May 1, 2023

সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় সংহতি স্থাপনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ডঃ নন্দিতা বসু সর্বাধিকারী

সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্রসংগীত, নৃত্য ও নাটক বিভাগ

সংগীতভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন

      সংগীত, নৃত্য ও অভিনয় চিরকাল সমাজে সংঘাত ও অনৈক্য হ্রাস করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছে। ভারতবর্ষে যুগে যুগে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে চিরাচরিত মাধ্যমগুলি যেমন ভ্রাম্যমান শিল্পীদের সংগীত, বিভিন্ন জনসমাজের পরম্পরাগত সংগীত, লোকনৃত্য ও লোকাভিনয় যথা যাত্রা, পালাগান, পুতুলনাচ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

      অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের মত আমাদের দেশেও প্রচলিত ও আধুনিক গণমাধ্যমের একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।

মুদ্রণ-শিল্প

      প্রাচীনতম প্রচারমাধ্যম মুদ্রণ-শিল্পর সাহায্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ভাষায় সংগীতের অজস্র পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, এবং স্বরলিপিও মুদ্রিত হয়েছে। এর সাহায্য ছাড়া আমাদের সমৃদ্ধ সংগীত-ভাণ্ডারের বাণী ও সুর অবলুপ্তির পথে হারিয়ে যেত। আধুনিক সভ্যতায় বিবিধ প্রযুক্তি আবিষ্কার যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবদিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে। বৈদ্যুতিন মাধ্যম আজ বিশ্বায়নের দ্বার উদ্‌ঘাটিত করে দিয়েছে। আঞ্চলিক সমাজকে অতিক্রম করে, সাংস্কৃতিক গণ্ডী উত্তীর্ণ হয়ে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি বিশ্বে।

বেতার মাধ্যম

      ভারতবর্ষে সর্বশক্তিমান গণমাধ্যম বেতারজগৎ দেশ-বিদেশের সংগীত, সাহিত্য, অভিনয় ইত্যাদি প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে একসূত্রে গ্রথিত করে সহজেই। ভারতের স্বাধীনতার প্রথম দিকে ৩২টি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীত। প্রত্যহ উষাকালে রেডিওর কার্যক্রমের শুভসূচনা হয় ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতের মাধ্যমে।

      ১৯৫০ সালে প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব হয় এবং ১৯৫৬ সালে ভারতের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এবং প্রায় অর্দ্ধেক সংখ্যক দেশবাসীর কাছে পৌঁছে যায় বেতার সম্প্রচার। তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের অধীনে সংগীত ও নাটক বিভাগে প্রায় ৪৩টি বিভাগীয় গোষ্ঠী এবং ৫০০টি বেসরকারী সংস্থা প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ অনুষ্ঠান ক’রে থাকে। বিবিধ শ্রেণীর শ্রোতারা এর মাধ্যমে সম্মিলিত হয়। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি জনগণের আগ্রহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বেতারে National Programme আয়োজিত হয়।

      পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং হিন্দুস্থানী ও দক্ষিণী শাস্ত্রীয় সংগীত-শিল্পীদের সম্মিলিত প্রয়াসে নির্মিত হয় ‘বাদ্যবৃন্দ’। ১৯৫৪ সাল নাগাদ অনুষ্ঠানের ৩১ শতাংশ ছিল মার্গসংগীত-নির্ভর। বর্তমানে, বেতার-অনুষ্ঠানের ৪২ শতাংশ হল সংগীতানুষ্ঠান। F.M. প্রচার-তরঙ্গের মাধ্যমে বেতারজগৎ তার ক্ষেত্রপ্রসারে নিয়তই প্রয়াসী। প্রায় ৮৪টি প্রচারকেন্দ্র প্রায় ৯০ শতাংশ দেশবাসীর কাছে তার সম্প্রচার পৌঁছে দেয়। প্রতিদিন ৩৫টি ভাষা এবং ১৩৭টি আঞ্চলিক ভাষায় দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্ভারতে বেতার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। আমরা দেখি গ্রামেগঞ্জে, মফস্বল শহরের রাস্তাঘাটে, দোকানে শ্রমিক বা কৃষকদের কর্মক্ষেত্রে সারাদিনের সাথী হল ট্রান্‌জিস্টার।

চলচ্চিত্র

      ভারতে চলচ্চিত্র-শিল্পের সাফল্য অনেকাংশই সংগীতের উপর নির্ভরশীল। প্রথমদিকে লোকসংগীত, ভক্তিগীতি, উচ্চাঙ্গসংগীত, গজল ও কাওয়ালি বেশি ব্যবহার হত।

      বৃটিশ সরকারের সেন্সর বোর্ড মূলত চলচ্চিত্রের সংলাপের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতেন, কিন্তু ছবিতে ব্যবহৃত দেশাত্মবোধক গানগুলি মুক্তি পেতে বাধা পেত না। ফলে এগুলি গভীর জাতীয় সংহতিভাব জাগ্রত করত এবং জাতীয় আন্দোলনে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ১৯৩৬ সালে ‘জন্মভূমি’ ছবিতে অশোক কুমারের ‘জয় জয় প্যারী জন্মভূমি মাতা’, ১৯৪০-এ ‘বন্ধন’ ছবিতে লীলা চিৎনিস্-এর ‘চল্ রে নওজয়ান’, ১৯৪৩-এ অনিল বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘কিসমেত’ ছবিতে ‘আজ হিমালয় কি চোটি সে’, ১৯৪৪-এ জি.এম্. দুরানি ও মঞ্জুর ‘ওয়াতন সে চলা হ্যায়’ প্রভৃতি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়।

