July 1, 2022

রবীন্দ্রসংগীত : শ্রুতির দরবারে

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ডঃ মৌসুমী পাল

রবীন্দ্রনাথের গান যখন আমরা শুনি কোনো শিল্পীর কন্ঠে তখন গানের চেয়েও গায়কি বড় হয়ে ওঠে। তাই গায়ক বিশেষের নাম ঘোষণায় শ্রোতাদের মধ্যে উল্লাসের করতালি ধ্বনি শোনা যায়। আবার কোনো এক স্বল্প পরিচিত বা অথ্যাতনামা শিল্পীর ঘোষণা হলে চারিদিকে নিঃশব্দ থাকে, শীতল অভ্যর্থনা ঘটে সেই শিল্পীর। তারপরে গান গাইবার উপবে তার গুণাগুণ নির্ভর করে। অর্থাৎ সাধারণভাবে একথা সত্য যে সমষ্টিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের পরিবেশনায় গায়কিরই গুরুত্ব ঘটে, গানটির নয়। সমঝদার শ্রোতারা গানের ব্যাকরণের দিকে বেশী মাথা ঘামান। কেউ কেউ সুরের সঙ্গে কাব্যের গভীরে প্রবেশ করারও অধিকারী হন। মোটের উপর গায়ক গায়িকার কন্ঠ, সুরজ্ঞান, ছন্দজ্ঞান, উচ্চারণ, ভাব, গায়কী, সংগীত নির্বাচন এইসব কিছু নিয়েই এঁদের মতামতকে এই লেখায় দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: [প্রথমটি বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত, এবং দ্বিতীয়টি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বর্ণিত।]

রবীন্দ্রসংগীতের একটি দিক হল শ্রুতির দরবারে তার আবেদন, অর্থাৎ পরিবেশন প্রণালী যা শিল্পীর কণ্ঠে উত্তীর্ণ হয়ে স্রষ্টার সৃষ্টি সম্পদকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে, আবার শিল্পীর ব্যক্তিত্বকেও তুলে ধরবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবিতকালে তাঁর গান যাঁরা কন্ঠে ধারণ করতেন, তাঁদের কারো কারো সম্পর্কে গুণমুগ্ধ প্রশংসা করে এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন। তাঁর গান কেমন করে গাইতে হবে, তাঁর নিজের কন্ঠের রেকর্ডে এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রেকর্ডে তা’ ধরা আছে। তাছাড়াও সরাসরি যাঁরা কবির জীবিতকালে স্বয়ং কবির কাছ থেকে বা তৎকালীন রবীন্দ্র সরোবরে অবগাহন করে তাদের কলস পূর্ণ করেছেন এমন শিল্পীদের কন্ঠের রেকর্ডও রয়ে গেছে। তাঁরা হলেন সাহানা দেবী, অমনা দাশ, কনক দাশ, রাজেশ্বরী দত্ত, সতীদেবী, সাবিত্রী দেবী কৃষ্ণাণ প্রভৃতি। কিন্তু রেকর্ডে যতই রবীন্দ্রসংগীতের সঠিক গায়নরূপ ধরা থাকুক না কেন, তবু কানের ও রুচির পরিবর্তনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই ঘটে। গানের সঙ্গে সংগীতায়োজনের চরিত্র বদলায়। ফলে গানের চিরতন আবেদন কতটা পরিবর্তিত হয়, কস্তটা ক্ষতিগ্রয় হয়, কতটা পব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়। তা নিয়ে তীন সংস্কার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সাতও দেখা দেয়। এইভাবে যুগরুচি রবীন্দ্রসংগীতকে নতুন করে পায়, নতুন করে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে। এটা একটা দান্দ্বিক পদ্ধতি। তাই সেখান থেকে একাল পর্যন্ত অনেক গুণী, আচার্য, শিল্পী, শিক্ষক, রবীন্দ্রসংগীত কেমন করে গাইতে হলে, কেমন করে গাইলে কালের সঙ্গে সামজস্য রেখেও রবীন্দ্রসংগীতের যাবতীয় সৌন্দর্যকে অক্ষুন্ন রাখা যায় সে বিষয়ে পথনির্দেশ করে গেছেন অথবা, কিছু পরামর্শ নি, নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। আমরা বর্তমানে এই লেখার মাধ্যমে তাঁদের মূল্যবান উপদেশ, পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছি। প্রথমটি বিভিন্ন গ্রন্থে এবং দ্বিতীয়টি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বর্ণিত।

