লোকায়ত দর্শন ও দেহতত্ত্বের গান
ড. শ্রাবণী সেন
আ্যসোসিয়েট প্রফেসর, সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী
সংস্কৃতির উৎস লোকজীবন। সমাজে যাদের ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়, তারা সাধারণ অমার্জিত এবং নিরক্ষর বা অল্প লেখাপড়া জানা মানুষ। এরা শহর ও নগরের মানুষ থেকে আধুনিকতার নিরিখে অনেক পিছিয়ে। এই ‘লোক’ নামে কথিত মানুষদের একদিন প্রতিদিনের জীবন চর্চার মধ্যে নিহিত সংস্কৃতিই-লোকসংস্কৃতি। মানুষের জীবনাচারণের জন্য নানা কর্মকাণ্ডের ভেতর থেকেই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে বলা যায়। লোকসংস্কৃতি বলতে বোঝায় যারা নগর সভতার বাইরে পিছিয়ে পড়া মানুষ, যাদের জ্ঞান, বিশ্বাস, ভাবনা, নৈতিকতা, আচার-আচরণ আবহমান কাল ধরে অদ্যাবধি প্রবাহমান। এই সংস্কৃতি নিয়ে পিছিয়ে পড়া ‘লোক’ নামে অভিহিত মানুষেরা নগর সংস্কৃতির পাশাপাশি তাদের সংস্কৃতিকে আজও আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। সংস্কৃতির একটি বড় মাধ্যম হল ‘ধর্ম’। এদের মধ্যে কেউ বা একেশ্বরবাদী, কেউ বা বহুমাত্রিক দেবদেবীতে বিশ্বাসী। কিন্তু যারা লোক নামে চিহ্ণিত, ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ধারণাও ভিন্ন। এদের বেশিরভাগই কেবল ‘বস্তু’কে প্রত্যক্ষ করে বলে তারা বস্তুবাদী। এরা বলে ‘যারে দেখি না নয়নে তারে ভজিব কেমনে’। এরা নিজেদের বাইরে বিশ্বকে অনেক বড় করে দেখে। এমনিভাবে তারা সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, প্রকৃতি, সমুদ্র ইত্যাদিকে যেমন ভয় পায়, আবার তাদের দেবতা জ্ঞানেও পূজো করে। এদের জ্ঞান যতটুকু তার মধ্যেই তাদের অবস্থান। পণ্ডিতেরা তাদের ‘লোকায়ত’ বলে অভিহিত করেছেন। লোকায়ত বলতে তারা সাধারণ লোকের দর্শন, জনসাধারণের দর্শনকে বুঝিয়েছেন।লোকায়ত হলো ইহলোক সংক্রান্ত দর্শন: যারা পরলোক মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না তাদেরই বলে লোকায়তিক। তারা মনে করে জল মাটি আগুন হাওয়া দিয়ে গড়া এই মূর্ত পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য, আত্মা বলতে দেহ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। সাধারণ লোক অর্থ ও কামকেই পরম পুরুষার্থ মনে করে। এরা পরকাল নিয়ে ভাবে না আর সে কারণে পরলোকের কথাকে তারা বিশ্বাস করতে চায় না। লোকায়ত হল দেহাত্মবাদ, বস্তুবাদ -‘মেটিরিয়ালিজম’। এরা পদার্থকেই জানে। যা চোখে দেখা যায় বা প্রত্যক্ষ করা যায়, তাকেই এরা বিশ্বাস করে। সে কারণেই তারা লোক এবং তাদের ধর্ম লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী দর্শন।