সংগীতে সৃজন পদ্ধতি ও যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগ : ঐতিহ্য ও আধুনিকতা
ড. সুদীপেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, অতিথি শিক্ষক, যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে,
যেন সিন্ধুপারের পাখি তারা, যা য় যা য় যায় চলে॥
আলোছায়ার সুরে অনেক কালের সে কোন্ দূরে
ডাকে আ য় আ য় আয় ব’লে॥১
সংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গ বা ” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ভাবনা। এই ভাবনার সঙ্গে যখন নানান সুরে ছন্দে বাদ্যযন্ত্রগুলি সেই কাহিনীর মূল সুরটিকে বিভিন্ন ব্যঞ্জনার মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকে। সেই আবহে প্রকাশিত হয় এক ভিন্ন স্বতন্ত্র ‘ মুড’ বা তার নিজস্ব অভিব্যাক্তি। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে ‘ থিম সংগীতে’ মূল সুরটি নির্ভর করে কাহিনী বা স্ক্রিপ্টের উপর এরই সঙ্গে কাহিনীর স্থান কাল পাত্র হিসাবে সুরের কাঠামোটির গঠন ও নির্মাণ হয়। যেমন পাহাড় অঞ্চলের কাহিনীর ক্ষেত্রে ধামসা, মাদল, ঢোল, টুমদা,তামাক,দোতারা, সারিন্দা, বাঁশি, বানাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় সেই স্থান মাহাত্যটিকে ফুটিয়ে তুলতে। আবার শহুরে জীবনের পথচলা ও তার সুরটিকে বাঁধা হয়, Violin ,Viola,Cello, Base, Piano accordian,Piano,Guitar, Tabla,Congo, Bongo, to Drums এমন বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রতে শহুরে চাকচিক্যকে মেলে ধরে। কাহিনীর প্রেক্ষাপট ও যন্ত্রগুলির নির্বাচন এখানে গুরত্বপূর্ণ। থিম সংগীতের একটি স্বতন্ত্র দিক হলো কাহিনীর চরিত্র। এখানে চরিত্রটিকে একটি বিশেষ সুরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে।মূল চরিত্রটি একটি সুরের মধ্যে যেন বাঁধা হয়ে যান।
আমাদের দেশের স্বনামধন্য চিত্র-পরিচালক এবং সংগীত পরিচালকেরা তাঁদের মুন্সীআনায় এর অসামান্য নিদর্শন রেখে গেছেন। যেমন মহানায়ক উত্তম কুমারের রুপালি পর্দায় প্রবেশ মাত্রই হারানো সুরের সেই স্মৃতি মধুর তুমি যে আমার সুরটি বেজে ওঠে। সংগীত পরিচালক ভি বালসারার আঙ্গুল স্পর্শে একটি সময়কে যেনো বেঁধে দিয়ে গেছেন।
চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায় অভিনেতা উৎপল দত্তের জন্য একটা জটিল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। শ্রীউৎপল এর জটিল চরিত্রর ফ্রেসিংটা সুরের মাধ্যমেই মনে করিয়ে দেয়। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ এর টাইটেল মিউজিকে যে ভারতবর্ষের নানা জাতিবর্ণ কে একটা সার্কাস্টিক কমেডির মধ্যে তুলে ধরেছেন পরিচালক। আসলে সংগীত পরিচালক টাইটেল মিউজিক এর মধ্য দিয়েই সমগ্র কাহিনীর বক্তব্য টিকে তুলে ধরেন আর থিম সংগীতটি তার মূল নির্যাস। কাহিনীর স্ক্রিপ্ট মধ্যে যেমন নায়ক, নায়িকা অনুষঙ্গ শিল্পী অভিনেতাদের ভূমিকা পালন হয়ে থাকে তেমনি যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগের মাধ্যমে মূলসুর বা মেলডির সঙ্গে আসে ‘কাউন্টার মেলোডি’ বা ‘অব্লিগেট লাইনস’ ইত্যাদি, ‘ফার্স্ট ভায়োলিন’, ‘সেকেন্ড ভায়োলিন’, ‘চেলো ‘, বেস এই ভাবেই আরো তালবাদ্যের বিভিন্ন লাইনগুলি তৈরি হয় মুডকে ফুটিয়ে তোলার তাগিদে। প্রসঙ্গত কাহিনীর পরিস্থিতিতে একটি গ্রাম্য নারী যখন শহরের রাস্তায় উপস্থিত হয় সেইমত সংগীত পরিচালক তখন গ্রাম্য সুরের ধারাটি বদলে শহুরে জমজমাটে ভরপুর করেন। তাই মেঠো সুরের ভঙ্গিমাটিও বদল করে শহুরে করতে হয় ।
