January 1, 2022

ছ’য়ের দশকে বহুরূপীর রবীন্দ্র নাটক ও শম্ভু মিত্রের নাট্য প্রযোজনা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

কৃষ্ণপদ দাস

(ভূমিকা আধুনিক বাংলা-নাট্যের আলোচনায় অন্যতম ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র। অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক এবং সংগঠকের ভূমিকায় থেকে প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের সূত্রপাতের জনক তিনিই। প্রথম গ্রুপ থিয়েটার ‘বহুরূপী’ — যা তৈরীর কৃতিত্ব শম্ভু মিত্রের। গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে নিয়ে ‘বহুরূপী’ খুব স্বল্প সময়েই বিশেষ উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে রবীন্দ্র-নাট্যের প্রযোজনা দিয়ে — যা পাঁচের দশক থেকে শুরু হয়েছিল। পাঁচের দশকে ‘রক্তকরবী’, ছয়ের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ‘বিসর্জন’ ‘রাজা’ নিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠে বহুরূপী। বহুরূপীর পাশাপাশি এল নান্দীকার, শৌভনিকের মত নাট্যদল। তবে আমার এই মুহূর্তের উপস্থাপনা শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাট্যভাবনা এবং বহুরূপীর নিজস্ব প্রযোজনায় রবীন্দ্র-নাটক।)

স্বাধীনতা উত্তর বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাদের প্রায় সকলেই গণসংস্কৃতির প্রশস্ত রাস্তায় পা মিলিয়েছিলেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ করে ভারতের শ্রমজীবী মানুষের । মনেও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরিত হয়। স্বাধীনতা দেশপ্রেম ও মানবমুক্তির । সংজ্ঞায় শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব যুক্ত হল । এরই পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত গণনাট্য সংঘের কর্মসূচিতে যে সকল প্রগতিশীল শিল্পী-নাট্যকর্মী এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন যুবক শম্ভু মিত্রও । গণনাট্য সংঘের ‘ল্যাবরেটরি’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’ নাটকের প্রযোজনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তার । অভিনয়ে ও পরিচালনায় তার দক্ষতা স্বীকৃত হয় । কয়েক বছর বাদে গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে শম্ভু মিত্র ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সম্মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা (১৯৫০, ১ মে) । বাংলা নাটকের ইতিহাসে সূচিত হল এক স্মরণীয় পর্ব ।

বহুরূপীর নাট্যাদর্শ  ও প্রযোজনারীতি গণনাট্য সংঘের পথে অগ্রসর হয়নি বলে শম্ভু । মিত্র সমালোচিত হলেও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি । বিশেষ করে রবীন্দ্রনাটকের । উপস্থাপনা ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল স্রষ্টার । রবীন্দ্ৰনাটকের ব্যাপক পরিচিতির মূলেও তাঁর অবদান বিস্মৃত হবার নয় । সে কারণেই বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্যকার কুমার রায় বলেছেন –

“ভারতীয় থিয়েটারের রূপরেখা শম্ভু মিত্র প্রযোজিত, নির্দেশিত রবীন্দ্রনাটক অবলম্বন করেই আঁকা যায় । যে ইতিহাস তিনি এ ক্ষেত্রে তৈরি করে গেছেন তাকে । আজকের বিশ্লেষণী চোখে, আজকের দূরত্বে কেউ হয়তো বিচার করতে পারেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনায় তার সাফল্য অস্বীকার করা যায় না ।”

পাঁচের দশকেই বহুরূপী রবীন্দ্রনাটককে এক বিশেষ উচ্চতায় তুলে ধরেছিল । ছয়ের দশকেও বহুরূপীর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু দলও রবীন্দ্রনাটকের একাধিক প্রযোজনা করেছে । ১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ । সেই জন্যে রবীন্দ্রনাটক অভিনয়ের একটা নতুনতর প্রচেষ্টা দেখা দিচ্ছিল । বহুরূপীর ‘বিসর্জন’ ও ‘রাজা’ ছাড়াও নান্দীকার অভিনয় করেছে ‘চার অধ্যায়, সুন্দরম ‘ডাকঘর’ এবং শৌভনিক মঞ্চস্থ করেছে একাধিক রবীন্দ্ৰনাটক ‘রাজা ও রাণী’, ‘তাসের দেশ’, ‘বাঁশরী’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষ রক্ষা । থিয়েটার ইউনিট প্রযোজনা করেছে ‘নৌকাডুবি’ ও ‘শোধবোধ’। আসলে রবীন্দ্র নাট্যভাবনা, নাট্যাঙ্গিক সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছে বোধগম্য না হওয়ায় রবীন্দ্রনাটককে । বহুকাল মঞ্চনীরব থাকতে হয়েছে । শম্ভু মিত্র আদ্যন্ত একটি ভারতীয় নাট্যকলার সন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন,  সেই সূত্রে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের কথাও ভাবতেন । ঐতিহ্য কী, আধুনিকতা কী এসব ভাবতে ভাবতেই ‘আধুনিক কালকে বুঝতে বুঝতে, ব্যক্তি ও সমাজের বন্ধনকে ও দ্বন্দ্বকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে করতে, পথ । চলে এল প্রাক্তন যুগের এক রবীন্দ্রনাথের প্রাঙ্গণে ।

শম্ভু মিত্রই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও নাট্যভাষা আয়ত্তে এনেছিলেন বুদ্ধি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে এবং আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে, বিজ্ঞানীর মতো অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে । তাই একথা আজকে কেউ অস্বীকার করবেন না যে, তিনি একটা যুগ তৈরি করে গেছেন— ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করেই; তিনি রবীন্দ্রনাটককে মঞ্চে পুনরাবিষ্কার করে গেছেন ।

(ক) বিসর্জন

রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন’ নাটকটি বহুরূপীর প্রযোজনায় ও শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় দিল্লির । আইফ্যাক্স হলে মঞ্চস্থ হয় ১৯৫১ সালের ২৭ অক্টোবর। এই নাটককে সময়োপযোগী । করে মঞ্চস্থ করেছিল বহুরূপী । এই নাটকের বার্তা দেশকালজয়ী । কেননা যুগে যুগে সব । দেশে আদর্শের নামে, ধর্মের নামে নরমেধ যজ্ঞ অতীতেও ঘটেছে, আজও ঘটছে । ১৯১৬-তে ‘বিসর্জন’-এর ইংরেজি রূপান্তর ‘স্যাক্রিফাইস’ রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন জাপানের পথে জাহাজের ডেকে বসে, এক বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধ তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে দেশ-বিদেশের নগর প্রান্তরকে করেছে প্লাবিত । উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন— “I dedicate this play to those heros who bravely stood for peace when human sacrifice was claimed for the God of war”. ‘রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এই নাটকে প্রেম আর প্রতাপের মধ্যে ভাবের বিরোধ বেঁধেছে । একদিকে অহিংস প্রেম, অপর দিকে সংস্কারাশ্রয়ী হিংসার উন্মত্ত উল্লাস । একদিকে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের অটল আদর্শনিষ্ঠা ও আত্মপ্রত্যয়, অন্যদিকে শক্তির উপাসক রঘুপতির মোহান্ধতা ও  দাম্ভিক ব্রহ্মতেজ— এই দুয়ের সংঘাতে দিশাহারা জয়সিংহের দুঃসহ চিত্তদাহ, যার চরম নিবৃত্তি আত্মবিসর্জনে । রাজর্ষি গোবিন্দমাণিক্যের অঞ্চল স্থিতপ্রতিষ্ঠ আদর্শ বিশ্বাসে রানি গুণবতীর দেশাচারমূলক অন্ধ আবেগ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাহৃত রঘুপতি আত্মপ্রেমের কাছে নিষ্কলুষ জয়সিংহের আত্মবলি করুণ রসকে আরো ঘনীভূত করে । তুলেছে, অন্যদিকে অপর্ণা তার রিক্ততা হাহাকার ও বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে দর্শকদের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে । প্রেয় ও শ্রেয়র দ্বন্দ্বে জয়সিংহ ক্ষতবিক্ষত, সত্য ও মিথ্যার মায়ায় দোদুল্যমান; রঘুপতি অন্ধ বিশ্বাস ও হিংস্র সংস্কারের নাগপাশ থেকে মানবিক প্রেম ও প্রীতিতে উত্তীর্ণ । সমগ্র নাটকের সার্থক রূপায়ণে দর্শকবৃন্দ সংঘাতের শিখরে বিচরণ করতে করতে স্তম্ভিত বিস্ময়ে উপনীত হন এক মঙ্গলময় পরিণতিতে, যেখানে বজ্ৰদগ্ধ । পুরোহিত রঘুপতি অশ্রুধৌত পরিশোধিত চিত্তে সাড়া দেয় অর্পণার আহ্বানে ।

সেকালের অনেক সমালোচক বলেছেন যে মঞ্চের চরিত্রদের যে কোনও রকম একমুখী ভাবকে পরিচালক বর্জন করেছিলেন বলে তারা হয়ে উঠেছিল রক্ত-মাংসের স্ত্রী-পুরুষ, সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে যাদের সহজেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ৩ ধীরস্থির দয়াবান গোবিন্দমাণিক্য (কুমার রায়) যে কত নিঃসঙ্গ, তার স্ত্রী বা তাই । তার অতরের অংশভাগ নয়, তা যেমন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, তেমনি প্রথানিষ্ঠ, প্রাণ । হত্যায় দ্বিধাহীন, ধর্মের নামে মিথ্যাচারের অসংকোচ, আপাত দৃষ্টিতে নিষ্ঠুর রঘুপতি । (অমর গাঙ্গুলী) যখন জয়সিংহের আত্মবলিতে হাহাকারে ভেঙে পড়েন, তখন গর্বোদ্ধত অহংকারের অন্তরালে সুগভীর স্নেহের প্রবাহ আর গোপন থাকে না, আর জয়সিংহের (শম্ভু মিত্র) দুই পরস্পরবিরোধী প্রত্যয়ের মাঝখানে পড়ে যে দোদুল্যমানতা, তা শুধু দুটি ভাবের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার নয়রঘুপতি ও গোবিন্দমাণিক্য দুজনের সঙ্গেই তার হৃদয়ের, জীবনের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য । শিশুকাল থেকে রঘুপতি তাকে মানুষ করেছে; কালী মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতির । সঙ্গে মিশে আছে রঘুপতির প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা, সেখানে ভিন্নমুখী টান দিয়েছে । শুধু গোবিন্দমাণিক্যের স্বভাবসঙ্গত প্রত্যয় নয়, তাকে জোরদার করেছে রাজার নির্মম, নির্ভয় ব্যক্তিত্ব । আর তাতে প্রেমের স্পর্শ এনেছে সরল, একাকিনী বালিকা অপর্ণা । কিন্তু দর্শককে গভীরভাবে আলোড়িত করে জয়সিংহের আত্মবলি । অবশ্য তাকেও । ছাপিয়ে যায় রঘুপতির মমদ শোকসন্তাপ । কালী প্রতিমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আগে তার সেই আর্ত হাহকার—

“দে ফিরায়ে জয়সিংহ মোরে ! দে ফিরায়ে ! দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী ! শুনিতে কি পাস আছে কর্ণ ? জানিস কী করেছিস ? কার রক্ত করেছিস পান ?”

‘বিজর্সন’-এর স্মারক পত্র থেকে জানা যায়—

“পৃথিবীর অজস্র রাজনৈতিক বেদীর সামনে আদর্শের নামে, ভবিষ্যতের নামে, ঐতিহ্যের নামে ব্যক্তিগত মানুষের সুখ, দুঃখ আশা আর ভালোবাসা সমস্ত কিছুকে । অবজ্ঞায় ভূলুণ্ঠিত করে এক বিরাট নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন ইচ্ছা । সমাসন্ন সেই ভয়ঙ্কর বিসর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো ‘বিসর্জন’ নাটকে বাঁচবার পথের একটা দিশা পাব ।”

‘বিসর্জন’ নাটকের সঙ্গে সরাসরি হয়তো মধ্যবিত্ত জীবনে সম্পর্ক নেই । তাই, রঘুপতির দম্ভ, গোবিন্দমাণিক্যের আজ্ঞা দেশকালোত্তীর্ণ মানবের সঙ্কট । রবীন্দ্রনাট্যে শ্রেণি-উত্তীর্ণ যে কোনও মানবের আর্তনাদ শোনা যায় । তবুও নাটক অবশ্যই মধ্যবিত্ত জীবনপ্রান্ত স্পর্শ করে থাকে। বিশেষত বহুরূপীর বিশিষ্ট প্রযোজনারীতি ও সমকালীনতার জন্য ।

আসলে জয়সিংহের এই দাহ দেখা দিয়েছে হৃদয়ের দুটি পরস্পর গতি থেকে । একদিকে পশুবলির প্রতি বিতৃষ্ণা, অন্যদিকে গুরুর প্রতি আনুগত্যের অভ্যাস জয়াসহ চিরকাল থেকে গেছে এই দুয়ের মাঝখানে । কিন্তু বর্তমান অভিনয়ে এই অন্তর্দাহের মূল । কারণগুলি যেমন একদিকে স্পষ্টতর শব্দে ধ্বনিত হয়েছে— এত স্পষ্ট এবং মর্মভেদী আর কখনো শুনিনি, তেমনি অন্যদিকে একালের এযুগের কতকগুলো ভাবানুষঙ্গ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । এরা অস্পষ্ট ব্যঞ্জনার মতো, তবু তারা অর্থবহ । জয়সিংহ শুধু রঘুপতি নামক পণ্ডিত, দাম্ভিক পুরোহিতের দ্বারা আবদ্ধ নয়, সে প্রথার দাসত্বে আবদ্ধ । কিন্তু অভিনয়ের ব্যঞ্জনা এইখানে যে সে একালের ভাবানুষঙ্গ এনে দাঁড় করাচ্ছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই প্রথা শুধু ধর্মের, মন্দিরের, দেশাচারের প্রথাও নয় । বারবার মনে হয়েছে এ জগতে, এ যুগে তাছাড়াও আরও প্রথা আছে যে নিষ্ঠুর স্পর্ধিত, যে প্রথার কাছে আমার জয়সিংহ প্রতিদিন আত্মরক্তদানে নিহত। এ-কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের, যা নাটকের চিরন্তন বাণী । নাটকের এই চিরন্তন বাণীর ব্যঞ্জনা মানব-সঙ্কটকেই নতুন রূপে আমাদের চেনায় । ছয়ের দশকের ভারতের রাজনৈতিক সঙ্কট, দেশনেতাদের দোলাচলতা, অসংখ্য প্রাণের নিত্য বলিদানের কথা এ প্রসঙ্গে মনে জাগে । ক্ষমতার সেই উল্লাস এর বিষয়বস্তুকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে ।

“But Sambhu Mitra has given it through passion, movement and action a certain dimension. His interpretation goes beyond the surface story of king Gobindamanikya’s edict blood sacrifice and emphasizes of humanism and Love.”

এই নাটকটিতে জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র স্বয়ং । ১৯৬১-র নভেম্বর ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকায় শম্ভু মিত্র পরিচালিত এ অভিনীত ‘বিসর্জন না ? সম্পর্কে লেখা হয়—

“But it is not in individual performance that ‘Visarjan’ serves the highest praise. Its claim to wider recogniu that Sambhu Mitra is doing the same kind of work o Bengali Stage as Satyajit Roy is doing on the Bengali Screen; and this is not praising Sambhu Mitra too much. The importance of dialogue in productions to non-Bengali audiances; but I am happy to learn that that the group’s recent performances in New Bohurupee’s, may help integrate the country, whatever the theme.”

যুগান্তর পত্রিকা ‘বিসর্জন’-এর অভিনয় সম্পর্কে লেখে—

“…বহুরূপীর কৃতিত্ব এবং মৌলিকতা এইখানে যে, তারা বিসর্জনের কোনও আক্ষরিক অর্থকে বিনষ্ট হতে না দিয়েও একটি প্রবল আবেগময়, নিষ্ঠুর যন্ত্রণাদায়ক উপলব্ধিকে সার্থকভাবে অনুবাদ করেছেন ।… নাটকের প্রশ্নগুলির সঙ্গে তারা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সমসাময়িক চিন্তার উত্তাপ এনে যুক্ত করেছেন । এই উত্তাপ বর্তমানকে চিরন্তনের সঙ্গে যুক্ত করেছে । এই উত্তাপ আমাদের অন্তরের সংঘাতকে রবীন্দ্রনাটকের অন্তর্নিহিত সংঘাতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ।”

‘বিসর্জন’-এর পর রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকটি বহুরূপী  মঞ্চস্থ করল  ১৯৬৪ সালে । নাটকটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারকে উপহার দিয়েছিলেন এক অন্য অভিজ্ঞতা । ‘রাজা’ একটি আত্ম-জাগরণের নাটক । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—

“…the human soul has its inner drama, which is just same as any thing else that concers man.”