একসময় আমাদের দেশে লোকায়ত গুহ্য ধর্মসাধনার প্রয়োজনে বাণীর আড়ালে তত্ত্বকে লুকিয়ে রাখা হত। যদিও চর্যাগান থেকে নাথপন্হীদের গান, বৈষ্ণব সহজিয়াদের গান, শাক্তগান ও বাউলগানকে ছুঁয়ে সেই গোপন গানের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানকেও স্পর্শ করেছে। এগান রূপকগান যার বাইরের অর্থ এক আর ভেতরের অর্থ আর এক। এ গান অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অনুধাবন সম্ভব। দেহতত্ত্বের গান বলে লোকায়ত বর্গের গান বাংলাদেশ বহুকাল ধরে চলে আসছে। হাজার বছরের বাংলা গানের স্রোতধারার অলক্ষে রয়ে গেছে গভীর গোপন ব্যক্ততা। রূপকের আবরণে ঢাকা চর্যাগান থেকে বাউলগান পর্যন্ত বাংলা গানের এই ধারায় এক অন্তঃস্রোতের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের শিক্ষিত সমাজের অজ্ঞতায় তা দেহতত্ত্বের গান বলে চিহ্ণিত হয়েছে। কিন্তু দেহতত্ত্বের গান আসলে এক বলিষ্ঠ জীবনবাদের বাস্তবতার ধারাবাহী। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে আধ্যাত্মপ্রেমে দেহবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। চৈতন্যদেব দেহকে প্রতীকী রূপে বিবেচনা করে রাধাকৃষ্ণের প্রেমে এক নতুন বৈভব এনেছিলেন। বর্ধমান বীরভূম অঞ্চলের বাউল গানে দেহতত্ত্ব রাধাকৃষ্ণের প্রতীকী প্রেমে স্রষ্টাকে মানবপ্রেমের দৃষ্টান্তে ধরা দেয়। যদিও এ প্রেম গুরুর মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভালোবাসার সম্পর্ক কেবল গুরুই নির্দেশ করতে সক্ষম হয়। বাউল প্রেমের এই গুরু প্রধান্যের উৎস মূলত চর্যাপদ। বাউল গানেও তারই আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।দেহতত্ত্বের গান শুধু বাউলরাই লিখেন নি, বস্তুত বাংলা গানের একেবারে আদি উৎস সিদ্ধদের রচনা চর্চাগীতি থেকে শুরু করে মধ্যযুগের সহজিয়া বৈষ্ণবদের গান, যোগী সম্প্রদায়ের গান, এমনকি রামপ্রসাদের শাক্তগানে দেহসাধনার কথা স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বেশী দেহসংকেত পাওয়া যায় বাউল, মুর্শিদা ও মারফতি গানে, কর্তাভজাদের গানে, সাহেবধনী এবং বলরামীদের গানে। এইসব উপধর্মীয় সম্প্রদায় যে শুধু দেহাত্মবাদী তাই নয়, তারা গুরু নির্দেশিত কায়াসাধনাতেও বিশ্বাসী। কায়াসাধনার সঠিক পথনির্দেশের জন্য এ ধরণের গানের জন্ম হয়েছে বলা যায়।দেহতত্ত্বের গান রূপক আর প্রতীকে গাঁথা। জোলা, তাঁতী, কামার, মোদক, শিউলি- জৈবিক সমাজের বৃত্তিজীবী মানুষের সমন্বিত জীবনের লেনদেনের শরিক হয়ে থাকে বাউল ফকির বা দেহাত্মবাদী সাধকেরা। তাদের গানের ভুবনে তাই বস্ত্তজীবনের ছবি রূপকে-প্রতীকে উঠে আসে। গানের গীতিকার মূলত তারাই। জীবনের অনিত্যতা দেহের নশ্বরতা আর প্রাণের আসা-যাওয়া বোঝাতে গ্রাম্যগীতিকার লেখেন – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়’। রূপকপ্রিয় গ্রাম্য শ্রোতাকে দেহ-খাঁচার বিষয়ে আসক্তি ত্যাগের উপদেশ দেওয়া হয়েছে গানে – মন তুই রইলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে। ১দেহতত্ত্বের গান আমাদের দেশে দুই ধরনের সাধক লিখেছেন। কায়া সাধক এবং মরমিয়া। এই দুই বর্গের সাধকই নিজেদের সহজ পথের পথিক বলে আখ্যাত করেছেন। উচ্চবর্ণের দেবদেবী পূজার সমান্তরালে দেহচেতনাসম্পন্ন গুহ্য সাধনা অব্যাহত ছিল। অদ্বৈতবাদীদের ঝোঁক ছিল দেবতাকে জানা নয়, নিজেকে জানা। আমাদের মরমিয়া সহজ সাধকেরা তাঁদের স্বাভাবিক ভারতীয় ঐতিহ্য থেকেই আত্মোপলব্ধির পথকে প্রাধান্য দেন।
সহজিয়ারা বলেন – আপন শরীরতত্ত্ব জানে যেই জন। সেই তো পরমযোগী শাস্ত্রের বচন।।২ – নিজ দেহ জানিলে আপনি হবে স্হির।৩ অন্তরের আত্মোপলব্ধির পথ হল নিজের শরীর তত্ত্বকে জেনে সিদ্ধিলাভ। অর্থাৎ আত্মোপলব্ধির অর্থ নিজের শরীর আর আত্মাকে বোঝা। এক্ষেত্রে সাধনার দুটি পথ- ‘স্বকীয়া’ অর্থাৎ সকাম এবং ‘পরকীয়া’ অর্থাৎ নিষ্কাম সাধনা। অর্থাৎ স্বকীয়াকে আশ্রয় করে পরকীয়ায় পৌঁছানোই সহজ সাধনার লক্ষ্য।দেহবাদীরা বিশ্বাস করেন-লজ্জা ঘৃণা ভয় তিন থাকতে নয়।৪ তাই শরীরের বর্জ্যপদার্থ তারা বিনা সংকোচে গ্রাস করে। তাকে বলে ‘চারিচন্দ্র সাধন’। চারিচন্দ্রের অর্থ আব বাতাস খাক বাদ অর্থাৎ জল আগুন মাটি বাতাস।‘চন্দ্র’ শব্দটি দেহবাদীদের পক্ষে খুবই দ্যোতক। স্বর্গচন্দ্র আর দেহচন্দ্রকে এক করাই তাঁদের কাজ। তাদের বিশ্বাস মানব শরীরে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে- দেহের তত্ত্ব জানবি তবে আগে গুরুর চরণ ধর। পাবি রে তুই নিত্যদেহ চারিচন্দ্র সাধন কর। ৫নিত্যদেহ লাভ করার অর্থ ‘জ্যান্তে মরা’। সাধক সেই অবস্থায় পৌঁছাতে চান। যেমন-সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের তত্ত্ব ওই হাতে দশ পায়ে দশ গণ্ডস্হলে দুই। অধরে ললাটে দুই অর্ধচন্দ্র তার উপর।৬ এই চন্দ্রবহুল মানবশরীর নিয়ে যখন পুরুষ নারী সংগত হয় তখন তাকে বলা হয় ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’। বাউলদের কোনও কোনও গান অধরা সম্পর্কিত। অধরার অবস্থিতি ও প্রাপ্তির নির্দেশ আছে গানে। সাধনরহস্যের গান তার ইঙ্গিতে পূর্ণ। তাদের এইধরণের গানে থাকে দ্ব্যর্থক জটিলতত্ত্ব, হেঁয়ালি ধাঁধার মত কথায় আবৃত। দেহতত্ত্বের গান যাঁরা লিখেছিলেন দেহই ছিল তাঁদের ইহ জীবনের একমাত্র সম্পদ, তাই দেহের উপমাতেই তাঁরা জীবনকে বুঝেছেন এবং অন্যকে তা বুঝিয়েছেন। সমমানস স্তরের সাধক না হলে ভাবের আদান প্রদান সম্ভব হয় না। বিশেষ করে সহজিয়া সাধনের ইঙ্গিতপূর্ণ তত্ত্ব বোঝান শক্ত।