March 1, 2023

রাঢ়বঙ্গের মিশ্র সংস্কৃতি

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড.শ্রাবণী সেন

আ্যসোসিয়েট প্রফেসর,সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709

পশ্চিম সীমান্ত বাংলার বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের মধ্যে মিশ্রসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। পশ্চিমবাংলার অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমা, পশ্চিম বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বীরভূমের সাঁওতাল পরগণা সীমান্ত অঞ্চল এবং বর্ধমান  জেলার আসানসোল মহকুমা এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অন্তর্গত। এই অঞ্চলের জনবিন্যাস, লোকভাষা, লোকসাহিত্য-সংগীত-নৃত্যকলা প্রভৃতির মধ্যে সীমান্ত বাংলার সংস্কৃতি বিশেষরূপে রূপায়িত হয়েছে। প্রাচীন রাঢ়ভূমির অন্তর্গত এই পুরাভূমে ধর্মে-কর্মে, আচার-অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণে, নৃত্য-গীতে, রীতি-নীতি-শিল্পকলায় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আজও রক্ষা করে চলেছে।

পুরাণে ‘প্রাচ্যদেশ’ বলতে রাঢ় অঞ্চলসমূহ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় গোটা এলাকা বোঝাত। এ অঞ্চলে জৈনধর্মের দ্বারা আর্যীকরণ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে  বাংলার পালরাজারা বৌদ্ধধর্মানুরাগী এবং সেনরাজারা ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়ায় জৈনধর্মস্রোতে ভাটা পড়ে। কিন্তু সেনরাজাগণ উদার ধর্মমতের অনুসারী থাকায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মাঝে জৈনধর্মের একাত্মীকরণ ঘটে। বস্তুত রাঢ়-বঙ্গে জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দুসংস্কৃতির সঙ্গে আর্যেতর উপাসনা ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। সেখানে জৈনভাবনার পাশে বৌদ্ধতান্ত্রিক যুগের অষ্টভুজা দেবীদুর্গা এবং শিব-পার্বতী-গণেশ প্রভৃতি প্রস্তরমূর্তি আজও দেখা যায়। সংস্কৃতি-সমন্বয়জাত মিশ্রসংস্কৃতির ফলে প্রত্যন্ত বাংলার মন্দিরসংলগ্ন বৃক্ষতলে কালভৈরব, বড়াম, কুদরাসিনি, সিঙবোমা, মারাঙবরু প্রভৃতি অপৌরাণিক তথা আর্যেতর জনগোষ্ঠীর দেবদেবীরও পূজা করা হয়। 

