রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গের সমস্যা
কুশনি সরেন
বাঙালির মননে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রসংগীত, আর রবীন্দ্রসংগীত প্রাসঙ্গিক হয়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। তাই এই গানের এত ব্যাপ্তি। রবীন্দ্রসংগীত এই যে যুগের পর যুগ ধরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের শিরোপা জয় করে চলেছে, তাতে যোগ্য সহযোগিতা করার দায়িত্ব পালন করে যন্ত্রানুসঙ্গ, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রসংগীত শিল্পী এবং যন্ত্র আয়োজকরা গানটিকে সুন্দর করে পরিবেশন করতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে basic album, বিজ্ঞাপণ, টিভি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসংগীতের বহুল ব্যবহার সবার জানা।
রবীন্দ্রসংগীত নিঃসন্দেহে উচ্চমার্গের সংগীত, কিন্তু এই গান পরিবেশনের ক্ষেত্রেও যন্ত্রানুসঙ্গ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যুগে যুগে রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, যন্ত্রানুসঙ্গের ধরণ পাল্টে গেছে, সমস্যাও তৈরি হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, অনেক রকম বাধা বিপত্তিও এসেছে।
ঠাকুরবাড়িতে পাশ্চাত্য সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের চর্চা, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কনসার্ট ও গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসা, গানে পাশ্চাত্যের হার্মনির ব্যবহার রবীন্দ্রনাথকে যেমন ছোটবেলা থেকে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন যন্ত্রানুসঙ্গের সঙ্গে পরিচিত করেছিল, বাড়িতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চা তাঁকে সে বিষয়েও সমান ভাবে শিক্ষিত করে তুলেছিল। প্রাথমিক সংগীত চর্চার সময় তাঁর জ্যোতিদাদা পিয়ানো বাজাতেন গানের অনুষঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় লিখছেন: ‘ছাদের ঘরে এল পিয়ানো। … এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম সুর তৈরি করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে। তখনি তখনি সেই ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার।’….. ‘গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান।’[1] দ্বিতীয়বার বিলাত যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে থাকাকালীন সেখানে কিছুদিন হারমোনিয়াম যন্ত্রযোগে গান গেয়েছেন। জীবনস্মৃতিতে বলছেন, ‘কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম— জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন, আমি গান গাইতাম’।[2] এমনও অনেক নজির আছে যেখানে গায়ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ২৫ বছর সেইসময়ের কথা লিখছেন : ‘একবার মাঘোৎসবে সকালে ও বিকালে আমি অনেকগুলি গান তৈরি করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে একটা গান ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’ – পিতা তখন চুঁচুড়ায় ছিলেন। সেখানে আমার এবং জ্যোতিদাদার ডাক পড়িল। হার্মোনিয়ামে জ্যোতিদাদাকে বসাইয়া আমাকে তিনি নুতন গান সব কটি একে একে গাহিতে বলিলেন। কোনো কোনো গান দুবারও গাহিতে হইল।’[3] আরও কিছু পরে দেখি রবীন্দ্রনাথ গান করছেন সঙ্গে যন্ত্র বাজছে অর্গান। ১৯০৩ সালে মহর্ষির জন্মদিনে অর্গান বাজিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অর্গান, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। শান্তিনিকেতনে শারদোৎসব’-এর গান রচনার সময়ের দিনেন্দ্রনাথ বসতেন এস্রাজে আর অজিতকুমার বাজাতেন হারমোনিয়াম।
দ্বিতীয় বার বিলাত যাত্রার পথ থেকে ফিরে এসে যখন জ্যোতিদাদার চন্দননগরের বাড়িতে ছিলেন, তখনকার কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন: “আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ-করা পূর্ণ-বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো-বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্র যোগে বিদ্যাপতির ‘ভরাবাদর মাহভাদর’ পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম”। [4]
অথচ হারমোনিয়াম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বারবার মত পাল্টেছিলেন। ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, “তখন হারমোনিয়াম আসেনি এদেশের জাত মারতে। কাঁধের ওপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কলটেপা সুরের গোলামি করিনি।”
রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপে সূক্ষ্ম মীড়ের কাজ মনের মধ্যে যে ভাব ও আবেশের সৃষ্টি করে তা হারমোনিয়াম যন্ত্রটির reed থেকে তোলা বেশ কষ্টের। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির প্রয়োগ বিশেষভাবে দেখা যায় না। শেষ জীবনে পৌঁছে কবি হারমোনিয়াম ব্যবহারের ব্যাপারে এতটাই ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন যে ১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ এ আকাশবাণী কলকাতার সেই সময়কার স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেন-কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন “I have always been very much against the prevalent use of Harmonium for purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our ashram. You will be doing a great service to the cause of Indian Music if you get it abandoned in the studio of All India Radio”.[5]
এই চিঠিকে মান্যতা দিয়ে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ হারমোনিয়াম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন, যা স্বাধীনতার পরেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বহাল রেখেছিলেন। এর প্রতিবাদে আকাশবাণীতে দিলীপকুমার রায়, শচীন দেববর্মণ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা গান গাওয়া বন্ধ করে দেন।
একথা মানতেই হবে, হারমোনিয়াম ব্যবহারের অনেকগুলি সুবিধা আছেই। এটি অনেক বেশি সহজলভ্য, সহজে বহনযোগ্য, আর সহজে শিখে নেওয়া যায়। এটি সহজে যেকোন স্কেলে বাজানো যায়, এবং অন্যান্য অনেক যন্ত্রের মত প্রত্যেকবার বাজানোর আগে টিউন করতে হয় না, অনুষ্ঠানের মাঝে টিউনিং নষ্টও হয়ে যায় না। তাই এর কার্যকারিতা, সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা কখনোই অস্বীকার করা যাবে না। বরং যুগে যুগে যন্ত্রানুসঙ্গে হারমোনিয়ামের জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ বেড়েছে। আকাশবাণীতে হারমোনিয়াম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে যন্ত্রানুসঙ্গের যথেষ্ট সমস্যা তৈরি হয়েছিল। অবশেষে সেই নিষেধাজ্ঞা ১৯৮০ সালে পুরোপুরি উঠে গিয়ে সমস্যা দূর হয়। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়াম নিষিদ্ধ করেছিলেন। শান্তিদেব ঘোষ এই বিষয়ে লিখেছেন, ‘১৯২২ সাল থেকে অর্থাৎ বিশ্বভারতীর যুগ থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির ব্যবহার গুরুদেব শান্তিনিকেতনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’।[6] শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতিচারণে দেখি, ‘শান্তিনিকেতনে এসে দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই যন্ত্র আর ছুঁয়েও দেখিনি।’[7] শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের তাই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে দেখা যেত না।
আমি নিজে যখন ছাত্রী ছিলাম, তখনও দেখেছি শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়ামের ব্যবহার খুবই গৌণ ছিল। তাই হারমোনিয়াম বাজানোর ব্যাপারে কাউকে কোনদিন উৎসাহ দেওয়া হত না। এস্রাজকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হত। এস্রাজ ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান হতই না। বরং বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে একাধিক এস্রাজ ব্যবহার হত অনুষ্ঠানে। আজকের দিনেও এই প্রথাই চালু আছে শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানে যন্ত্রানুসঙ্গের ক্ষেত্রে এস্রাজ বাদ্যযন্ত্রটিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর গানে সঙ্গত নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ তিনি দিয়ে যাননি। তাতে শিল্পী থেকে শ্রোতা, সবার লাভই হয়েছে, যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছে।