বস্তুত মানুষের জীবন ধারাবাহিক মায়াবদ্ধতার ইতিহাস। সংসার, নারীদেহ, সন্তান, মায়ামোহ আর আত্মপ্রেমে তার বদ্ধতা এসে যায়। একটি গানে বলা হয়েছে-আত্মতত্ত্ব বিচার কর দেখি ওরে মনপাখিতুমি কি পড়ে পণ্ডিত হয়েছেতোমার স্বরবর্ণ আছে বাকি।আত্মতত্ত্ব স্বরবর্ণ সে তো নয় সামান্যপরতত্ত্ব ব্যঞ্জনবর্ণ ফলাতে গণ্যসে যে স্বর ভিন্ন নয়-স্বর হতে হয় দুয়েতে মাখামাখি।যারে গুরুতত্ত্ব কয় সে যে যুক্তাক্ষর হয়-স্বরবর্ণ জ্ঞান বিনে যুক্ত কেহ না বুঝায়।ও যার স্বরেতে ভুল লেগেছে গোলকি হবে যুক্ত শিখি।৭অর্থাৎ দেহতত্ত্বের মূল ইঙ্গিতগুলো নির্দেশিত হয়েছে। বর্ণবোধের সূচনায় যেমন স্বরবর্ণ দেহযোগর সাধনায় প্রথমেই সেরকম আত্মতত্ত্ব অর্থাৎ আমি কে, আমি কোথায় ছিলাম, আমার কি কাজ, আমার পরিণাম কি? এবং পরতত্ত্ব অর্থাৎ আমার সঙ্গে জগৎ ও জীবনে সম্পর্ক কি, শরীরে আমার কোন বস্ত, মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? আত্মতত্ত্ব না হলে পরতত্ত্ব হয় না। কোথায় পাবো আমার মনের মানুষ, এই প্রশ্নে বস্তুবাদ ভেদ করে এক ভাবময় আকুতি, যেন মনকে ছুঁয়ে যায়। অলব্ধ ও অপ্রাপণীয়ের জন্য বেদনার গাঢ় আকুতি দেহতত্ত্বের গানে সুদূরতা এনেছে। মরমি শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে এই গান। রহস্যসুন্দর বাংলা দেহতত্ত্বের গানের একটা বড়ো অংশ তাই সবসময় অদৃশ্য থেকে যায়।বাউলদের দেহতত্ত্বের গান বা সাধনরহস্যের গান এমনি দ্ব্যর্থকভাবে রচিত হয়ে থাকে। সাধন-পদ্ধতির ইঙ্গিত পর্যন্ত বাউলদের গানের কথায় প্রচ্ছন্ন। একসময় নিম্ন স্তরের হাড়ি-বাগদি-কৈবর্ত-জেলের মধ্যেও সহজিয়া সাধনরীতির প্রচলন ছিল। লালন-দুদ্দু-কবীরের জন্ম খুব নিম্নবর্গের খেটে খাওায়া মানুষের ঘরে। কবীর ছিলেন জাতে জোলা, রুইদাস চামার, দাদ্দু ছিলেন ধুনকর। কবীর-দাদ্দু সাধক পরম্পরা আমাদের জন্য রেখেগেছেন যে অজস্র গানের উত্তরাধিকার তার সাথে বাউল বা সহজিয়াদের গানের সত্যে বা তত্ত্বে খুব ফারাক নেই।বাংলা দেহতত্ত্বের গান সবসময় নিম্নবর্গ ও নিম্নবিত্তদের রচনা নয়। অনেক শিক্ষিত মানুষও এ ধরণের গান লিখেছেন। গান রচনার ধারা সবসময় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভেদ করে না। দরিদ্রসীমার নীচে বেঁচে থাকা গ্রামবাসীদের সান্ত্বনা ও পরামর্শ দেয় এই গান। পুরাণ কোরনের নানা উল্লেখ, নানা প্রতীকের ব্যবহার, জীবন ও সমাজের ব্যবহারিক ছবি দেহতত্ত্বের গানের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছে। সাধারণ অশিক্ষিত শ্রোতার মনেও এ গান নানা চিন্তা ও তর্কের আলোড়ন তোলে, ভাববাদ থেকে তাদের নিয়ে আসে বস্তুচেতনায়। তারা নানা প্রসঙ্গ ও যুক্তি দিয়ে জাতিধর্মহীন উদার সমাজের সুস্থ স্বপ্ন দেখায় । বলরামীদের