রাঢ়ের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় – প্রাচীন জৈনধর্মগ্রন্হে (আচারাঙ্গ সূত্ত) ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশের কথা আছে। রাঢ় দেশের দুটি ভাগ- ১)বজ্জ ভূমি বা বজ্রভূমি, ২) সুব্ভ  বা সুহ্মভূমি। খ্রীঃপূর্ব  দ্বিতীয় শতকে মহাভাষ্য-রচয়িতা পতঞ্জলি পূর্বভারতের অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম  তিনটি বিভাগের কথা বলেছেন। অঙ্গের বেশিরভাগ এখন বিহারে; কিছু অংশ মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম অঞ্চলে। গঙ্গা নদীর বিস্তীর্ণ জলময় স্হান ‘বঙ্গ’। ‘বঙ্গ’ কথার মূল অর্থ জলাভূমি। রাঢ় অঞ্চলকে বলা হত সুহ্ম। খ্রীঃ চতুর্থ-পঞ্চম শতক থেকে ‘সুহ্ম’ নামের পরির্তে ‘রাঢ়’ নামের প্রচলন হয়। জৈন উপাঙ্গ ‘পণ্ণবণা’ (প্রজ্ঞাপনা) গ্রন্হে রাঢ় ও বঙ্গের জনগণেকে আর্য বলা হয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীতে লেখা পালি ‘মহাবংশ’-এ ‘লার’ এবং নবম শতাব্দীতে ধর্মপালের তাম্রশাসনে ‘লাট’ শব্দেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো রাঢ়দেশ বোঝাতে ব্যবহৃত হত। সমগ্র বীরভূম, সাঁওতাল পরগণার বিভিন্ন অংশ, দামোদর নদের উত্তর তীরবর্তী বর্ধমান জেলা উত্তর রাঢ়ের অন্তর্ভুক্ত। হুগলী, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং সন্নিহিত ছোটনাগপুরের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ-রাঢ়। সীমান্ত অঞ্চল  জুড়ে ‘ভূম’ রাজ্যগুলো ছড়িয়ে আছে। একেবারে উত্তর-পশ্চিম সীমানায় বীরভূম; আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে নেমে এলে মানভূম। ভূমি থেকে ভূম আর ভুঁই। আদিবাসী ‘ভূমি’ বা ‘ভূম’ রাজ্যগুলো আজ যেন স্মৃতি থেকে লু্প্ত হতে বসেছে। এরই আশেপাশে ভাষাসংস্কৃতি-জনগোষ্ঠীর অচ্ছেদ্য বন্ধনে পরস্পরের গা-ছুঁয়ে আছে সাঁওতালভূম, মানভূম, সিংভূম, ধলভূম। পশ্চিমে বাংলার প্রাচীনতম অঞ্চল – রাজমহল, সাঁওতালভূম, মানভূম, সিংভূম, ধলভূমের পূর্বের মালভূমি এই পুরাভূমির অন্তর্গত। আবার বাংলা-বিহার সীমান্তের একদিকে বীরভূমের পশ্চিম সীমানা, আর একদিকে সাঁওতাল পরগণা, পশ্চিম বর্ধমান, ধনবাদের খনি অঞ্চল, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর ধলভূম এবং উত্তর রাঢ়ভূমি  বীরভূমের প্রত্যন্ত দেশে অবস্হিত  বিহার প্রদেশর সাঁওতাল পরগণা, হাজারিবাগের পূর্ব অংশের ভূ-প্রকৃতি, সমাজবিন্যাস, ভাষাসংস্কৃতির আত্মিক বন্ধনে দুইদিক এক ও অভিন্ন হয়ে ধরা দিলেও-এই সমস্ত অঞ্চল রাঢ় খণ্ডেরই অধীন – ভাষায় ও  সাংস্কৃতিতে তা বৃহৎ বঙ্গেরই অংশ।     

পশ্চিম বাংলার পশ্চিমসীমান্তবর্তী অঞ্চলে রাঢ় সাংস্কৃতিক পটভূমিকায়  অনার্যভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পরিক সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। মূল অষ্ট্রিক ভাষী সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, বিরহড়, মাহালী, কোড়া প্রভৃতি উপজাতির অন্তরঙ্গ ভূমি হিসেবেই এই অঞ্চলে অবস্হিতি। রাঢ়ের  আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন ‘গোপ’ রয়েছে তেমনি আছে ব্যগ্রক্ষত্রিয় ও উগ্রক্ষত্রিয়। বাগদি, বাউরি, ডোম, সদগোপ,  চাষা, ধীবর, কুর্মিমাহাতো, আগুরি এই অঞ্চলে আদিকাল থেকে বাস করছে। অনেক উপজাতি বর্তমানে অষ্ট্রিক ভাষাকে বর্জন করে সীমান্তরাঢ়ী বাংলাকে গ্রহণ করেছে, ফলে তাদের সংস্কৃতিতেও এই ঐতিহ্য বর্তমান।

