সাঁওতালি সংগীতে সাঁওতাল সমাজচিত্র
মণি বারিক, এম. ফিল. গবেষক, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
আদিকালে সাঁওতালদের সামাজিক কার্যক্রম জন্মউৎসব, বিবাহ, সাধ্য অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি প্রেম নিবেদনের মাধ্যম ছিল সংগীত। সাঁওতালদের মুখে প্রচলিত গানই লোকগীতি। যুগ যুগ ধরে তা তাদের মুখে মুখে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সহজ সরল এই লোকগীতিই হল সাঁওতাল সমাজের অমূল্য সম্পদ। যুগ যুগ ধরে তারা লাঞ্চিত, অবহেলিত, অনাদিত ও বঞ্চিত। এদেশের আদি বাসিন্দা হয়েও সব হারিয়ে তারা নিম্ন হয়েছে কিন্তু সু-সংযোজিত এমন হৃদয়বাণী তারা আজও হারায়নি। বরং স্বযত্নে ধরে রেখেছে সেগুলিকে। এই জনা আজও সেই মানুষদের কাছ থেকে গানের বাণী শুনতে পাই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে সাঁওতাল সমাজের অসংখ্য লোকগীত। এইসব লোকগীতির ভাব যেমন গভীর ও তেমনি সাবলীল এবং অর্থব্যঞ্জনা সব আবহমান কাল ধরে এগুলি তাদের মুখে মুখে প্রবাহিত হয়ে আসছে। এই লোকগীত সাঁওতাল লোক কবিদের কন্যাসম। এইসব কালজয়ী রচনার আবেদন দেশকালের গন্ডি ছাড়িয়ে সর্বকালের সর্বলোকের হৃদয়ের সাড়া জাগায়। কিন্তু অতন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে এই সব লোককবি, যারা শুধু নিলেন বিনিময়ে কিছুই পেলেন না তারা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেলেন। কিন্তু সাঁওতালির লোক কবিদের হয়ে বলবার কেউ নাই। সুখ এবং দুঃখ একই মুদ্রার একপিঠ ওপিঠ। লোককবিরাও রক্তমাংসে গড়া মানুষ, সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ।সামাজিক জীব হিসাবে সমাজের কাছেই দায়বদ্ধ। তাই সামাজিক যে কোন সমস্যায় তারা নির্বিকারে থাকতে পারেনা। সবার দুঃখে লোক কবি দুখি হল। তার মনকে নাড়া দেওয়া সেই ব্যথা বেদনার কথাই তার মুখে গান হয়ে বেরিয়ে আসে। নিম্নে প্রদত্ত সন্ধানী লোককবিদের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি থেকে সমাজ চিত্রের যে পরিচয় পায় তার কথাই তুলে ধরা হল –
“চীয় চাম্পা গাড় দ লিলি বিছি
বাদলী কিয়ডা গাড় লিখন গড়হন,
দায়া গে চীয় চাম্পা বাদলী কিয়দা গাড়
দায়া গে গাড় দ বন বাগী য়াদা ”
এই গানের মধ্য দিয়ে যে সাঁওতালদের যে দুর্গ বা গড় ছিল, সেই চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে। সাঁওতালদের ১২ টি পদবী, ১২ টি দুর্গ বা গড় ছিল, সেগুলি হল- টাইগড়, চামপাগড়, কয়ডাগড়, বাদোলীগড়। উল্লেখযোগ্য সেইসব দুর্গে তারা বাস করত। জীবন যাপন করলে এবং শত্রুদের আক্রমনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই দুর্গ ব্যবহার করতো। কোনো কারণে যদি সাঁওতালরা পরাজিত হয় তাহলে তারা সেই দুর্গ ছেড়ে চলে আসে, সেখানে অজস্র ধন সম্পত্তি নষ্ট হলেও বা হারিয়ে গেলও তাদের অন্তঃস্থিত সেইসব বাজনা ভুলে যায়নি। সঙ্গীতের বা লোকগীতির মাধ্যমে যেখানে গিয়েছে সেখানেই পরিবেশন করেছে। জন্ম উৎসব, বিবাহ উৎসব, এবং ঋতু উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগুলিতে সাঁওতাল সমাজচিত্র খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় চেতনা, সংস্কার, আনন্দানুভূতির সব বিবরন লোক সঙ্গীত গুলিতে বিবৃত।