তাঁর জীবদ্দশাতে রবীন্দ্রসংগীত যতটা জনপ্রিয় ছিল, মৃত্যুর পর তা অনেক বেড়েছে। প্রচারের আলোকে যত এসেছে, যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে ‘experiment’ করার প্রবণতাও তত বেড়েছে। আগে ভারতীয় সংগীতে ‘Composer শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পাশ্চাত্য সংগীতে Symphony Orchestra Music- এর বিখ্যাত বিখ্যাত সমস্ত Composer – Mozart, Beethoven, Chopin, Bach, সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের নির্দেশসহ লয়, স্কেল সহ notation লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কিন্তু এই পদ্ধতি তো রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিতে নেই। তাই লয় নির্বাচন, গায়কি, স্কেল-এর ক্ষেত্রে শিল্পীর পরিবেশনের স্বাধীনতার সঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের স্বাধীনতাও যথেষ্ট রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভীমরাও শাস্ত্রী ও দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গান এবং এস্রাজ শেখাতেন। ১৯১৯ সালে নকুলেশ্বর গোস্বামী বিষ্ণুপুর থেকে এসে সেই কাজে যোগ দেন। পিঠাপুরম থেকে এলেন বীণাবাদক সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রী। তাঁর কাছে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী বীণা শিক্ষা শুরু করেন। সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রীর সাহায্যে পিঠাপুরম থেকে আশ্রমের জন্য বেশ কয়েকটি বীণাও তৈরি করে আনা হয়েছিল। মিসেস্ ভ্যান ইগেন একমাসের ওপর হল্যান্ড থেকে শান্তিনিকেতনে ইউরোপীয় সংগীত শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। ১৯২২ সালে আরেকজন ওস্তাদ বীণকর এসেছিলেন ত্রিবায়ুর থেকে। ইনি বেহালা বাদনেও দক্ষ এবং যুরোপীয় সংগীতশাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞানী ছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে ইনি ছাত্রছাত্রীদের বেহালা ও বীণা বাদনের শিক্ষা দিতেন। সে বছর আশ্রমে ‘বসন্তোৎসব’ হয়েছিল। ‘ফাল্গুনী’-র গানের সঙ্গে পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী মৃদঙ্গম বাজিয়েছিলেন। ১৯২৩ এ রণজিৎ সিংহ সেতার ও এস্রাজের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবলা ও পাখোয়াজ শিক্ষা দিতেন পূর্ণচন্দ্র ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শৈলজারঞ্জন মজুমদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী এস্রাজ বাজিয়ে গান শেখাতেন। রবীন্দ্রসংগীতে শ্রুতির এবং মীড়ের ব্যবহার অনেক বেশি, তাই তারযন্ত্রে এই গানের সঙ্গত অনেক শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। এই কারণেই শান্তিনিকেতনে এস্রাজ এত মূল্য পেয়ে এসেছে। আর এই কারণেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর গানের সঙ্গে সারেঙ্গী বাজুক। সেসময় বেহালা যন্ত্রটিও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দক্ষ বেহালাবাদক ছাড়া সংগতের অনুমতি দিতেন না। সেতার বাদক হিসাবে নিযুক্ত হন সুশীল ভঞ্জ। অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এস্রাজ, হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, প্রায় সব ধরণের যন্ত্র বাদনেই পটু ছিলেন। তালবাদ্য হিসাবে কবির জীবদ্দশায় পাখোয়াজ, মৃদঙ্গম্ ও শ্রীখোলই ব্যবহৃত হতো। তবলার ব্যবহার প্রথম দিকে ছিল না। পরে তা ব্যবহৃত হলেও খুব সীমিত ছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে তবলা যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়মিত হয়। তবলা যন্ত্রটি নিয়মিত ব্যবহারের শুরুর দিকে শ্রী অনাদি দত্ত ছিলেন একজন সুদক্ষ তবলা ও শ্রীখোল বাদক।
যে সময় রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি আজকের মত সহজলভ্য ছিল না, শিল্পীদের স্মৃতিনির্ভর হয়েই গাইতে হত,স্বাভাবিক ভাবেই সুরের বিচ্যুতি ঘটত। ১৯১৬ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত করা রেকর্ডে এমনটা দেখা যায়। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ চুক্তিবদ্ধ হন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির সাথে। এর পর থেকে সরাসরি রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে অধিকাংশ শিল্পীর রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড হতো। যে সমস্ত রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড ১৯২৬ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, তা বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অনুমোদন করেছেন। সেই সময়কার জনপ্রিয় শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কণক দাস (বিশ্বাস) যিনি তিরিশটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন। কবির অন্যতম প্রিয় গায়িকা ছিলেন সাহানা দেবী, যাঁর ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ এবং ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ গান দুটিতে যন্ত্রানুসঙ্গে শুধু Organ বাজিয়েছিলেন ভানু ব্যানার্জী। রবীন্দ্রনাথ গান দুটিতে তবলা, শ্রীখোল অথবা পাখোয়াজ ব্যবহার করতে দেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যের রেকর্ডিং- এ তালবাদ্য হিসাবে তবলা, শ্রী খোল, পাখোয়াজ ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডিংয়ের শুরুর দিকে বিভিন্ন যন্ত্রে পারদর্শী শিল্পী ও যোগ্য সঙ্গতের অভাবে তাঁর গানে সেগুলির ব্যবহারের অনুমোদন দেননি, জীবনের শেষের দিকে দক্ষ ও পারদর্শী যন্ত্রশিল্পীদের তিনি স্বয়ং অনুমোদন দিয়েছেন।
নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হতো, সেগুলির যন্ত্রানুসঙ্গে বেহালায় ছিলেন অবনী মুখোপাধ্যায় ও পরিতোষ শীল, বাঁশিতে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবীশ, এস্রাজে দক্ষিণা মোহন ঠাকুর, music arrangementএ রাইচাঁদ বড়াল। তখনকার বেশ কিছু বেসিক রেকর্ডে এস্রাজ বাজিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। ‘Columbia Record’ থেকে যে সমস্ত রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশ রেকর্ডেই গীটার বাজিয়েছেন তারকনাথ দে । এর পরবর্তী সময়ে যন্ত্রানুসঙ্গে বেহালা ও পিয়ানো যন্ত্রের দ্বৈত প্রয়োগে ‘tune follow করা এবং Prelude কিংবা Interlude বাজানোর প্রচলন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছে ছিল, তাঁর গানে সারেঙ্গীর অনুষঙ্গ থাকুক, তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে মিরাট থেকে একটি সারেঙ্গী আনিয়ে দিয়েছিলেন। শৈলজারঞ্জন উৎসাহের সঙ্গে শিখতে শুরুও করেছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে কবির মৃত্যু হয়। শৈলজারঞ্জনের সারেঙ্গী শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি, তাই তা কোন গানে বাজানো হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ অন্য কোন সারেঙ্গী বাদক পাননি তাঁর জীবদ্দশায়। তিনি বৈচিত্রময় যন্ত্র যেমন পাননি, বেশ কিছু যন্ত্রের সহযোগও পাননি দক্ষ যন্ত্রশিল্পীর অভাবে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ২০ বছর পরে ১৯৬১ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের যথার্থ মান বজায় রাখার জন্য ‘বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি’ তৈরি হয়, ২০০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে যার অনুমতি বাধ্যতামূলক ছিল। এতে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরাই সদস্য হতেন। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল রেকর্ড, ক্যাসেটের স্বরলিপিসম্মত গানের এবং যন্ত্রানুসঙ্গের ‘যথোপযুক্ত’ সাংগীতিক গুণমান পর্যালোচনা করে তাকে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া। রেকর্ড প্রকাশের অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির নির্দিষ্ট কোনো নিয়মাবলী ছিল না। যে গানের সঙ্গে যে যন্ত্রের সঙ্গত যথাযথ বলে মনে করতেন, সেই ধরনের গানে প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি সমিতির সদস্যরা দিতেন। কোনো যন্ত্রের ব্যবহার সেই বিশেষ গানটির সাথে ‘শ্রুতিমধুর’ লাগছে বা লাগছে না, মূলতঃ তার উপরে নির্ভর করেই ‘বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি’ যন্ত্রানুসঙ্গের বিষয়টিতে রেকর্ডের অনুমোদন দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির অনুমোদন পাওয়া যেত না ‘যন্ত্রানুসঙ্গ যথাযথ না হওয়ার কারণে’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই ‘যথাযথ’ যন্ত্রানুসঙ্গের কোন সংজ্ঞা কোনদিন কোথাও ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কারণে গান রেকর্ডের অনুমোদন না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, যা যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়পত্র পেত, যা হয়ত অন্যদের ক্ষেত্রে অনুমোদন পেত না। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের গানের উপর থেকে কপিরাইট উঠে যাওয়ার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগরীতির একটি বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কপিরাইট থাকাকালীন বিশেষ কিছু বাদ্যযন্ত্র কিছু কিছু শিল্পীর গানের যন্ত্রানুসঙ্গে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। দেবব্রত বিশ্বাসের লেখা ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’এ এমন পক্ষপাতের উদাহরণ দেখতে পাই। তাঁর গানের অনুমোদন না দিয়ে সমিতি লিখেছিল, “Inspite of repeated requests to control and restrict uncalled for composed musical interludes, the same have been applied freely making the production awfully jarring and distorted.[8]
- পুষ্প দিয়ে মারো যারে – Excessive music accompaniment hampers the sentiment of the song.
