July 1, 2022

The Ichamati River: A Lifeline of Heritage and Reflection in Vibhutibhushan Bandopadhyay’s ‘Ichamati’

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Abstract:

The river, a fundamental entity in the tapestry of human civilization, has been essential for the development of societies and the survival of living beings. Often referred to as the “life flow,” rivers play a pivotal role in shaping landscapes and cultures. This paper explores the significance of rivers, focusing on the Ichamati River, through the lens of the literary masterpiece ‘Ichamati’ by Bibhutibhushan Bandopadhyay. The Ichamati River, a natural freshwater body, holds historical importance, and its waters are synonymous with life. The river’s classification, including main rivers, tributaries, and branch rivers, provides insight into its intricate structure. Small rivers, named based on geographical locations, often carry the names of girls. River expert M. Moriswa defines a river as a stream flowing through a chasm, emphasizing its role as a flowing canal. The paper delves into the historical context of the Ichamati River, with a particular focus on Bandopadhyay’s novel ‘Ichamati.’ This literary work, published posthumously in 1950, portrays the oppressive British rule and the rural life along the Ichamati about a century and a half ago. Bandopadhyay paints a vivid picture of the societal norms, superstitions, and struggles faced by the people during that period. The novel captures the rebellion of farmers against the atrocities of British rulers, particularly the cruel Neelkuti. During this era, riverside towns reflected the biases and superstitions of Bengali society. Bandopadhyay, however, presents this portrayal not as a critique but from a humanistic perspective. The novel progresses through the condemnation of elder Brahmins, the exploitation of Neelkuthi workers, and the tales of village brides. The author finds profound beauty in the Ichamati River, symbolizing the delicate balance between tradition and change. The Ichamati River becomes a metaphorical canvas for the author to explore the complexities of Bengali society, from caste systems to the oppression of women and British influence. The narrative weaves through the joyous occasions and rituals along the riverbanks, providing a glimpse into the cultural tapestry of the time. In conclusion, the Ichamati River, as portrayed in Bandopadhyay’s ‘Ichamati,’ becomes more than a geographical feature; it becomes a symbol of heritage, reflection, and the ever-flowing stream of life. The paper aims to underscore the river’s profound impact on civilization and its ability to encapsulate the essence of societal evolution.

ইছামতীর ইতিকথা, ড. শ্যামাপ্রসাদ মণ্ডল

মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘নদী’ River এক অপরিহার্য নাম। এই নদী দিয়ে প্রবাহিত জলধারা যা সভ্যতার বিকাশ ও জীবের জীবন ধারনে অপরিহার্য। তাই এই জলের আরেক নাম জীবন … এই জলপ্রবাহকে তাই জীবন প্রবাহ ও বলা যেতে পারে। নদী শব্দটির  সমর্থক শব্দ হিসাবে আমরা তটিনী, তরঙ্গিনী, সরিৎ ইত্যাদি পেয়ে থাকি। সাধারণত মিষ্টি জলের একটি প্রাকৃতিক জলধারা যা ঝরনাধারা, বরফগলিত স্রোত, অথবা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে প্রবাহ  শেষে সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে পতিত হয়। নদীকে তার গঠন অনুযায়ী প্রধান নদী, উপনদী, শাখা নদী, নদ ইত্যাদি নামে অবিহিত করা যায়। আবার ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে ছোট নদীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। সাধারণত নদীর নামকরণ করা হয়েছে মেয়েদের নামে। নদী বিশেষজ্ঞ M. Moriswa নদী বলতে বুঝিয়েছেন খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা। অর্থাৎ River is a canal flow.