একক মানুষ বাইরে এবং ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে চাইছে । সেখানে প্রত্যেকের নিজের মতো করে রাজা আছেন যার কাছে আত্মনিবেদন করতে  হয় । রানি সুদর্শনার আত্মপলব্ধির সেই তীর্থযাত্রাই এই নাটকের কাহিনি । নাটকের রাজা কোনও কুমুটধারী রাজা নয় । তিনি বিশেষ গুণবান একজন উত্তম মানুষ । নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রানি সুদর্শনা, দেশের নাগরিকবৃন্দ, বিদেশের রাজা ও পথিকদল সবাই যে রাজার অন্বেষণে ছুটে বেড়া, সে রাজা নিচক আধ্যাত্মিক চেতনা প্রসূত রাজা নন । এই অদৃশ্য রাজা সঙ্কটমুহূর্তে যেমন আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রানিকে এবং জনগণকে রক্ষা করেন । রাজা যে দেশকে ভালোবাসে তা তার এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে । দিয়েই প্রমাণিত । এই অদেখা রাজাকে চোখের সামনে দেখতে চেয়ে রানি সুদশনা । নিজেকে সাধারণ নাগরিকদের দলে নামিয়ে এনেছে । তার অবস্থা অনেকটা বিদেশ পথিক দলের মতো—

“সত্যি বলছি ভাই, রাজা আমাদের এমনি অভ্যেস হয়ে গেছে যে, এখানে কোথাও রাজা  না দেখে  মনে হচ্ছে   দাঁড়িয়ে আছি,   কিন্তু পায়ের তলায় যেন মাটি নেই ।” ১০

সুদর্শনা রাজাকে শক্তি, ক্ষমতা ও রূপের মধ্যে দিয়ে পেতে চায় কিন্তু এ সবই তো বিমূর্ত । সুদর্শনা নিজের আমিত্ব ও অহংবোধকে বজায় রেখে ভালোবাসা পেতে চায় । তার ইচ্ছে সে যেভাবে রাজাকে ভালোবাসে রাজাও যেন তাই-ই করেন । এ যেন আধুনিক বস্তুবাদী সমাজের শিক্ষিত নরনারীর সমস্যা । কিন্তু ভালোবাসা তো পুঁজি নয়, একে দিয়ে আর যাই হোক বিনিময় চলে না ।

(খ) রাজা

“রাজা নাটককে বলা হয়েছিল ‘অন্ধকারের নাটক । স্বভাবতই আমাদের প্রশ্ন জাগে শম্ভু মিত্রের অনুসন্ধানে অন্ধকারই কি আরদ্ধ ? মহৎ শিল্পীর তপস্যা তো আলোর তপস্যা, তবে কেন এই অন্ধকারের আহ্বান ? অন্ধকার তো মহৎ শিল্পীর নাট্যভাবনাকে কলঙ্কিত করে । আসলে এই ‘অন্ধকার’ শব্দটি শম্ভু মিত্রের অনুভবে দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিয়েছিল । এই অন্ধকার সূর্যের অবর্তমানে যে তমসা, তা নয় । আলোর বিপরীতার্থক শব্দও নয় । এই অন্ধকার মুদিতনেত্র যোগীর ধ্যানের জগতের অন্ধকার । বাইরের জগতের কোলাহল ও তুচ্ছতা থেকে সরে এসে আমরা যখ ডুব দিয়ে কোনও সত্যকে উপলব্ধির চেষ্টা করি, তখন মনের ভেতরের অন্ধকার কিন্তু শূন্যতার রূপ নয়, সত্যকে আবিষ্কার করার একটি উপযোগী পরিমণ্ডল । শম্ভু মিত্র এই সত্যের উপলব্ধির অন্ধকারের দ্যোতনা পেয়েছিলেন ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে । এই অন্ধকার আসলে আলোতে ফিরে আসার পথ । তাই ‘এ আঁধার আলোর অধিক । ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে এই ভাবনাই প্রতিফলিত ।—

বহুরূপী প্রযোজিত ‘রাজা’ নাটকটি অসম্ভব মঞ্চ সাফল্য পেয়েছিল সেই সময় । তার একটি কারণ রবীন্দ্রনাথকে শম্ভু মিত্র অনুভব করেছেন এক অন্য মন নিয়ে । এ প্রসঙ্গে রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য—

“রাজা’ নাটকের প্রয়োগেও তিল তিল করে শম্ভু মিত্র সৃজন করেছেন রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রত্যয়ের মনোভূমি । আলো, মঞ্চ, সঙ্গীত, পোশাক, কারুকৃতি, চরিত্র বিন্যাস আর অভিনয় সব মিলিয়ে সে এক অনন্তের সন্ধান অনিঃশেষের দৃশ্যকাব্য । রবীন্দ্রনাটকের অন্তরের সুখ দুঃখের-ভালোবাসার কাব্য হয়ে আলো ছড়িয়েছিল এখানে, যে আলোয় হারিয়ে যাওয়া পথ পাওয়া যায়, যে পথ মানুষকে পূর্ণ করে তোলে, যে পথে সব ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতার বাঁধন টুটে যায় ।” ১১

যাই হোক, ‘রাজা’র অভিনয়ে বহুরূপীর শিল্পীরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি । বিশেষত শম্ভু মিত্রের অভিনয় দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল । সন্তোষকুমার ঘোষ দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৭ জুন মন্তব্য করেন—

“…. এই নাটকে ‘রাজা’ও একটি নিয়ত উপস্থিতি— শ্রী শম্ভু মিত্রের সুষ্ঠু ও নিষ্ঠাবান উচ্চারণে বারবার তার অমোঘ; অভ্রান্ত আবির্ভাব…।” ১২

শম্ভু মিত্র তথা এই বহুরূপী নাট্যদলই রবীন্দ্রনাটককে পেশাদারি মঞ্চে সাফল্য এনে দিয়েছিল । একটা সময় ছিল রবীন্দ্রনাথের এই সব রূপক নাটকগুলি বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রায় ব্রাত্য ছিল । তার গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য বহুল পরিমাণে এবং উপন্যাসের নাট্যরূপও শিশিরকুমার পূর্ব বাংলা মঞ্চে অভিনীত হলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সমালোচনা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাটকের জনপ্রিয়তার অভাব সম্পর্কে তারা সচেতন ছিলেন । যেমন ‘নাচঘর’ পত্রিকা বলেছে—

“রবীন্দ্রনাথের নাটকের মর্মগ্রহণ করবার মতো শিক্ষার উৎকর্ষ ও রসবোধ এদেশের দর্শক সাধারণের নেই…” ১৩

গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন রূপে গড়ে ওঠার পর, প্রথমে বহুরূপী, তারপর একে একে বহু দলের রবীন্দ্রনাটকের এই নিরীক্ষা বাঙালির রুচিবোধ, সংস্কৃতি সচেতনতা ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসাকেই প্রমাণ করে । তবে বহুরূপীর প্রচেষ্টাগুলো যে সমকালীন অন্যান্য দলেরও অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে কুমার রায় বলেছেন—

“রবীন্দ্রনাথের নাটককে আমরা মঞ্চে পুনরাবিষ্কারের জন্য গৌরব করতে পারি । পারি, কিন্তু একটি একটি মাত্র সংস্থার সুবাদে । সে সংস্থা বহুরূপী, এবং তার রূপকার-নির্দেশক-অভিনেতা শম্ভু মিত্র ।” ১৪

শম্ভু মিত্র কর্তৃক রূপান্তরিত ও পরিচালিত নাটকের পরিচয়

শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাটকের প্রযোজনা তথা রবীন্দ্রনাটকের কথা এতক্ষণ আলোচিত হল । শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটকসহ তাঁর নাট্যভাবনার কথা না বললে বোধহয় আলোচনাটি খণ্ডিত থেকে যায় । তাই সেকথা এখানে বর্তমানে বলবার চেষ্টা করছি । তবে শম্ভু মিত্রের সারাজীবনের সৃষ্টি নিয়ে এখানে আলোচনা করার অবকাশ নেই, শুধুমাত্র ছয়ের দশকে শম্ভু মিত্রের নাটক ও নাট্যাভিনয় নিয়ে আলোচনা করা হবে ।