- তোমার শেষের গানের – Music accompaniment is too much.”
বলা বাহুল্য, এই ‘excessive’ বা ‘too much music accompaniment’ এর মাপকাঠি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছে ছিল না। দেবব্রত বিশ্বাস বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডকে ‘dictator’ আখ্যা দিয়েছিলেন, হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা যেন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডকে বিশেষ অনুরোধ করেন, grace marks দিয়ে সেবারের মতো গান গুলো পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য, কারণ তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল আর নতুন করে গানগুলো রেকর্ড করতে অনেক টাকা খরচ হতো। আমরা জানি গান দুটি অনুমোদন পায় নি। শিল্পী ১৯৬৯ সালে রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন, কারণ রেকর্ড করার সময় অনেক বাদ্যযন্ত্রীর পারিশ্রমিক বাবদ প্রচুর অর্থ খরচ হতো, গান অনুমোদিত না হলে সমস্ত টাকা লোকসান হতো। পরের বছর কোম্পানীর কর্ণধারের বিশেষ অনুরোধে তিনি নতুন অনেকগুলি গান রেকর্ড করেন, যার মধ্যে কয়েকটি গান আবার অনুমোদিত না হওয়ায় শিল্পী আর কোনদিন রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন নি। এর ফলে prelude, interlude এ নতুন যন্ত্রানুসঙ্গের যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শিল্পী করতে চেয়েছিলেন, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্বাভাবিক কারণেই অন্যান্য শিল্পীরাও যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে তেমন সাহস করেননি। চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্রগুলিই ব্যবহার করা হতো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত। নতুন নতুন যন্ত্র ব্যবহারে, নতুন ধরনের আবহের music arrangement এর পরীক্ষা নিরীক্ষায় শ্রোতারা যে আনন্দ পেতে পারতেন, ১৯৬১ থেকে ২০০১ সালের ৪০ বছরের দীর্ঘ সময়ে তা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সমস্যা এটাও, যে তখনকার রেকর্ড করা কালজয়ী শিল্পীদের গানে বৈচিত্রময় যন্ত্রানুসঙ্গ থেকে আমাদের চিরকাল বঞ্চিত থাকতে হবে। পরে ক্রমশঃ বাণিজ্যিক রবীন্দ্রসংগীতে Prelude, Interlude, Chords, Harmony প্রভৃতি ব্যবহার করার চেষ্টা শুরু হয়। এতে নতুন নতুন যন্ত্রের ব্যবহার যন্ত্রানুসঙ্গকে ধীরে ধীরে নতুন রূপ দিতে শুরু করে, কিন্তু ২০০১ সালে Copyright উঠে যাওয়ার পরও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত সংগীত শিক্ষাব্যবস্থা ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের ধরণ অপরিবর্তিতই থেকেছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে তাঁর গানের সাথে কখনো ‘Prelude’ বা ‘Interlude’ ইত্যাদি বাজানো হত না। ক্রমশঃ রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীতের যন্ত্রানুসঙ্গের ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি পরিবর্তিত রূপ এসেছে। এই আদর্শে চারতুকের রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে যন্ত্রানুসঙ্গের রূপটি হল-
১) গানের শুরুতে Prelude Music
২) স্থায়ী ও অন্তরার মধ্যবর্তী পর্যায়ে 1st Interlude Music
৩) সঞ্চারীর আগে 2nd Interlude Music
কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সমস্যাটি হল Prelude, 1st Interlude এবং 2nd Interlude Music দিতেই হবে, নাহলে একটি গান বাণিজ্যিক ভাবে সফল হবে না, এই বাধ্যবাধকতা বজায় রাখতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে গানের সুর ব্যাহত হয়। যেমন, ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুল গুলি ঝরে’ গানটিতে যদি সঞ্চারীর আগে interlude music দেওয়া হয়, তাহলে স্থায়ী থেকে ‘সা রা’ হয়ে গড়িয়ে সঞ্চারীতে গান্ধারে পৌঁছে ‘বউকথাকও’ বলার সৌন্দর্যের সুযোগটি হারিয়ে যায়, কারণ interlude music এর পরে সরাসরি সঞ্চারী ধরা হয়।