রাঢ়-বঙ্গ এবং সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তিক বাংলার বহমান লোকসংস্কৃতির অন্তর স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে প্রাগৈতিহাসিক আদি-অস্ত্রাল জনগোষ্ঠী তথা পরর্তীকালে আর্যীকরণ ভাবনার স্তর বিন্যাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা প্রয়োজন। একসময় জৈন-বৌদ্ধ  ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম রাঢ়-বঙ্গে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তিক বাংলায়  বিস্তৃত জনজীবনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপকরণের মাঝে মিশ্র সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া যায়। ফলে আদি-অস্ত্রাল ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষের ধর্ম ভাবনার সঙ্গে মিশেছে আর্য সংস্কৃতির ধারা, সেই সাংস্কৃতিক বিমিশ্রণের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় শিবের গাজনে, করম-বাঁধনা-ভাদু-টুসু পরবের মধ্যে।

‘সুহ্ম’ বা ‘রাঢ়দেশ’ এবং সন্নহিত পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ছোটনাগপুর  অঞ্চল বিভিন্ন নামে অভিহিত হলেও সেখানকার বিশাল জনজীবনের সাংস্কৃতিক চেতনা মূলত একই জীবন ছন্দে বহমান। ফলে সীমান্ত বাংলার আদিম ও লোকজীবনকে আঁকড়ে আছে এইসব অঞ্চলের লোকমুখে প্রচারিত  গ্রামীন সংগীত বা লোকগান। এইসব লোকসঙ্গীতের মধ্যে আছে ভাদু, টুসু, ঝুমুর, মনসার জাত, মেয়েলীগীত, বৃষ্টিনামার গান প্রভৃতি। বাংলার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ত্রাল ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী প্রাগার্য-জনসংস্কৃতির  সঙ্গে পরবর্তীকালে হিন্দু-সংস্কৃতির মিশ্রণ বা সমন্বয় দেখা যায়। ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলা এবং সন্নিহিত ছোটনাগপুরের বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলেও মূলত রাঢ়ের ভাষা প্রচলিত।

বঙ্গদেশ তথা রাঢ় এবং সন্নিহিত ছোটনাগপুর অঞ্চলে লোক-উৎসবকে (Folk Festival)) প্রধানত দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় – ১) আচার অনুষ্ঠানমূলক (Ritual), ২) ঋতুমূলক(Seasonal)। শিব, ধর্মরাজ, মনসা প্রভৃতির পূজা মূলত আচার অনুষ্ঠানমূলক এবং করম, জাওয়া, ভাদু, বাঁধনা, টুসু ঋতুমূলক উৎসব।

দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তিক বাংলা এবং সন্নিহিত ছোটনাগপুর অঞ্চলে প্রচলিত  লোকসংস্কৃতির বিশেষ ধারা টুসুগানের উৎস সন্ধানে শুশুনিয়া পাহাড়ের প্রস্তরগাত্রে উৎকীর্ণ রাঢ়-বঙ্গের প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া গেলেও তার মধ্যে লোকায়ত জীবনের সাংস্কৃতিক ভাবনার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিম ঘেঁষা এলাকা অর্থাৎ বীরভূম-বর্ধমান-হুগলী-মেদিনীপুর-বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া – যা একসময় রাঢ়দেশের অংশ, সেখানে এবং তার পাশ্ববর্তী ধানবাদ-সাঁওতালপরগণা-হাজারিবাগ- রাঁচী, পশ্চিম মেদিনীপুর সংলগ্ন এলাকা ধলভূম-সিংভূম প্রভৃতি বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে গ্রামীণ কৃষিজীবি পরিবারের কিশোর-যুবতী, এমনকি পুরুষকণ্ঠেও শোনা যায় শস্যোৎসবের গান। পৌষের ডালা পাকা ফসলে ভরায় টুসু গান। ভৌগোলিক পরিবেশ অনুসারে প্রাচীন রাঢ়দেশ যাকে বলা হত তাইই হয়ে উঠেছে টুসুর আবাসস্হল। রাঁচি-হাজারিবাগ প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শুরু করে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া ছাড়িয়ে মেদিনীপুর পর্যন্ত টুসু আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে।

