রবীন্দ্রমানসে বিলাতী গানের প্রভাব
ড.শ্রাবণী সেন,অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী, e-mail- srabanisn1@gmail.com, Mobile no- 6290242709
রবীন্দ্রনাথের গীতিসত্ত্বার নেপথ্যে ভারতীয় ভাষায় বিভিন্ন প্রাদেশিক গান, প্রাচীন বাংলাগান, গ্রাম্যগীতি এবং বিদেশী বা বিলিতি গান অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভারতীয় গান, বাংলাগান ও বিলিতি গানের ত্রিবেণী স্রোতে অবগাহন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব গানের কাঠামো তৈরী করেছিলেন। রবীন্দ্রমানসে পাশ্চাত্য-অভিঘাতের নানা চিহ্ণই তাঁর সঙ্গীত ভাবনা ও সঙ্গীত সৃজনের মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। পাশ্চাত্য যাত্রা, পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনা, বোঝা আয়ত্ত ও উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সঙ্গীতের মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তারে, একদিকে যেমন নাগরিক ধনীসমাজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চা অব্যাহত ছিল অন্যদিকে অব্যাহত ছিল বাংলা লোকসংগীত-বাউল, কীর্তন কিংবা টপ্পা গান। ঊনিশ শতকেও আমাদের নাগরিক সংস্কৃতিতে ছিল নবাবী আমলের ছোঁয়া। অষ্টাদশ শতকের শেষার্দ্ধে কলকাতার ধনী সমাজে সংস্কৃতি চর্চায় প্রতীচ্যের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। বদলাতে থাকে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির ছবি। এদেশীয় ধনীরা ও আমোদপ্রমোদের জন্য বিদেশী রীতি অনুসরণ করতে থাকেন। লৌকিক ও পৌরাণিক যাত্রাপালা, কবির লড়াই-এর আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে পাশ্চাত্যরীতি অনুসৃত থিয়েটারের যুগ শুরু হয়। ১৮৩১ খ্রীঃ প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয়ের অবিচ্ছিন্ন প্রয়াস চলতে থাকে। ইংরেজি বাদ্য ‘অর্কেস্ট্রা’ থিয়েটারের হাত ধরে যণ্ত্রসঙ্গীতে জায়গা করে নেয়। ১৮৩৫-এ বিদ্যাসুন্দর নাটকে প্রথম বাঙালিরা ইউরোপীয় রীতির অর্কেস্ট্রা বাজনা প্রয়োগ করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষার্দ্ধ থেকে ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই কলকাতার শিক্ষিত ধনী সমাজ নৃত্য, গীত-বাদ্য ও অভিনয়ের নতুন এক ধারার সাথে পরিচিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতাবাসীর এই চর্চার প্রতি আগ্রহ বেশী দেখা যায়। এই আগ্রহ থেকেই ইউরোপীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির দুই ধারার মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই সমন্বয়ের ফলে দেশী ও বিদেশী যণ্ত্রে দেশী গতের অর্কেস্ট্রা, বাংলা -ভাষায় গান, নাটক, বাংলা স্বরলিপি, যাত্রা-থিয়েটারে কণ্ঠ সঙ্গীতের সঙ্গে ইউরোপীয় বাদ্যযণ্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার এবং ইটালিয়ান অপেরার অনুকরণে বাংলা গীতিনাট্য তৈরী হতে থাকে।
ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের মাধ্যমে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মাধ্যমে এই যোগাযোগের সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূ্ত্রেই দ্বারকানাথের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। দ্বারকানাথ পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বাদ্যযণ্ত্রের চর্চা করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ম্যাক্সমুলার সাহেব বলেছিলেন, বিলেতে থাকাকালীন ইটালিয়ান ও ফরাসী গান শুনতে আর গাইতে খুব ভালোবাসতেন দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপীয় সঙ্গীত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
দেবেন্দ্রনাথের মানসিকতায় ছিল ঊনিশ শতকের জাতীয়তাবোধের ধারণা। তাই ইউরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় থাকলেও দেশী সঙ্গীতের প্রতিও তিনি সমান উৎসাহী ছিলেন। বলা যায় দেশী, বিলিতি সব ধারাই ঠাকুর পরিবারের আবহাওয়ায় মিলে মিশে সমৃদ্ধ ঐকতান হয়ে উঠেছিল। দেবেন্দ্রনাথের পু্ত্ররা ইউরোপীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি সমানভাবে ভারতীয় সঙ্গীতের চর্চাও করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ,হেমেন্দ্রনাথ স্বদেশী ও বিদেশী গান ও বাদ্যযন্ত্র চর্চায় পারদর্শী ছিলেন। ঠাকুর বাড়ীর মেয়েরাও দেশীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত চর্চায় পিছিয়ে ছিলেন না।
ভারতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংগীতের ধারণা রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন পারিবারিক সূত্রেই। পাশ্চাত্য বাদ্যযণ্ত্রের কনসার্টের সঙ্গে বাল্যকালেই তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ‘জীবন স্মৃতিতে’ তিনি লিখেছেন -‘এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নতুন নতুন সুর তৈরী করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাঁহার অঙ্গুলিনৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুর বর্ষণ হইতে থাকিত। আমি এবং অক্ষয়বাবু তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম। গান বাঁধিবার শিক্ষানবিসি এইরূপে আমাদের হইয়াছিল।’ শিক্ষানবিস পর্বেই সঙ্গীত সৃষ্টির পরীক্ষা নিরীক্ষায় সুরের অবলম্বন ছিল, বিলিতি বাদ্যযণ্ত্র। জীবনের কৈশোর পর্বে অক্ষয় চৌধুরীর মুখে ‘আইরিশ মেলোডীজ’ শুনে মূল সুরগুলি শেখার বাসনা জাগে রবীন্দ্রনাথের মনে। তাই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে চেনাজানার সূত্রপাত শুধু নয়, পাশ্চাত্য সংগীতকে আরও গভীরভাবে জানার আগ্রহ রবীন্দ্রনাথেরর প্রথম থেকেই ছিল।
১৮৭৮ খ্রীঃ সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বিলেতে যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো বছর। প্রথমবার বিলেত যাত্রা তাঁর সৃষ্টিজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে পরিচয় সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিকথায় পাই :
‘At seventeen, when I first came to Europe, I came to Know it intimately, but even before that time I heard European music in our house hold. I had heard the music of Chopin and others at any early age?’
ইউরোপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের পর রবীন্দ্রনাথের গানের জগতে, গান সম্পর্কিত ভাবনায় অনেকখানি রূপান্তর ঘটে। তাঁর প্রথম প্রবাসের সময়কাল এক বছর পাঁচ মাস। ‘জীবনস্মৃতি’ ইউরোপীয় পত্র থেকে জানা যায়- বিলেতে থাকাকালীন ইংলণ্ডের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায়ই গানবাজনা চর্চা চলত ইউরোপীয় সমাজের নিমন্ত্রনের আসরে। বিলেতে থাকাকালীন সেখানকার সঙ্গীত, অপেরা প্রভৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচিতি ঘটেছিল। ব্রাইটনের সঙ্গীতশালায় ম্যাডাম ক্রিস্টিন্ নীলসন্ অথবা ম্যাডাম্ আলবানীর গান শোনার অভিজ্ঞতা, লণ্ডনে Mr.K -র পরিবারে গানবাজনার চর্চা, ডাক্তার স্কটের গৃহে সন্ধের সময় গানের আসরের কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেগেছেন ‘জীবনস্মৃতি’তে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘আমাদের দেশে গান সাধাটাই মুখ্য, সেই গানেই আমাদের যত কিছু দুরূহতা; য়ুরোপে গলাসাধাটাই মুখ্য, সেই গলার স্বরে তাহারা অসাধ্য সাধন করে। আমাদের দেশে যাহারা প্রকৃত শ্রোতা তাহারা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকে, য়ুরোপে শ্রোতারা গান গাওয়াটাকে শোনে।’
রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ইংলণ্ডে যাত্রা করেন ১৮৯০খ্রীঃ ঊনত্রিশ বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার ইংলণ্ডে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি নাট্যাভিনয় ও অপেরা দেখেন। দ্বিতীয়বার বিলেত যাত্রার সময় দেখেন : Drnary Lane নাট্যশালায় ‘Million of Money’, Lyceum Theratre – এ স্কটের ‘Bride of Lammermoor’, স্যাভয় থিয়েটারে দেখেছিলেন ‘Gondoliers’। বিলেত থেকে ফেরার পথে টেম্স জাহাজের যাত্রীদের, আর ইংলণ্ডে থাকাকালীন ওস্ওয়াল্ড ও ব্র্যাণ্ড পরিবারে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ১৮৭৮ -এ প্রথম বার বিলেত যাওয়া আর ১৮৯০-এ দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়া এবং বিলেতে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চত্য সঙ্গীতের চর্চা করেছিলেন নিবিড়ভাবে। এই সময় কিছু আইরিশ, স্কচ ও ইংরেজি গান রবীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় –
1.’Go where glory waits thee’.
