে, যার ব্যাখ্যা ও রূপকল্প এইরূপ হতে পারে। শূন্য হাতে আমায় ফিরিয়ে দিও না, কুঞ্জে পাখিদের কূজন এখনোও মেতে আছে। হাসি যদি নাই দাও তবু বাঁশি বাজিও। এই রাতে আঘাত যদি দাও তা যেন হয় সুরের আঘাত। ব্যাথা দিও কিন্তু অবহেলা কর না………। অপূর্ব এই লিরিকাল কম্পোজিশন । হৃদয়ের ভাবগুলো এত সহজভাবে এখানে বর্ণিত, তাই হয়তো শ্রোতার কানে পুরোনো হয়নি আজও এই গান। রাধা – কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহলীলা , রাইকিশোর, ললিতা, যমুনার ঘাট, শ্যামরাই প্রভৃতির বাইরেও বাংলা রাগপ্রধান গানের কথায় এক অন্য চমক এনেছে এই আধুনিকী ধারা। আরও একটি কালজয়ী গানের কথা নিয়ে আলোচনা করছি ঃ-

জোছনা করেছে আড়ি

আসেনা আমার বাড়ি

গলি দিয়ে চলে যায়

লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি

চেয়ে চেয়ে পথ তারি, হিয়া মোর হয় ভারি

রূপের মধুর মোহ

বলোনা কি করে ছাড়ি।।

এই গানের যে কথা তা পুরোপুরি প্রেম সুলভ। বিরহ , ভালোবাসা এবং দুষ্টু মিষ্টি অভিমান নিয়ে রচিত এই সব বাংলা রাগপ্রধান গানে রয়েছে এক ম্যাজিক। “ জোছনা “এই  গানের মুখ্য চরিত্র। এই ‘ জোছনা ‘ শব্দের মধ্যে দিয়ে কবি তার মনের কোনো প্রিয় মানুষের দিকেও ইঙ্গিত করতে পারেন যা তিনি চাঁদের আলোর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ‘জোছনা, বাড়ি ,রূপোলি শাড়ি ‘ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে দিয়ে হয়তো কবি তার মনের আন্দোলনকে বুঝিয়েছেন। জোছনা আড়ি করেছে ,সে বিরহীর বাড়ি আসেনা। অন্য গলি দিয়ে চলে যায়, তার আভাস রেখে। তার পথ চেয়ে চেয়ে বিরহীর মন হয়ে ওঠে ভারি। তবুও সেই প্রিয়র রূপের মোহ ছাড়তে পারেনা বিরহী। এভাবেই অপেক্ষা চলে অবিরত।

বেগম আখতারজির রাগপ্রধান গানগুলিতে ঠুমরী ও দাদরার প্রভাব-

যেটা না বললেই নয় তা হল রাগপ্রধান বাংলা গানগুলি বেশি প্রভাবিত হয়েছে ঠুমরী ও দাদরা অঙ্গের গানগুলি থেকেই। বহু লেখনীর দ্বারা এমন বহু বাংলা রাগপ্রধান গানের ঠুমরীর সাথে হুবহু অনুকরণের প্রমান মিলেছে। এই উদ্দেশেই বলা যায় যে শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরারোপিত ও লিখিত “ কোয়েলিয়া গান থামা এবার “ গানটি পুরোপুরিই দাদরা অঙ্গের। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত প্রায় সব গানগুলিই বেগম আখতারজির কন্ঠে কোনোটা ঠুমরী ও কোনোটা দাদরা অঙ্গের বলে মনে হচ্ছে। “ চুপি চুপি চলে না গিয়ে “ , “ এই মরসুমে পরদেশে “ প্রভৃতি রবি গুহ মজুমদার রচিত গানগুলিতে ঠুমরী ও দাদরার প্রভাব রয়েছে।

এই প্রসঙ্গেই শ্রী অমলেন্দু বিকাশ  করচৌধুরীর একটি লেখনিতে তিনি বলেছেন,[6] “ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের লেখা ও সুর দেওয়া এবং বেগম আখতারের গাওয়া ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’ গানখানিও দাদরা অঙ্গের রাগপ্রধান হিসেবে এক অনুপম সৃষ্টি বলা চলে !“