দক্ষিণরাঢ় এবং ছোটনাগপুর অঞ্চলে পূজিত ধর্মরাজ বা ধর্মঠাকুর সূর্যদেবতার প্রতীক। বাঁকুড়ায় অসংখ্য ধর্মঠাকুরের নামের সাথে সৌরভাবনা কাজ করে। অনাবৃষ্টি রোধে ঐন্দ্রজালিক উপায়ে বৃষ্টির আবাহনকল্পে সূর্যপূজা আদিমকাল থেকে নানাদেশে প্রচলিত। ধর্মপূজায়  ‘গৃহভরণ’ বা ‘ঘর ভরা’ এবং ‘কামিন্যা-আনয়ন’ অনুষ্ঠানে বৃষ্টি-আবাহনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ছোটনাগপুর মালভূমির ওঁরাওগণ  ‘ধর্মেশ’ নামে সূর্যদেবতার পূজা করে। ‘বিরিবেলাস’ নামেও তিনি পূজ্য। বর্ষশেষে শিবের চড়ক-গাজন হয়। বিষুব-সংক্রান্তি সূর্যপূজার দিন। মকর সংক্রন্তিতে সূর্য  বক্রগতিপ্রাপ্ত হয়। সেই ভাবনা থেকেই ধর্মঠাকুরের ‘বাঁকুড়া রায়’ বা ‘বুড়ো রায়’ নামকরণ হয়েছে। ধর্মঠাকুর বিভিন্ন নামে যেমন – ‘মেঘরায়’,’যাত্রা সিদ্ধি’, ‘দোলু রায়’ নামে পূজিত হন।

সর্পপূজা দ্রাবিড়-সংস্কৃতির অবদান। আর্যগণ পরবর্তীকালে দ্রাবিড় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের এক জাতি সর্পফণাকে জীবক (Totem) হিসেবে ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে মনসা গাছের সঙ্গে জীবিত সর্পভাবনা এক হয়ে গেছে।

ছোটনাগপুরের ওঁরাওদের মধ্যে মনসা পূজার প্রচলনে সাপের ওঝাকে তারা ‘নাগমতি’ বলে, রাঢ়ঙ্গের বহুস্হানে তাকে ‘গুণিন’বা ‘গুণী’ বলা হয়। জৈষ্ঠমাসের তেরো তারিখ ‘রোহিণ’- এদিন থেকে মনসা পূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। লোকভাবনায় সেদিন বৃষ্টি হলে সাপের বিষ ঝড়ে যায়। ঐদিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম প্রভৃতি দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায়  ঝাঁপান -পরব অনুষ্ঠিত হয়। ডাক-সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে লোকভাবনা অনুসারে গর্ভবতী ধানের চারাকে ‘সাধভক্ষণ’  করানো হয়। ছড়াকেটে গ্রামের লোকজন বলেন –

এতে আছে শুকুতা

  ধান হবে গজ-মুকুতা।

    এতে আছে পুরানো ‘বড়’

   মরাই করবে কড়্ কড়্।

দক্ষিণ রাঢ় এবং সন্নিহিত পশ্চিমাঞ্চলে জৈষ্ঠমাসে ‘দশহরা’র দিন মনসা পূজা হয়।  রাঢ়ের মনসাপূজা শুধুমাত্র আদিবাসী জীবনের উৎস নয়, বর্ণহিন্দুদের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে এই পূজায় অংশ গ্রহণ করে। বাঁকুড়ার দ্বারকেশ্বর নদতীরর্তী বাহ্মণপ্রধান অযোধ্যা গ্রামে দশহরার দিন ‘কালীবুড়ি’ মনসার পূজা এবং সেই উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা বসে। নাগপঞ্চমীর মধ্যে আমন ধান লাগানো  পর্বশেষ হয়। এ সময় ‘খইধরা’ পালন করা হয়। মনসা দেবীর ঐ ‘পালন’ করলে গৃহস্হের বংশবৃদ্ধি ও ধনলাভ হয়। প্রজনন -ভাবনাযুক্ত ঐ ‘পালন’-কে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া অঞ্চলে ‘খইঢেড়া’ বলে।