গানেও মানবদেহ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে দেহ হল মায়ার ঘর আর তাতে রয়েছে প্রবোধর বেড়া। তারা মানবদেহকে বলেছেন ‘কল’। গানে বলা হয়েছে এ কলের দুখান চাক বাঁকা উপরে খেলছে দুই পাখা – দুজন কলে চৌকি আছে দুজন তাই দিচ্ছে পাহারা। ৮এখানে ‘দুখান চাক বাঁকা’ বলতে দুই কণ্ঠাস্হিকে বোঝান হয়েছে। দুই পাখা বলতে বোঝান হয়েছে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসকে। কলের চৌকি দিচ্ছে দুই চোখ, আর তাকে পাহারা দিচ্ছে নাক আর কান। গানে বলা হয়েছে- যেমন জলের ভিতর আগুনআগুনের ভিতর সে জলকারিগরের গড়া এ কল কখনও তা হয়নাকো অচল। ৯ আগুন আর জল হল দেহের উষ্ণতা আর শীতলতার রূপক। এই দুইয়ের স্বাভাবিক সঞ্চারে দেহ-কল সচল থাকে। এই কলের পাশে চারখানা থাম আছে গো তারদেখ দেখতে কি বাহার ? থামের ভিতর তিন থাম আছে কারিগর খবর নিচ্ছে তার। ১০ চারখানা থাম মানে দুই হাত আর দুই পা, তিন তার অর্থে ইড়া পিঙ্গলা সুষু্ম্না নাড়ি।আবার বলা হচ্ছেকোন্ প্যাঁচে ওঠায় বসায়কোন্ প্যাঁচে চলায় বলায় কোন্ প্যাঁচে কারিগরের হাতে। কখন টিপ নিয়ে বন্ধ করবে কল। ১১ দেহ-কলের চাবি নিজের হাতে নেই। তা যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।দেহতত্ত্বের সাধনায় গুরুবাদ বা গুরুপ্রসঙ্গও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই দেহতত্ত্বের সাধনায় গুরু ত্যেজে গৌর ভজা চলে না। তাই গুরু সাধন পথের দিশারি। এঁদের বিশ্বাসের বিচিত্র জগতে গুরু অগনণ। দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু ছাড়াও নিজের শ্বাসগুরু ও ভজনসঙ্গিনী নারীকেও গুরু বলা হয়।সাধারণভাবে মানুষ মায়ার বশীভূত। সে ভাবে-‘ভুলে আত্মতত্ত্ব সংসার লয়ে কেবল ‘আমার’ ‘আমার’ করিছে’। ১২তাকে আত্মস্হ করাই দেহবাদীদের কাজ। তারা পূর্বজন্মে বিশ্বাসী নন। তাই বলেছেন-পাবে সব বর্তমানে প্রাপ্তি যাহা এ জীবনেবিফল সব মরণে। ১৩সেইকারণে এঁরা কল্পনাবাদী নন, ভাববাদী নন। এঁদের বক্তব্য-এই দেহ মিথ্যে নয় এ দেহেই আছে রতন।যে খোঁজে পায় অন্বেষণ জীয়ন্তে মরে আপন ইচ্ছায়।১৪দেহাত্মবাদীদের মতে সেই অন্বেষণ না করে, নিজের দেহভাণ্ডকে না জানলে অবস্থা দাঁড়ায় –আপন ঘরের খবর হয় না বাঞ্চা করি পরকে চেনা। ১৫এইকারণেই দেহতত্ত্বের গানের একটা পর্যায়কে বলে ‘মনঃশিক্ষা’ এবং আর একটা পর্যায়কে বলে ‘আখেরি চেতন’।স্পষ্ট দেহেন্দ্রিক শব্দ ছাড়াও এমন অনেক ধরণের গান পাওয় যায় যা মনঃশিক্ষা, গুরুতত্ত্ব ও আখেরি চেতন পর্যায়ের। সব পর্যায়ের গানগুলো দেহতত্ত্বের গানের সঙ্গে একটা সুপরিকল্পিত ছকে বাঁধা।আবার মাঝির কণ্ঠেও শোনা যায় অধ্যাত্ম চেতনার গান-বাইস্যা উজাইতাম না পারিমনের মতন না আইলে মাঝিবুঝাইতাম না পারিজণ্মি ধরি চাওনা মাঝি,মণিপুরার কাচারি।