রবীন্দ্র গানের অঙ্গনে প্রকৃতির অবয়ব
শুভ্রপর্ণা বিশ্বাস

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে সঙ্গীত রচয়িতা ও সুকণ্ঠ গায়ক । তাঁর বিপুল সৃষ্টি ভাণ্ডারের মধ্যে অন্যতম সৃষ্টি কাজ হল সঙ্গীত, যা রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে বাঙালী তথা বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত। তাঁর এই বিপুল সঙ্গীত সম্ভারকে বিভিন্ন পর্যায় বিভক্ত করলে পাই ৬টি পর্যায়, যথা- পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক। এই ৬ টি পর্যায়ের মধ্যে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গানগুলি অন্যতম। আলোচ্য বিষয়ে মুল কর্মক্ষেত্রটি হল রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের গান। কবির জীবনের শেষ দুই দশকে রচিত বিভিন্ন প্রকৃতি পর্যায়ের গানের মধ্যে যে নৈস্বর্গীক ভাবনা ও বিশ্বপ্রকৃতির নানা রূপের যে সাদৃশ্য ও সাযুর্জ ঘটেছে তার বিন্যাস-সাধন এবং বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে তিনি কিভাবে অবলীলাক্রমে মানবপ্রকৃতির নানা রূপের মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন তার বিশ্লেষণ । বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান বলতে যে সব কথা মনে আসে তা হল- আলো, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, তরুমূল, ঋতুচক্র ইত্যাদি ।এই বিষয়গুলি কিভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতির গানের বিভিন্ন উপমা ও উপমানের মধ্যে দিয়ে চিত্রিত করেছেন, তার বাস্তবরূপ খুঁজে দেখবার প্রয়াস নিম্নোক্ত অংশে করা হল।
মূখ্য শব্দ সমূহ
ঋতুচক্র, প্রকৃতি, আলো, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, ফুল,তরুমূল, বিশ্বপ্রকৃতি, ঋতুলীলা, বন্দনা, মহাকাশ, মানবপ্রকৃতি, ঋতু, পর্যায়, নৈস্বর্গীক, সাধনা, আনন্দ, শান্তিনিকেতন, পদ্মা, নটরাজ, ঋতুরাজ।
গুরুদেব মনে করতেন আনন্দের সাধনার পথে প্রকৃতিই মানুষের একটি বড় অবলম্বন। প্রকৃতি আমাদের চারিদিকে ঋতুতে ঋতুতে যে সৌন্দর্য ও আনন্দ বিতরণ করে তা আমাদের ভোগের জন্য। তাকে গ্রহণ না করলে মনের একটি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় । অল্প বয়স থেকেই কবির কাছে বিশ্বপ্রকৃতির লীলা বিশেষ উপভোগের বস্তু ছিল। তিনি তাঁর “ছেলেবেলা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “আমার জীবনে বাইরের খোলা ছাদ ছিল প্রধান ছুটির দেশ। ছোটো থেকে বড়ো বয়স পর়্ন্ত আমার নানা রকমের দিন ওই ছাদে নানাভাবে বয়ে চলেছে। আমার পিতা যখন বাড়ি থাকতেন তার থেকে কত দিন দেখেছি, তখনো সূর্য ওঠে নি, তিনি সাদা পাথরের মূর্তির মতো ছাদে চুপ করে বসে আছেন, কোলে দুটি হাত জোড়-করা। মাঝে মাঝে তিনি অনেকদিনের জন্য চলে যেতেন পাহাড়ে পর্বতে, তখন ওই ছাদে যাওয়া ছিল আমার সাত সমুদ্দুর-পারে যাওয়ার আনন্দ। চিরদিনের নীচে তলায় বারান্দায় বসে বসে রেলিঙের ফাক দিয়ে দেখে এসেছি রাস্তার লোক-চলাচল; কিস্ত এ ছাদের উপর যাওয়া লোকবসতির পিল্পেগাড়ি পেরিয়ে যাওয়া।”[1] রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও মননের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির যে আত্মিক যোগ তা ছিল তাঁর ছেলেবেলা থেকেই এবং তার পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ ঘটে কবিগুরুর জীবনের শেষ দুই দশকের রচিত গানে।