শ্রাবণ-সংক্রান্তিতে মনসা পূজায় সীমান্তবাংলার আদিবাসী মানুষের  মনসাথানে হাঁস-মুরগী বলি দেয় রীতি আছে। মনসাপূজারীর উপর মাঝে মধ্যে ‘ভর’ হয়। সীমান্তবাংলার মানুষ ‘ভর’ পাওয়া অপ্রকৃতিস্হ অবস্হায়, পূজারীর ঢাকের তালে নাচাকে বলে ‘ঝুপাইল’। মনসাপূজা উপলক্ষ্যে ‘ঝাঁপান’ অর্থাৎ সাপ-খেলানোর আনন্দ-উৎকণ্ঠাপূর্ণ মহড়া হয়। ‘আগেকার দিনে সর্পবিষারদ ‘গুণী’ দের ঝাঁপানে করে সমুৎসুক দর্শকণ্ডলীর সামনে উপস্হিত করা হত। ঝাঁপান গানে  ঝিঁঝিট, জয়জয়ন্তী, পাহাড়ী রাগের সন্ধান পাওয়া যায়। মনসার থানে মাটির হাতি-ঘোড়া, মনসার ঘট, মনসার চালি পূজার উপকরণ হিসেবে দেওয়া হয়।

লোকউৎসব (Folk Festival) আচার-অনুষ্ঠানমূলক (Ritual) বা ঋতুমূলক  (Seasonal) যা-ই হোক  না কেন, তাদের মধ্যে দৃশ্যত বা অন্তর্লীনভাবে কৃষিভাবনা তথা উর্বরতাবাদ বা প্রজননভাবনা (Fertility Cult) ক্রিয়াশীল। লৌকিক দেবতাদের মধ্যে শিব সর্বপ্রাচীন। তার কারণ অস্ট্রিকভাষাভাষী আদি-অস্ত্রাল  মানুষদের জীবনধারা ছিল কৃষিভিত্তিক। হিন্দু সমাজে ধান, ধানের গুচ্ছ, দুর্বা, হলুদ, পান, সুপারি, কলা, কলাগাছ, কর্পাস, পট্টবস্ত্র, সিঁদুর ইত্যাদি শুভকাজের মাঙ্গলিক উপকরণ। সৌভাগ্য কামনাকরী  এইসব মাঙ্গলিক উপাচার কিংবা লিঙ্গ পূজা (Phallic Worship) আদি-অস্ত্রাল ভাবনাজাত।