বহুমুখী প্রতিভার দ্যুতিতে শম্ভু মিত্রের সৃষ্টিশীল জীবন আলোকিত হয়ে উঠেছিল । তিনি যে কেবল নাট্য-নিদের্শনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা তথা ভারতীয় আধুনিক থিয়েটারের জনক ও তার শ্রেষ্ঠতম রূপনির্মাণ করেছিলেন তাই-ই নয়- চলচ্চিত্র, আবৃত্তি ও সাহিত্যকর্মেও তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব । নাট্য-নির্দেশনার পাশাপাশি নাটক রচনাতেও অসামান্য পরিচয় রেখেছেন । নাট্যরূপ, অনুবাদ, রূপান্তর এবং মৌলিক নাটক নির্মাণের এই বিচিত্র প্রবাহে তিনি অবগাহন করেছেন । তার এই বিপুল কর্মের সামান্যতম অংশের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হবে ।

বিশ শতকের ছয়ের দশকের প্রারম্ভে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপী রবীন্দ্ৰনাটক প্রযোজনা করে । পরবর্তীতে তার সংখ্যা আরো বেড়ে যায় । সেকথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি । যাই হোক রবীন্দ্ৰনাটক বাদ দিলে ছয়ের দশকের প্রারম্ভে শম্ভু মিত্র পরিচালিত ও অভিনীত নাটকগুলির একটি ‘দশচক্র’ । ১৫ এই সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর নিউ অ্যাম্পায়ারে নব পর্যায়ে ‘দশচক্র’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় । নতুনভাবে বিন্যস্ত সঙ্গীতের পথ ধরে সমগ্র অভিনয়কে এই নাটকে বেঁধেছিলেন পরিচালক । ডাক্তার পূর্ণেন্দু গুহ-র ভূমিকায় শম্ভু মিত্র যখন উপযুপরি ‘Strike the tent’ এবং ‘one must bear one’s own cross to the calvary’ বাক্য দুটি যোজনা করেন, সমগ্র প্রযোজনাটি যেন—

“আবেগ ও বুদ্ধি, হৃদয় ও বোধিকে আশ্রয় করে এক আত্মপ্রতিষ্ঠ মানুষের দুর্মর আশার, নিরন্তর সংগ্রামের নাটক হয়ে ওঠে ।” ১৬

এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন ছয়ের দশকে রবীন্দ্রনাটক বাদে শম্ভু মিত্র নর্দেশিত প্রথম নাটক ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ । নাটকটি শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্রের যৌথ চরনা । ১৯৬১ সালের ২৪ জানুয়ারি বিশ্বরূপা মঞ্চে নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় । নাটকটি সম্পর্কে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন—

“…..সামগ্রিক বিচারে কাঞ্চনরঙ্গ’বহুরূপী-র একটি মনোহারী সৃষ্টি । বিশেষত পরিচালনা বাবস্থাপনা ও অভিনয়ের দিক হইতে নাটকটিকে নিখুত বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না…। ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ কাঞ্চনের চেয়ে জীবনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছে ।” ১৭

এরপরে ১৯৩০ সালের ১২ জুন নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হয় ‘রাজা অয়দিপাউস’ । সোফোক্লিসের এই নাটকটি অনুবাদও করেন স্বয়ং শম্ভু মিত্র । প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ও করেন তিনি নিজে এবং দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল অভিনন্দন লাভ করেন । সেই সময় দেশ পত্রিকায় ‘রাজা অয়দিপাউস’সম্পর্কে ছাপা হয়—

“ঈদিপাসের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র অসাধারণ অভিনয় করেছেন । ভাগ্যবিড়ম্বিত একটি চরিত্রের স্বগত হাহাকার তার অভিনয়ে অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে । এই চরিত্রের মর্মজ্বালা ও অসহায়তা তিনি অবলীলায় তার অভিব্যক্তি ও বাচনভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন । মঞ্চে এই অভিনয় তুলনারহিত ।” ১৮

‘রাজা অয়দিপাউস’-কে নিয়ে সে সময় কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, নাটকটিকে কেউ কেউ অশ্লীল ও প্রগতিবিরোধী বলে মন্তব্য করেছিলেন । তবে এ কথাও ঠিক যে ক্ল্যাসিকের বিচার এমন ভাবে হয় না । নাটকটির সপক্ষে রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন—

“রাজা অয়দিপাউস মায়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলেন কী করলেন না এটা কোনও বিষয়ই নয় । যুদ্ধজয়ী রাজা রানির অধিকার পাবে, এটাই ছিল তৎকালীন গ্রিস দেশের নিয়ম । মায়ের সঙ্গে যৌন মিলন বা মায়ের গর্ভে নিজের সন্তানের জন্মদান, এ সবই ঘটেছে অয়দিপাউসের অজান্তে । তাই কোনও পাপ বা অন্যায় স্পর্শ করতে পারেনি অয়দিপাউসকে।” ১৯

আসলে অয়দিপাউসের সত্যের তৃষ্ণা, তার দেশপ্রেম এই নাটকের প্রধান বিষয় । অত্যাচারী স্ফিংক্সকে পরাজিত করে থেবাই-এর রাজা হয়েছিল অয়দিপাউস । থেবাই নগরীর জনসাধারণ গভীর কৃতজ্ঞতায় সিংহাসনে বসিয়েছিল সেই আগন্তুক, বীরশ্রেষ্ঠ অয়দিপাউসকে । রাজা হয়ে সিংহাসনে বসাই তার কাল হল । ঘনিয়ে এল মহা বিপর্যয় ।  দেশবাসীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল রাজা । দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তেইরেসিয়াসের কণ্ঠে চরম সর্বনাশের সতর্ক বাণীও তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি সত্য-সন্ধান থেকে । আর এখানেই ‘রাজা অয়দিপাউস’ এক মহা ক্ল্যাসিকে উত্তীর্ণ হয়েছে । এখানে বড় হয়ে উঠেছে সত্যের সন্ধান । রাজা অয়দিপাউস সব সীমা আর ক্ষুদ্রতাকে তুচ্ছ করে সত্যের তৃষ্ণায় মহীয়ান হয়ে ওঠেন । সত্যকে জেনেই রাজা অয়দিপাউসের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয় । রাজা জানতে পারল, সে পিতৃহন্তা । আপন জন্মদাত্রীর গর্ভে তিনি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন । সমাজে কোনও পাপ একা, বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে না । সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে রাজা খুঁজে পেল, এই পাপের উৎসে রয়েছে সে নিজে । অনুশোচনায়, আত্মধিক্কারে সে নিজেই নিজের চোখ উপড়ে নিল । নাটকের শেষে অন্ধ অয়দিপাউস যখন বলেন যে, নিয়তি আর কী সঞ্চিত রেখেছে তার জন্য, তখন নাটকটি হয়ে ওঠে আরও মর্মস্পর্শী । যুগ যুগ ধরে রাজা অয়দিপাউসের সত্যের সন্ধান আলোকিত করে এসেছে সারা পৃথিবীর দশর্কদের । শম্ভু মিত্র ‘রাজা অয়দিপাউস’ অভিনয় করে সেই অসামান্য অভিজ্ঞতায় নিয়ে এসেছিলেন বাঙালি দর্শকদের । বাঙালি দর্শক সেদিন ক্ল্যাসিকের বিশালতায় অবগাহন করেছিলেন ।

আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে ছয়ের দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে দেখা দিয়েছিল নতুট সঙ্কট । সাম্যবাদী শিবিরে ফাটল, ভারত-চিন সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করল । জাতীয় জীবনের সে এক তমসাচ্ছন্ন ছবি । উৎপল দত্ত ‘কল্লোল’ প্রযোজনা করে এই অন্ধকারে নবতর প্রত্যয়ের আলো জ্বেলেছিলেন । শম্ভু মিত্রও ‘রাজা অয়দিপাউস’ এবং ‘রাজা অভিনয় করে সেই প্রত্যয়ের এবং সম্ভাবনার আলোই জ্বেলেছিলেন । উৎপল দত্ত এবং শম্ভু মিত্র দুজনেই সত্যকে খুঁজেছেন । দুজনের প্রকাশ আলাদা কিন্তু লক্ষ্য একই । কল্লোল’ নতুন যুগের ক্ল্যাসিক হয়েও শার্দুল সিং-এর শৌর্য, সাহস, ত্যাগ, ভালোবাসায় কোথায় যেন চিরকালীন ব্যাপ্তি পেয়ে যায় । আর ‘রাজা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’ চিরকালের চির প্রাসঙ্গিক । বিশ্ব নাট্য-সাহিত্যে যা অতুলনীয় ।

‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকটির মাধ্যমে শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারকে উপহার দিয়েছিলেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা । অভিনয়, আলো, আবহ, মঞ্চ, পোশাক— সব মিলিয়ে এক সাঙ্গীতিক ঐকতান । রাজা অয়দিপাউস ও রানি ইয়োকাস্তের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় সেদিন বাংলা থিয়েটারকে বিস্মিত করেছিল । আজও বিস্ময়ের সেই দুই ধ্রুপদী চরিত্রের অভিনয় । পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের সমকক্ষতার দাবি করে সেই অভিনয় ।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সাঙ্গীতিক ঐকতান গড়ে তোলা হয়েছিল । আলো, আবহ, মঞ্চ, পোশাক, অভিনয়, কারুকৃতি অভিনেতাদের বিন্যাস সব মিলিয়ে এক ভিন্ন রকমের ছন্দ গড়ে উঠেছিল সেই প্রযোজনায়। শম্ভু মিত্রের নির্মাণ ও সৃজনে সমগ্র । নাটকটি অসামান্য হয়ে উঠত । অভিনয়, মঞ্চ এবং সাজপোশাকের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়েছিল । ‘রাজা অয়দিপাউস’ প্রযোজনাটি সম্পর্কে কুমার রায়ের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ্য—

“মধ্য মঞ্চ থেকে শুরু করে মঞ্চ গভীর পর্যন্ত মঞ্চজোড়া পাটাতন ধূসর কাপড়ে ঢাকা । রঙ্গ শীর্ষে মধ্যিখানে লালচে মেরুন রঙের দুটি বৃহৎ থাম, স্বল্প-অলঙ্কৃত । কয়েক ধাপ সিঁড়ি থামের মধ্য স্থানে পাটাতনের ওপর থেকে উঠে গেছে ।… অভিনেতার ডানদিকে অন্দরে যাওয়ার আলোকিত পথ । থামের বাইরে দিয়ে দু’দিকে প্রসারিত কালো পর্দা । মঞ্চব্যাপী পাটাতনের সামনের অংশে রঙ্গস্থলে দু’দিকে খানিকটা ছেড়ে দুটি কিংবা তিনটি ধাপের টানা সিঁড়ি । অভিনেতার ডানদিকে সেই সিঁড়ির ধাপের শেষে একটা ঢালু সরু চাতাল নেমে এসেছে মঞ্চতল ছুঁয়ে । মঞ্চবামে মূল পাটাতনের ওপর একটা প্রার্থনা জানানোর বেদী । সেটার রঙও ধূসর এবং গ্রিক মোটিফের অলঙ্করণ তার গায়ে । দুই থামের ওপরদিকে মধ্যবর্তী স্থানে একটা ছোট মেরুন রঙের ফ্ল্যাট লাগানো থাকত— তার মাঝে দেব আপোল্লোনের প্রতীক সোনালি-হলুদ রঙের সূর্য। ওই সূর্য চিহ্ন যুক্ত ফ্ল্যাটটা লাগানোর ফলে থামের মাঝে একটা প্রবেশ পথের অনুরূপ তৈরি হত । অন্ধকার প্রেক্ষায় যবনিকা উঠতে শুরু করলেই যারা নতজানু হয়ে মূল মঞ্চে, সিড়ির ধাপে, হাতে পল্লব ও পশম নিয়ে বসে থাকত (প্রায় তিরিশ জন) তাদের মুখে। রাজা নাম নিয়ে আর্তনাদ শোনা যেত ।” ২০

এই নাটকের আলো নিয়েও ছিল বিস্তীর্ণ ভাবনা । শম্ভু মিত্র এর জন্য আলোক-লেখ (Light Script) তৈরি করেছিলেন । ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর ধ্রুপদী বাস্তবতার ক্যানভাসকে ফুটিয়ে তুলতে গভীর, সংযমী আলোর তুলি ব্যবহার করেছিলেন শম্ভু মিত্র । সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। কোনও আবহসঙ্গীত ব্যবহার করতেন না শম্ভু মিত্র । তাঁর নিজের কণ্ঠস্বরে, আবৃত্তির স্পর্শে তুলে ধরতেন অন্তরের সুর আর ছন্দ ।

১৯৬৪-তে ‘রাজা’ ও ‘রাজা অয়দিপাউস’ দটি ক্যাসিক নাটক প্রযোজনা করার পর ১৯৬৫-তে শম্ভু মিত্র নতুন কোনও নাটকের কথা ভাবেননি । ‘ছেঁড়াতার’ থেকে শুরু করে পুরনো নাটকগুলি এই সময় পুনর্বার মঞ্চস্থ করা হয় । ১৯৬৬-তেও ‘বহুরূপী নতুন কোনও নাটক মঞ্চস্থ করতে পারেনি । আগের বারের মতোই পুরনো নাটকের অভিনয় হতে থাকে ‘৬৬-তে । ১৯৬৭ সালে শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় । ৭ মে নিউ এমপায়ারে প্রথম অভিনয় হয় । এই নাটকটিতে শম্ভু মিত্র অভিনয় করেননি । নাটকটির বিষয়বস্তু খুব উঁচু মানের একথা সেদিন সবাই মানেননি, কিন্তু শম্ভু মিত্রের পরিচালনার প্রশংসা করেছিলেন সকলেই । তারই অসাধারণ পরিচালনায় ও সম্মিলিত অভিনয়ে বাদল সরকার যে নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন সেদিন, তা কিন্তু ভুলে যাবার নয় । বাকি ইতিহাস প্রসঙ্গে ‘দেশ’ পত্রিকায় সে দিন লেখা হয়—

“বহুরূপীর নতুন নাটক ‘বাকি ইতিহাস’ ও যথাবিহিত দর্শকদের আনন্দ দেবে, মুগ্ধ করবে । তবে তা সুপ্রযোজনা, সুপরিচালনা ও সম্মিলিত অভিনয়ের জন্য নাট্যামোদীদের প্রশংসা যতটা পাবে, নাটকের জন্য ততটা নয় ।… শম্ভু মিত্র বুদ্ধিদীপ্ত নাট্য পরিচালনার ছাপ নাটকের প্রতি দৃশ্যেই মেলে । ডিটেল-এর প্রতি তার নজর এবং শ্রী মিত্রের বাস্তববোধ লক্ষ করার মতো।” ২১

১৯৬৮ সালে আবারও পুরনো নাটকের অভিনয় করে বহুরূপী । ১৯৬৯-এ নীতীশ সেন নামে আর এক নতুন নাট্যকারের লেখা ‘বর্বর বাঁশি’ নাটকের পরিচালনা করেন শম্ভু মিত্র । নতুন নাট্যকারের নাটক মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র পূর্বেও ঝুঁকি নিয়েছেন (বাদল সরকারের ক্ষেত্রে), এবারও নিলেন । ১৯৬৯-এর ৭ মে কলামন্দিরে ‘বর্বর বাঁশি’ মঞ্চস্থ হল । শম্ভু মিত্র আবার প্রমাণ করলেন তাঁর নির্দেশনার গভীরতা । ফলে একেবারে নতুন নাট্যকারও সকলের কাছে পরিচিত হয়ে গেলেন ।

শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটক

এতক্ষণ ছয়ের দশকের শম্ভু মিত্র পরিচালিত নাটকগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল । এবার অলোচনা করবো ছয়ের দশকে শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটকগুলি ।

এই সময় শম্ভু মিত্র রচিত মৌলিক নাটকগুলি হল— ‘গর্ভবতী বর্তমান’ (১৯৬৩), ‘চাঁদ বণিকের পালা’ (১৯৬৫) ও ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ (১৯৬৫) । শম্ভু মিত্র ‘গর্ভবতী বর্তমান’ ও ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ একাঙ্কিকা দুটি লেখেন সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ছদ্মনামে । গ্রন্থভুক্তি কালে (বৈশাখ, ১৪০০) এদের তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘কৃষ্ণকৌতুকীয় নাটিকা’ বলে । যাকে নাটকীয় পরিভাষায় বলে ‘ব্ল্যাক কমেডি’ । ব্ল্যাক কমেডির মধ্যে কমেডির বৈশিষ্ট্য আপাতভাবে বজায় রেখে ভেতরে ভেতরে সমাজ ও জীবনের গুঢ় গম্ভীর, বিকট এক কৃষ্ণচ্ছায়ার আভাস সঞ্চারিত রাখা । ফলে কমেডির কৌতুকময় সুখকর রূপের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ এক অশুভ-সংকেত উঁকি দেয় । গর্ভবতী বর্তমান এবং ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ নাটিকা দুটির মধ্যে ব্ল্যাক কমেডি বার কৃষ্ণকৌতুকীয় নাটকের এই বৈশিষ্ট্য বর্তমান । গর্ভবতী বর্তমান’-এ মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ-সন্ধানের বিপন্ন অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলের পটভূমিতে । ‘অতুলনীয় সম্বাদ’-এ প্রেম-বিবাহ- সংসার-সন্তান-সন্ততি প্রবাহিত জীবনে দুর্নীতি ও অনাচারকে চেপে রেখে বহিরঙ্গে নীতির মহিমা কীর্তনের এক হাস্যকর প্রয়াস ।