তিনি মুগ্ধ চিত্তে তখন থেকেই ঋতুকে ও তার বৈচিত্র্যকে মনে প্রাণে উপভোগ করবার চেষ্টা করেছেন। কখনো তা নিজের চোখ দিয়ে, কখনো বা অন্তর দিয়ে, কখনো বা জ্ঞানচক্ষু দিয়ে। তাঁর জীবনের শেষ দুই দশকে রচিত সৃষ্টি কাজের মধ্যে প্রকৃতির গান ছিল অন্যতম। সেই সময় থেকে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অন্তরের গভীর যোগের উন্মোচন ঘটে ।
গীতবিতান এর তৃতীয় পর্যায়ে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গান গুলি (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত) সংগৃহীত আছে। এই পর্যায়ে প্রকৃতির মোট গানের সংখ্যা ২৮৩ টি। যেখানে প্রথমে ৯ টি সাধারণ পর্যায়ের গান, গ্রীষ্মের ১৬ টি গান, বর্ষার ১১৫ টি গান, শরৎ এর ৩০ টি গান, হেমন্তের ৫ টি গান, শীতের ১২ টি এবং বসন্তের ৯৬ টি গান সংকলিত রয়েছে। প্রথম জীবনে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ছিল ১২ টি, যেখানে বর্ষার গান ৭ টি, বসন্তের গান ৩ টি, শরৎ এর গান ১ টি এবং আরও ১ টি গান যেখানে পূর্বের তিনটি ঋতুর সমাবেশ রয়েছে। বর্ষার গান গুলো মূলত মল্লার রাগিণী, বসন্তের গান গুলো মূলত বাহার ও বসন্ত রাগিণী ও শরৎ এর গানটি যোগীয়া-বিভাস রাগিণীর ওপর আধারিত ছিল।[2]
তাঁর শেষ জীবনে রচিত প্রকৃতির গানে তিনি কেবল মেঘমল্লার, বসন্ত, বাহার, যোগিয়া, বিভাস ছাড়াও ইমন, বেহাগ, ভূপালী, ভৈরবী, সিন্ধুকাফি ইত্যাদি রাগের ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছপালা, ফুল, ফল, আলো, বাতাসের মতো তাঁর জীবনটিও ঋতুলীলার বিকাশে সাহায্যে করেছে। প্রত্যেক ঋতুই যেন গুরুদেবের গান ছাড়া অসম্পূর্ণ। তিনি ঋতুতে ঋতুতে তাঁর গানের ফুল ফুটিয়েছেন আর তারই সাহায্যে ঋতুর আনন্দ অনুভব করা আমাদের পক্ষে আরো সহজ হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের গান বলতে মুলত ৬টি ঋতুর গান (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত) ছাড়াও কখনো কখনো কোনো নৃত্যনাট্য বা গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির গান ব্যবহার করেছেন, যেমন—“চক্ষে আমার তৃষ্ণা” (চন্ডালিকা), “গুরু গুরু, গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে” (চিত্রাঙ্গদা), ময়ূর ও ময়ূরী নাচিছে হরষে/ রিমঝিম ঘন ঘন রে বরষে”(বাল্মিকী প্রতিভা)
গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহ “ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়” ও গুরুমেঘগর্জনের মধ্যে কালবৈশাখীর আভাস এবং রিমঝিম ঘন বরষায় ময়ুর-ময়ুরীর অপরূপ নৃত্যশোভা ইত্যাদি।রবীন্দ্রনাথ এখানে মানবজীবনের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির উপাদান জলবায়ু ঋতুচক্রকে এক্সুত্রে গেঁথেছেন ।
এছাড়া প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ পূজা-পর্যায়ের গানেও প্রকৃতিকে দেখেছেন, যেমন –”আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ / খেলে যায় রৌদ্র ছায়া বর্ষা আসে বসন্ত”-এখানে এই ছয় ঋতুর সমাগমে বর্ষা ও বসন্তের আগমন সেখানেও কবি বারবার উপমার প্রয়োগ করেছেন।
প্রকৃতির ঋতুচক্রের সাথে গ্রামীণ বাংলার আর্থসামাজিক জীবনও যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পর্যায়ক্রমে তার উদাহরনস্বরূপ বলা যায়-
- “আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই… লুকোচুরি খেলা ” (শরৎ),
- “নমো, নমো, নমো,/ নমো, নমো, নমো,/ তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য/ অম্ত-অন্ন- ভোগ ধন্য করো অন্তর মম”(হেমন্ত),