মনের মতন না আইলে মাঝি বুঝাইতাম না পারি। ১৬ভাঁটির টানে নৌকার গতি হয় নিম্নাভিমুখী। উজানগতিই উর্ধ্বমুখী। উজান যেতে গেলে কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। তেমনি উর্ধ্বগামী সাধনাও পরিশ্রম সাপেক্ষ। বিশেষকরে সহজিয়াপন্থীদের গান। ষটচক্রসাধন পদ্ধতিতে-কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করে উর্ধ্বমুখী করাই সাধকের লক্ষ্য। সে সাধনা শ্রমসাধ্য, উজানে চলার মত। ষটচক্রর অন্যতমচক্র মণিপুর পদ্মের অবস্থিতিও মাঝির অজ্ঞাত। তাই মাঝি ক্ষোভ করে গায়-জণ্ম ধরি চাওনা মাঝি, মণিপুরার কাচারি।এ কাচারি দেহমধ্যে নাভিমূলেস্থিত মণিপুরচক্র-শুধু কথ্যভাষায় সহজরীতিতে প্রযুক্ত মাত্র। সরল ধর্মবিশ্বাস, এক বিশেষ মানসচেতনার অধিকারী-সাধক এর অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম।বৈষ্ণব বাউলরা দেহতত্ত্বের গানকে বুঝিয়েছেন-আগে দেহের খবর জান – দেহের মাইঝে, পরমরতন বাইরে খুঁজলে পাবে কেন?দেহের ছয় রিপুকে বাইধ্য (বাধ্য) কইরেপ্রেম রসেত টেইনে আন আগে দেহের খবর জান। ১৭কখন বাউলরা গায় তুলনামূলক দেহতত্ত্বের গান। দেহমধ্যস্থিত ষটচক্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন চক্রের অবস্থিতি বোঝাতে কলকাতাস্থিত বিভিন্ন রাস্তার বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে তুলনা করে গান রচনা করেছেন- ললাটেতে লাটের বাড়ি জিহ্বায় জেজের ঘর কণ্ঠেতে কালেক্টর বইসে কাচারি গুলজার মানবদেহ কলকাতা হয় কি তা চমৎকার।। ১৮অর্থাৎ লাটের বাড়ির অবস্থান যেমন সেরা জায়গায়, তেমনি ভ্রু-যুগলে অবস্থিত আজ্ঞাচক্রও দেহের মধ্যে সেরা স্থান। কণ্ঠেতে আছে বিশুদ্ধ চক্রের অবস্থিতি। বিশুদ্ধ চক্র ষোলদল বিশিষ্ট, সেখানে সেই চক্রে অর্থাৎ কণ্ঠে কালেক্টর বসে আছেন। কখনও তারা দেহতত্ত্বের গানকে সাধারণের বোধগম্য হওয়ার জন্য রেলগাড়ির সঙ্গে তুলনাও করে থাকেন-গাড়ি চলছে আজব কলে দিয়ে মাটি পরিপাটি আগুন জ্বালায় হাওয়ার বলে।। (শ্বাস সাধন) কুলকুণ্ডলিনী মহারানি বইসে আছে চতুর্দলে হাওয়ার দম বন্ধ হলে কপাট সব যাইবে খুইলে।। ১৯ গভীর ভাবের দেহতত্ত্বের গানও বাউলেরা গায়-মন চল রে রূপনগরে গোলকের পতি তার মূলে স্থিতি যে রূপে সতত বিরাজ করে।সুষুম্না ধরিয়ে মৃণাল বাহিয়ে-উঠ শতদল পদ্মে –দেখবি চৌষট্টি কুঠুরি, আছে সারি সারিমণিময় চাঁদ সেই শহরে।। মন চল রে রূপনগরে – ২০ আবার বাউলরা বলছে-মানব দেহখান, আছে কতরূপ বাগানকলকাতা তার কোথায় লাগে, ইংরাজের নির্মাণ।