রবীন্দ্র সংগীতের পরিবেশনা সম্পর্কিত আলোচনার একটা অংশ একান্তই শিক্ষক সুলভ পরামর্শ। যেমন দিয়েছেন শুভ গুহঠাকুরতা তাঁর গ্রন্থে উচ্চারণ, বৈশিষ্ট্য, শ্বাসগ্রহণ পদ্ধতি, কন্ঠস্বরের পরিবর্তন প্রভৃতি শিরোনামে। সুবিনয় রায়ের ‘রবীন্দ্রসংগীতে সাধনা’, প্রফুল্ল কুমার দাসের রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে (প্রথম খন্ড), অমিয় মুকুল দের ববীন্দ্রসংগীতে বৈচিত্র্য গ্রন্থগুলিতে শিক্ষার্থীদের উপযোগী কিছু জরুরী তত্ত্ব আছে। এই ব্যাপারে খুব মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার।

রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে বহু তথ্য, তত্ব সহ বিশ্লেষণ ‘রবীন্দ্র সংগীত ভাবনা’ গ্রন্থে সংকলিত। রবীন্দ্রনাথের গান কেমন করে গাইতে হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে গীতবিতান পত্রিকায়।

রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুষঙ্গ রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি সাহিত্যপত্র যাত্রাপথের আনন্দगान

শৈলজারঞ্জন মজুমদার  সারা জীবন ধরে রবীন্দ্রসংগীত কেমন করে গাইতে হয় বা শুদ্ধতা রক্ষার উপায় বা কিভাবে তা অনুভব করে শিল্পী তাঁর কন্ঠে ফুটিয়ে তুলবেন এই নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। তাঁর আলোচনায় এই সংগীত সম্পর্কে যেমন তাঁর সুগভীর অধিকারের পরিচয় আছে তেমনি আছে শিক্ষার্থীর প্রতি এক আচার্যসুলভ সহ সহৃদয়তা। মতবাদের দিক থেকে কিছুটা রিজিড মনে হলেও বস্তুত তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি ছিল না। তাই রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে শুদ্ধতা নামক প্রবন্ধটিতে তিনি বলেছেন,

“কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য রবীন্দ্রসংগীতের ‘গ্রামাটিক্যাল’ দিকটির প্রতি বেশী মনোযোগ দেন এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান ভাব, বস, মাধুর্য্য্য সর্বোপরি শিল্পসৃষ্টি না হয়ে, তার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা না করে, খড়ের কাঠামোতেই তৃপ্ত থাকছেন। আমার দীর্ঘ জীবনের শিক্ষকতায় এই ধরণের পরিবেশন আমাকে দুঃখ দেয়।”

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা গ্রন্থে ছড়ানো কিছু আলোচনায় এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তার আয়োজন দেখা যায়। কয়েকটি উদাহরণ-