ঠুমরী সাধারণত রোমান্সধর্মী একপ্রকার উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত। নাটকীয় ভঙ্গিতে গায়ন এবং একের অধিক রাগ – রাগিনীর উল্লেখ ঠুমরীর প্রধান বৈশিষ্ঠ্য। কথার বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে কানহা, কানু, মূরলী, শ্যাম প্রভৃতি ছাড়া প্রায় অধুরা ঠুমরী গানগুলি। যদিও বর্তমানে এগুলি ছাড়াও নানা ধরনের বোল বাকথা দিয়েও রচিত হচ্ছে ঠুমরী ও দাদরা গান।

বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে আখতারজীর জনপ্রিয়তা

বেগম আখতারজীর কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গানগুলি যেমন, জোছনা করেছে আড়ি, ফিরায়ে দিও না মোরে, কোয়েলিয়া গান থামা এবার, চুপি চুপি চলে না গিয়ে, পিয়া ভোলো অভিমান, এই মৌসুমে পরদেশে, ফিরে কেন এলোনা , ফিরে যা ফিরে যা বনে প্রভৃতি গানগুলি বিংশ শতকের বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে এক একটি অমূল্য সম্পদ। উক্ত সমীক্ষা বেগম আখতারজীর কন্ঠ ও গায়কীর মোহনীয়তা এবং প্রসিদ্ধতা ছাড়াও রচয়িতার ভূমিকাকেও কূর্ণিশ জানায়। কথা ও সুরের মালা গেঁথে যারা রাগপ্রধান গানের স্নিগ্ধ ভুবনে আজও ভ্রমণ করিয়ে চলেছেন শ্রোতাদের, তাঁদের অর্থাৎ শ্রী রবি গুহ মজুমদার,  শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শ্রী পুলক ব্যনার্জি প্রমুখ ব্যক্তিত্ত্বদের কাছে চীরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে আগামি প্রজন্মেরা। শ্রী রবি গুহ মজুমদারের সুরে ও কথায় যে কয়টি গান যথাঃ-  চুপি চুপি চলে না গিয়ে, জোছনা করেছে আড়ি, এই মরসুমে পরদেশে, ফিরে যা ফিরে যা বনে প্রভৃতি গানগুলি প্রত্যেকটিই মাদকতার ভেলা । আবার শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত ও সুরারোপিত কোয়েলিয়া গান থামা এবার, ফিরায়ে দিও না মোরে , পিয়া ভোলো অভিমান প্রভৃতি গান গুলিও সুর ও কথার যাদুতে হৃদয়ের গহীনে তৈরী করে এক অসীম শূন্যতার। বাঙালি জাতি তো চীরকালই গীতিপ্রিয়।  পুরোনো কোনো নেশার গন্ধ  আঁকড়ে , ভাবের ভেলায় ভেসে অতলে গা ভাসানো বাঙালি জাতির কাছে এক উপহার স্বরূপ শ্রী রবি গুহ মজুমদার, শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শ্রী পুলক ব্যনার্জির কম্পোজিশনগুলি। বিদূষি বেগম আখতার একজন সুদক্ষ ও সনামধন্য ঠুমরী ও দাদরা শিল্পী হবার জন্য তাঁর কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গানগুলিতেও সেই রেষ থেকে গেছে। অকৃত্রিম কন্ঠের অধিকারী আখতারজী তাঁর গায়কীর মাধ্যমে যে সুধা ঢেলেছেন তা সত্যিই অকল্পনীয়। তাঁর অমিত শক্তিশালী কন্ঠ যেন সুরের ছলে হৃদয়কে সম্মহিত করে নিয়ে যায় কোনো এক অপরিচিত ভুবনে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধূনকে তিনি যে বাংলা রাগপ্রধান গানের মধ্যে কি সাফল্যের সাথে ঢেলে দিয়ে গেছেন, তা বলাই বাহুল্য।