আর ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে এক আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি । নাটকটি ‘বটুক’ ছদ্মনামে ছাপা শুরু হয়েছিল । ১৯৬৫ সালে নাটকটির । প্রথম পর্ব ‘বহুরূপী’ নাট্য পত্রিকার ২৩তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । দ্বিতীয় পর্বাংশ বহুরূপী’র ২৪তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে ।

মনসামঙ্গল কাব্যের চঁদ সদাগরের কাহিনিকে আশ্রয় করে এই নাটকের মধ্যে দিয়ে নাট্যকার প্রকাশ করেছেন আধুনিককালের কিংবা সর্বকালের এক মহাকাব্য । মূল কাহিনির অনেক রদবদল করে  দেশকাল সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দর্শন, উপলব্ধি  ও অনুভবের  এক গভীরতম কাহিনি শম্ভু মিত্র আমাদের শুনিয়েছেন ‘চাঁদ বণিকের গালা’তে । জীবনের, সমাজের অনিবার্য, অমোঘ কত প্রশ্ন, কতরকম উপলব্ধি, কত রহস্যের সংবাদই না রয়েছে এই নাটকে । নীতিহীনতার বিরুদ্ধে, অজ্ঞানের বিরুদ্ধে, আন্ধকারের বিরুদ্ধে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ এক সুগভীর প্রতিবাদ । নাটকের শুরু চাঁদ বণিকের অভিযানের প্রস্তুতি দিয়ে, তারপর সাগর-যাত্রা, সাগরে দুরন্ত ঝড়ের মধ্যে, প্রচণ্ডতম বিরুদ্ধতার মধ্যে এ পাড়ি দেওয়ার বিফলতাও যেন বিফলতা নয়, পরাজয়ও পরাজয় নয় । কারণ চরম দুর্যোগ ও বিরুদ্ধতার মধ্যে মানুষের অভিযাত্রী অন্তর তো থেমে থাকতে পারে না তাহলে তো থেমে যাবে জীবনের প্রবহমানতার শাক্ত, তাহলে তো স্তব্ধ হয়ে যাবে জীবনের মহত্তর রূপের আবিষ্কারের ইতিহাস । তাই এই নাটকের একেবারে শেষে চাঁদ সব হারিয়েও বলতে পেরেছে—

“চাঁদ  ।।      আমরা ক’জনা প্রেতের মতন চিরকাল পাড়ি দিয়্যা যাব । আমাদের

                কেউ নাই, কিছু নাই । নাোঙর তো কেট্যে দেছে শিব।—প্রস্তুত

সবাই? হৈ-ঈ-ঈ-য়াঃ । কতো বাঁও জল দেখ । তল নাই ?– পাড়ি দেও । এ আন্ধারে চম্পকনগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে । পাড়ি দেও— পাড়ি দেও—” ২২

‘চাঁদ বণিকের পালা’-র চাদের মতো প্রত্যেক মানুষের জীবনই বোধহয় এমন এক পাড়ি দেবার কাহিনি— অন্ধকার থেকে আলোতে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে । পথ চলতে চলতে, পথের বাধায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে গড়ে ওঠে একজন মানুষের নিজস্ব জীবনবোধ বা দর্শন—

“চাঁদ  ।।      কিন্তু এটাও যেন ভাই বেভুল না হয়, যে, আমাদের পথে হোল

                দুরুস্তর বাধা । সমাজে, সংসারে,— দেখো, সবায়ে তো আমাদেরে

                খালি অপবাদ দিবে । আপন ঘরের লোকে, আত্মীয় স্বজনে,

                আমাদেরে খালি গালমন্দ দিবে । কেননা, তুমি যে শিবের ভজনা

                করো । যেটা সত্য মনে করো সেটারে যে তুমি মন খুল্যে সত্য

বলো । এইট্যাই অপরাধ ।… আমাদের পথ সত্য, চিন্তা সত্য, কর্ম

সত্য । আমাদের জয় কেউ ঠেকাতি পারে না ।” ২৩

নাটকের শুরুতেই চাঁদের এই বক্তব্য থেকে আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একেবারে সম্পূর্ণভাবে বৈপরীত্যহীন একরৈখিক মহাসর্বনাশকে, সেই মহাসর্বনাশের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা অতল অন্ধকারকে নাট্যকার দেখতে পাচ্ছেন, অন্ধকারকে দেখাতে চাইছেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’য় ।

সত্যতাকে সম্বল করে বুকভরা প্রত্যয় নিয়ে সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেবার সংকল্পে দলবলসহ এগিয়ে এসেছিল চাঁদ, স্বপ্ন ছিল চাদের ভাবনা বাস্তবায়িত হবে । কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো । চাঁদের এই ব্যর্থতা, তার সর্বহারা হয়ে যাবার ইতিবৃত্ত যেন আমাদের ব্যর্থ জীবনের ইতিবৃত্তের সঙ্গে মিলে যায় । সত্য পরাজিত হবে, এ কথা কখনো মেনে নিতে পারে না, তাই সে বলে—

“চাঁদ   ।।      মিথ্যা যতোই কেন প্রবলপ্রতাপী হোক, তবু সে ভঙ্গুর, অবশেষে

                সত্য জয়ী হয় ? জীবনে সত্যের জয় অবশ্য, নিশ্চিত ?” ২৪

এর উত্তরে বল্লভাচার্য বলে—

“বল্লভ  ।।     …ইতিহাস খুল্যে দেখো, অবশেষে চিরকাল মিথ্যা জয়ী হয়্যা এল ।

                রামচন্দ্র জানকীরে উদ্ধারের লেগ্যে পুণযুদ্ধ করে, কিন্তুক, সে জয়

                তো সাময়িক । প্রজাদের মিথ্যা কুৎসা শুন্যা গর্ভবতী পত্নীট্যারে

                পুনরায় বনবাসে দিতে হয়। সেই হোল অবশেষ । কার জয় হয় ?

                সেই অবশেষে ?– কুরুক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ হোল, কতো বীর অকাতরে

                প্রাণ দিল,— ধর্মরাজ্য স্থাপনের লেগ্যে । কিন্তুক, কোথায় ? সেই

                ধর্মরাজ্য ? এ ভারতে এখনো কি এল ? ভুল, ভুল, পৃথিবী যেখানে

                ছিল সেখানেই আছে । কুচরিত্রা মন্থরার পরামর্শে কৈকেয়ীরা একদিন

                রামচন্দ্রে বনবাসে দেয়,— আর তারেপর আরদিন কুৎসাকারী

                প্রজাদের কথা শুন্যে রামচন্দ্র জানকীরে বনেতে পাঠায় । এই হয়

                অবশেষে । কার জয় হয় ?” ২৫

অবশ্য চাঁদ পথ চলতে চলতে লক্ষ করে কীভাবে ‘আমাদের আধুনিকতা নষ্ট হয়্যা যায়’ । চাদের জীবনের টানাপোড়েনের সঙ্গে আমাদের জীবনের সমস্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । সমাজে কোনও, ‘জ্ঞানের সম্মান নাই, বিদ্যার মর্যাদা নাই, সুভদ্র আচার নাই, সুভাষণ নাই, মাংস সুখ ছাড়া অন্য কোনো সুখচিন্তা নাই’– এই উপলব্ধি যেমন চাঁদের তেমনি তা আমাদেরও। চাদের এক সময়ের গুরু বল্লভাচার্যও এক সময় বলে—‘আদর্শের পাছে ছুট্যে কোনো লাভ নাই’ । তবুও চাঁদ তার নিজের সংকল্পে দৃঢ় থাকে । এমনকী তার ছয় পুত্রের মৃত্যুও তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি । সে বলেছে—