ইছামতী নদী সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে গেলে বা তার অতীত ঐতিহ্য জানতে গেলে কথা – সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসের উপর আলোকপাত না করলে কোন আলোচনাই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনের শেষ উপন্যাস ছিল – ‘ইছামতী’ যা রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৪-১৯৫০ কাল পর্বে ১৯৫০ সালের ১৫ই জানুয়ারী এটি মিত্রালয় প্রকাশনা থেকে সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই উপন্যাসের জন্য তাঁকে মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করেন (১৯৫০-৫১)। এই উপন্যাসটিতে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তুলে ধরেছিলেন ব্রিটিশ নীলকুটি ও ব্রিটিশ শাসকদের দুর্দমনীয় অত্যাচার, গ্রামীন জীবনের চিত্র, বিভিন্ন ঐতিহ্য, কুসংস্কার ও প্রায় দেড় শতাব্দী আগে ইছামতীর অবস্থা। ইছামতী নদীর পাশের পাঁচপোটা গ্রামের মৌলাহাট গ্রামের নীলকুটিতে বসবাসরত একজন ইংরেজ শিটশন ও তার অত্যাচার। এলাকার কৃষকরা তার অত্যাচারে ক্ষুব্ধ। নীলচাষের কারনে কৃষকদের হাহাকার ও তার প্রতিবাদে কৃষকদের যে বিদ্রোহ, এই উপন্যাসে নীলকুটির অত্যাচারের সেই দিকটি ও তুলে ধরা হয়েছে।

ইছামতী উপন্যাসটি যে সময়ের উপর ভিত্তি করে লেখা তখন নদী পাড়ের জনপদগুলি সেকেলে বাঙালী সমাজের মতই গোঁড়ামী আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। জাত প্রথা আর নারীর অবদমন থেকে শুরু করে ভারতীয় সমাজে বৃটিশ আরাধনা আর দুর্বলদের উপর নিপীড়ন, সমস্ত দিকের একটি প্রতি ছবি উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে। তবে তিনি বাঙালী সমাজের এই চিত্র সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গীতে নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই তুলে ধরেছিলেন। গ্রামের বয়জেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের পরনিন্দা, নীলকুঠির কর্মচারীদের দাদাগিরী, আর গ্রাম্য বধূদের গল্প, প্রভৃতির মধ্য দিয়েই উপন্যাসটি এগিয়ে যায়। ঐতিহ্য আর পরিবর্তনের মাঝে ভারসাম্য রেখেচলা সে অদৃশ্য ধারার গভীর সৌন্দর্যকে বিভূতিভূষণ যেন ইছামতীর মাঝেই খুঁজে পান। ইছামতীর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তাই তিনি লিখেছেন – কত তরুনী সুন্দরী বধূর পায়ের চিহ্ন পড়ে নদীর দু-ধারে, ঘাটের পথে, আবার কত পৌঢ়া বৃদ্ধার পায়ের দাগ মিলিয়ে যায়। … গ্রামে গ্রামে মঙ্গল শঙ্খের আনন্দধ্বণি বেজে ওঠে বিয়েতে, অন্নপ্রাশণে, উপনয়ণে, দূর্গাপূজোয়, লক্ষীপূজোয় … সে সব বধূদের পায়ের আলতা ধুয়ে যায়, কালে কালে ধূপের ধোঁয়া ক্ষীণ হয়ে আসে।

বর্ষার দিনে ইছামতীর কূলে কূলে ভরা ঢল ঢল রূপে সেই অজানা মহা সমূদ্রের তীর হীন অসীমতার স্বপ্ন দেখতে পায় কেউ কেউ … কত যাওয়া আসার অতীত ইতিহাস মাখানো নদী পাড়ের মাঠ, মাঠের ঢিপি, কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়ের হাসি ওতে অদৃশ্য রেখায় আঁকা। আকাশের প্রথম তারাটি তার খবর রাখে হয়ত।

ইছামতী আজ একটি মৃতপ্রায় নদী। একদিকে যেমন তার বক্ষদেশ পলি আর কচুরি পানায় ভরে গিয়েছে, তেমনী স্বার্থাণ্বেসী রাষ্ট্র প্রশাসন তাকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছে। ইছামতী বর্তমানে ভারত – বাংলাদেশের যৌথ নদী, কারন নদীটি দুই দেশের ভূখন্ডের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। মৃতপ্রায় ইছামতীর ক্ষেত্রে একটি প্রবাদ অকপট সত্য – ‘ভাগের মা গঙ্গা পায়না’। একদিকে দুই স্বাধীন দেশের টানাপোড়েন আর অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের টানা পোড়েনে নদী সংস্কারের অভাবে ইছামতী বর্তমানে একটি মৃতপ্রায় নদী। এ প্রসঙ্গে তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলার একটি কবিতার কথা মনে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেলেন –

“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,

দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।’

কবির এই কল্পনা যেন ইছামতী নদীড় ক্ষেত্রে সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে। অতীতে যেখানে নৌকা চলত, নিয়মিত জোয়ার ভাটা খেলত, সেখানে নদী পাড়ে এখন দু-চারখানা ভাঙা নৌকো পড়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও বসিরহাট-হাসনাবাদ অঞ্চলে এখনও ইছামতী নদীতে জোয়ার ভাটা দেখা যায়। ইছামতীর কোথাও চর পড়ে নদীর উপর দিয়ে তৈরী হয়েছে পথ, কোথাও কচুরিপানা জমে জলস্তর চেখেই পড়ে না, আবার কোথাও নদী বক্ষে শুরু হয়েছে ধান চাষ। গতি হারিয়ে এমনই অবস্থা ইছামতীর। সে যেন আজ মৃত্যুর দিন গুনছে জ্বরা ব্যাধি গ্রন্থ বৃদ্ধের মত।

ইছামতীর নদীর উৎপত্তি স্থান নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও খাতা-কলমে নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়ার পাবাখালিতে চুর্ণী ও মাথাভাঙা নদীর সংযোগ স্থলে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতী নদীর সৃষ্টি। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ইছামতীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৪ কিলো মিটার। ইছামতী শুধু ভারতেই প্রবাহিত নয়, মাজদিয়া থেকে বেরিয়ে ২০ কিমি পথ অতিক্রম করে মোবারকপুরের কাছে বাক নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর পর বাংলাদেশে ৩৫ কিমি পথ প্রবাহিত হয়ে আবার দত্তফুলিয়াতে ভারতের ভূখন্ডে ফিরে এসেছে। এরপর নদীয়া জেলা অতিক্রম করে ইছামতী উত্তর চব্বিশ পরগণায় ৪৩ কিমি পেরিয়ে মহাকুমা শহর বনঁগায় প্রবেশ করেছে এবং সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে আঙরাইল হয়ে বেড়ি গোপালপুর পর্যন্ত ২১ কিমি পথ ভারত – বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে প্রবাহিত হয়েছে। বেড়িগোপালপুর থেকে আরো ১০ কিমি প্রবাহিত হয়ে টিপি-তে যমুনা নদী এসে ইছামতী নদীতে মিশেছে। টিপি থেকে ইছামতী তেঁতুলিয়া, বসিরহাট, গোয়ালপাড়া, টাকি হয়ে হাসনাবাদে এসে ইছামতী দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। এর পশ্চিম শাখাটি হাসনাবাদ খাল নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বিদ্যাধরীর সঙ্গে মিশে মালঞ্চ ও রায়মঙ্গল হয়ে সাগরে মিশেছে। আর প্রধান শাখাটি হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে সুন্দরবনের কালিন্দী নদীর মোহনার কাছে সাগরে এসে মিশেছে। তবে মাজদিয়ে থেকে বেড়িগোপালপুর পর্যন্ত ১৩৩ কিমি গতিপথে ইছামতি এখন স্রোতহীন কচুরিপানায় ভরা।

মৃত প্রায় ইছামতীকে বাঁচাতে শুরু হয়েছে আন্দোলন। তবে নদীয়া জেলার নদী আন্দোলন অনেক প্রাচীন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বরদাকান্ত সান্নাল প্রথম অঞ্জনা নদী সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে এই আন্দোলনকে সুসংহত রূপ দেন সুনীল চন্দ্র দাস। তিনি নদী আন্দোলনকে আরো সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালী করার জন্য তিনি কলমও ধরেছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘কাঁদে মরালি কাঁদে যমুনা’ River Research Institute –এর বিজ্ঞানীরা রেফারেন্সের কাজে ব্যবহার করেন। ইছামতী নদীর সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে আন্দোলন হয়েছিল সে বিষয়ে কিছুটা আলোচনা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে সুন্দরলাল বহুগুণা ও পান্নালাল দাসগুপ্ত যৌথ ভাবে নদী বাঁচানোর জন্য গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত একটি পদযাত্রা করেন। সেই সময় নদীয়ার নদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শ্রীমা মহিলা সমিতির বাণী সরস্বতী। তারা ঠিক করেন, দত্তফুলিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃত প্রায় ইছামতী নদীকে নিয়ে তারা আন্দোলন গড়ে তুলবেন। ১৯৪২ সালে মাজদিয়া রেলব্রিজ তৈরী হবার পর থেকে মাথাভাঙার জল ইছামতীতে ঢোকা বন্ধ হতে থাকে। তাই উৎসমুখ সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় ১০০০ মানুষের স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে ‘ইছামতী বাঁচাও কমিটি’ নদীমুখ খানিকটা ছাড়িয়ে দিলেও রেলওয়ে পিলার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বর্ষার সময় ইছামতীতে জল কিছুটা আসলেও সারাবছর কচুরিপানায় ভরে সুখাই থাকে ইছামতীর উৎসমুখ।