রাঢ়-বঙ্গে ঋতুমূলক  লোকউৎসবগুলো  শস্যোৎসব এবং তা প্রধান শস্য ধানকে নিয়েই। তাই ক্ষেতে লাঙল দেওয়া, বীজ বোনা, ধান রোওয়া, ধানগাছের পরিচর্যা, ধান কাটা, ফসল তোলা কৃষিজীবি মানুষেরা খুব আনন্দের সঙ্গে করে থাকে।ফলত প্রতিটি দেশের কৃষ্টি বা সংস্কৃতির সঙ্গে সেই দেশর মাটি ও মানষেুর, বিশেষত কৃষিভাবনার গভীর যোগ থাকে। দেশজ ভাবনাজাত কামনাবাসনা, অনুরাগ-বিরাগ, সুখদুঃখ নরনারীর শুধু প্রাণে নয়, গানেও জাগে। তাই রুক্ষ রঢ়ভূমি  ও সন্নিহিত ছোটনাগপুর  অঞ্চলেও দেখা যায়- ধান রোওয়ার ঠিক পরেই করম-জাওয়া পরব। ভাদ্রমাসে ভাদুই ধান ঘরে উঠলে ভাদু পরব, কার্তিকমাসে আমন ধান যখন মঠে মাঠে ফুলছে, কৃষিলক্ষ্মীর আগাম আগমনবার্তা তখন ঘরে ঘরে আনন্দেরজোয়ার আনে, ফসল কাটা, সোনার ধান ঘরে তোলার লোকউৎসব টুসু পরব। সীমান্তবাংলার প্রায় প্রত্যেকটি উৎসবেই কৃষি-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের প্রাধান্য। করম, ঈদ, বাঁধনা, টুসু প্রভৃতি প্রাচীন কৃষি উৎসবেরই বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন ঋতুগত অনুষ্ঠান। নাচে ও গানে এই ঋতুগত বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর(বিশেত ঝাড়গ্রাম ও শালবনী অঞ্চল) সিংভূম, ধলভূম, ধানবাদ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলা সন্নিহিত ছোটনাগপুর অঞ্চলের কুর্মী-মাহাতো ভূমিজ অধ্যুষিত আদিবাসী জনজীবনে করম উৎসবের প্রচলন। করম ভাদ্রের পরবে কিশোরী-কুমারী মেয়েরাই প্রধানত এই পরবে অংশ নেয়। ভাদ্রের শক্লা একাদশী তিথিতে  এ উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও  এর প্রস্ততি ভাদ্রের প্রথম থেকে দেখা যায়। অনেক জায়গায় শ্রাবণ মাস থেকে শুরু হয়। ভাদ্রের শুক্লা একাদশী তিথি পাশ্বৈকাদশীতে অনন্তনাগশয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুপাশ ফিরে শয়ন করেন। পরের দিন ইন্দ্রদ্বাদশী, অনুষ্ঠিত হয় ‘ছাতাপরব’। সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় সামন্তরাজগণ করম উৎসবের উপর হিন্দুগরিমা  আনার জন্য ইঁদ পরব বা ছাতাপরবের আগের দিন ‘করম-রাজা’ র  পূজার উপর  অনুষ্ঠানিক বিধি আরোপ করেন। জমিদার বাড়ীতে আগে করম-পূজা হওয়ার বিধি। তারপর প্রজারা তা পালন করে।

করম-পরবে করম গাছের দুটি ডাল মাটিতে প্রোথিত করে পূজা করা হয়। এটিকে করম রাজা মনে করা হয়। তিনি সূর্যের প্রতীক। এতে উর্বরতাবাদের (Fertility Cult) ইঙ্গিত আছে। সূর্যের তাপে অর্থাৎ ঔরসে এবং পৃথিবীর গর্ভে শস্যোৎপাদন হবে। পূজারিনীরাও কিশোরী কুমারী – অহল্যা ধরিত্রীর প্রতীক। ভাদ্রের সন্ধ্যা হলুদরঙের বন্যায় ভরিয়ে দেয় যে ফুল, সেই তাজা ফিরোজিয়া ঝিঙে ফুল – প্রিয়জনের কাছ থেকে খোঁপায় পরতে চায় পল্লী কিশোরী।  করম গানে ফুটে তার সুর –

ঝিঙা ফুল গাঁথি দেন ম’কে।

   হাতে ধরি চুমা খাব ত’কে।…..

সরস  ভাদ্রের মায়াবী সন্ধ্যায় সীমান্ত বাঙলার কিশোরীরা ঝিঙা ফুলের হলুদ হাতছানির ব্যাকুল। তাই বার বার ‘ফিরোজিয়া ঝিঙেফুল’ করম গানে ধরা পড়ে-

ঝিঙে ফুল সারি সারি

বঁধু বিনা রইতে লারি।

    আইজ্ বঁধু রইল কন্ খানে

          সখি ল, জইবন্ ঝিঙাফুলের কলি।…..