উপসংহার

উক্ত সমীক্ষার শেষে এটুকুই বলতে পারি; জনসমুদ্রে প্রসিদ্ধ হবার এই শ্রেয় হয়তো শুধু গায়ক -গায়িকাদের নয়। গীতের সমগ্র এই সৌন্দর্য্যের দায়ভার সুরোকারদেরও। এবং তারও পরে যারা এই সৌন্দর্য্যকে গ্রহণ করেছেন এবং স্থান দিয়েছেন হৃদয়ে, সেই শ্রোতার ভূমিকাও কম নয়। বাংলা গান যে রূপেই আসুক না কেন সমগ্র বাঙালি জাতিই তাকে গ্রহণ করেছে। শাস্ত্রীয় গানপাগল বাঙালি আখতারজীর গায়কী এবং দরদী কন্ঠে মুগ্ধ চীরকালই। আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও এই গানগুলির আমেজ একটুও পুরোনো হয়নি। বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে আখতারজীর কালজয়ী গানগুলির যে সুর, আবেগ, গায়কী, যাদু, স্তব্ধতা ও জনপ্রিয়তা তা গগনচুম্বী। শুরুর রেষ ধরেই বলতে পারি , বিংশ শতকে শ্রী রবি গুহ মজুমদার, শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ,শ্রী পুলক ব্যানার্জি প্রমুখ বিদ্বানেরা তাঁদের হৃদয় মোড়ানো কথা ও মদিরাবিষ্ট সুরের যা ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে বেগম আখতারজী “ জোছনার “ মতোই মায়াবী স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে তাকে পরিপুর্ণ করে তুলেছিলেন। এবং আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও সেই স্নিগ্ধ আলোর ছটা শ্রোতার হাত ধরে খুঁজে চলেছে সেইসব শোক ও গ্লানির আঘাতে জরাজীর্ণ মনকে, এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে এক টুকরো “ জোছনা “।। 

সাক্ষাৎকার

শ্রী শ্যামল লাহিড়ী (প্রখ্যাত রাগপ্রধান শিল্পী আচার্য্য চিন্ময় লাহিড়ীর পুত্র)

ডঃ প্রদীপ কুমার ঘোষ ( প্রখ্যাত মিউজিকোলজিস্ট )।

তথ্যসূত্র

[1] দত্ত, দেবব্রত, সঙ্গীত তত্ত্ব, দ্বিতীয় খন্ড, ব্রতী প্রকাশনী, ১৯৯৭

[2] Kotharsur.com

[3] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ১০

[4] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ৭১

[5]  জানা, অজন্তা, বাংলা গানে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, Lokogandhar, ২৮.১১.২০১৯

[6] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ১২

সহায়ক গ্রন্থ

১. করচৌধুরী, বিকাশ অমলেন্দু , রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, ফার্মা কে এল এম, প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা ১৯২ চৌধুরী।

২. চৌধুরী, নারায়ণ ,বাংলা গানের জগৎ, ফার্মা  কে এল এম প্রাইভেট লিমিটেড,২৫৭ , বি, বিলিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলিকাতা।

৩. চক্রবর্তী, মৃদুলকান্তি, বাংলা গানের ধারা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুন বাগিচা, রমনা, ঢাকা।

. চক্রবর্তী, সুধীর,  বাংলা গানের চার দিগন্ত, কুন্ডু লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯।

৫. রায়, শ্রীবুদ্ধদেব, বাংলা গানের স্বরূপ, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড,  কলিকাতা-১৯৯০।

৬. করচৌধুরী, বিকাশ, অমলেন্দু, ফার্মা কেএলএম (প্রাইভেট) লিমিটেড, কলিকাতা- ৭০০০১২, ১৯৮৬ , কলিকাতা- ৭০০ ০১২, ১৯৮৬ ।

৭. ডঃ ছায়ারাণী মন্ডল, অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী।

.  Khan Hamza, After 38 yrs, Begum Akhtar’s grave gets due attention, Lucknow, Wed Nov 07 2012, 05:42 hrs

প্রত্যুষা রায়, ইমেলঃ pratyusha03131@gmail.com