ইছামতী বাঁচাও আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য ও নদী সংস্কারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৯৪ সালের ২৩ নভেম্বর দত্তফুলিয়ায় ইছামতী ব্রিজের কাছে পান্নালাল দাসগুপ্ত ও বাণী সরস্বতীর নেতৃত্বে বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে মাছ ছাড়ার অনুষ্ঠান পালিত হয়। আন্দোলনের এই ধারাকে অব্যহত রাখতে স্থানীয় নেতৃত্ব ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারে মৎস দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বর্ষাকালে ‘মীনমঙ্গল’ নামে মাছ ছাড়ার অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে এই সকল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসব প্রবনতা বৃদ্ধি পেলেও ইছামতীর সার্বিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। দীর্ঘদিন ইছামতী আন্দোলনের সাথে যুক্ত বনগাঁর আইনজীবী স্বপন মুখপাধ্যায় বলেন – ইছামতী নদীকে বাঁচাতে হলে উৎসমুখ সংস্কার করতেই হবে। না হলে নদীকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

পাবাখালি থেকে ফতেপুর পর্যন্ত ইছামতীর প্রায় সাড়ে ১৯কিমি গতিপথ বর্তমানে জলশূণ্য নদীবক্ষে পলি জমে সমতল ভূমি প্রায়। সেখানে এখন নদী বক্ষে ধান চাষ হয়। যদিও বর্তমান সময় থেকে ছয়-সাত দশক আগের পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই আলাদা, এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয় প্রবীন নাগরীকেরা। জীতেন্দ্রনাথ মন্ডল নামে নদী পাড়ে বসবাসকারি নাগরীক বর্তমানে তার বয়স ৮৫ থেকে ৯০ হবে বলে জানিয়েছেন তার স্মৃতিপট থেকে তিনি জানিয়েছেন – “ছেলেবেলায় দেখেছি নদী কত গভীর আর চওড়া ছিল। নদীতে জোয়ার ভাটা খেলত, নৌকো চলত। নদীতে আমরা সাঁতার কাটতাম। সেসব আজ অতীত হয়ে গিয়েছে।” নদীতে এখন ধানচাষ হয়।

ইছামতী উৎসমুখ হারিয়ে ফেলায় ভারী বৃষ্টি হলে দত্তফুলিয়া, বনগাঁ, বসীরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না। একদিকে যেমন গরমের সময় নদীতে জল না থাকায় কৃষকরা নদীর জল শেচের কাজে ব্যবহার করতে পারে না, অন্যদিকে একটু ভারী বৃষ্টিতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১৯ সাল নাগাদ বনগাঁ মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে নদী থেকে কিছু কচুরিপানা তোলা হয়েছে। নদীপাড়ের মানুষ স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে কচুরিপানা তুলেছেন। মহকুমা শাসক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন – ‘নদী থেকে তোলা কচুরিপানা দিয়ে জৈব সার তৈরী করা হচ্ছে। ডিসেম্বর থেকে তা বিক্রি করা হবে। নদীয়ার দত্তফুলিয়া সংলগ্ন এলাকাতেও স্থানীয় মানুষ নিজেদের উদ্যোগে প্রায় ১২ কিমি নদী কচুরিপানা মুক্ত করেছিল।