      স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় নেতাদের জীবন অবলম্বন করে নির্মিত বহু চলচ্চিত্রে স্বদেশী গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি নরসিং মেহ্‌তা রচিত ‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে’ গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় গান ছিল। শ্যাম বেনেগালের ‘গান্ধী’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে গীত হ’লে সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৬৬-তে ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে ক্ষুদিরামের স্মরণে পীতাম্বর দাসের রচিত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এবং INA-র অন্যান্য উদ্দীপক গানগুলিও প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিভাবান শিল্পী সবিতাব্রত দত্ত চারণকবি মুকুন্দদাসের ভূমিকায় অসাধারণ সব স্বদেশী-গান পরিবেশন করেন।

https://www.youtube.com/watch?v=5wjGc1zGWBc

      ১৯৫৫-তে রাজকাপুরের ‘শ্রী-৪২০’ ছবিতে মুকেশের গাওয়া, শৈলেন্দ্রর লেখা ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানী’ গানে ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দোস্তানী’ উল্লেখ করা যায়। ‘উপকার’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রের ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’, ‘পুরব ঔর পশ্চিম’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রের গান ‘ভারত কা রহনেওয়ালা হুঁ’ প্রভৃতি উল্লেখ্য। ১৯৫২ সালে বেতারে ফিল্মিগান প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর ফলে শ্রোতার সংখ্যা বিশেষভাবে হ্রাস পেতে থাকলে পাঁচবছর পর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। শুধু ভারতে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য-প্রাচ্য এবং আফ্রিকাতেও এর চাহিদা বিপুল বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি ভগৎ সিং-এর উপর ফিল্মেও আলোড়ন ফেলা দেশাত্মবোধক গান পাই। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত শুধু স্বদেশী গান নয়, প্রেমের গানও সংহতির ভূমিকা পালন ক’রে থাকে।

রেকর্ডিং

      ভারতবর্ষে প্রথম মোম-রেকর্ডিং প্রবর্তিত হয় ১৯০১ সালে। বম্বেতে ১৯০২ সালে প্রথম ভারতীয় সংগীতের রেকর্ডিং হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে H. Bose Records রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ১৪টি দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোম সিলিণ্ডারে রেকর্ড করা গানগুলি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পরে হেমেন্দ্রনাথ বসু ফরাসী কোম্পানী Pathey-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কবিকণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ এবং ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’ গান দুটি মোম সিলিণ্ডারের পরিবর্তে ডিস্কে রেকর্ড করেন। অবশ্য প্রকাশের সময় রেকর্ডে ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’-র জায়গায় ‘সোনার তরী’ কবিতা আবৃত্তি প্রকাশিত হয়।

Two-minute wax cylinders. http://www.tinfoil.com/cylinder.htm
Close-up of Edison ‘Home’ phonograph playing an old wax record.Tinfoil.com – Early Recorded Sounds & Wax Cylinders

      প্রথম যুগে কুসংস্কারবশত ভদ্র পরিবারের শিল্পীরা রেকর্ড করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। পেশাদারী মহিলা শিল্পী বিশেষত বাঈজীরাই রেকর্ড করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং অনেকেই উচ্চমানের শিল্পী ছিলেন। ক্রমে এই মাধ্যম খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

      প্রথমদিকে গ্রামোফোন কোম্পানী শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত রেকর্ড করলেও পরে ভারতীয় লোকসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানও রেকর্ড হতে থাকে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘বন্দেমাতরম’ গানেরই ১২৫টি পৃথক রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৩০-এর দশকে সবাক চলচ্চিত্র আসার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটে।

      প্রসঙ্গক্রমে আমরা বিখ্যাত সংগীত রচয়িতা শচীনদেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী বা ভূপেন হাজারিকার অবদান স্মরণ করব যাঁরা তাঁদের নিজস্ব সুরের সঙ্গে লোকসংগীতের সুরের সম্মিলন ঘটাতেন অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে। জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ও হিন্দী রেকর্ড জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। রাহুল দেব বর্মণ আমাদের সংগীতে পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণ ক’রে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন।

দূরদর্শন

      একবিংশ শতকে সাংস্কৃতিক সংহতি আনয়নে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হল দূরদর্শন।

      ১৯৫৯ সালে দিল্লীতে পরীক্ষামূলকভাবে দূরদর্শনকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং ১৯৬৮ সালে তার জয়যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে, দৈনিক ১২টি ভাষায় ১৮ থেকে ২২ ঘন্টা সম্প্রচার কার্য চলে। কিন্তু গ্রামের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন ক্রয় করতে সমর্থ। দূরদর্শনে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিবিধ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দূরদর্শন-প্রচারিত ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ ১০/১২টি ভাষায় গীত গানটি যেন সারা ভারতকে একসূত্রে বাঁধে। কুসংস্কার দূরীকরণ, বিজ্ঞান ও শিল্পসংস্কৃতির বিবিধ অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে সংগীত।

      নব নব টেলিকমুনিকেশন আঞ্চলিক সমাজ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন করে। তাদের সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধ’রে তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগায়। এর ফলে একদিকে যেমন মুছে যাচ্ছে ভৌগোলিক সীমানা, শিল্প-সংস্কৃতি হয়ে উঠছে সার্বজনীন, অপরদিকে আধুনিক বাজারের চাহিদানুযায়ী একীকরণের প্রবণতার ফলে আঞ্চলিক শিল্প-সত্তা এক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় স্বতন্ত্রতা, নিজস্ব মৌলিকতা।

তথ্যসূত্র

১. D.S. Mehta – Handbook of PR. Allied Pub Ltd.

২. Ashok Ranade – Hindusthani Music

৩. Jogendra Singh – Cultural Change in India.

৪. A Team of Experts, Modern UGC NET / SLET 2004.

৫. John Story – Cult Studies and Studies of Pays Cult.

৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – সংগীতচিন্তা।