সভ্যতার বিবর্তন ও কালের প্রভাবে সরল সাধারণ মানুষের এই সব জীবন গাথা ক্রমে ক্রমে বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যাচ্ছে অথচ গ্রাম বাংলার অমূল্য সম্পদ এইসব লোকগীতির মাধ্যমে পাই। কত প্রেম, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য সেই সকল গানে জড়িয়ে আছে, এগুলির সঙ্গে কত বিরহ বেদনার সুর গাথা আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা, শিল্প, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক এই সব গানের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে সমাজ জীবনের পূর্ন ছবি দেখতে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এই সব গানের মধ্যেই অতীত সমাজ বা পারিবারিক জীবনের ঘাত প্রতিঘাত কেমন ভাবে রূপক হয়ে উঠেছে তাও ধরা পড়ে। মানুষের কর্মপ্রীতি আলাপ অভিলাসকে পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে সংস্কৃতিকে বোঝা যায় না। এসব কিছুর পর্যালোচনা তাই সংস্কৃতি বিচারে প্রথম সোপান। দু-একটি গান বিচার করলে এসব গানের মাহাত্ম্য বোঝা যায়নি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সঙ্গীতকারদের সঙ্গে মিশে তাদের হৃদয় আবেগ গথিত স্বত:স্ফূর্ত গান শুনলে তবেই গানের অনন্ত সৌন্দর্যের আশ্বাস লাভ করা সম্ভব। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই সব গানের রচয়িতা আমাদের নিরক্ষর পূর্বপুরুষেরা। কাজের গান, আনন্দের গান, ধর্মের গান থেকে শুরু করে তারা জীবনের প্রতিটি অংশের প্রতিটি ভঙ্গীর উপর এক একটি গান রচনা করেছিল। হয়ত সেদিন এসব গানের প্রাধান্য ছিল খুবই বেশি। তাই তার সমাজের প্রয়োজনে নিজ নিজ বৃত্তি ও ধর্মনুসারে বিভিন্ন গান রচনা করেছিল। কত তুচ্ছ বিষয়কে অবলম্বন করে কত সুন্দর ও কত মনোহর গান রচন্স করেছিল। কিন্তু আজকের মানুষ পূর্বের মতন এসব গানের মূল্য দেয়না। এসব গানের চলন এখন কমে এসেছে। লুপ্তপ্রায় এসব জীবন গাথা পুনরুদ্ধার করতে পারলেই তো আমাদের দেশের সাহিত্যের গৌরব বিকাশ ও বৃদ্ধি পাবে, এবং গানের ভান্ডার ও সেইসঙ্গে সংবৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
