বুদ্ধদেব গুহ’র উপন্যাসে কন্দজীবন ও সংস্কৃতি : প্রসঙ্গ ‘পারিধী’
অর্জুন মাঝি, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, গভর্নমেন্ট জেনারেল ডিগ্রি কলেজ শালবনি, পশ্চিম মেদিনীপুর
মোবাইল নং – 7872506712 , ই-মেল – majhiarjun79@gmail.com
সংক্ষিপ্তসার – বাংলা কথাসাহিত্যে অন্ত্যজজীবন ও সংস্কৃতি একটি বহুল চর্চিত বিষয় । বাংলা কথাসাহিত্যে প্রথম রবীন্দ্রনাথের হাতেই অন্ত্যজ মানুষেরা কেন্দ্রীয় বিষয় বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা পায়। তাঁর পরবর্তীকালের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা বঙ্গীয় অন্ত্যজ মানুষদের পাশাপাশি বহির্বঙ্গীয় অন্ত্যজ মানুষদেরকেও কথাসাহিত্যে তুলে আনেন। কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতাতে বুদ্ধদেব গুহের জন্মলাভ ঘটলেও বাল্য ও কৈশোরের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছিল সেই রংপুরেই । বুদ্ধদেব গুহ বড় হয়ে ওঠেন একপ্রকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলেই । তাঁর পিতামাতার মতো মামাবাড়ির সদস্যরাও ছিলেন শিক্ষিত ও সাহিত্যিক গোত্রের । বাল্যকাল থেকেই বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। যেকোন বিপজ্জনক কাজে ঝুঁকি নিতে পিছিয়ে যেতেন না তিনি । বিভিন্ন সময়ে পিতার সঙ্গে বরিশাল, রংপুর, দেওঘর, বিহারের রাঁচি, গিরিডি, পালামৌ, আসাম, উড়িষ্যা ইত্যাদি স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সু্যোগ পান। ফলে বঙ্গ ও বহির্বঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র, অশিক্ষিত, আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হন । পরিণত বয়সে তিনি দেশ-বিদেশের সেই সকল দুর্গম এলাকার ব্রাত্য মানুষদের জীবন ও সংস্কৃতিকে কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন । তাঁর হাতে রচিত অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘পারিধী’(১৯৮৩) উপন্যাসে তিনি উড়িশ্যার খন্দমালের বিবিগড় পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত এলাকায় বসবাস করে আসা কন্দ জনজাতির জীবন ও সংস্কৃতি অসাধারণভাবে পরিবেশন করেছেন । তাঁদের বাসস্থান, খাদ্য, সামাজিক বিশ্বাস ও সংস্কার, ধর্মবোধ, স্বাস্থ্যচেতনা ইত্যাদি দিকগুলি যেভাবে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য ।
সূচক শব্দ
অন্ত্যজ, বুদ্ধদেব গুহ, ঋজুদা, পারিধী, খন্দমাল, কন্দ, মেরিয়া প্রথা ।
প্রতিপাদ্য বিষয়
বাংলা কথাসাহিত্যে অন্ত্যজজীবন ও সংস্কৃতি একটি বহুল চর্চিত বিষয় । বাংলা সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকেই সমাজের অন্ত্যজ মানুষেরা সহানুভূতির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে স্থান লাভ করে আসছে । তবে, বাংলা কথাসাহিত্যে প্রথম রবীন্দ্রনাথের হাতেই অন্ত্যজ মানুষেরা কেন্দ্রীয় বিষয় বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা পায় । দৃষ্টান্ত হিসাবে তাঁর হাতে রচিত ‘শাস্তি’ গল্পটির কথা তুলে ধরা যেতে পারে । শ্রমজীবী রুইদাস পরিবারের বড়ো ভাই দুখিরামের হাতে রাধার নিহত হবার ঘটনায় শাস্তি পায় ছোটো ভাইয়ের নিরপরাধা স্ত্রী চন্দরা । পরিবারে নেমে আসে একপ্রকার বিপর্যয় । রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, সুবোধ ঘোষ, সমরেশ বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, মহাশ্বেতা দেবী, বুদ্ধদেব গুহ, ভগীরথ মিশ্র, সৈকত রক্ষিত প্রমুখ কথাসাহিত্যিকের হাতে অন্ত্যজজীবন ও সংস্কৃতি যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে । তাঁদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা বঙ্গীয় অন্ত্যজ মানুষদের পাশাপাশি বহির্বঙ্গীয় অন্ত্যজ মানুষদেরকেও কথাসাহিত্যে তুলে আনেন। কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ’র জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতা শহরে । তাঁদের পূর্বপুরুষ একসময় বসবাস করতো বরিশালে্, তারপর চলে আসেন ফরিদপুরে । সেখানে পদ্মার ভাঙনে ভিটেমাটি ডুবে যাওয়ায় ফরিদপুর ছেড়ে রংপুরে চলে আসতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তাঁর পিতা শচীন্দ্রনাথ গুহ কর্মসূত্রে কলকাতা আসেন এবং স্থায়ীভবে সেখানেই বসবাস শুরু করেন । বুদ্ধদেব গুহের কলকাতাতে জন্মলাভ ঘটলেও বাল্য ও কৈশোরের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছিল সেই রংপুরেই । তিনি রংপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্যে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে কমার্স বিভাগে ভর্তি হন । সেখান থেখেই তিনি C.A. পাশ করেন এবং চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন ।
বুদ্ধদেব গুহ বড় হয়ে ওঠেন একপ্রকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলেই । তাঁর পিতামাতার মতো মামাবাড়ির সদস্যরাও ছিলেন শিক্ষিত ও সাহিত্যিক গোত্রের । তাঁর বড়মামা ছিলেন বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসু এবং সেজোমামা ছিলেন ‘কালিকলম’ পত্রিকার একসময়ের সম্পাদক সুকোমল বসু । বড়মামা একদিন দেখা করতে গেলেন ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর কর্ণধার সুবোধ মজুমদারের সঙ্গে । উদ্দেশ্য ছিল ‘শিশুসাথী’ ও ‘শুকতারা’ পত্রিকায় ভাগ্নের লেখা সাহিত্য প্রকাশের সুপারিশ করা। সেই লেখা প্রকাশিত হয় সেই সুপারিশেই । প্রকাশক বুদ্ধদেবকে হেসে হেসে প্রশ্ন করেন তিনি মামার মতো লিখতে পারবেন কিনা । তখন তাঁর –
“বড়োমামা হেসে বলেছিলেন, ভাগ্নে মামার মতো লিখতে যাবে কোন দুঃখে । ও ভাগ্নের মতোই লিখবে ।’’ ১
মামার সেই বলা কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল । পরবর্তীকালে সেই ভাগ্নেই বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন দখল করে নিতে সক্ষম হলেন একটু ভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্প রচনা করে ।
বাল্যকাল থেকেই বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। যেকোন বিপজ্জনক কাজে ঝুঁকি নিতে পিছিয়ে যেতেন না তিনি । তাঁর সেজোকাকা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । লেখক নিজেও বাল্যকালে নিজের স্কুলব্যাগে ভরে কাকার দেওয়া পিস্তল ও গুলি কাকার এক সঙ্গিনীকে পৌঁছে দিয়েছিলেন । তাঁর পিতা জঙ্গলে শিকার করতে পছন্দ করতেন। তাই, অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি শিকারপ্রিয় পিতার কাছে শিকারের কাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের রাইফেল ও পিস্তল খুব কাছ থেকে দেখে আসছেন । দশ বছর বয়স থেকে বাঘের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ভয় ব্যাপারটা তাঁর চরিত্রে কখনোই সেঁধোতে পারেনি । জীবনের কোন ক্ষেত্রেই । বরং অন্যে যা-কিছুই ভীতিজনক বা অসাধ্য বলে মনে করেছেন, চিরদিনই সেই কাজ করতে এগিয়ে গেছেন ।
