March 1, 2023

Tracing the Roots and Evolution of a Percussive Tradition

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Abhi Gharai, Researcher, Sangeet Bhavan, Visva Bharati, Santiniketan

Abstract: This study delves into the rich tapestry of the Pakhwaj, a traditional Indian percussion instrument with a history steeped in cultural significance and musical evolution. From its enigmatic origins in ancient Indian classical music to its transformative journey through various regions and genres, the Pakhwaj has played a pivotal role in shaping the rhythmic landscape. This exploration spans centuries, highlighting key moments and influences that have sculpted the instrument’s distinct character and repertoire. Through an interdisciplinary lens, this research amalgamates historical narratives, musical analysis, and cultural contexts to illuminate the intricate story of the Pakhwaj, shedding light on its enduring legacy and contemporary relevance in the world of music.

পাখোয়াজের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

অভি ঘড়াই, গবেষকসঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন  

ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস এতই বিস্তৃত যে সৃষ্টির ইতিহাসের সঠিক তথ্য নিরূপণ করা আজও মতপার্থক্যের সম্মুখীন। তবে উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন গুণী মানুষ ভিন্নমত পোষণ করেছেন‌। অনাদি কাল থেকেই সঙ্গীতের চর্চা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তবে সঙ্গীতের ভাষাগত এবং শব্দগত প্রভাব সম্বন্ধে সঙ্গীতজ্ঞরা আজও পৌরাণিক মতকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। অবস্থানগত দিক থেকে সঙ্গীতের বহুল পরিবর্তন হয়েছে। গঠনগত ভাবেও বহুবৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। অঞ্চলভেদেও বাদ্যযন্ত্রের বহুল রূপ পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে তার নতুন নামকরণও হয়েছে এবং ব্যবহারিক প্রয়োগও ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। বাদ্যের ব্যবহারের ফলেই গীত ও নৃত্যের সম্যক স্ফুর্তি ঘটেছে বহুকাল ধরেই। এই প্রসঙ্গে শারঙ্গদেব রচিত ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে – 

                          “গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে”।[1]

  – অর্থাৎ গীত, বাদ্য এবং নৃত্য এই তিনটি হলো সঙ্গীতের অঙ্গ। গীত, বাদ্য এবং নৃত্যের মাধ্যমে আনন্দপিয়াসী মানুষ সঙ্গীতের রসাস্বাদন করে থাকেন। সঙ্গীতের অন্যতম একটি ধারা হলো বাদ্য। ভরতমুনি ‘নাট্যশাস্ত্রে’ রসের উপসৃজনে বাদ্য সম্পর্কে বলেছেন(নাট্যশাস্ত্র ছয় নম্বর অধ্যায়)[2]

“শৃঙ্গারহাস্যযোগে বাদ্যং যোজ্যং তথাহর্চিতেমার্গে                                 

বীরাদ্ভুত রৌদ্রাণাং বিতস্তমার্গেণ বাদ্যং তু।                                 

করুণরসেহপি হি বাদ্যং যোজ্যং হ্যালিপ্তপ্রকরণ মার্গেতু

বীভৎস ভয়ানকয়োস্তথৈব নিত্যং হি গোমুখ্যা।।”

 অর্থাৎ- শৃঙ্গার ও হাস্য রসের যোগ থাকলে আর্চিতমার্গে বাদ্যের প্রয়োগ করতে হবে। বীর, অদ্ভুত এবং রৌদ্র রসের যোগ থাকলে বিতস্তমার্গে বাদ্যের প্রয়োগ করতে হবে। করুণ রসের ক্ষেত্রে আলিপ্তমার্গে বাদ্যের প্রয়োগ করতে হবে। বীভৎস এবং ভয়ানক রসের যোগে গোমুখীমার্গে বাদ্যের প্রয়োগ করতে হবে। নটি রস হলো- ১) শৃঙ্গার, (২) বীর, (৩) করুণ, (৪) অদ্ভুত, (৫) হাস্য, (৬) ভয়ানক, (৭) বীভৎস, (৮) রৌদ্র এবং (৯) শান্ত । তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো নাট্যশাস্ত্রে আটটি রসের কথা আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে শান্ত রস সম্বন্ধে একমাত্র আলোচনা করা হয়নি।