রাজ্যেশ্বর মিত্র – রবিঠাকুরের গান: রবীন্দ্রসংগীত

ধ্রুব গুপ্ত – রবীন্দ্রসংগীত চর্চা : পরিবেশন

পঞ্চালন রায়চৌধুরী – রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গেলে

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত শেখা ও গাওয়া

সুপ্রতিম সরকার ২০০৫ বনাম ১৯৯৫

সাধন দাশগুপ্ত – রাবীন্দ্রিকতা

পীযূষকান্তি সরকার – এই ইজারা কারা দিয়েছে ওদের? ইত্যাদি

রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন –

“এখনকার শিল্পীদের বাংলা গান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা নেই, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত শিখতে হলে ঐ সময়ের ট্র্যাডিশনকে মনে রেখেই শেখা উচিত। রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপিতে জোর দিতেন ঠিকই কিন্তু তারই সাথে যুক্ত হয়ে থাকল গানের প্রাণ। সেই প্রাণবন্দ গায়কী এখনকার শিল্পীদের মধ্যে নেই। স্বরলিপি তোলার গায়কী আছে, রেন্ডারিং ডাফ নোটেশন নেই। রবীন্দ্রনাথ বন্দপ্রিয় ছিলেন। আবৃত্তিতে তো বটেই, গানেও সে দন্দটা অটুট রাখতেন। আজ মর্মরধ্বনি কেন জাগিল যে, কেন্তু গান। চঞ্চলতা ইত্যাদি অজস্র গালে দুটো জিনিস করা উচিত নয় – গানে দন্দকে এলোমেলো করা যাবে না। আড়ি দেওয়া ঠিক নয়। আড়ি ছাড়া গানগুলির মধ্যে অন্ধজনে দেহ আলো’, ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও’, রবীন্দ্রনাথের গায়কিতে ভালো শোনায়, অসম্ভব।

ধ্রুব গুপ্ত উন্নাসিক ও সুঘোষিত গুরুর মত কিছু সদুপদেশ বিলিয়েছেন অপগায়কদের বিরুদ্ধে যেন সত্যিই অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তাঁর বর্ণনার মত বিকৃত কণ্ঠে গায় –

“কাজেই যারা রাবীন্দ্রিকতার মৌরসিপাট্টা নিয়েছেন বলে মনে করেন তাদের ই কারকে ‘এ’ কারের কাছাকাছি আনা বন্ধ করতে হবে (বাণী হয়ে যায় বাণে), ‘ও’ কারকে ‘উ’ কার আর ‘অ’-কে ‘আ’র দিকে ঠেলে অতি মাধুর্য্য্য সৃষ্টির ন্যাকামি বর্জন করতে হবে (সাব যে হয়ে গেল কালু … অর্থাৎ রেডিও বা টেলিভিশনের কতিপয় ঘোষকের চিটে গুড় মাথা মিঠিমিঠি আধো আধো বুলি ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ করতে হবে একার কে ‘য’ ফলা ‘এ’ কার করার প্রবণতা (মনে কে মোন্যে)। আর একটি দোষ এক্ষেত্রে বিশেষ অস্বস্তির সৃষ্টি করে অনুনাসিকের আধিক্য।”

পঞ্চালন রায়চৌধুরী পরিবেশনের কোনো সূত্র ব্যাখ্যা করেননি। শুধু বলতে চেয়েছেন –

“সরকারি বেসরকারি সকল শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিরই ভেবে দেখা উচিত যেভাবে রবীন্দ্রসংগীত শেখা বা শেখানো হচ্ছে তা মোটেই মনোপযোগী নয়।”

সংবাদপত্রগুলিতে প্রায়ই কিছু মানুষ সবজান্তা হয়ে কেউ কিছু জানে না, কেউ কিছু পারে না, সব ভুল, সব বিকৃত এরকম একটা নাক উঁচু, হাততালি কুড়োনো মন্তব্য করে বেরিয়ে যান। যেমন সুপ্রতিম সরকার আনন্দবাজারে একটি পৃষ্ঠায় লিখেছেন

……..সুর ও গায়কির বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে একধরনের শুচিবাই। যার নিট ফল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে উপলক্ষ, পরিবেশনার ব্যাকরণ অক্ষত রাখাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। রবীন্দ্ররচনাবলীর প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন, রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও বিশ্বভারতীর কপিরাইট এই ঘরানাকে লালন করে এসেছে…”

অথচ এই ধরণের কথা যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রতিষ্ঠিত শিল্পী বলেন, তখন তা কত সুখশ্রাব্য ও মনোজ্ঞ হয়ে ওঠে। যেমন-