বুদ্ধদেব গুহ’র পিতা নিম্ন সম্প্রদায়ের খেটে খাওয়া মানুষদের খুব ভালোবাসতেন । বাড়িতে যেকোন অনুষ্ঠানে উচ্চবিত্ত মানুষদের সঙ্গে তাদেরকেও ডেকে খাওয়াতেন । পিতার সেই গুণ পুত্রের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল । তাছাড়া, তিনি বাল্যকাল থেকেই পিতার সঙ্গে বন, জঙ্গল, খাল, বিল, পাহাড়, নদী ইত্যাদি দুর্গম ও বিপজ্জনক এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন । ফলে, মনে সাহস সঞ্চারিত হয়েছিল অল্প বয়স থেকেই । বিভিন্ন সময়ে পিতার সঙ্গে বরিশাল, রংপুর, দেওঘর, বিহারের রাঁচি, গিরিডি, পালামৌ, আসাম, উড়িষ্যা ইত্যাদি স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সু্যোগ পান। ফলে বঙ্গ ও বহির্বঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র, অশিক্ষিত, আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হন । তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন । এছাড়াও, পরিণত বয়সে দেশের ও বিদেশের বহু স্থান তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন । কখনও কর্মসূত্রে, কখনও শিকারের উদ্দেশ্যে, আবার কখনও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি দুর্গম এলাকায় পা রেখেছেন । একই সঙ্গে দেশ-বিদেশের সেই সকল দুর্গম এলাকার ব্রাত্য মানুষদের জীবন ও সংস্কৃতিকে কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন ।
বুদ্ধদেব গুহ’র অধিকাংশ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু অরণ্য ও অরণ্যে বসবসকারী আদিবাসী মানুষজন । তাই, সমালোচকদের চোখে তিনি ‘জঙ্গলের লেখক’ হিসাবে পরিচিত । শিশু-কিশোরদের আনন্দ দানের জন্যে তিনি সৃষ্টি করেন ‘ঋজুদা’ চরিত্র । তাদের জন্যে লিখে ফেলেন ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’, ‘বন বিবির বনে’, ‘ঋজুদার সঙ্গে লবঙ্গীর জঙ্গলে’, ‘অজগরের দেশে’, ‘ঋজুদার সঙ্গে বক্সারের জঙ্গলে’র মতো একের পর এক কাহিনি । তাঁর হাতে রচিত জনপ্রিয় উপন্যাসের তালিকায় উঠে আসে ‘গামহারডুংরী’(১৯৬৫), ‘জঙ্গলের জার্নাল’(১৯৭০), ‘ঝাঁকি দর্শন’(১৯৭৬), ‘লবঙ্গীর জ্জঙ্গলে’(১৯৭৭), ‘কোয়েলের কাছে’(১৯৮০), ‘পারিধী’(১৯৮৩), ‘কোজাগর’(১৯৮৪), ‘আলোকঝারি’(১৯৮৬), ‘মাধুকরী’(১৯৮৬), ‘শালডুংরি’(১৯৮৭), ‘সাসানডিরি’(১৯৯০) ইত্যাদি ।
‘পারিধী’(১৯৮৩) উপন্যাসের পটভূমি উড়িশ্যার খন্দমালের বিবিগড় পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত এলাকা। এই এলাকায় বহুদিন ধরে বসবাস করে আসছে কন্দ জনজাতি । লেখক অত্যন্ত সুকৌশলে সৌমেনবাবু চরিত্রটির মুখ দিয়ে ‘পারিধী’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন । তিনি বলেছেন –
“আগেকার দিনে ওড়িশার বিভিন্ন নৃপতিরা মহাসমারোহে মৃগয়ায় যেতেন । মৃগয়াকে বলে পারিধী । এরাও বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে পারিধীতে বেরয় । ছুলোয়া শিকারে । আসল উদ্দেশ্য বারা শিকার । বারা, কুট্রা, খুরাণ্ডি, মৃগ ইত্যাদি ছোটখাটো জানোয়ার যা পায় তাই তারা মারে ।’’ ২