- “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে , আয় রে চলে আয়, আয়, আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায় ” (শীত)
গান তিনটি ভিন্ন পর্যায়ভুক্ত হলেও বাংলার শস্য শ্যামলা অন্নপূর্ণার তিন মাতৃ রূপের প্রতি আলোকপাত করেছে।
প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুচক্রের ওপর গড়ে ওঠে সাধারন মানুষের মিলন উৎসব-“ হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিকবধূরা ধানের ক্ষেতে ” অথবা
“আমরা চাষ করি আনন্দে/ মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে” অথবা “মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হলো/ ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো ওগো খোলো দুয়ার খোলো” নতুন ফসল কেটে ঘরে তোলার যে আনন্দ উৎসব এ যেন তারই উদযাপন। এছাড়া, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল” একটি অতি জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় সঙ্গীত যার মধ্য দিয়ে কবি ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের বন্দনা করেছেন।
‘নটরাজ ঋতুনাট্যশালা’ নাটকে কবি দেবাদিদেব মহাকালের বিভিন্ন রূপের সাথে ঋতুচক্রের বর্ণনা করেছেন।বৈশাখে তিনি আসেন তপস্বী বেশে, তখন তার তপের তাপে জগৎ হয়ে ওঠে তপ্ত। “তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে/ হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে”। আবার বর্ষায় তিনি রূপ নেন আষাঢ় সন্ন্যাসীর , ঘরছাড়া এই সন্ন্যাসীর জন্য কোনো এক উমা কোথায় যেন বিরহের তপঃশয্যায় দীর্ঘপ্রহর নিশি-দিবস যাপন করে চলেছেন।
“কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা।
কোন্ শূন্য হতে এল কার বারতা ॥
নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত বিদায়বিষাদে উদাসমত–
ঘনকুন্তলভার ললাটে নত, ক্লান্ত তড়িতবধু তন্দ্রাগতা ॥
কেশরকীর্ণ কদম্ববনে মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে
বর্ষণহর্ষ-ভরা ধরণীর বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।
ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো! বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান’
আজও হয় নি ম্লান’—
ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর মালতী তব চরণে প্রণতা॥[3]
শরতে শারদার পুত্র শরৎ – রূপে তিনি কুয়াশা ও সাদা মেঘের বেশে, কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে ও ভোরবেলার শিউলি ফুলের পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।
“… শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মর্মরানির ঢেউ উঠালে”॥[4]
হেমন্তে তিনি হেমকান্ত স্নিগ্ধ শান্তির পূর্ণতায় পাকা শস্যের মধ্যে দিয়ে তিনি পৃথিবীতে বিচরণ করেন।
“হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা ॥
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা ॥
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা ॥“[5]
শীতে তিনি যেন রুদ্র সন্ন্যাসী, কিন্তু তা বিনাশের রূপ নয়, নবতর জীবনের ভূমিকামাত্র।
“হে সন্ন্যাসী,
হিমগিরি ফেলে নীচে নেমে এলে কিসের জন্য।
কুন্দমালতী করিছে মিনতি, হও প্রসন্ন॥
যাহা-কিছু ম্লান বিরস জীর্ণ দিকে দিকে দিলে করি বিকীর্ণ।
বিচ্ছেদভারে বনচ্ছায়ারে করে বিষণ্ন– হও প্রসন্ন॥
সাজাবে কি ডালা, গাঁথিবে কি মালা মরণসত্রে!
তাই উত্তরী নিলে ভরি ভরি শুকানো পত্রে?