“এখন রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার, প্রসার, সমৃদ্ধি ও সমাদর অনেক বেড়েছে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলবার কাজে আমাদের পরবর্তী যুগের গাইয়েদের যথেষ্ট অবদান আছে। এখন অজস্র শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছে, অনুষ্ঠানের সংখ্যা এবং বেতারের প্রচারের মাত্রাও দারুণভাবে বেড়েছে। এর ওপর আবার দূরদর্শন। বর্তমানে এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে রবীন্দ্রসংগীত শেখবার ও শেখাবার আন্তরিকতা যত্ন আর সর্বোপরি নিষ্ঠার যাতে কোনরকম ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য উভয়কেই সযত্ন দৃষ্টি দিতে হবে।

সম্প্রতি রবীন্দ্রসংগীতের গায়কী ও স্বরলিপি নিয়ে গাইয়েদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, বিভ্রান্তি হচ্ছে আবার নানান তর্কও উঠে আসছে। অনেক সময় দেখতে পাই যে কেবল গায়কীই নয় স্বরলিপিরও অদল-বদল বা হেরফের হচ্ছে। এই সমস্যার একেবারে মূলে যেতে হলে আমাদের সবার কিন্তু ফিরে যেতে হবে আবার রবীন্দ্রনাথের কাছেই।

অনেক সময় প্রয়োজনমত তিনি নিজেই গানের সুরের অদল-বদল করেছেন। পরে ভুলে যেতে পারেন এই ভাবনায় আশঙ্কায় তিনি অনেক সময় গান রচনা করেই তার সুর বিভিন্ন ঘনিষ্টজনদের গলায় সঙ্গে সঙ্গেই তুলে দিতেন। স্বাভাবিক কারণে সুবে কিছু কিছু পার্থক্যও থেকে গেছে পরে যখন একই গান বিভিন্ন সুরে শোনান হয়েছে তখন গুরুদেব কেবলমাত্র একটি সুবই গ্রহণ করা উচিত এমন কথাও সব সময় বলেননি। সে কারণে আমার মনে হয় যে সব গানের একাধিক সুব আছে সেখানে যান্ত্রিকভাবে কোন একটি বিশেষ স্বরলিপিকে ধরে না রেখে সবকটি বিকল্প স্বরলিপি নিয়ে পাশাপাশি প্রয়োজনীয় টীকাসহ স্বরলিপি কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা উচিত। স্বরলিপির বিভ্রান্তি নিয়ে পরস্পরবিরোধী যে বিতর্ক উঠেছে এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন শিল্পীদের নিয়ে একটা বড় আলোচনাচক্র বা কর্মশালার আয়োজন করতে পারলে ভালো হয়। এর থেকে সুচিন্তিত মূল্যবান তথ্য জানা যাবে।”

এই ধরণের মতামত সাধন দাশগুপ্তের লেখাটিতেও দেখা যায়। তাই তিনি শিক্ষার্থীকে রসের উপদেশ দেন “তার গানের গীতশৈলী বা গায়কীতে পূর্ণমর্যাদায় থাকে কথা-সুর, ছন্দ নয় তাল, ভাব-ভাষা স্বরগুযোগ- স্বরক্ষেপণ অলংকরণ; সবার উপর একটি রস-শান্তু মধুর রস। যে রসটিকে কৈশোরে শুদ্ধবাণী ধ্রুপদে গেলেন। এই রসটি তাঁর উপনিষদের চিন্তার মতো সৃষ্টিকর্মের অন্তরে-বাহিরে চিরবন হয়ে গেছে। শৈলীর বিশেষত্বের অনেকগুলি স্বরবিতানের স্বরলিপিতে জানানো হয়েছে। হয়তো কিছু কিছু জানানো যায় না। যায় না বলেই লেখা থাকে গানটি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শিক্ষণীয়। তবু, সব কিছু জানানো হলেও গানের পরিবেশনে প্রভেদ থাকে। কারণ গান নানা লোকের কন্ঠের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলেই গায়কের নিজের দোষগুণের বিশেষত্ব গানকে নিয়তই কিছু না কিছু রূপান্তরিত না করেই পাবে না। ছবি ও কাব্যকে এই দুর্গতি থেকে বাঁচানো সহজ। ললিত কলার সৃষ্টির স্বকীয় বিশেষত্বের উপর তার রস নির্ভর করে। গানের বেলাতে তাকে, রসিক ছোক অবসিক হোক, সকলেই আপন ইচ্ছামতো উলটপালট করতে সহজে পারে বলেই বেশি দরদ থাকা চাই। সে সম্বন্ধে ধর্মবুদ্ধি একেবারে খুইয়ে বসা উচিত নয়।” (পৃ. ৩৬-৩৭)