পাশাপাশি তিনি এই এলাকায় বসবাস করে আসা কন্দ জনজাতির জীবন ও সংস্কৃতি অসাধারণভাবে পরিবেশন করেছেন । ‘কন্দ’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে সৌমেনবাবু জানিয়েছেন –
“কন্দ কথাটার ব্যুৎপত্তি একটি তামিল শব্দ থেকে । কিন্দ্রি একটি তামিল শব্দ । তেলেগুতে তাকেই বলে কণ্ডা । কিন্দ্রি মানে পাহাড়, ছোট পাহাড় । এবং কণ্ডা কথার মানে পাহাড়ি লোক । যে অঞ্চলে কন্দরা বাস করত সেই পুরো অঞ্চলটাকেই খন্দমাল বলত ।’’ ৩
আলোচ্য উপন্যাসে তাদের বাসস্থান, খাদ্য ও পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস ও সংস্কার, ধর্মবোধ, স্বাস্থ্যচেতনা ইত্যাদি দিকগুলি উপন্যাসের মধ্যে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।
বাসস্থান – কন্দ জনজাতির পূর্বপুরুষেরা একসময় অন্য কোন সম্প্রদায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে খন্দমালের বিবিগড়ে উপস্থিত হয়েছিল । সে সময় সেই এলাকা ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ । তারা জঙ্গল কেটে সাফ করে বসতবাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস শুরু করে । প্রকৃতিতে তারা যেমন পরিশ্রমী, তেমনি সৎ । তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল । তাই, পাকা বাড়ি বানানোর মতো ক্ষমতা তাদের ছিল না । রাস্তার দুপাশে বাঁশ, মাটি ও পাথর দিয়ে ঘরগুলি নির্মাণ করত । ঘরের মাথায় পাতার বা খড়ের ছাউনি । তবে তাদের –
“প্রতিটি ঘর এমন সুন্দর করে নিকানো যে তা বলার নয় । কাঠকয়লার ছাই ও মাটি দিয়ে ওরা ঘরের দেওয়ালে এমন এক আলপনা ও প্রলেপ দিয়েছে যে লাল কালো ও খয়েরি দেওয়ালগুলো দেখে মনে হয় এগুলো পোড়ামাটির টালি দিয়ে তৈরি ।’’ ৪
আবার, তারা তাদের দেবস্থান তৈরি করে পাথরের উপরে পাথর সাজিয়ে ।
খাদ্য ও পানীয় – বিবিগড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার কন্দ সম্প্রদায় আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল । রোজগারের তেমন উন্নত মাধ্যম না থাকায়, তাদের ভাগ্যে উন্নত মানের খাদ্য ও পানীয় জুটতে দেখা যায় না । তাদের খাদ্যতালিকায় পাওয়া যায় ভাত, আলুর তরকারি, জঙ্গল থেকে শিকার করে নিয়ে আসা শুয়োরের মাংস বা অন্য কোন পশুর মাংস, মোরগের মাংস ইত্যাদি । পানীয় হিসাবে থাকে মহুয়া । তাই চন্দনী আর চন্দ্রকান্তের বিয়ের সময় পরিকল্পনা করা হয় –
“রাতে বিয়ের ভোজ হবে । ভাত, আলুর তরকারি, শুয়োরের মাংস আর আমের চাটনি । তার আগে মহুয়া খাওয়া হবে । গ্রামের সমস্ত লোক আজ এখানে খাওয়া-দাওয়া করবে ।’’৫ সেই পরিকল্পনা অনুসারে —
“অন্ধকার হতে না হতে উনুনের আগুন গনগনে হয়ে উঠল । গ্রামের প্রতি ঘরে যত ঘড়া ও কলসি আছে সব জড়ো করা হয়েছে গাছতলায় । রান্নার তদারকি করছে ভাম । গ্রামের ছেলেরা সব গাছতলায় বসে গল্প-গুজব করছে, কেউ কেউ গান গাইছে । তিনজন লোক গেছে দশপাল্লায় মহুয়া আনতে ।
শুয়োরের মাংসটা চাপানোর একটু পরেই ওরা মহুয়া এনে হাজির করল ।’’ ৬
তবে, সাধারণত গাঁয়ের মেয়েদের মধ্যে মদ্যপানের রেওয়াজ নেই । কখনও সখনও দু’একজন আবার খেতেও পছন্দ করে ।