2.’Nancy Lee.’
3.’The British Grenadiers.’
4.’Ye bank and braes.’
5.’Robin Adair.’
6.’Drink to me only with thine eyes.’
ইউরোপকে প্রথম দেখা ও জানার আনন্দ, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অন্দরমহলে প্রবেশের অভিজ্ঞতা, প্রথম জীবনে তার গানের জগতে এনেছিল বিপুল উৎসাহ ও উত্তেজনা। ১৮৭৮ খ্রীঃ পর থেকে ১৮৮৫-৯০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত চিন্তায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। বিলেতে বসবাসকালে ইউরোপীয় সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। ১৮৮৫ খ্রীঃ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বিলেতি সুর ভেঙে বেশ কিছু সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন। রচনা করেছিলেন গীতিনাট্য। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বাস্তবজীবনের যে বিচিত্র ভাবের খেলা এবং কথার প্রাধান্য আছে তা রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
কৈশোর উত্তীর্ণ কবির প্রথম ইউরোপের সঙ্গে সংযোগের অভিজ্ঞতা, ইউরোপীয় সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর ভাবনা, আদর্শ ও সঙ্গীত সৃষ্টির জগৎকে প্রভাবিত করেছিল। বিলেত থেকে প্রত্যাগমনের পর ১৮৮১তে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, ১৮৮২তে ‘কালমৃগয়া’ এবং এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের রচনা ‘সঙ্গীত ও ভাব’ (১২৮৮) ‘সঙ্গীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা’ (১২৮৮), সঙ্গীত ও কবিতায়(১২৮৮) পাশ্চাত্য প্রভাবের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
ইউরোপীয় সঙ্গীতকে উপলব্ধি আর আয়ত্ত করার মধ্যে দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের ব্যকরণের শৃঙ্খল সম্পর্কে সচেতন হচ্ছিলেন। আমাদের সঙ্গীতকে সুর ও তালের নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে স্বতঃস্ফূর্ততায় মুক্তি দেবার ভাবনা তাঁর প্রতিফলিত হল প্রথম গীতনাট্যে। ১৮৮০ খ্রীঃ বিলেত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রচিত হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। আমাদের দেশে গীতিনাট্যের প্রচলন মূলত লোকসংস্কৃতির প্রবাহে। এইসব গীতিনাট্যে থাকে নাচের প্রাধান্য। কিন্তু ইউরোপীয় গীতিনাট্যে নাচের ব্যবহার নেই। অপেরার ক্ষেত্রে গানই মুখ্য। গানকে বা সুরকে আশ্রয় করে অভিনীত নাটকই – ‘অপেরা’। ‘বাল্মীকি প্রতিভার’ অভিনবত্ব হল ‘এটি গানের সূত্রে নাট্যের মালা’। রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি প্রতিভায় বহু দেশি রাগরাগিণীকে ভেঙে চুরে বিদেশী ঢঙে সাজিয়েছেন। এতে বিলেতিগান আছে তিনটি- ‘কালী কালী বল রে আজ’, ‘আয় সবে আয়’ এবং ‘মরি ও কাহার বাছা’। ‘কালী কালী বল রে আজ’ গানটি ‘Nancy Lee’ নামক ঊনিশ শতকের ইংল্ডের ব্যালাড জাতীয় গানের সুরে রচিত। বাল্মীকি প্রতিভার ‘আয় সবে আয়’ গানটির মূলে আছে ইংল্ডের একটি গান Hunting Song- ‘John Peel’। ‘মরি ও কাহা বাছা’ গানটির মূল – ‘Go where glory waits thee’। এটি আইরিশ কবি টমাস ম্যরের ‘আইরিশ মেলোডীজ’ এর অন্তর্গত। এই একই সুরকে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োগ করেন ‘কালমৃগয়া’র ‘মানা না মানিলি’ গানে কিংবা ‘মায়ার খেলার’ ‘আজি এ বসন্তে’ গানে। এই সুরে আর একটি গান পাওয়া যায়- ‘ওহে দয়াময় নিখিল আশ্রয়’।