রবীন্দ্রসংগীতের সমালোচনায় কিছু সমালোচক যেন শিল্পীদের উপর খড়গহস্ত হয়েই থাকেন। তাই জনৈক অৰ্চনা সরকার সমতট পত্রিকায় জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সংখ্যায় রবীন্দ্রসংগীতের একগুচ্ছ রেকর্ড শুনে লেখেন-

“বলতে দ্বিধা নেই সুশীল মল্লিকের দরদী গলাতেও ফল ফলাবার আশা জমে না, পূরবী মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ধরা দিয়েছি গো পাংশু শোনায়। শর্মিলা রায়ের পূর্ণচাঁদের মায়ায় স্বরলিপি রক্ষার সতর্ক আড়ষ্টতা গানের সেই অনুপম মায়াটুকু সৃষ্টি করতে পারেনি। হেমন্তের কন্ঠে ওরা অকারণে চঞ্চল কার চাঞ্চল্যপ্রসূত নির্বাচন ভেবে পাই না। বরীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সংগীত বেছে নেওয়ার ব্যাপারে হয় নির্বোধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, নতুবা কোনো স্বাধীনতাই নেই। এর মাঝামাঝি কোনো গন্থা নিশ্চয় হতে পারে।” (পৃ. ২৫)

ঐ একই সংখ্যা উক্ত ধ্রুব মুগ্ধ অভাব অপরিচ্ছন্ন ভাষায় লংপ্লেয়িং রেকর্ডে চিত্রাঙ্গদার সমালোচনা করে লেখেন,

“সমতটে উৎসব সংখ্যায় (নং ২১-২২) নতুন রেকর্ড করা চিত্রাসদার আলোচনা গড়ে উৎসাহিত বোধ করে রেকর্ডমানি আনাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুজনবেই কন্ঠে চিত্রাসদার অপরূপ গানগুলি শুনতে দারুন আগ্রহ হল। কিন্তু রেকর্ডটি শুনে তার গুণ সম্পর্কে আপনাদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। তার কতগুলি কারণ আছে – (১) অর্জুন চিত্রাসদা ও সখীর কন্ঠে সুববর্জিত সংলাপগুলির অশ্রাব্যতা। এক প্রভাতের শুধু পরমায়ু এই স্বগতোক্তিতে জোর গড়ার কথা এক প্রভাতের এর ওপর; মহিলা জোর দিয়েছেন শুধু’র ওপর। তার ফলে কথাটি দাঁড়িয়েছে এক সকালবেলার ‘আয়ু’ অন্যকিছু নয়। পুরুষ কন্ঠটির বাচনভঙ্গি খারাপ নয়, কিন্তু কন্ঠস্বরটি, সুশ্রাব্য নয়, মহিলা সংলাপ সুচিত্রা স্বয়ং উচ্চারণ করলে আমার মনে হয় অনেক বেশি অর্থপূর্ণ ও মহিমময় হত। (২) দুঃখের বিষয় সংগীতে সুচিত্রা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মহিমার পরিচয় রাখেননি। আমরা যারা পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি নিউ এম্পায়াবে শুধু সুচিত্রার কন্ঠে চিত্রাসদার গান শুনব বলে রবিতীর্থের প্রযোজনা দেখতে গিয়েছিলাম যাদের কানে এখনো প্রেক্ষাগৃহ সম্পূর্ণ ভবে দেওয়া আমি রাজেন্দ্র নন্দিনী’র অকল্পিত সুর বাজছে, কিংবা ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশনের আকুতি অপূর্ব বেদনার স্মৃতি জাগাচ্ছে, তাদের কাছে সুচিত্রার এই গান তাঁর শিল্পকৃতির ক্ষীণ ভগ্নাংশ মাত্র৷ অবশ্য তাঁর একটা অসুবিধার কথা মনে রাখতে হবে – তিনি তাঁর নিজস্ব স্কেলের অপেক্ষা বেশি উঁচুতে গাইতে বাধ্য হয়েছেন অন্যান্য শিল্পীদের খাতিবে সম্ভবত। শুধুমাত্র আজ শুধু করি নিবেদন নিখাদ ও সুরে তিনি স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সে অংশের ত এক নিমেষের পরমায়ু (৩) হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর কন্ঠসম্বরের স্বাভাবিক মাধুর্য সম্ভবত বয়স ও অতিব্যবহার হেতু হারিয়েছেন। তাছাড়া তাঁর কন্ঠে ড্রামা সর্বত্র ঠিক রূপ পায়নি।