অধিকাংশ সাঁওতালি গানই নাচ সহযোগে পরিবেশিত হয়। যেমন, দং, লাগড়ে, পাতা, সহরায়, কারাম, ডাহার, দাঁসায় ও বীর সেরেঞ। লাগড়ে গান প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ব্যবহার হয়, পাতা গানে কথাই প্রধান এবং এইসুর নাচকে নিয়ন্ত্রন করে, দং গান বিবাহ ও ছাঁটিয়ীর অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। দং আবার চড়া সুরের জন্য বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত। যেমন, সহরিয়া দং, ডৌঙ্গুয়ী দং, ঝিকৌ দং । বাহা সহরায়, কারাম, দাঁসায় এই উৎসবের সময় গাওয়া হয়। পূর্বে বীর সেরেঞ গাওয়ার সময় নাচের প্রচলন ছিল না। দংগেড় নাচের সময় রুচিসন্মত কিছু কিছু বীর সেরেঞ গাওয়া হয়। নাচ ছাড়া গানের মধ্যে যেগুলি পড়ে সেগুলি হল- বাপলা সেরেঞ, হোয়ো রুয়ৗড় সেরেঞ, ঝারনি সেরেঞ, মরনা সেরেঞ । এসব ছাড়াও বহু সুরের সাঁওতালী গান আছে, সাঁওতালী ভাষার দুটি ছাঁটিয়ীর কথার অর্থ হল নামকরণ অনুষ্ঠান। নবজাতক শিশুকে কি নামে ডাকা হবে তা শিশুর পিতা মাতার পরামর্শ অনুযায়ী ধাইমা প্রকাশ করে। সমবেত লোকেদের উদ্দেশ্য করে বলে যে- আজ থেকে অমূক নামে ডাকবে, ছেলে হলে শিকারে ডাকবে, আর মেয়ে হলে মেয়েরা তাকে জল তোলা থেকে শুরু করে শাকতোলা বনে বাঁদাড়ে পাতা তোলা এই নামে ডাকবে । গ্রামের নায়ক বা পুরোহিত গ্রামের লোকদের সামনে শিশুটিকে প্রধান দেবতা মারাংবুরু এবং ধর্মের কাছে সমর্পন করেন। শিশুটির সুস্থ শরীর ও তার সঙ্গে বেড়ে ওঠার কামনা করেন। সেই সময়ের একটি গান হল-
“তকয়াঃ রাচারে দাঃ ভূঁবুকেন দা: ভূঁবুকেন মা না চাওলে বহেলেন,
ফারনা কওয়াঃ রাচারে দা: ভূঁবুকেন, দা: ভূঁবুকেন মা না চাওলে বহেলেন।’’
বঙ্গানুবাদ – কার উঠানে জলের তোড় জলের তলে চাল ভেসে গেল? অমুকের উঠানে জলের তোড় জলের তোড়ে চাল ভেসে গেল। এই গানটির আক্ষরিক অর্থ হল- শিশুটি মাতৃগর্ভে ভাসমান অবস্থায় থাকে, জল ভাঁঙার সাথে সাথে চালের মতো শিশুটি বেরিয়ে আসে। এই রকম অর্থ সাধারণ অর্থে বোঝা যায়না। সেই রকম আর একটি গান হল বিবাহ সংগীত-
“ছামড়া লাতার রে চেৎ ক হালে সাড়ে কান রিহিড় বিদিড়
সাড়ে কান কঁয়ডাকো বাদোলিকো কুঁদাইহারিরে,
ছামেডা লাতার রে তুমদা: টামাক সাড়ে কান রিহিড় বিদিড়
সাড়ে কান কঁয়ডা ক বাদোলি ক কুদাইরিরে।’’
এই গানটির আক্ষরিক অর্থ হল- বিবাহ বাড়িতে যে ধামসা মাদলের যে বাজনা এবং নাচের যে আসর এই চিত্রটি আমরা দেখতে পাই। এই রকম আর একটি সাঁওতালী পল্লিতে সহরায় উৎসব মন মাতানো গান হল-
“নুমিন মারাং রাসি আতু দাড়া
রাকাব রাড়া রাকাব আড়গো,
উকুর সিরিজল আপে অড়া: দদারা হারা অডা:
তালে আতাং পিডীদ ওয়ৌর
আচুর বলদ ছিতী আলে অডা: গে ।’’
গানটিতে একটি বাড়ির বর্ননা দেওয়া হয়েছে । বিশাল এক গ্রামে সিরিজল নামে ছেলেটির বাড়ি। এদিক ওদিক খুঁজে না পেয়ে উপাসনা করে দ্বিতা নামের মেয়েটি। উত্তরে ছেলেটি জানায় সেখানে প্রাচীরে ঘেরা বিশাল বাড়ীর সদর দরজার সামনে বসার চালাঘর। এই বাড়িটিতে তাদের নাচ গানের আসরে প্রথম আলাপ হয়।
তাদের লোকগীতির একটি বড় অংশ ভরে আছে ধর্মীর লোকগীতিতে। ধর্মীয় লোকগীতিতে আছে বহু দেবদেবীর প্রশংসা এবং সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা। যেমন,
“ তকথা: পরে সেটের এনায় তিরে কাপি আতে