গ্রামোফোন পরবর্তী কালে EP আর LP রেকর্ডের যুগে যখন লম্বা দৈর্ঘের রেকর্ডিং প্রকাশের সুযোগ এলো, তখন গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্য গুলির audio রেকর্ড এবং অ্যালবাম প্রকাশের ক্ষেত্রে স্থানাভাবের জন্য গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের অনেক গান রাখা সম্ভব হতো না, বা স্বরলিপি নির্দেশিত পুনরাবৃত্তি রক্ষা করা সম্ভব হতো না। যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র তেমন রাখা যেত না। পরে সিডির ব্যবহার শুরু হওয়ার পরে এই সমস্যা দূর হয়।
বর্তমানে গানের ছন্দবিন্যাস, চরিত্র, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তালবাদ্য যন্ত্র হিসাবে তবলা, শ্রীখোল বা পাখোয়াজের জায়গায় পিয়ানো বা গিটারের ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও বাউল, ভাটিয়ালী প্রভৃতি লোকসংগীত ভাঙা রবীন্দ্রসংগীতে দোতারা বা একতারাকে তালবাদ্য যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ঢোল ব্যবহার হচ্ছে। অন্যান্য বাংলা গানে তালবাদ্য যন্ত্রে যতটা লয়কারী এবং আনুষঙ্গিক বৈচিত্র এনে বাজানো হয়, রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ঠেকা বা সামান্য বৈচিত্র সহকারে গানের ছন্দের পটভূমি রচনা করার কাজই করা হয়। বাউলাঙ্গ, কীর্তনাঙ্গ বা ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে কেমন ঠেকা দিয়ে কী তালবাদ্য বাজবে, অলিখিত নিয়মে তা নির্ধারিত হয়ে গেছে, বিশেষ বিচ্যুতি হয় না সাধারণত।
যে কোন শ্রুতি মাধ্যমের রেকর্ড, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। প্রথম যুগে ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড, যা দম দেওয়া গ্রামফোনে বাজতো। একটা রেকর্ডের দু পিঠে দুটো কিংবা বড়জোর চারটে গান থাকতো। রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড বিক্রির মূল্য থেকে রয়্যাল্টী দিত শিল্পীদের। সেই রয়্যাল্টীই শিল্পীদের উপার্জনের পথ ছিল। এর পরে আবিষ্কার হলো বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রে EP এবং LP রেকর্ড। এতে লম্বা সময়ের অনুষ্ঠান ধারণ করার সুযোগ তৈরি হয়। এই সময় থেকেই গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রেকর্ড হিসাবে প্রকাশ পেতে শুরু করে। এরপর ক্যাসেট এবং টেপ রেকর্ডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার বহনযোগ্যতা এবং কম দামের ফলে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। তারপর আসে ডিজিটাল যুগ। কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি, digital versatile disc বা ডিভিডি, মিনি ডিস্ক হয়ে mp3 ডিস্ক, পেন ড্রাইভ এবং মাইক্রো এসডি কার্ডে গানের মুক্তি হয়েছে ক্রমশঃ। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে এই সময়টার বেশির ভাগ অংশে ছিল বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ। যখন এই নিয়ন্ত্রণ আর থাকলো না, কাকতালীয় ভাবে বাজার থেকে সিডি বাজানোর যন্ত্রও ক্রমশঃ হারিয়ে গেল। কম্পিউটারেও এখন আর কোন মিডিয়া ড্রাইভ থাকে না যাতে সিডি বা ডিভিডি বাজিয়ে গান শোনা যায়। এই আমূল পরিবর্তনের পেছনে একটাই কারণ, অল্প খরচায় জোরালো ইন্টারনেট এবং সবার হাতে স্মার্টফোন, যাতে ইচ্ছে-মতো যে কোন গান যখন খুশি, যেখানে খুশি শুনে নেওয়া যায়। তাই কেউ আর সিডি কিনে গান শোনার প্রয়োজনই বোধ করেন না। অথচ আজকের দিনেও কোন অ্যালবামের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সিডি প্রকাশ করা। সিডি ডেটাবেস (CDDB) বা ডিস্ক আইডি না থাকলে কোন গান আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় প্রচার মাধ্যম যেমন