সুচিত্রার মতো নৃত্যনাট্যের ড্রামার মেজাজ আনার ব্যাপারে আগে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অতখানি সার্থক আগে হতেন না, কিন্তু এই রেকর্ডে কণিকার অসাধারণ সুরেলা কন্ঠে আগের তুলনায় অনেক পরিশীলিত উচ্চারণে সুরূপা চিত্রাঙ্গদার গানগুলি অপূর্ব শুনিয়েছে। সম্ভবত এই রেকর্ডে সেটাই একমাত্র পাওনা। (.২৫)

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক মনে হয় যখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরাও পারস্পরিক সম্পর্কে সৌজন্যের অভাব প্রকাশ করেন। তাই গীযূষকান্তি সরকার নামে একালের এক শিল্পী ক্রুদ্ধ তিরস্কারকে বিষণ্ণ ক্ষোভের মোড়কে ঢেকে লেখেন-

“আসলে যেটা আমি বিশ্বাস করি কিংবা আমার কাছে যেটা সত্য, তাকে প্রকাশ্যে এবং সোচ্চারে বলতে আমি ভয় পাই না। অনেকের মুখ আর মুখোশ একাকার হয়ে যায়। দ্বিচারিতায় তাদের বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ নেই। যেমন আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আমার পূর্বসূরীদের মধ্যে কার কার গান আমার ভালো লাগে। আমি সুবিনয় রায়ের প্রতি দুর্বল। বিশেষত: উনি যখন জাগে নাথ করেন তখন আমি দুর্বল হয়েই গড়ি। মানতি ঘোষাল, সাহানা দেবী, সতী দেবী, মোহরদি, সুচিত্রা মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এঁদের সম্পর্কে আর কী বলব? এঁদের প্রশংসা করার মতো যোগ্যতাও কি আমার আছে? আমি এত দীন, দীনাতিদীন। ওঁদের যেমন অনেকের আমাকে লাথি মারার উগ্র বাসনা, আমি কিন্তু আবার এত পূজোর জায়গা থেকে ওঁদের দেখি, যে আমার মনে হয় ওঁদের প্রশংসা করার মতো যোগ্যতাও কি আমার আছে? যেমন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মশাই আমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করেন এবং সর্বত্রভাবেই আমার বিরোধিতা করার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি একটি সম্বর্ধনা সভাতে আমার তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করার কথা ছিল। উনি আপত্তি করেছেন। এতই তাঁর রবীন্দ্রসংগীত প্রীতি, এতই তাঁর রবীন্দ্রমনস্কতা যে, এই সময়ের বহু নিন্দিত, বহু বিতর্কিত এবং বহু বন্দিত শিল্পী সীযূষকান্তি সরকার, যিনি রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠান করেন, তাঁকে তিনি ঈর্ষা করেন। অথচ আমার কিন্তু তাঁর প্রতি কোনো ঈর্ষাবোধ নেই। দ্বিজেনবাবুর গলায় সলিল চৌধুরীর গান কিম্বা ঐ জানালার পাশে অথবা ‘তোমরা আমার এ বিরহের প্রভৃতি গানগুলি একসময় আমাকে পাগল করেছে। এতই অনবদ্য ওঁর পরিবেশন শৈলী।