শারঙ্গদেব বাদ্যযন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-  “এতদ্ হস্ত সমাযোগাদ্বাদনং বাদ্যমুচ্যতে”। [3] অর্থাৎ হাতের সাহায্যে যা বাজানো হয় তাই বাদ্য। এতে চামড়া লাগিয়ে হাত বা কাঠের লাঠির দ্বারা আঘাত করে স্বর উৎপন্ন করা হয়। সঙ্গীতে তাল রক্ষা করার জন্য বিশেষত এই প্রকার বাদ্যযন্ত্র বেশি ব্যবহৃত হয়। যেমন- মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, তবলা প্রভৃতি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।

৪. সুষির বাদ্য – বায়ুর সাহায্যে এই সকল যন্ত্রের স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- বাঁশী, হারমোনিয়াম, সানাই প্রভৃতি। এই প্রকার বাদ্যযন্ত্র আবার দুই শ্রেণীর-

ক)  যেগুলি [i]রীড্[4] এর (ধাতু নির্মিত পাত বা পাত্তি) সাহায্যে স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- হারমোনিয়াম।

খ) যেগুলিতে বায়ু দ্বারা ছিদ্রপথে স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- বাঁশী, সানাই প্রভৃতি।


[1] তবলা বিজ্ঞান, ইন্দুভূষণ রায়, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫

[2] ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ , দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৩২

[3] তবলা বিজ্ঞান, ইন্দুভূষণ রায়, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৬

[4] রীড্ – ধাতুনির্মিত পাত


[i] রীড্- ধাতুনির্মিত পাত। অবনদ্ধ শ্রেণীর বাদ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হলো মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ বাদ্যযন্ত্র। “মৃন্ময়ং অঙ্গং যস্য স মৃদঙ্গঃ” – মাটি যার অঙ্গ সেই মৃদঙ্গ অর্থাৎ মাটির দ্বারা গঠিত বাদ্যযন্ত্রকে মৃদঙ্গ বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনী থেকে আমরা পাই, মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে বধ করার পর, ভগবান্ ব্রহ্মা সেই অসুরের রক্তে ভেজা মাটি দিয়ে মৃদঙ্গের অঙ্গ তৈরি করেছিলেন, অসুরের চামড়া দিয়ে য ভরতমুনি লিখিত নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থের (আনুমানিক দ্বিতীয় শতকে) অষ্টাবিংশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

” ততং চৈবাবনদ্ধং চ ঘনং সুষিরমেব চ।

চতুর্বিধং তু বিজ্ঞেয়মাতোদ্যং লক্ষনাম্বিতম্”।

    – অর্থাৎ ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই চারটি ভাগ হলো ১.তত বাদ্য, ২.ঘন বাদ্য, ৩.অবনদ্ধ বাদ্য, ৪.সুষির বাদ্য।

১. তত বাদ্য – তাঁত অথবা তারে আঘাত করে এই সকল যন্ত্রের  স্বর উৎপাদন করা হয়। যেমন- বীণা, তানপুরা, সেতার, এসরাজ প্রভৃতি। ততবাদ্য আবার তিন প্রকার-

ক) যে সকল যন্ত্রের তারে আঙ্গুল দিয়ে আঘাত করে স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- তানপুরা, একতারা প্রভৃতি।

খ) যেগুলি মিজরাব, জবা প্রভৃতি ধাতু বা তার নির্মিত কোন বস্তুর সাহায্যে স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- বীণা, সেতার,সরোদ প্রভৃতি।

গ) যে সকল যন্ত্রের তারে বা তাঁতে গজ বা ছড় টানিয়ে স্বর উৎপাদন করা হয়। যেমন- এসরাজ, বেহালা, সারেঙ্গী, দিলরুবা প্রভৃতি।