যন্ত্রের কথা নেই তবে যেটি আছে সেটি হল ভাব! আর এই ভাবনাকেই আশ্রয় করে যে কথা মুখে বলা যায় না তা প্রকাশিত হয় যন্ত্রে একজন যন্ত্র ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে। বাস্তবিক জীবনে একজন স্বাভাবিক মানুষ যেমন বাজার করে আনে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংসারে তাগিদে তেমনি একটি ‘মুখ ‘ বা বোবা-লোক তার নানা অভিব্যক্তি দিয়ে তার বাজার কার্যটি সম্পন্ন করে। চলচ্চিত্রে সংগীতের তাগিদে বাদ্যযন্ত্র গুলিও তার অভিব্যক্তি ও ভাবনাগুলিকে সুরের মাধ্যমে কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। থিম সংগীতের মধ্যে একটি কাল্পনিক চরিত্র রূপ থেকে অরূপে রূপান্তরিত হয়। নানান শব্দের সুরের ব্যঞ্জনায় ভরিয়ে তোলে তার আবেগ। চরিত্রের মধ্যে সুরটি এমনভাবে তার ডানা বিস্তার করে যে দর্শক শ্রোতা দর্শনে ও শ্রবণে চোখে আসে জল এবং এই নাটকীয়তার মধ্যে দিয়েই এক আবেগের জন্ম হয়।
আধুনিককালে সময় ব্যস্ততা পরিবেশের অভাবে ভাবনাগুলিও এককে রূপান্তরিত হয়েছে! ডিজিটালাইজেশনের যুগে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, কম্পিউটার বিভিন্ন মাধ্যম যেমন বাণিজ্যিক সফলতা এনে দিয়েছে, ফলে আজ অনেক সুবিধা এবং অনেক কিছু আমাদের হাতের নাগালে ।একটি মুঠোফোন বা চলমান যন্ত্রেই আমরা বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন পেয়ে থাকি কিন্তু সেকালের শিল্প সৃষ্টিতে সুরের ব্যাঞ্জণায় এমন কিছু নির্মাণ কৌশল ছিল যা চলচ্চিত্র তথা চলচ্চিত্র সংগীত জগতে আজও অধরা ।

এইভাবেই চলচ্চিত্র জগতের সুরের কাঠামোটি যে যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বহমান সেই স্রোতের উৎস তার নির্মাণ কৌশল। কোন সুরটির বিপরীত কি সুর যাবে যা কখনোই বেসুর হবে না বরং সৃষ্টি করবে তার ঐকতান।
সত্যজিৎ তার ছবিতে রবীন্দ্রনাথের পুরো গান ব্যবহার করেছেন খুব সীমিত জায়গায় কিন্তু সেখানেই গোটা গানকে ব্যবহার করেছেন যা হয়ে উঠেছে সিকোয়েন্স ও চারিত্রিক ভাব বিন্যাসের অমোঘ উপকরণ বহু ছবিতেই যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত খন্ডাংশ ব্যবহার করেছেন তেমনি বহু ছবির মুডকে ধরিয়ে দেবার জন্য নেপথ্যে যন্ত্রণানুসঙ্গে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ব্যবহার করেছেন। অপুর সংসার ছবিতে আমরা অপুকে বাঁশি বাজাতে দেখেছি। এ নেপথে বাঁশিতে শোনা গেছে।
” আমার সোনার বাংলা” সুরটি। চারুলতার মতো ‘ঘরে বাইরে’ ছবির থিম মিউজিক হিসেবে সত্যজিৎ ‘পুজা ‘ পর্বের অনবদ্য রচনা “একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে” গানের সুরকে ব্যবহার করেছেন। ঋত্বিকের ছবি আমাদের এক ভিন্ন শিল্পরসের সন্ধান দেয়। ঋত্বিকের ছবির চড়া সুর আর আবেগ সমৃদ্ধ দৃশ্য বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গান আরো এক ব্যাপ্তি তে স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছায়াছবিতে হৃদয়বিদারকভাবে প্রয়োগ করেছেন “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে” রবীন্দ্রনাথ যে অনুসঙ্গে গানটি লিখেছিলেন ঋত্বিক সেই জায়গা থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যঞ্জনাতে এটিকে ব্যবহার করেছেন। বাজে করুন সুরে গানের শেষ কটি চরণ “এ মম পান্থ চিত চঞ্চল/ জানিনা কি উদ্দেশ্যে/… ইত্যাদি প্রয়োগ সম্পর্কে স্বয়ং বিদেশী সমালোচককে বলেছিলেন- It is very ornate very lonely song that also lately suited the mood. It is not that the words actually reflects her situation – they are not important here – it is the tune”২
চলচ্চিত্র সংগীতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং’ গুলি হয় স্বতন্ত্র, ঠিক নিয়মানুগতিক পদ্ধতি মেনে শিল্প শৈলী গুলি তৈরি হয় না। এ প্রসঙ্গে শ্রী সত্যজিৎ নির্মিত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ ‘চলচ্চিত্রে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে ছিলেন তবলিয়া শ্রী রাধাকান্ত নন্দী, সময় ওভাবে ওর বাজনাটি তখন রেকর্ড করা যায়নি। যদিও রাধাকান্ত প্রতিদিনই আসেন, বিষয়টি সত্যজিৎ এর গোচরে আসতে রাধাকান্তকে বিশেষ বাজাতে না বলে ফ্লোরে জনৈক মিউজিসিয়ানের ডুবকি দিয়ে কেবল পাঁচ মিনিট বাজাতে বলেন, একজন প্রথিতযশা তবলিয়া কে এমন একটি বাজনা বাজাতে দেখে সেদিন ফ্লোরে অন্যান্য কলা কুশলীরাও অবাক হয়ে যান। আসলে সেদিন হয়েছিল এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি ! সিনেমায় অভিনেতা কামু মুখার্জির জাগলিং দৃশ্যায়নে সত্যজিৎ ডুবকি টি ব্যবহার করেছিলেন ঠিক এমন ভাবেই বোধহয় ইতিহাস রচনা হয়।৩