করম কুমারী মেয়েদরই পরব। অনেক জায়গায় বিবাহিত কিশোরী বিয়ের পরও এপরবে অংশ গ্রহণ  করে। তাই প্রবাসী কান্তের বিরহে বিরহিণী পশ্চিম সীমান্ত বাংলার যৌবনবতীও করম গান গেয়ে ওঠে-

 পখইর্ কুঁড়ালে বঁধু না বাঁধাইলে ঘাট।

ডালিম লাগায়েঁ  বঁধু গেলে পরবাস।।

     পাকিল ফাটিল  ডালিম পরে ভাঁইয়ে খায়।

ইদেশে পণ্ডিত নাই সঁয়াকে বুঝায়।।

      পাকিল ফাটিল  ডালিম চোরে ভাঁইঙে খায়।

      আমার বঁধু ঘরে নাই জইবন্ বইয়ে যায়।।

শিকার অরণ্যচারী  আদি-অস্ত্রালদের প্রাণের প্রিয় উৎসব। বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুরের আদিবাসী জীবন ‘অযোধিয়া বুরু’ অর্থাৎ অযোধ্যা পাহাড় যৌবনের হাতছানি দেয়। করমগানেও নবোদ্ভিন্না  কিশোরীর মুখে যৌবন দীক্ষার পীঠস্হান অযোধ্যা পাহাড়ের কথা নব অনুরাগে ধ্বনিত হয়-

    উঠিল পুণ্ণিমার চাঁদ দেশ হইল আল রে

 রাজা এই চাঁদে অযোধ্যা-শিকার।…..

জাওয়া-পরব ভাদ্রমাসের শুক্লা কাদশী তিথিতে করমের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। জাওয়া ডালিতে থাকে ‘পঞ্চশস্য’। জাত শব্দজাত ‘জাওয়া’ শস্যোৎসব। তাই জাওয়া গানে শোনা যায়-

  উপর ক্ষেতে হাল দাদা নাম ক্ষেতে কামিন রে।

              কন্ ক্ষেতে লাগাব দাদা ক্ষেতে  কামিন-কাজল ধান রে।।….

ভাদ্রে ভাদু পূজা।পুরুলিয়ার কাশীপুররাজ নীলমণি সিংহ-দেওরর  রূপবতী, গুণবতী কিশোরী মেয়ে ভদ্রেশ্বরী  বা ভদ্রাবতীর অকাল প্রয়াণ ঘটে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দর প্রজাগণ ভাদু পূজার প্রচলন করে, এবং ক্রমে তা ছড়িয়ে যায়- এ রকম লোকশ্রুতি দীর্ঘকাল প্রচলিত। যদিও ইতিহাসের বিচারে এ কাহিনীর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

 ভাদু কৃষিভাবনাজাত লোক উৎসব। ভাদ্রে  ভাদুই বা আউশ ধান হয়।  ভাদুই ধান ঘরে তোলার আনন্দ থেকেই ভাদু পরব। এই পরবে কৃষিলক্ষ্মী মূর্তিমতী নারীরূপা বন্দিতা –

ভাদুর আগমনে

কি আনন্দ হয় গো মোদের প্রাণে

ভাদু আজ এলো ঘরে গো

এলো গো শুভদিনে।…..

সারা ভাদ্রমাস ধরে ভাদু গান গায় অবিবাহিতা কিশোরী ও বিবাহিতা নারীরা। ভাদ্রসংক্রান্তির আগের রাত হয় ‘জাগরণ’। ‘জাগরণের’ রাতে ভাদু-করা কিশোরীদের  সঙ্গে বিবাহিতা নারীরাও প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিতে যোগ দিয়ে ভাদু গান গায়। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর অঞ্চলে ভাদু যৌবন লীলা ও রূপ মদিরতার প্রতিমূর্তি। কোথাও কোথাও ভাদুর অনুরূপ পুরুষ মূর্তি ‘ভাদা’কে নিয়ে স্হূল নত্য-গীত হয়ে থাকে।