আমাজন মিউজিক, আপেল মিউজিক, স্পটিফাই, উইঙ্ক মিউজিক, জিও সাওন ইত্যাদিতে স্থান পায় না। আকাশবাণীর কোন কেন্দ্রে রেকর্ডেড গান প্রচারের ক্ষেত্রেও এই ডিস্ক আইডি জরুরী। তাই শ্রোতার কাছে সিডি বাজানোর কোন উপায় না থাকলেও গানের অ্যালবামের মুক্তি হওয়া চাই সিডির মাধ্যমে। মিউজিক স্টোরের সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই কমে কমে উধাও হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক কারণে যন্ত্রশিল্পীদের পারিশ্রমিক আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বিক্রি করে উপার্জনের কোনো উপায় আর নেই। ফলে খরচ কমানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। রেকর্ডিংয়ের নির্দিষ্ট কিছু খরচ থাকে যেগুলো এড়ানো সম্ভব নয়। শ্রোতাকে গান শোনানোর একটা বিকল্প উপায় এখন হয়েছে – ইউটিউবে গানপ্রকাশ করা, যেখানে কোন কোম্পানিকে অর্থ দিতে হয় না। এটা এমন সহজলভ্য একটা মাধ্যম, যা শুধু ইন্টারনেট থাকলেই চলে। কিন্তু সেখানে প্রকাশনার জন্য গানটির সঙ্গে একটি নান্দনিক ভিডিওরও প্রয়োজন হয়। সেটাও যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, কারণ সেক্ষেত্রে ভিডিও রেকর্ডিং, এডিটিং এবং পোস্ট প্রোডাক্শনে অর্থ লাগে। সুতরাং, এত খরচ এড়াতে কোপ পড়ছে যন্ত্রানুসঙ্গের ওপর, বিশেষ করে তালবাদ্য, বাঁশি এবং কিছু ব্যতিক্রমী যন্ত্রের ওপর যেমন সন্তুর, oboe, স্যাক্সোফোন, সানাই, সারেঙ্গী, বেস গিটার, সরোদ, twelve string guitar, বীণা, harp, mandolin ইত্যাদি। ন্যূনতম অনুষঙ্গ সহ গানের আবহ রক্ষা করে পিয়ানো বা গিটারে vamping, strumming বা arpeggio দিয়ে তাল রক্ষা করলেই গান গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই এমন কিছু গান শিল্পীরা মুক্তছন্দে গাইছেন, যেগুলি তালবাদ্যের সঙ্গে গাইলেই বেশি ভালো লাগে শুনতে। রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ডিংয়ের প্রথম যুগে যন্ত্রানুসঙ্গের যোগানের অভাবে যে minimalistic ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে যন্ত্রানুসঙ্গে অনেকটা তেমনই minimalistic ব্যাপার ফিরে এসেছে অর্থনৈতিক কারণে। আমরা, রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতারা মানিয়ে নিচ্ছি ক্রমশঃ কমে যাওয়া যন্ত্রানুসঙ্গের সঙ্গে।
তথ্যসূত্র
[1] https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/7199
[2] https://nobojug.blog/রবীন্দ্রনাথের-গান-২য়-পর/
[3] https://www.tagoreweb.in/Songs/pooja-o-prarthana-508/noyon-tomare-pay-na-dekhite-9067
[4] https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/shaarechuattor/30337006
[5] https://www.songsofyore.com/baaja-that-was-harmonium-that-was-music/
[6] https://gaanpaar.com/rabindranath-and-harmonium/
[7] https://gaanpaar.com/rabindranath-and-harmonium/
[8] https://www.facebook.com/kabiguru1861/photos/a.548802931851101/2373986015999441/?paipv=0&eav=AfZ-Ga6rlhvj-RLdXCb_Tfik2JZOunawMKjCsaXgz8nMAO72Zp9jhB-QLG2Dmk8zqjA&_rdr
সহায়ক গ্রন্থ
১. জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর( বিশ্বভারতী)
২. ছেলেবেলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(বিশ্বভারতী)
৩. যাত্রাপথের আনন্দগান – শৈলজারঞ্জন মজুমদার( আনন্দ পাবলিশার্স)
৪. রবীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্য – সুভাষ চৌধুরী( প্রতিভাস)
৫. রবীন্দ্রস্মৃতি – ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ( প্রতীক)
৬. রবীন্দ্রসংগীত চিন্তা – শৈলজারঞ্জন মজুমদার (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি)
৭. ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত – দেবব্রত বিশ্বাস (করুণা প্রকাশনী)