বর্তমান সময়ের যে সব সংগীত-পরিচালক কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রী দেবজ্যোতি মিশ্র, উপল চক্রবর্তী, শ্রী অনুপম প্রমুখ। পুরাতন এবং নুতন সংগীতায়োজন পদ্ধতির মধ্যে যেমন ব্যবধান আছে তেমনি কখনো অ্যাকাউস্টিক বাদ্যযন্ত্র নিয়েও কাজ হচ্ছে । অর্কেস্ট্রাশন করতে ভায়োলিন, ভিওলা,চেলো ডবল বেস্ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আজও রেকর্ডিং হয়।
আবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে VST Library, Sound Lab প্রযুক্তিতে, Midi- keyboard এর মাধ্যমে নানান শব্দ বা টোন সংগ্রহ করা হয়। এমত ব্যবস্থায় বিদেশে বসে কোন সংগীত ব্যবস্থাপক সরোদ, সেতারের নানান শব্দ নিয়ে কাজ করে থাকেন। যদিও বেহালা বা বাঁশির feel বা আবেগ এর জন্য প্রয়োজন সমবাদ্য এবং সমযন্ত্রীর। আবার সিম্ফোনিক অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ট্রাক রেকর্ডিং ক্ষেত্রে কোন ভায়োলিনের মাধ্যমে বিভিন্ন Layer বা সুরের রেখাকে বিন্যস্ত করা হয়। যেমন মূল সুরটির সঙ্গে হারমোনি লাইন তৈরি করা হয়। আবার সফটওয়্যার মাধ্যমে ভায়োলিনের পঞ্চাশটির মত টোন তৈরি করা যেতে পারে। আগে যেমন বাদ্যযন্ত্রীদের আঙ্গুলের টিপ বা পিচের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু আধুনিক কালের ‘পিচ কারেকশন সফটওয়্যার’ মাধ্যমে বাজনা চলাকালীন বাদকের শুটটি সংশোধিত হয়ে যাচ্ছে সফটওয়্যার প্রযুক্তি মাধ্যমে।

আবার ‘প্রসেসর রেকর্ড সিষ্টেম ‘ মাধ্যমে বাচিক মাধ্যমে ছন্দের নকশা তৈরি বা ‘কর্ড প্যাটার্ন ‘ বানিয়ে তার সঙ্গে বাদক সুর-বিহার করে থাকে। আর এমনি ভাবেই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে অতীত থেকে বর্তমান সময়ের সাথে প্রযুক্তির হাতে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য ও শ্রাব্য মাধ্যমে (You tube, Media Sights..etc.) একালের সংগীত পরিচালক, শিল্পীরা নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন। রবি ঠাকুর মনে করতেন যে শিল্প সৃষ্টির মধ্যে সত্যই কোনো রসদ আছে সেটি মানুষের মধ্যে রয়ে যাবে, আর বাকি টা মহাকালের গর্ভে লীন হবে। সুতরাং সংগীতসৃষ্টির মধ্যে যে নান্দনিক অনুভূতি, বিষাদ-বিপর্যয় – হাহাকার যখন শিল্পীর গভীর দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে- ভাষায় সুরে ছন্দে তার প্রকাশও হয় অভিনব। আজকের সংগীত ও তার সৃজন পদ্ধতি ও বিভিন্ন ধারার যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগের যে নিত্য নতুন পরিকল্পনা যেমন আধুনিক সেই সঙ্গে কতদূর ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যাবে সেটি আগামী দিনের সংগীত সমালোচক শ্রোতাই তার মূল্যায়ন করবে। এমনি ভাবেই সময়ের ধারাপথকে অনুসরণ করে শিল্প স্রষ্টার চিন্তনে-মননে তাঁর কল্পনার তারগুলি নব-নব ছন্দে বেজে উঠে। কবির ভাষায়..
মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি কোন নব চঞ্চল ছন্দে।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে।।
তথ্য সুত্র
১.পূর্ণ চাঁদের মায়ায় : প্রকৃতি পর্যায়, কবিতা রবীন্দ্রনাথ
২.The Inner Eye; Andrew Robinson, Page 132
৩. সাক্ষাৎকার ২০০৯; দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়,বেহালাবাদক, সংগীত ব্যবস্থাপক
৪. মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি – প্রকৃতি পর্যায়, কবিতা,প্রথম সংস্করণ ১৯১৯ )