বাল্মীকি প্রতিভা রচনার অব্যবহিত পরেই ১৮৮২ খ্রীঃ পাশ্চাত্য সঙ্গীতেরর আদর্শ ও প্রেরণায় রচনা করেন কালমৃগয়া গীতিনাট্য । কালমৃগয়ায় বিলেতি সুরের গান পাঁচটি। যেমন- ‘ও দেখবি রে ভাই’-এর মূল গান ‘The Vicar of Bray’। আর একটি গান–তুই আয়রে কাছে আয়, আমি তোরে সাজিয়ে দি – এর মূল সুর ‘The British Grenadiers’ গান থেকে নেওয়া। মূলে তা ছিল ব্রিটিশ সেনাদের জনপ্রিয় Regimental March Song। কালমৃগয়ার বিলেতি সুর ভাঙা তৃতীয় গান হল -‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে / বহে কিবা মৃদু বায়।’ এর উৎসে রয়েছে ‘Ye bank and braes’- প্রাচীন স্কচ লোকগীতি। ১৮৮৮খ্রীঃ রচিত ‘মায়ার খেলা’ গীতনাট্যে বিলেতি সুরের গান আছে একটি। ‘আজি এ বসন্তে’ গানটি ‘Go where glory waits thee’ সুরে রচিত।
আবার গীতিনাট্যের জন্য রচিত হয় নি এমনও সরাসরি বিলিতি সুর বসিয়ে রচনা করেছেন – ‘ওহে দয়াময় নিখিল আশ্রয়’, ‘কতবার ভেবেছিনু’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ প্রভৃতি। পুরানো সেই দিনের কথা – গানটির মূল উৎস বিখ্যাত স্কটিশ লোকগীতি – ‘Anld Lang Syne’। এই গনটি স্কচরা তাদের মাতৃভূমির স্মারক রূপে বহন করে। মূল বিলিতি গানগুলোর সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো শুধু সুরে নয় কথার ক্ষেত্রেও অনেক জায়গায় মিল পাওয়া যায়। বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে, যেখানে কোন বিলেতি গানের সুর হুবহু বসানো নয়, যে গুলোর সামগ্রিক রূপে সুরের Composition- এ বিদেশী ছাঁচ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ‘আমার সকল রসের ধারা’ বা ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’ গানে। এছাড়াও ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’, ‘নয় এ মধুর খেলা’, আলো আমার আলো ওগো’, ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদ খানি তারায় তারায় খচিত’ প্রভৃতি গানে বিদেশী সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সরাসরি বিলিতি গান ভাঙা রবীন্দ্রসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৭৮ থেকে ১৮৮৫ খ্রীঃ মধ্যে। এরপর রবীন্দ্রনাথ আর এমন গান সৃষ্টির উৎসাহ বোধ করেন নি। সঙ্গীত-ভাবনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই নতুন যৌবনের স্তর ছেড়ে পরিণত স্তরে উন্নীত হয়েছেন। নির্মান করেছেন সাঙ্গীতিক সৃজন ও ভাবনার স্বকীয় পথ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আজীবনের সঙ্গীত সাধনায়, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বাস্তবজীবনস্পর্শী বিচত্রভাবের কোলাহলকে আমাদের দেশি রাগরাগিণীর একক আত্মার সাথে মেলাতে চেয়েছিলেন। এই সমন্বয় সাধনে তাঁর অপরিহার্য মনে হয়েছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের হার্মনিকে। ইউরোপ বিচিত্রের দিকে দৃষ্টি রেখেছে বলেই তার গানের মুখ্য অবলম্বন ছিল হার্মনি। আমাদের গীত আর ইউরোপের হার্মনির মিলনের দিন এসেছে – এই ছিল তাঁর প্রত্যয়। বস্তুত ইউরোপে গানস্রষ্টার স্বাধীনতা আর সঙ্গীতবিষয়ে পাশ্চাত্যের উপর দৃষ্টিভঙ্গিটাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন।
অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতরাজ্যে পশ্চিমের জানলাটা খুলে গিয়েছিল। বিদেশী সঙ্গীতকে জেনেছিলেন বলেই স্বদেশের উচ্চাঙ্গ ও লোকসঙ্গীতের স্বরূপ ও গভীরতাকে যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। এই উপলব্ধির পরিণতি – সঙ্গীত সাধনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘য়ুরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সঙ্গীতকে আমরা সত্য করিতে শিখিব’। রবীন্দ্রনাথের গান যেন সেই বিশ্বাত্মবোধে উজ্জীবিত সত্যেরই সাধনা ।
তথ্যসূত্র
১। রবীন্দ্রনাথ – সঙ্গীতচিন্তা।
২। শান্তিদেব ঘোষ – রবীন্দ্রসঙ্গীত ।
৩। অনুরাধা পাল চৌধুরী – বিলাতী গান ভাঙা রবীন্দ্রসঙ্গীত।
৪। শান্তিদেব ঘোষ – রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা।
৫। প্রশান্ত কুমার পাল – রবিজীবনী।
৬। প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী – রবীন্দ্রসঙ্গীত -বীক্ষা কথা ও সুর।