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া,মেদিনীপুর,পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, ধলভূম এবং ছোটনাগপুরের বিভিন্ন স্হানে কার্তিকী অমাবস্যা উপলক্ষ্যে ‘বাঁধনা পরব’ হয়। বন্দনা থেকে বাঁধনা কথাটি এসেছ। আশ বা ভাদুই ধান ঘরে উঠলে, মাঠে মাঠে আমনের শিষের গুচ্ছে হেমন্তের বাতাস কৃষিকার্যের শুভ ইঙ্গিত বহন করে আনে, তখনই  সীমান্তবাংলার কৃষিজীবি মানুষ  গোজাতির প্রতি শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতায় বাঁধনা পরব করে। শস্যোৎপাদনের জীবন্ত হাতিয়ার বলদ, পুরুষ মহিষের(কাড়া)সঙ্গে গরুও আনুষ্ঠানিক বন্দনা করা হয়। গোমহিষের বিশেষ বন্দনা বা আপ্যায়নের মধ্যে আদিম সমজর জাদুভাবনা ও উর্বরতাবাদের ইঙ্গিত স্পষ্ট।  

সীমান্ত বাংলার শুধু আদিবাসী সমাজে নয়, বহু বর্ণহিন্দু সমাজেও বাঁধনা পরবে ‘জামাই-বাঁধনা’- অনুষ্ঠান হয়। এইঅনুষ্ঠান সীমান্ত বাংলার কৃষিজীবি পরিবারে জামাইষ্ষ্ঠীর অনুরূপ।বাঁধনা পরবের দিন জামাতৃকুল বিশেষ সমাদৃত হন। কার্তিকী অমাবস্যার রাতে বাঁধনা পরবের ‘জাগরণ হয়। মনে করা হয় ঐ রাতে যদি গৃহস্হ জেগে থাকে, তবে লক্ষীলাভ হয় এবং গোমহিষের বংশবৃদ্ধি ঘটে।পরের দিন শুক্লা প্রতিপদের পূর্বাহ্ণে হয় ‘গোরৈয়া পূজা’। দ্বিতীয় দিনে হয় ‘বুঢ়ী বাঁধনা’, তৃতীয় দিন ”দেশ বাঁধনা’। অমাবস্যা ও প্রতিপদের দিনে হয় গো-বন্দনা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে হয় গোরু-খুটা, কাড়া-খুঁটা। গ্রামের রাস্তায় অথবা ফাঁকা মাঠে শক্ত খুঁটিতে গোরু ও কাড়াদের বেঁধে আনন্দ-উৎসব পালন করা হয়। ‘কাড়া-খুঁটা’র মধ্যে আদিম উল্লাস লক্ষ্য করা যায়। ধাগড়িয়া  পানম ও রক্তচক্ষু নিয়ে চিৎকার করে ভাঙা গলায়  ‘অহীরা’ গান গেয়ে খুঁটিতে বাঁধা কাড়াকে জাগায়। হাতে থাকে চামড়ার ‘ছড়্’ বা পাকানো খড়ের ‘বড়্’। কৌতুহলী জনতার সামনে বাজানো হয় ঢাক-ঢোল আর ধামসা। উল্লসিত জনতার সামনে ‘ধাগড়িয়া’ ছড় বা বড় দিয়ে কাড়াকে খেপায়। রোষে ক্ষিপ্ত কাড়াটি শিঙ উঁচিয়ে মহিষাসুরের মত মাটি খুঁড়ে, চারিদিক লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

লোকায়ত জীবনের ঐতিহ্য-সংস্কার, পজাপার্বণ, গল্পকথা, উৎসব, সঙ্গীত নানাভাবে নানা দৃষ্টিতে এইভাবে রাঢ় বাংলার সংস্কৃতিকে মেলবন্ধনপ্রয়াসী করে তুলেছে।

          সহায়ক গ্রন্হ

১। বিনয় ঘোষ – পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি।

       ২। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু

       ৩। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোক-সংস্কৃতি।

       ৪। মানিক সিংহ – পশ্চিম রাঢ় তথা বাঁকুড়া সংস্কৃতি।

       ৫।  শান্তি সিংহ – টুসু

      ৬।  চিত্তরঞ্জন লাহা – ধলভূমের লোকগীতি (দ্বিতীয়খণ্ড – মকর)।