আছে চৌদ্দ পোয়ায় চৌদ্দ ভুবনখোদা খোদা করে তৈয়ার মানবদেহ কলকাতা হয় কী তা চমৎকার।। ২১ ভাবার্থ – ‘চৌদ্দ পোয়া’ অর্থে এই দেহ, সাড়ে তিন হাত। এই চৌদ্দ পোয়া-যুক্ত দেহমধ্যে আছে বিভিন্ন চক্র। বিভিন্ন চক্র ভেদ করে উর্ধ্বগামী হওয়াই বাউলদের সাধনার উদ্দেশ্য। তাতেই হয় সিদ্ধি। চৌদ্দ পোয়ায় আছে চৌদ্দ ভুবন। বাউলদের কথায় আছে- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে-তাই আছে দেহভাণ্ডে। সাড়ে তিন হাত দেহমধ্যে সব কিছুই আছে- বাউলরা এরকম ধারণাই পোষণ করেন।বাংলা দেহতত্ত্বের গানগুলোকে বিচার করলে তার মধ্যে আমরা একটা দর্শন খুঁজে পাই। দেহও জীবনের অনিত্যতাবোধ, গুরুকরণের অবশ্যম্ভাবিতা, শাস্ত্রবিরোধিতা এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মানবপ্রেম এঁদের সকলের জীবন ও গানের মূল কথা। সারা ভারতের দেহতত্ত্বের গান একসঙ্গে সংকলিত হলে ভারতীয় নিম্নবর্গের এক সমৃদ্ধ জন-ইতিহাস পাওয়া যাবে। তথ্যসূত্র১। ব্রাত্য লোকায়ত লালন- – পৃঃ-২৬৬২। বাংলা গানের সন্ধানে- পৃঃ-৫৫৩। বাংলা গানের সন্ধানে-পৃঃ- ৩৮৪।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৬৯৫।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৭৮৬।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্যপৃঃ-৩৯৭। বাংলার বাউল ও বাউল গান-পৃঃ-৮৪৪৮। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্যপৃঃ-৪৮৯। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৪৮১০। বাংলা গানের সন্ধানে-পৃঃ-৪৯১১। বাংলা গানের সন্ধানে-পৃঃ-৫০১২। বাউল ফকির কথা –পৃঃ-১২৫১৩। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৪৫১৪। ব্রাত্য লোকায়ত লালন-পৃঃ-৭৯১৫।ব্রাত্য লোকায়ত লালন-পৃঃ-২৭১১৬। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-১৪৮১৭। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-১৫৩১৮।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-১৫৫১৯।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ১৫৩২০।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-১৫৫২১। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-১৫৬সহায়ক গ্রন্হ১। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়- লোকায়ত দর্শন।২। সুধীর চক্রবর্তী – বাউল ফকির কথা।৩। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য – বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রত্নাকর।৪। বিনয় ঘোষ – পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি।৫। দিনেন্দ্র চৌধুরী – পূর্ব বাংলার লোকসংগীত।৬। সুধীর চক্রবর্তী- বাংলা গানের সন্ধানে। ৭। মণি বর্ধন – বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য। ৮। বাংলার বাউল ও বাউল গান- অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।