তবে ব্যক্তিগত দেনা যদি কারো কাদে থেকে গিয়ে থাকে আমার, তাঁর নাম অবশ্যই দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁর গানের শব্দবোধ, তাঁর গানে বিরাম বা যতিচিহ্নের ব্যবহার, কোথায় কতটা থামব কিম্বা কোথায় কতটা জোর দেব- এটা তো আমি একেবারেই জর্জদার কাদ থেকে পেয়েছি। যদিও আমি কোনোদিন তাঁর কাছে গিয়ে গান শিখিনি, তবু জর্জদার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও দুর্বলতা তো রীতিমতো সুবিদিত। এজন্য আমার কোনো শ্লাঘা অথবা মালি বোধ নেই।” (পৃ. ৩৬)

এইসব পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মনে পড়ে –

“কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে

ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে

হেনকালে গগনতে উঠিলেন চাঁদা কেরোসিন শিখা বলে এসো মোর দাদা।”

এই জাতীয় রচনায় নানা মনন, মেধা, বুদ্ধি ও অনুভবের প্রভাব আছে, লেখকদের কেউ কেউ প্রবীন, অনেকেই তরুণ। সব মিলিয়ে একালের প্রজন্ম গত অর্ধ শতক ধরে রবীন্দ্রনাথের গানকে কিভাবে গ্রহণ করেছেন সেইসব ভাবনা, জিজ্ঞাসা, বিশ্বাস এগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলির অনেক মন্তব্যই আমাদের সমর্থন দায়। অনেক মন্তব্য প্রতিবাদও জানায়।

রবীন্দ্রসংগীতের বর্তমান, সাংগীতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ভূমিকা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই সংগীত কন্ঠে নিয়ে যাঁরা সাধারণের কাছে পৌঁছেছেন সেই শিল্পীদের প্রসঙ্গও রবীন্দ্রসংগীতের সামগ্রিক মূল্যায়নে কম জরুরী নয়।

একথা সত্যি রবীন্দ্রনাথের গান প্রচলিত, কমার্শিয়াল, লঘু সংগীতের তুলনায় একেবারেই স্বতন্ত্র। এই ভাবসমৃদ্ধ, ঐশ্বর্যবান, বাক্‌সম্পদে গরীয়ান, সুবের ব্যক্তিত্বে চির উজ্জল, স্বয়ং রবীন্দ্র স্পর্শে ধন্য সংগীত বাংলার অন্য কোনো গীতধারার সঙ্গে তুলনীয় নয়। এ সংগীত রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসানের একাশি বছর পরেও সমভাবে সমুজ্জল। তাই রবীন্দ্রনাথের গানের কাছে যখন শ্রোতা শ্রুতি মেলে বসেন তখন সে বসার একটিই দাবী কোলাহল তো কারণ হল, এবার কথা কানে কানে। এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে।।

রাজার পথে লোক দুটেছে,

বেচাকেনার চাঁক উঠেছে,

আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেই বা জানে।।

উল্লেখপঞ্জী

১।রবীন্দ্রসংগীতের ধারা শুভ গুহঠাকুরতা, দক্ষিণী, ১লা চৈত্র ১৩৬৬।

২। রবীন্দ্রসংগীত সাধনা – সুবিনয় রায়, এ মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রা. লি. – জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৫ (তৃতীয় সং)