 অনেকে এই প্রকার বাদ্যকে আবার ‘বিতত’ বাদ্যও বলে থাকেন। তবে এই নিয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে।

২. ঘন বাদ্য- এই প্রকার বাদ্য কোন ধাতুর উপর বা অন্য কোন বস্তুর উপর ধাতু বা কাষ্ঠখন্ড দ্বারা আঘাত করে স্বর উৎপন্ন করা হয়। যেমন- মঞ্জিরা, মন্দিরা, কাঁসর, ঝাঁঝ, করতাল প্রভৃতি এই শ্রেণীর  অন্তর্গত।  

৩. অবনদ্ধ বাদ্য- এই প্রকার বাদ্য কাঠ অথবা ধাতু বা মাটির আধার দ্বারা গঠিত হয়। তন্ত্রের দুই মুখের ছাউনী, শিরা থেকে ছোট এবং হাড় কেটে মৃদঙ্গের গুলি তৈরি করেছিলেন। পরে মহাদেব গনেশকে মৃদঙ্গ শিক্ষা দেন।

অনেকের ধারণা যে, মাটির মৃদঙ্গ দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের সময় থেকে কাঠের তৈরি হতে থাকে। গীতার প্রথম অধ্যায়ের ১৩নম্বর শ্লোকে আমরা “ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানক গোমুখাঃ” এই লাইনটি পাই। তাতে ‘পণব’ নামটি দেখতে পাচ্ছি। গীতার ব্যাখ্যাকারেরা পণব শব্দটির অর্থ মৃদঙ্গ বলেছেন। আবার মহাভারতের বিরাট পর্বে “পণবাদিকাশ্চ তথৈব বাদ্যানি চ বংশশাব্দাঃ” শ্লোকেও ‘পণব’ নামক বাদ্যটিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং বাদ্যটি যে যুদ্ধে ব্যবহৃত হতো সেটাও আমরা জানতে পারছি। তবে সেই সময় সকল মাটির তৈরি বাদ্যকেই মৃদঙ্গ বলা হতো একথাও পরবর্তী সময়ে সঙ্গীতজ্ঞরা বলেছেন।  তবে এই বিষয়ে অনেক গল্পকথা আছে সেসব নিয়ে আমরা এখানে আর আলোচনা করলাম না। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে মৃদঙ্গের প্রচলন বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের ১৫শ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণের সময়েও এর নাম পাওয়া যায়। নাট্যশাস্ত্রকার ভরতের লেখনীতে দেখা যায়, সঙ্গীতশাস্ত্রী স্বাতি মৃদঙ্গের অনুকরণে পুষ্করাদি যন্ত্র সৃষ্টি করেছিলেন এবং ভরতের জন্মের আগে থেকেই যন্ত্রটির প্রচলন ছিল তার প্রমাণও পাওয়া যায়। মৃদঙ্গে গাব লাগানোর পদ্ধতি তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন এবং মনে করা