পোশাক-পরিচ্ছদ – অধিকাংশ দরিদ্র কন্দ পুরুষ ও নারীদের শরীরের অর্ধাংশ পোশাকে আবৃত থাকে, বাকি অর্ধাংশ খালি থাকে । পুরুষদের শরীরে ধুতি ও নারীদের শরীরে দেখা যায় শাড়ি । কেউ কেউ মাথাতে নানা রঙের ফুল গুঁজে রাখে । শরীরে ব্যবহার করে নিম বা করঞ্জার তেল । তাই, কাহিনিতে দেখা যায় কথকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা একজন মোড়ল বা প্রধানের দেহের উপরের অংশ অনাবৃত । কোমর থেকে কেবলমাত্র একটা ধুতি ঝোলানো । একইভাবে দণ্ডধর নামে এক কন্দ যুবকের পরিচয়ে জানা যায় –
“ছেলেটার নাম দণ্ডধর । মাথায় বাবরি চুল । বাঁশির মতো নাক— । কাটা কাটা চোখ—খালি গা, কোঁচা ঝুলানো গেরুয়া ধুতি । একেবারে ছেলেমানুষ ।’’ ৭
আবার, কথকের চলার পথে বিপরীত দিক থেকে আসা তিনটি যুবতীকে দেখা যায় –
“শুধু শাড়িটাকে জড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে, মাথায় গাঢ় কমলা রঙ ফুল গুঁজেছে তিনজনেই—কী ফুল জানি না। ওদের কালো কুচকুচে কালো নিম আর করৌঞ্জের তেল-মাখা শরীরে রোদ পিছলে যাচ্ছে ।’’ ৮
এমনকি, বিয়ের দিন দেখা যায় কন্দ পাত্রী চন্দনীর আনন্দমাখা লজ্জাই ছিল একমাত্র প্রসাধন ।
“একটা লাল সস্তা তাঁতের শাড়ি সে জড়িয়ে পরেছিল । গায়ে কোন জামা ছিল না । হাতে পেতলের একজোড়া বালা ছিল শুধু । আর গলায় পুঁতির হার । মাথার পেছনে একটি হলুদ রঙা হলুদ কাঠের কাঁকই গোঁজা ছিল ।’’ ৯
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এরূপ পোশাক-পরিচ্ছদেই তাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল । অন্যদিকে বিবাহের পাত্র চন্দ্রকান্ত –
“একটি ধুতি পরেছিলেন মালকোঁচা মেরে । গায়ে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি । পায়ে মোটরের টায়ার কেটে বানানো চটি –যা গ্রামের হাটে কিনতে পাওয়া যায় ।’’ ১০
সমাজব্যবস্থা – আলোচ্য উপন্যাসে উল্লিখিত কন্দ সমাজের মাথার উপরে থাকেন পঞ্চায়েত প্রধান বা মুখিয়া । সমাজের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করেন তিনি । সেই সঙ্গে কেউ কোনো সমাজবিরোধী কাজ করলে তার শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হয় তাঁকেই । গ্রামে কোন অতিথি এলে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে থাকেন তিনি । কথক ও দলবল বিবিগড় গ্রামে পৌঁছালে এরকমই একজন মুখিয়া বা প্রধান দেখা করতে আসেন তাঁদের সঙ্গে । নমস্কার করে তিনি জানালেন –
“আপনি এ গ্রামে এসেছেন; আমাদের অতিথি । অতিথিকে আমরা ভাই-এর মতো দেখি । আমার সব পুরুষ আপনার ভাই, সব মেয়ে আপনার বোন ।’’ ১১
সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস ও সংস্কার – উড়িশ্যার বিবিগড় ও খন্দমালে বসবাস করে আসা কন্দ জনজাতির মধ্যে নানা প্রকার সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস ও সংস্কার প্রচলিত । তাদের পূর্বপুরুষদের সমাজে প্রচলিত ‘মেরিয়া প্রথা’ ছিল অত্যন্ত নৃশংস প্রকৃতির । সেসময় তাদের সমাজে নরবলি চালু ছিল । বলির উদ্দেশ্যে অন্যের কাছ থেকে ক্রয় ও পালন করা শিশুদের বলা হত মেরিয়া । সমতলের অধিবাসীরা কন্দ প্রভুদের কাছে অল্পবয়সের ছেলে-মেয়ে ধরে নিয়ে এসে বিক্রি করে দিত । কখনও কখনও আবার নিজেদের ছেলেকেও বিক্রি করে দিত । কন্দপ্রধানরা তাদের আদর যত্ন করে বড় করে তুলতেন । শেষে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলা হত । পরে তাদের বলি দেওয়া হত ।