“চাঁদ    ।।     হয়তো-বা আরো পুত্র যাবে । হয়তো-বা আমরাই কতো জনা যাব ।

                তবু যদি আমরা সকলে আজ পাড়ি দিতে পারি— তাইলে যে, তারি

                মধ্যে আরো কতো পুত্র বেচ্যে যাবে ! সেই সব বীজগুলা একদিন

                গাছ হবে, মহীরুহ হবে, ফল দিবে, ছায়া দিবে, আমার দেশের মুখ

                হাসিতে ভরাবে । ভাইরে, আমি জানি, আমার এ দেশের অন্তর মরে

                নাই । সে তো আমাদেরে ডাকে । চলো, চলো, চলো—” ২৬

কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবদাস ছাড়া অন্য সঙ্গীরা চাঁদকে ছেড়ে চলে যায় । চাঁদ অনুভব করে সে একা হয়ে যাচ্ছে—

“চাঁদ   ।।      শিবদাস, আরো কতোবার এইমতো হবে বলো দেখি ? এই যে,

                সকলের বিশ্বাস হারাবে,— বারে— বারে সকলেই নাও ছেড়্যে চলে

                যেতে চাবে, আর আমি বারে— বারে বাক্যজাল বুন্যে, যুক্তি দিয়্যা,

                কথকতা দিয়্যা, তাদের পড়ন্ত মন উৎসাহিত করে-কর্যে যাব ?

                আমারও যে ক্লান্ত লাগে । আর তো পারিনে শিবদাস ।” ২৭

এই একাকিত্বের জগতে চাঁদ সম্পূর্ণ নগ্ন, একেবারেই নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ । এতটাই একা যে জ্বলন্ত ক্ষতের পরে এতটুকু শুশ্রুষা কামনা করে সে স্ত্রী সনকার কাছে এসে দাঁড়ায়—মনসাভক্ত সনকার কাছে যে ন্যূনতম আশ্রয়টুকু পায় না । চাদের গুরু বল্লভাচার্য পর্যন্ত বাস্তব অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়, ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে সে চাঁদকে বোঝানোর চেষ্টা করে । তার ছেলে লখিন্দর পর্যন্ত তাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না । এত কিছুর পরেও চাঁদ বিশ্বাস হারাতে নারাজ । জীবনের কেন্দ্রে কোনো এক মহৎ সত্যের ওপর বিশ্বাস ছিল চাঁদের, তাই অর্থহীন, যুক্তিহীন অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি সে । কিন্তু এক সময় সনকা যখন চাঁদকে বলে—

“আগুকার কথা হোল তুমি অহঙ্কারী। আপনার অহঙ্কার তোষণের তরে তুমি লড়াই করেছ ।” ২৮

আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত চাঁদ তখন শিহরিত হয় সনকার কথায় । কেননা সে যা চেয়েছিল তা তো কেউ বোঝেনি, চাঁদ তো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জয় চায়নি । আসলে বড় কোনও লক্ষ্য নিয়ে জীবনকে কেউ যখন এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সে চাওয়া কি শুধু ব্যক্তিগত থাকে ? তার আন্তরিক আপ্রাণ প্রচেষ্টা কি শুধু ব্যক্তিগত তাগিদ ? অথবা তার ব্যর্থতা কি শুধুমাত্র ব্যক্তির ব্যর্থতা ? চাঁদ কখনোই তা ভাবে না, বরং চাদের মহত্বই প্রকাশিত হয় তার কথায়—

“…যা কিছু আমার আছে সমস্ত উৎসর্গ করা দেউল্যা হয়্যা যাব,— যাতে ভবিষ্যৎ একদিন রঙেতে রঙীন হয়, যাতে চম্পকনগরী সুস্থ, মুক্ত, অনর্গল হয়্যা । যেতে পারে ।— সেদিন আমারে যদি ভুলে যায় লোকে,— যাক, ভুল্যে যাক ।… আমি কিছু চাইনেক । শুধু হোক । শুধু সেই ভবিষ্যৎ সত্য হোক ।” ২৯

শেষ পর্যন্ত পরাজয় হয় চাঁদের । যুক্তিহীনতার কাছে, মিথ্যার কাছে মাথা নত করতে হয় তাকে । তাকে নিচু হতে হয়েছে অমঙ্গলের কাছে, অন্ধকারের কাছে । অবশেষে চাঁদ ক্ষতবিক্ষত চিত্তে মনসার পুজো দেয় । এই সময়ে চাঁদের অভিব্যক্তি আর্তনাদের মতো শোনায়—

“চাঁদ    ।।     (দু-হাতে তার মাথাটা ধরে প্রায় ফিস্ ফিস্ করে শুরু করে) আমি

                পূজা দিব । পূজা দিব । জানিনে তো সে মানুষ আছি কিনা । তবু পূজা

                দিব । (বেহুলাকে ছেড়ে) জীবনের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা শিবাইয়ে

                পৌঁছাতে চাই, সেথা শিবাই মেলে না । আর শিবায়ের থিক্যা অঙ্ক

                কষ্যা-কষ্যা জীবনে পৌছাতে চাই, দেখি জীবন মেলে না ।” ৩০

কিন্তু চাঁদের মনসাকে পূজা দেওয়াও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচালো না, বিষ খেয়ে মারা গেল বেহুলা— লখিন্দর । এবারে আক্ষরিক অর্থেই চাঁদ একা হল—

“চাঁদ   ।।      এট্যাও বিফলে গেল !— পূজা দেওয়া হোল । তবু যেন পূজা দেওয়া হয় নাই । পাড়ি দিয়েছিনু, তবু যেন পাড়ি দেওয়া হয় নাই । ঘর বেন্ধেছিনু তবু যেন ঘর বান্ধা হয় নাই । তুমি তো উলঙ্গ শিব তাই মোরে বুঝি উলঙ্গ করাতে চাও ? চাঁদ বণিকের সব পরিচয়— যেন জলের আল্পনা ? সব মুছে দিতি চাও ? দেও ।” ৩১

তবে, এমন শোচনীয় পরিণামের পরে, এমন মর্মন্তুদ হাহাকারের পরেও একবারের

জন্যও মনে হয় না এই ঘৃণ্য পৃথিবী বাসযোগ্য নয় । গভীর অন্ধকার বুকে নিয়েও ‘চাঁদ বণিকের পালা’ শেষপর্যন্ত এক জীবনবোধ, অন্যতর এক জীবনস্পর্ধা জাগিয়ে তোলে আমাদের অনুভবে, এ নাটকের অন্তর্নিহিত এক সূক্ষ্ম ভালোবাসার উচ্চারণে ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে জেগে ওঠা এক পরম মমতাময় নগ্নতায় আমাদের মনেপ্রাণে এক জীবনস্পর্ধাই উচ্চকিত হয়ে ওঠে । ‘চাঁদ বণিকের পালায় মৃত্যর বীভৎস প্রেক্ষাপটে বেহুলা-লখিন্দর যেন পরস্পর বলে ওঠে, ‘এত ভালো কেউ কারে কোনোদিন বাসেনি কখনো অথবা, আমরা দুজনা যেন ভালোবেস্যা বেস্যা মরে যেতে পারি’– তখন আমরা বুঝতে পারি মনসার চরম আধিপত্য সত্ত্বেও ‘সুন্দর জীবন’ আছে । আবার সনকা চাঁদকে যখন বলে, ‘আজ চলো— সব কিছু ছেড়া দিয়্যা দুইজনা চল্যে যাই’— তখন মনে হয় এই প্রশান্তিময় কথা শোনার জন্যই পৃথিবীতে বারে বারে জন্মাননা উচিত । তখন পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা, মলিনতা দূরে সরিয়ে রেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শাশ্বত ভালোবাসা ।

এই নাটকে শেষ পর্যন্ত কোথাও উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া বা জয়ী হওয়াটা বড় হয়ে ওঠে না, বড় হয়ে ওঠে পথ চলা, শুধু জীবনসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া, নতুন সম্পদের সন্ধান করা । সব মিলিয়ে নাটকটি শম্ভু মিত্রের এক স্মরণীয় কীর্তি এবং আমাদের বাংলা নাট্য-সংসারের এক বিশাল সম্পদ । তবে কোনও কোনও নাট্য-সমালােচক এ নাটকের কিছু ত্রুটি লক্ষ করেছেন—