হয় যে কাঠের মৃদঙ্গ তারই আবিষ্কার। মৃদঙ্গের তিন রকম রূপের কথা নাট্যশাস্ত্রে পাওয়া যায় এবং যন্ত্রটি মাটির তৈরি ছিল তা জানা যায়। হরিতকি আকৃতি, যব আকৃতির এবং গোপুচ্ছ আকৃতির এই তিন প্রকার মৃদঙ্গের অঙ্গের নাম এবং বর্ণনা পাওয়া যায়। গোপুচ্ছাকৃতি মৃদঙ্গটি গরুর লেজের মত একদিক মোটা এবং অপর দিকটি সরু আকৃতির ছিল। হরীতকী ফলের আকৃতির মৃদঙ্গকে হরীতকী আকৃতির মৃদঙ্গ বলা হতো। যবের আকৃতির মতো মৃদঙ্গকে যব আকৃতির মৃদঙ্গ বলা হতো। মোঘল যুগে “আওয়াজ” নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। যন্ত্রটি দেখতে পখাবজের মতোই ছিল, তবে আকারে কিছু ছোট (অনেকটা বর্তমান মাঝারি মাপের মাদলের মতো দেখতে ছিল)। প্রাচীন মৃদঙ্গ থেকেই বর্তমান পাখোয়াজ বাদ্যটি এসেছে এটি নিশ্চিত। কারণ ফার্সী ভাষায় পখাবজকে তরঙ্গ বলে। পাক্ক অর্থাৎ পাকা এবং আওয়াজ অর্থাৎ ধ্বনি অথবা পাক অর্থাৎ পবিত্র ও আওয়াজ অর্থাৎ ধ্বনি এই ভাবে পবিত্র ধ্বনিকারক বলেই যন্ত্রটির নাম পাখোয়াজ হয়েছে এরূপ মনে করা হয়। তবে এই বিষয়েও অনেক মতপার্থক্য আছে। পনেরশো শতাব্দীতে পার্শ্বদেবের কালে জনৈক স্থানাঙ্গ সূত্রে অবনদ্ধ জাতীয় বাদ্য-সঙ্গীতের তালিকায় পুখারগায়া(Pukharagaya) নামে বাদ্যযন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে ১৪০৬ খ্রী. সিতাম্বরদলীয় জৈন সঙ্গীতশাস্ত্রী সুধাকলশ রচিত “সঙ্গীতোপনিষৎ সারোদ্ধার” নামক গ্ৰন্থে পটহকে আউজ বলা হয়েছে। এই বইতেই আমরা প্রথমে “পখাউজ” শব্দটি পাই। তাছাড়া, সঙ্গীত রত্নাকরের বাদ্যাধ্যায়ে দেখতে পাই যে প্রায় সমস্ত রকমের অবনদ্ধ বাদ্যকেই”আবজ” (অপভ্রংশ হয়ে আউজ শব্দটি এসেছে) বলা হতো। পুখারগায়া নামটি আমরা আগেই পেয়েছি, এখন পুখারগায়ার “পুখা” শব্দটির সহিত যদি “আবজ” কথাটি যুক্ত করা যায় তবে পুখা+আবজ= পুখাবজ এবং তারই অপভ্রংশে হিন্দি শব্দ পখাবজ জন্ম নিয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। আবার পখাউজ থেকেই পখাবজ শব্দটি এসেছে এটা ভাবা যেতেই পারে। মুসলিম যুগের বইতেই পখাবজ শব্দটির প্রচলন আমরা দেখতে পাই।