তিরে কাপি আতে মানা সাকোওয়া অরং আতে
মারাং দেওয়ায় সেটের এনা তিরে কাপি আতে
তিরে কাপি আতে মানা সাকোওয়া অরং আতে,
মা: মাগেয় মাগায় বাড়িজা এ মাগায়
অরং অরংআয় সাকোওয়া
আতে অরং আয়।’’
ভাবার্থ – হাতে কাপি এবং শিল্পধ্বনি দিতে দিতে কে এল, প্রধান দেবতা হাতে কাঁপি এবং শিং ফুকতে ফুকতে এলেন। তিনি সমস্ত কিছু কাটাকাটি করে পরিষ্কার করেন এবং শৃঙ্ধ্বনি দেন। কীপি বা একধরনের কুঠার । এইরকমের বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অসংখ্য গান গাওয়া হয়। সুরের বৈচিত্র্যে ভরপুর নানা ধরনের অসংখ্য গান সাঁওতাল জীবনে জড়িডে আছে। দং লাগড়ে, পাতা পরব হল একটি শ্রেণীর গান। উৎসব কেন্দ্রিক গানের মধ্যে বাহা গান, দাসায় গান, সহরায় গান, করম গান, সাকরাত গান। প্রতিটি কথা, ছন্দ, তাল লয় ভিন্ন ভিন্ন। সাঁওতালী লোকসঙ্গীত বাজনা, এবং নাচরে আদব কায়দা সব জায়গায় এক নয়। এসব গান যে সব জায়গা থেকে সংগৃহীত হচ্ছে সেই সব গান সেই সব জায়গায় নিজস্ব। এসব গানের মূল্য অপরিসীম। এদের সঠিক সংখ্যা নিরুপন করা অসম্ভব। কারণ, সাঁওতালদের মধ্যে সঙ্গীত শিক্ষার আসর বলতে শিক্ষাকেন্দ্র বোঝায় তা অতীতেও ছিল না, এখনো নেই। লোককবিরা এসব রচনা করতেন আর নাচ গানের আসরে গাইতেন।এভাবে লোকজনকে আনন্দ দিতেন। সমাজে এখন যেমন এরকম নাচগান চর্চা কম চলছে। তার পরিবর্তে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি সুরের অতিরিক্ত চর্চা চলছে। গ্রাম গঞ্জে তখন দং সা, লাগড়ে সাল, বাহা, সহরায়ে ছাপর ছাপরি নাচগান ক্রমাগত বেড়েই চলছে। সেখানে সাঁওতাল সমাজে যে চিত্র সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। তার বদলে নতুন সংস্কৃতি, নতুন সামাজিক চিত্র ফুটে উঠছে। সেই নাচ গানের সুর ছন্দ, লয় তাল, মাত্রার কিছুই ঠিক ঠিকানা থাকছে না। সেখানে সাঁওতাল সমাজের ভাতৃত্ববোধ, দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধের অভাব আমরা লক্ষ্য করছি। যেখানে আমরা সাঁওতাল সমাজের পরিচয় পাই সেটা হল সাঁওতালী সঙ্গীতঁ। সেই সঙ্গীত বর্তমানে হারিয়ে যাওয়ার পথে। বর্তমানে সাঁওতালী লোকসঙ্গীত থেকে আলাদা আধুনিক সাঁওতালী সঙ্গীত যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। মানছি যে আধুনিক সঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালী লোকসঙ্গীত চর্চা এবং গুরুত্ব কতখানি তা আমাদেরকে বুঝতে হবেজ। তা না হলে এই আধুনিক সাঁওতালী সঙ্গীত যে ভাবে বেড়েই চলেছে। তা বিশ্বায়নের যুগে সুস্থ পরিবেশ অনেক খানি ব্যাহত করছে।
গ্রন্থঋণ ঃ
(১) সাঁওতালী ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।
(২) সাঁওতাল পরমপরাতুলসন্ধানে ব্যস্ত এক মহান জাতির কথা – বুদ্ধদেব টুডু।
(৩) হড় সেরেঞ – বাবুলাল মুরমু।
৪) হিহিড়ি পিপিড়ি (সেদায় দং সেরেঞ পুথি) – রূপচাঁদ হাঁসদা।
৫) আদিবাসী জগৎ প্রবন্ধ সমগ্র, স্বপন কুমার।
———————————————