ধরণী যে তব তাণ্ডবে সাথি প্রলয়বেদনা নিল বুকে পাতি।
রুদ্র, এবারে বরবেশে তারে করো গো ধন্য– হও প্রসন্ন॥“[6]
বসন্তে তার তপস্যা যৌবন রসের বার্তা বয়ে আনে। শীতের ধরণী যেন উমারূপী তপস্বিনী। শীতের সন্ন্যাসীই বসন্তের বরবেশে নবযৌবনকান্তি নিয়ে তপোবনপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন স্বয়ং মহাদেব।
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥“[7]
রবীন্দ্রনাথের ‘ শেষ বর্ষণ ‘ নাটকে বাদললক্ষ্মী তার ঘোমটা সরানোর পর তিনিই যেন শরৎশ্রী রূপে প্রকটিত হন সবার সামনে। এই রূপকের সাহায্যে তিনি বর্ষার বিদায়ের সাথে শরতের আগমন কে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“তোমার নাম জানি নে, সুর জানি।
তুমি শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥
সারা বেলা শিউলিবনে আছি মগন আপন মনে,
কিসের ভুল রেখে গেলে আমার বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥“[8]
‘বসন্ত’ নাটকে তিনি ঋতুরাজ কে রাজা ও সন্ন্যাসী, এক সত্ত্বায় দুই রূপে বর্ণনা করেছেন। ঋতুরাজ বসন্ত ঐশ্বর্যে পূর্ণ, সেই পূর্ণতার আনন্দে তিনি তাঁর সর্বস্ব দান করে শূন্য হতে ফিরে যান। তিনি আসেন স্বর্ণরথে, কিন্তু সানন্দে ভিক্ষুকের মত দান যাত্রা করে ফিরে যান।
“সব দিবি কে সব দিবি পায়, আয় আয় আয়।
ডাক পড়েছে ওই শোনা যায়, আয় আয় আয়॥
আসবে যে সে স্বর্ণরথে– জাগবি কারা রিক্ত পথে
পৌষ-রজনী তাহার আশায়, আয় আয় আয়॥
ক্ষণেক কেবল তাহার খেলা, হায় হায় হায়।
তার পরে তার যাবার বেলা, হায় হায় হায়।
চলে গেলে জাগবি যবে ধনরতন বোঝা হবে,
বহন করা হবে-যে দায়, আয় আয় আয়॥“
এছাড়া “রৌদ্র দাহ হলে সারা নামবে কি ওর বর্ষাধারা”-[9]
এখানে রৌদের তীব্র দাবদাহকে নিবারণের জন্য যে বর্ষাকে প্রয়োজন বাংলার ঋতুতেও রবীন্দ্রনাথ তা বার বার মিলিয়েছেন। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর যে বর্ষার আগমন হয় , সেই বর্ষার সাথে রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনধারাকে মিলিয়েছেন এক সূত্রে। দুঃখের পরে সুখ, রাতের পরে দিন ও বিরহ-বিচ্ছেদের মধ্যে যে মিলন রবীন্দ্রনাথ তা বার বার দেখিয়েছেন। সেইদর্শন নিয়ে পর্যালোচনাই এই বিশ্লেষণের মূল উদ্দেশ্য।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান- জলবায়ু, আলো, বাতাস, ফুল, তরুমুল, বৃষ্টি, ঋতুচক্র, মহাকাশ ইত্যাদিকে এক সূত্রে গেঁথেছেন বারবার। শান্তিনিকেতন ও উত্তরবঙ্গের পদ্মা অঞ্চলের অপরূপ প্রকৃতি তাঁকে প্রকৃতির প্রেমে পড়তে ও গান লিখতে অনুপ্রাণিত করে এসেছে চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতির গানের যে সম্ভার আমাদের দান করে গেছেন তার মধ্যে এত রূপ, এত রস, এত উপলব্ধি, এত বৈচিত্র্য, নিত্যদিনের অতি ছোট ছোট সাধারণ ঘটনা অথচ তাকে এত তিনি পুঙ্খানপুঙ্খভাবে ব্যখ্যা করে অতি সাধারণ রূপে বর্ণনা করেছেন। প্রাকৃতিক জগতের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মহাবিশ্বের বিশালতা, তার সাথে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা, ও তাদের রহস্য কবির অন্তরকে আন্দোলিত হয়েছে বারবার এবং সেই আত্মপলব্ধির জোয়ারে ভেসে গিয়ে কবির মন গেয়ে ওঠে-
“আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥“[10]
তথ্যসূত্র
[1] https://archive.org/stream/chelebela-rabindranathtagore/chelebela-%20Rabindranath%20Tagore_djvu.txt
[3] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/keno-pantha-e-chanchalata-5185
[4] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/alor-amal-kamall-khani-5259
[5] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/hay-hemanta-lakkhi-5264
[6] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/he-sanyasi-himgiri-5279
[7] https://www.tagoreweb.in/Songs/bichitra-237/rangiye-diye-jao-5808
[8] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/tomar-nam-jani-ne-5255
[9] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/sab-dibi-ke-sab-dibi-pay-5305
[10] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/akash-bhara-surja-tara-5100
সহায়ক গ্রন্থ
গ্রন্থপঞ্জি
- গীতবিতান – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্ররচনাবলী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রসঙ্গীত – শান্তিদেব ঘোষ
- রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা – শান্তিদেব ঘোষ
- রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ – প্রমথনাথ বিশী