মেরিয়া বলি দেওয়ার দৃশ্যটা ছিল রোমহর্ষক । সাধারণত গ্রীষ্মকালে এপ্রিল-মে মাসে বলির আয়োজন করা হত । মিভি পেনু নামে এক দেবতাকে চাল, ফুল, মিষ্টি নিবেদন করার পরে মেরিয়ার সারা শরীরে নিম ও করৌঞ্জার তেল মাখিয়ে, মালা পরিয়ে একটা খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হত । শুরু হয়ে যেত নাচ-গানের অনুষ্ঠান । শেষে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত । তারপর-
“সে প্রাণভয়ে পালাত এবং গ্রামের লোকেরা তার পিছন পিছন ধাওয়া করে তার গা থেকে মাংস কেটে নিত । তারপর সেই মাংস নিজের নিজের বাড়ির সামনে পুঁতে রাখত ।’’১২
এই মাংস দিয়ে তারা একপ্রকার ধূপ তৈরি করত । তাদের বিশ্বাস, সেই ধূপের গন্ধে যেকোন দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় সম্ভব । তাই, তারা রোগীর ঘরে মেরিয়ার মাংসে তৈরি ধূপ রেখে দিত । ব্রিটিশ মেজর জেনারেল ক্যাম্পবেল ও মেজর জেনারেল ম্যাকফার্সনের যৌথ উদ্যোগে খন্দমাল থেকে এরূপ মেরিয়া বলি প্রথার অবসান ঘটে ।
কন্দ সম্প্রদায়ের বসবাস সভ্য জগৎ থেকে অনেকটা দূরবর্তী এলাকায় । শিক্ষাদীক্ষা থেকে একপ্রকার তারা বঞ্চিত । তাই, অশিক্ষিত, দরিদ্র কন্দ সম্প্রদায়ের মনে নানাপ্রকার বিশ্বাস ও সংস্কার দানা বেঁধেছিল । উপরে উল্লিখিত মেরিয়া মাংসে তৈরি ধূপে দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় তাদের একটি অন্যতম বিশ্বাস । এছাড়া তারা মনে করে, একটি গাছের শুকনো ছালে মোরগের রক্ত নিয়ে ঘরের চার দেওয়ালে লাগানোর পর সেই ছালটিকে দরজার উপর থেকে ঝুলিয়ে রাখলে কোন অশুভ আত্মা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না । তাই, কথক বিবিগড় গ্রাম পরিদর্শনের সময় একটি বাড়িতে এরূপ দৃশ্য দেখতে পান । এমনকি,তারা বিশ্বাস করে গর্ভবতী মেয়েরা মারা গেলে তার অতৃপ্ত আত্মা কোনও না কোনও সময় তাদের বাড়িতে ফিরে আসবেই । এজন্য তারা একটি পরীক্ষা করে মৃত মেয়েটির ফিরে আসার সম্ভাবনা যাচাই করে । মৃতদেহ দাহ করে ফিরে আসার পর পরিবারের লোকজন বাড়ি থেকে একটু দূরে পথের পাশে একটি পাত্রে চাল রেখে দেয় । পরের দিন সেই পাত্র থেকে চাল অদৃশ্য হয়ে গেলে তারা বুঝে যায় যে, মৃত মেয়েটির আত্মা পুনরায় তাদের বাড়িতে ফিরে আসবে । কন্দ সম্প্রদায়ের মানুষেরা এরূপ বিবিধ বিশ্বাসের পাশাপাশি নানাপ্রকার সংস্কার পালন ক্করে থাকে । তাদের সমাজে জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নানাপ্রকার সংস্কার প্রচলিত । যেমন –
জন্মসংস্কার – কারও বাড়িতে শিশু জন্মগ্রহণ করলে পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রদায়ের অন্যান্য মানুষদের মধ্যেও অশৌচ পালন শুরু হয়ে যায় । তা চলতে থাকে ত্রিশ দিন পর্যন্ত । শেষ দিন পূর্বপুরুষদের প্রতি পূজা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সেরূপ অশৌচ পালনের সমাপ্তি ঘটে । গ্রামের পুরোহিত একটি ধনুকহাতে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে শিশুটির পূর্বপুরুষদের নাম উচ্চারণ করতে থাকেন । যার নাম উচ্চারণ করার সময় ধনুকটা একটু কেঁপে ওঠে, নবজাত শিশুটির মধ্যে সেই পূর্বসূরি ফিরে এসেছে বলে ধরে নেওয়া হয় । তারপর –
“শিশুটির মাথা কামিয়ে ফেলা হল এবং একটি মোরগের মেটেভাজা শিশুটির জিভে ছুঁইয়ে সেই পূর্বসূরিকে মোরগ নিবেদন করার পর নবজাত শিশুটি এই বিবিগড়ের কন্দ সমাজে গৃহীত হল ।’’১৩