              কালক্রমে সময়ের গতি ধারায়, বর্তমানে পাখোয়াজকে মৃদঙ্গ নামেও অভিহিত করা হয়। তবে আধুনিক মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজের আকৃতি, বোলবাণী এবং বাদন পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পুরাকালে মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজকে আমারা সঙ্গতকারক বাদ্য হিসাবেই বেশি দেখতে পেয়েছি। সেখানে বোলবাণীর বা তালেরও এতো প্রকার আমরা দেখতে পাইনি। বোধগম্য হচ্ছে যন্ত্রটি বেশি পরিমাণে মাঙ্গলিক কাজে আরাধনার জন্য ব্যবহৃত হতো।

               বর্তমান সময়ে আমরা কাঠের তৈরি পাখোয়াজের যে রূপ দেখতে পারছি তার গঠন বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করছি। পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গ যন্ত্রটি মাটিতে বা বলে রেখে শুয়ে বাজানো হয়। মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজের দেহটি একটি মাত্র কাঠামোতেই আবদ্ধ। কাঠামোটি নিম, শিশু, চন্দন, খয়ের, কাঁঠাল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। তবে শারঙ্গদেবের ‘সঙ্গীতরত্নাকর’ গ্রন্থে বাদ্যাধ্যায়ে আমরা পাই-                                                    “শ্রেয়োদারববাদ্যানাং খদিরো রক্তচন্দনঃ”। সেইসময় অঙ্গটি রক্তচন্দন কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। এই মৃদঙ্গের দুটি মুখ। দুইটি মুখের একটিকে  দক্ষিণ এবং অপরটিকে বামক বলা হয়। মূল অঙ্গটির কাঠের ভিতরটা ফাঁপা এবং দুদিকেই ফাঁকা থাকে, ঐ দুই দিক ছাউনী অর্থাৎ চামড়ার দ্বারা আবদ্ধ থাকে। তাকে চামড়ার ছট দিয়ে ডান দিকের (১)পাগড়ীর সাথে বামদিকের পাগড়ী পর্যন্ত (২)ছট দিয়ে টানা থাকে। ছটের সংখ্যা ৩২টি। এই ছটের ভিতরে ৮টি কাঠের গুলি থাকে, তার মাধ্যমে প্রয়োজন মতো যন্ত্রের সুর বাঁধা হয়। প্রয়োজনে ১টি ছট থেকে ৪টি গুলিতে পর্যন্ত ছট তোলা হয়ে থাকে তাকে হাতুড়ির মাধ্যমে আঘাত করে প্রয়োজনীয় সুর বাধা হয়। ডানদিকের ছাউনীতে ৩টি অংশ থাকে, মাঝখানে থাকে কালো রঙের (৩) ‘গাব’ বা ‘স্যাহী’। মধ্যকার সাদা অংশটিকে বলা হয় সুর, লব বা ময়দান। ধারের দিকে এক ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চি পরিমাণ আলাদা একটি চামড়ার আচ্ছাদন থাকে। তাকে বলে ‘কানি’ বা ‘কিনার’। সাধারণতঃ পাখোয়াজের বা মৃদঙ্গের ডান দিকের ছাউনীর ব্যাস ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি এবং বামদিকের ছাউনীর ব্যাস ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি হয়ে থাকে। পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গের বামদিকে প্রায় ডানদিকের মতোই ছাউনী করা থাকে কিন্তু স্থায়ীভাবে কোন ‘গাব’ করা হয় না। যন্ত্রটি বাজাবার আগে বামদিকে আটার প্রলেপ দিয়ে নেওয়া হয়, ডানদিকের সহিত সুরের সামঞ্জস্য রাখার জন্য প্রয়োজনমত আটার পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো হয়। স্বর উঁচু করতে হলে আটার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয় এবং স্বর নিচু করতে হলে আটার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই প্রলেপের কম-বেশীর উপর বামদিকের মন্দ্রধ্বনির তারতম্য নির্ভর করে। সাধারণতঃ মধ্যসপ্তকের ষড়জ(সা) অথবা মধ্যসপ্তকের পঞ্চম (পা) ও মধ্যমে(মা) যন্ত্রটির সুর বাঁধা হয়। পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গের ধ্বনি খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ। বিশেষতঃ ধ্রুপদ, ধামার প্রভৃতি এই রকম সঙ্গীতের সাথে এই যন্ত্র সঙ্গত করা হয়।

বর্তমান পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গের পরিভাষা বা বর্ণ হলো ৮টি। ডান হাতে বাজানো হয় ৫টি বর্ণ এবং বাম হাতে বাজানো হয় ২টি বর্ণ।  উভয়হাতে বাজানো হয় ১ টি বর্ণ।

ডান হাতের বর্ণ                  বামহাতের বর্ণ           উভয়হাতের বর্ণ

১) তা                            ১) ক                      ১) ধা                                                   

২) দি                              ২) ঘ

৩) না                            

৪) তে

৫) টে

                তা, দি‌, না এই তিনটে বর্ণ ডানহাতের খোলা বোল। তে, টে এই দুটি বর্ণ ডানহাতের বন্ধ বোল। ক এবং ঘ বর্ণ দুটি হলো বামহাতের বন্ধ বোল। ধা ডান এবং বাম উভয়হাতের দ্বারা একসাথে বাজানো হয়। খোলা বোলের আওয়াজ পরিষ্কার হয় এবং সুরের রেশ থাকে। বন্ধ বোলের আওয়াজ চাপা হয়। অন্যান্য বোলগুলি  আটটি বর্ণের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়।

           পুরাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বহু উত্থান পতনের এবং বিবর্তনের, নামকরণের সাক্ষি থেকেছে মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ বাদ্যযন্ত্রটি। গঠনগত দিক যেমন বিবর্তন ঘটেছে, বাদনগত দিক থেকেও নতুন রূপ লক্ষ্য করা যায়। নামকরণ নিয়ে নানা মুনি নানা মত পোষণ করলেও, মানুষের অনুসন্ধিত্সু মন আজও আসল নামকরণের শিখরের সন্ধানে অন্বেষণ করে চলেছে। কালে কালে এই বাদ্যযন্ত্রটি গুরুমুখী শিক্ষার বাধা পেরিয়ে আজ বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বহু গুণে মানুষ কেউ অধ্যাত্মসাধনা, কেউ বা ভালোবাসার তাগিদে নিজেদের মধ্যে একাত্ম করে ফেলেছেন এই বাদ্যযন্ত্রটিকে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি ব্যক্তিরা। নামকরণের সঠিক নিরূপণ করা গেলেও যন্ত্রটি নিজেও বৈচিত্র্যে নিজের স্থায়িত্ব বজায় রেখে চলেছে। বর্তমানে কাঠের অঙ্গ পরিত্যাগ করে ধাতুর অঙ্গ বহন করছে। এতে হয়তো শব্দের পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু নামের পরিবর্তন একই থাকছে। ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্য প্রাচীন। এই বাদ্যযন্ত্রটি অন্য বিবর্তিত বাদ্যযন্ত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে আজও স্বমহিমায় বাদিত হচ্ছে। লোকসমাজে তার সমস্ত অতীতকে পরিত্যাগ করে বর্তমানকে পাথেয় করে এই বাদ্যযন্ত্রটি নিজ গুণে শব্দের কম্পনে আমাদের মোহিত করছে।

তথ্যসূত্র:-

১. রায়চৌধুরী, বিমলাকান্ত, ভারতীয় সঙ্গীতকোষ, শ্রীমতি মঞ্জু ভট্টাচার্য, ৮৬/১৪, পূর্ব সিঁথি রোড, কলকাতা-৩০, তৃতীয় প্রকাশ, বৈশাখ ১৪১৬ বঙ্গাব্দ।

২. দত্ত, দেবব্রত, সঙ্গীত-তত্ত্ব (১ম খন্ড), ব্রতী প্রকাশনী, ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩।

৩. দত্ত, দেবব্রত, সঙ্গীত-তত্ত্ব (২য় খন্ড), ব্রতী প্রকাশনী, ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩।

৪. ভট্টাচার্য্য, দুলাল, পরীক্ষার তবলা, বিশশতক, অধ্যাপক শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়, ৫, ডাঃ অক্ষয়পাল রোড, কলকাতা-৩৪।

৫. রায়, ইন্দুভূষণ, তবলা বিজ্ঞান (১ম খন্ড), আদিনাথ ব্রাদার্স, ৯, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩, দ্বিতীয় সংস্করণ- মে ২০১৫।

৬. রায়, ইন্দুভূষণ, তবলা বিজ্ঞান (২য় খন্ড), আদিনাথ ব্রাদার্স, ৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩, দ্বিতীয় সংস্করণ- মে ২০১৫।

৭. https://hi: wikipedia.org/wiki/ (সংগ্রহের তারিখ: ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।

৮. অধ্যাপক স্বপন কুমার ঘোষ মহাশয়ের ক্লাস লেকচারের আলোচনা থেকে (সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী ২০১২-১৬ A.D)।

৯. শ্রী প্রবাল নাথ মহাশয়ের ক্লাস লেকচারের আলোচনা থেকে (আন্দুল, হাওড়া ২০১৮-১৯ A.D)।

১০. http://www. gitabitan.com/lyrics/T/anonter banitumi.html(সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)।

১১. Agrawal.O.P., Preservation of Art Objects, publication – NBT. INDIA, New Delhi -70, ISBN 978-81-237-0643-6, 2011।

                                        ***********