কিন্তু একসঙ্গে সমগ্র নদীটাই কচুরিপানা মুক্ত না করায় পুনরায় পরিষ্কার করা নদী কচুরিপানায় ভরে যায়। স্থানীয় মানুষের আন্দোলনের ফলে ২০১৯ সালে ইছামতী নদী থেকে কচুরিপানা তোলার জন্য ৭৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য সেচ দপ্তর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে কচুরিপানা তোলার কাজ শুরু ও হয়েছিল। কিন্তু কাজ কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎ করে ওই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কচুরিপানার কারণে জমা জলে মশার উপদ্রব বাড়ায় নদী পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বনগাঁ উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস কমিটির তরফে ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচী পালন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক সম্মেলনের ও আয়োজন করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন বনগাঁ উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন ইছামতী নদী থেকে কচুরিপানা তোলার জন্য রাজ্য সেচ দপ্তর অর্থ বরাদ্দ করলেও বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্য কচুরিপানা তোলার কাজ বন্ধ রয়েছে। বনগাঁ অঞ্চলের ইছামতী নদী থেকে দ্রুত কচুরিপানা তোলার কাজ শুরু করার জন্য তৎকালীন সেচ মন্ত্রী সুভেন্দু অধিকারীকে জানানো হয়েছে বলে গোপাল শেঠ জানিয়েছিলেন।

সেচ দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে গোপালনগরের বিভূতিভূষণ স্মৃতিঘাট এলাকা থেকে বনগাঁ শহর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার নদীপথ থেকে কচুরিপানা তোলার কাজ হাতে নেয় বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশন। কাজ শুরু হলে বহুদিন পর নদীতে জল দেখতে পেয়ে খুশির জোয়ার আসে এলাকাবাসির মধ্যে। কচুরিপানার কারনে দীর্ঘদিন স্নান করা, সাজ ধরা, কাপড় কাচা, নৌকো চালনা করা এমনকি চাষের কাজে নদীর জল ব্যবহার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নদীতে কচুরিপানার কারনে মশা ও সাপের উপদ্রব বাড়ায় এলাকাবাসি ক্ষোভে ফুসতে থাকে। এমন একটি অবস্থা থেকে এলাকাবাসি যখন নদী কচুরিপানা মুক্ত দেখল তখন তাদের মধ্যে একটা উল্লাস দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই উল্লাস অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যায় কারণ কচুরিপানা তোলার কাজ শুরু হবার কিছু পরেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কচুরীপানা তোলার কাজ বন্দের কারণ অনুসন্ধান করলে বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশনের তরফে জানা যায় মনগাঁ মহকুমার মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জন প্রতিনিধি সকলে ওই সময় সাড়ে ৮ কিলো মিটারের পরিবর্তে বনগাঁ মহকুমার মধ্যে থাকা ইছামতীর সমস্ত অংশ থেকে কচুরিপানা তোলার দাবি তোলেন। কারণ অতীতে দেখা গিয়েছে নদীর একাংশ থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করায় কয়েকমাস পরে নদী পুনরায় কচুরিপানায় ভরে উঠেছে। এলাকার মানুষের দাবী একসঙ্গে মহকুমায় থাকা সমস্ত নদীপথ থেকে কচুরিপানা না তোলা হলে সমস্যা মিটবে না।

বনগাঁ মহকুমারবাসির আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বনগাঁ মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, দত্তফুলিয়া থেকে শুরু করে কালাঞ্চি পর্যন্ত প্রবাহিত ইছামতীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করতে গেলে আরো অনেক অর্থের প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের জন্য সেচ দপ্তরের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে ডি. পি. আর. (D.P.R.) তৈরী করা হয়েছে। সেচ দপ্তরে অর্থ মঞ্জুর হয়ে গেলেই কচুরিপানা তোলার কাজ পুনরায় শুরু করা হবে। বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশনের এহেন বক্তব্যে নদী পাড়ে বসবাস কারি সাধারণ মানুষ হতাশ। কবে অর্থ বরাদ্দ হবে, কবে কচুরিপানা তোলার কাজ শুরু হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে বারাসাত জেলা সদর দপ্তরের এক প্রশাসনি বৈঠকে যেখানে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সেখানে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে ইছামতী থেকে কচুরিপানা তোলার বিষয়টি তুলেছিলেন গোপাল শেঠ মহাশয়। তারপরই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নদী থেকে কচুরিপানা তুলতে তৎপরতা শুরু করেছিল সেচ দপ্তর।