“প্রথমত, নাটকটির আত্যন্তিক দীর্ঘতা । দ্বিতীয়ত, বড় বড় শিথিলগতি অনাটকীয় সংলাপের প্রাচুর্য । তৃতীয়ত, নাটকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় লোকের অবান্তর কথাবার্তার বাহুল্য । চতুর্থত, মূল একটি অবিচ্ছিন্ন কাহিনি দুই বিরুদ্ধ শক্তির ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়া অনিবার্য পরিণতি লাভ করে নাই । পঞ্চমত, খোলা ও স্থির মঞ্চে বহুবিস্তৃত জনস্থলের ঘটনা দৃশ্য পরিবেশ না আনিয়া এবং বিরতি না দিয়া মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্য রূপে উপস্থাপন করা প্রয়োগের দিক দিয়া খুবই সমস্যাপূর্ণ ব্যাপার ।” ৩২

‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটির ক্ষেত্রে ড. অজিতকুমার ঘোষের এই মন্তব্য সঠিক হলেও ““চাঁদ বণিকের পালা’ আমাদের সমকালের ‘ওডেসি’। বিষয়ে, গঠনে এ এক মহাবিস্ময় ।” ৩৩ শুধু তাই-ই নয় রবীন্দ্রনাথের পর এমন স্মরণীয় বাংলা নাটকের অন্য দৃষ্টান্ত মেলে না বললেই চলে ।

উপসংহার

অণু-গবেষণার শেষে এসে যে দু-একটি কথা আমরা আমাদের মতো করে বলতে চাই তা হল, বাংলা নাটকের গজতে শম্ভু মিত্র যথা অর্থে সফল নাট্য ব্যক্তিত্ব । তাঁর নাট্যজীবন নিয়ে কোনও কোনও সময়ে বিতর্ক হয়েছে বটে তবে তা তাঁর লক্ষ্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি । তিনি একদিনে সংগঠন তৈরি করছেন, তাঁকে সফল করতে নিজেই বিদেশি নাটকের রূপান্তর করে মঞ্চায়ন করছেন ; কখনও বা স্রোতের বিপরীতে হেঁটে রবীন্দ্রনাটককে পেশাদারি নাটক হিসেবে দর্শকের দরবারে এনে ফেলেছেন । আবার কখনও নিজেই লিখে ফেলেছেন  ‘চাঁদ বণিকের পালা’র মতো কালজয়ী নাটক । তবে যে বিষয়টি আমরা আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, তা হল তিনি যে যে নাটক বেছে নিয়েছেন বহুরূপীর জন্য বা লিখেছেন সেগুলোকে পাশাপাশি  রাখলে বোঝা যায়, তিনি যুদ্ধে নেমেছেন নাটক নিয়ে । এ-যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আসাম্যের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় শোষণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে । এক্ষেত্রে তার অস্ত্র শুধু নাটক । রক্তকরবী, রাজা, দশচক্র, কাঞ্চনবেদ, রাজা অয়দিপাউস, গর্ভবতী বর্তমান, চাঁদ বণিকের পালা— এই নাটকগুলোর বিষয় থেকেই স্পষ্ট হয়— তিনি একটা সমাজ সংস্কারের তাগিদ অনুভব করেছেন, সামাজিক শোধনেরও তাগিদ অনুভব করেছেন । সে কারণেই এমন সব নাটক নির্বাচন করেছেন তিনি । আর একটা ব্যাপারও আমাদের মনে হয়েছে, তা হল, তার অতি উচ্চ সৃজনশীলতার দিক । যে সমস্ত নাটকগুলির উল্লেখ করা গেল আগেই, তার প্রতিটি নাটকের প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন । প্রসঙ্গত বলা যায়, ‘নবান্ন’ নাটকের ক্ষেত্রে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের ব্যবহার সেসময় ছিল অভিনব । এছাড়া নিখুঁত পরিপাট্য তার নাটকের এক বিরাট গুণ । সবশেষে যেটা বলা যায়, তা হল, শম্ভু মিত্র বাংলা-নাট্যের ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠান ! মহীরূহ । তাঁর মতো নাট্যব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যত বেশি আলোচনা ও গবেষণা হবে ততই নতুন নতুন দিক পাঠকের সামনে উঠে আসবে । তা বাংলা নাটকের পক্ষে সত্যিই এক সদর্থক দিক । আমরা আমাদের অণু-গবেষণায় বহুরূপী ও শম্ভু মিত্র সম্পর্কে এই কথাগুলিই বলবার চেষ্টা করলাম ।

গ্রন্থপঞ্জী :

১)     ভিন্ন এক নাট্যের স্বপ্ন ও সৃজনশীল শম্ভু মিত্র, রায় কুমার, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র

        স্মরণ সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৫

২)     ভূমিকা, সম্মার্গ সপর্যা, মিত্র শম্ভু এম সি সরকার এন্ড সনস প্রাঃ লিঃ, কলকাতা

        ১৩৯৬,  পৃ: ১০

৩)     বিসর্জন, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতীর, পৌষ ১৪০৫, পৃ: ১১৫

৪)     বিসর্জন, স্মারক পত্র, বহুরূপী, ১৯৬১

৫)     বিসর্জনের অসাধারণ অভিনয়, মঞ্চ যুগান্তর, ১৯৬১

৬)     Theatre, Thought, November 25, 1961

৭)     ক্যাপিটাল পত্রিকা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৬১

৮)     যুগান্তর, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬১

৯)     গ্রন্থ পরিচয়, রাজা, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, মাঘ ১৩৯২

১০)   রাজা, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, মাঘ ১৩৯২, পৃ: ২৮

১১)    শম্ভু মিত্র ও অন্ধকারের নাটক, রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র স্মরণ

        সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৯১

১২)   আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুন, ১৯৬৪

১৩)   নাচঘর, ২৩ ফাধন ১১৩৬, ১৯২৯

১৪)    শৌভনিকের রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনা, প্রতিবেদন, দাস নিবেদিতা, নবম নাট্যোৎসব

        উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকা

১৫)   ১৯৫২ সালের ১ জুন শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপী প্রথম অনুবাদ নাটক মঞ্চস্থ

        করেন শ্রীরঙ্গমে । ইবসেনের ‘An Enemy of the People’-এর বাংলা রূপান্তর

        করেন শান্তি বসু, নাম দেওয়া হয় ‘দশচক্র ।

১৬)   দশকের ব্যবধানে দশচক্র : মজুমদার স্বপন, ‘বহুরূপী’, ৩৮, মে ১৯৭২, পৃ: ৮৬

১৭)    যুগান্তর, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১

১৮)   দেশ, ২৫ জুন ১৯৬৪

১৯)   শম্ভু মিত্র ও অন্ধকারের নাটক, গঙ্গোপাধ্যায় রঞ্জন, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র স্মরণ

        সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৯০

২০)   শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা : নির্মাণ ও সৃজন : রায় কুমার, বাংলা আকাদেমি পত্রিকা ৪,

        পৃ: ৩২৭

২১)   দেশ, জুন সংখ্যা ১৯৬৭

২২)   চাঁদ বণিকের পালা, মিত্র শম্ভু, দশম সংস্করণ, বৈশাখ ১৮২৬, এম. সি, সরকার

        অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ: ১৩১

২৩)   তদেব, পৃ: ১৪

২৪)   তদেব, পৃ: ২৪

২৫)   তদেব, পৃ: ২৪

২৬)   তদেব, পৃ: ৩৫

২৭)   তদেব, পৃ: ৪০

২৮)   তদেব, পৃ: ৬৯

২৯)   তদেব, পৃ: ৮৪

৩০)   তদেব, পৃ: ১২৮

৩১)   তদেব, পৃ: ১৩১

৩২)   বাংলা নাটকের ইতিহাস, ঘোষ ড. অজিতকুমার, প্রথম দে’জ সংস্করণ : কলকাতা

        পুস্তক মেলা, জানুয়ারি ২০০৫, পৃ: ৪৫০

৩৩)  নির্বাচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ, চট্টোপাধ্যায় মোহিত, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন। কলকাতা,

        জানুয়ারি ২০০৬, পৃ: ৮১

গবেষক :  কৃষ্ণপদ দাস

রিসার্চ স্কলার (বাংলা বিভাগ) বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়,

৪৩৯, কালিকাপুর রোড, পোঃ মুকুন্দপুর,

২ নং ইস্টএন্ড পার্ক, ফ্ল্যাট নম্বর (জি-১), কলকাতা – ৭০০০৯৯

ফোন নম্বর – 7003787726/ 9836680333

E-mail : krishnapadadas57@gmail.com

————————————————————————————————————————-