ইছামতী নাব্যতা হারিয়ে কয়েক দশক মৃতপ্রায়। নদীবক্ষে পলি জমে নদী তাঁর স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই কচুরিপানায় ভরা থাকে ইছামতী। উত্তর চাব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলায় কয়েক লক্ষ মানুষের দাবি ইছামতীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার। কারণ শুধু কচুরিপানা পরিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, নদী বক্ষে জমা পলি কেটে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। কারন এই নদীতেই অসংখ্য মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে। তাই ইছামতীর স্বাভাবিক গতি ফিরলে নদীপাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হবে। নদী তার স্বাভাবিক নাব্যতা হারানোয় গরমের সময় যেমন জল সঙ্কট দেখা দেয় তেমনি বর্ষার সময় একটু ভারী বৃষ্টি হলেই নদী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ বন্যার কবলে পড়ে। এ প্রসঙ্গে ২০০০ সালের ভারত-বাংলাদেশ বন্যার কথা উল্লেখ করতেই হয়। ২০০০ সালে বর্ষার মরসুমে মাত্রারিক্ত বৃষ্টি ঘটলে ফারাক্কা বাঁধের লকগেট খুলে দিতে বাধ্য হয় বাঁধ কর্তৃপক্ষ। ফারাক্কার জল পদ্মা, জলঙ্গী হয়ে এক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। নদীর জল বহন ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হওয়ায় ওই বন্যার জল নামতে প্রায় এক মাস সময় লেগে গিয়েছিল। বন্যায় অসংখ্য মাটির বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কৃষিপ্রধান এলাকায় বন্যায় ফসলের যেমন ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয় তেমনি মৎস চাষিদের মাছের ঘেরি ভেসে যাওয়ায় মাছ চাষেও ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার এবং নদী নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষনের জন্য ইছামতী নদী উন্নয়ণ পর্ষদ গঠনের দাবি তোলা হয়। এ বিষয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। কমিটি সূত্রে জানানো হয়েছে, চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন, তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়, নুসরত জাহান, প্রাক্তন সাংসদ তাপস মন্ডল এবং কমিটির সম্পাদক সুভাষ চট্টোপাধ্যায়। সংবাদ মাধ্যমকে সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন – ‘সাংসদ সৌগত রায়ের মাধ্যমে চিঠি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বিষয়ে উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছেন। এক্ষেত্রেও ইছামতীকে বাঁচাতে হলে উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন। পর্ষদ গঠিত হলে নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার এবং নদীর মধ্যে থাকা বেআইনি বাঁধ সরিয়ে নিয়মিত নদীর রক্ষনাবেক্ষন করা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র

১)     বন্দোপাধ্যায় বিভূতিভূষণ – ‘ইছামতী’, উপন্যাস।

২)     তদেব।

৩)     তদেব।

৪)     ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থ, কবিতা – আমাদের ছোটনদী।

৫)     https:bn.m.wikipedia.org, visit Date 02/06/2022.

৬)     নিজস্ব সাক্ষাৎকার।

৭)     আনন্দবাজার পত্রিকা, Online, সীমান্ত মৈত্র, বনগাঁ, ০৮ নভেম্বর, ২০১৯, সময় ০৪:২৭।

৮)     আনন্দবাজার পত্রিকা, Online, নিজস্ব সংবাদ দাতা, বনগাঁ, ১৪ মার্চ, ২০২০, সময় ০২:৩৩।

৯)     আনন্দবাজার পত্রিকা, Online, সীমান্ত মৈত্র, বনগাঁ, ১৮ জানুয়ারী ২০২১, সময় ০৪:৫৩।

Dr. Shyama Prasad Mondal

MAGT, Department of History,

Dr. B. R. Ambedkar Satabarshiki Mahavidyalaya

Helencha, North 24 Parganas

Mobile  No –  9143556240 /7980712097

Email ID –  spmondalwb@gmail.com