মৃত্যুসংস্কার – উড়িশ্য্যার বিবিগড় গ্রামের আদিবাসী কন্দ সম্প্রদায় জন্মকালে যেমন নানা প্রকার সংস্কার পালন করে থাকে, ঠিক তেমনি মৃত্যুকালেও নানাপ্রকার সসংস্কার পাল্লন করে । তারা মৃতদেহকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে চিতায় তুলে দাহ করে । অনেকসময় আবার কবরস্থও করে । কোন গর্ভবতী মেয়ে বা এক মাসের কম বয়সি শিশু মারা গেলে তাকে দাহ করা হয় না, পরিবর্তে কবরস্থ করা হয় । তারা মনে করে গর্ভবতী মেয়েরা মারা যাওয়ার পর পেত্নী হয়ে যায় । তাই, যাতে তার অশুভ আত্মা শরীর ছেড়ে বেরোতে না পারে, সেজন্যে মৃতার হাঁটু বা বুকে লোহার টুকরো পেরেকের মতো ঢুকিয়ে দেয় । দাহ করার ক্ষেত্রে দেখা যায় –
“কাঠ সাজিয়ে চিতা তৈরি করে মৃতের জামাকাপড় যা সে ব্যবহার করত এবং কিছু চাষ-বাসের যন্ত্রপাতি চিতায় ফেলে দেওয়া হয়। চিতা জ্বলে ছাই হয়ে গেলে সে ছাইয়ের গাদায় সেদিন হাত দেয় না কেউ । পরদিন সকালে, জানি এসে মন্ত্র পড়ে ও যারা শ্মশানে গতরাতে ছিল তাদের শুদ্ধ করে দেয় ।’’ ১৪
মৃতের পরিবারের লোকজনেরা কিছুদিনের জন্যে মাছ মাংস খাওয়া বন্ধ রাখে । এমনকি মদ পর্যন্ত তারা স্পর্শ করে না । জানি বা পুরোহিতের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে অশৌচ পালন শেষ হওয়ার পর তারা সেগুলি খাওয়া শুরু করে থাকে ।
বিবাহসংস্কার – বিবাহের ক্ষেত্রে কন্দ সমাজে নানাপ্রকার রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত । তাদের বিয়ে হয় জাঁকজমক সহকারে । সেটা একটা দেখার মতো ব্যাপার । রক্তের সম্পর্ক আছে এমন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিবাহ দেওয়া যায় না । এমনকি, একই গোষ্ঠীর ছেলে ও মেয়ের মধ্যেও বিবাহ অসম্ভব । বিবাহের ক্ষেত্রে আলাদা গোষ্ঠীর প্রয়োজন । সমাজে বাল্যবিবাহ চলে না । সতেরো থেকে বাইশ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হয় । প্রেম করে বিবাহ করার ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে না । ছেলেদের দিক থেকে প্রেমের প্রস্তাব আসে । মেয়েরা সেটা গ্রহণ করতে পারে , আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারে । তবে, ছেলেরা মেয়েদের প্রেমকে অবহেলা করতে পারে না । কখনও কখনও তারা ভিন জাতির ছেলের সঙ্গেও মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকে । উপন্যাসের কাহিনিতে কন্দ মেয়ে চন্দনীর বিয়ের ব্যবস্থা করতে দেখা যায় ভিন জাতির ছেলে চন্দ্রকান্ত প্রধানের সঙ্গে। বিয়ের নিমন্ত্রণ করার সময় হাতে একমুঠো চাল দিয়ে নিমন্ত্রণ করা কন্দ সমাজের একটা রীতি । তাই, বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এসে চন্দনীর ঠাম্মা সৌমেনবাবুর হাতে একমুঠো চাল সমর্পণ করেন । এছাড়া আদিবাসী কন্দ সমাজে বিবাহ সম্পন্নের পর প্রীতিভোজ খাওয়ানোর প্রথা প্রচলিত । চন্দ্রকান্ত ও চন্দনীর বিয়ের পর বিবিগড় গ্রামের সকল বাসিন্দাদের পাশাপাশি অতিথিদের জন্যেও প্রীতিভোজের ব্যবস্থা হয় । মেনুতে থাকে ভাত, আলুর তরকারি, শুয়োরের মাংস, আমের চাটনি আর পর্যাপ্ত মহুয়া । রাতের ভোজের পর নবদম্পতির হানিমুনে যাওয়ার দৃশ্য অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক । কথক চন্দ্রকান্তকে তাদের হানিমুনের স্থান বিষয়ে জানতে চাইলে —
“চন্দ্রকান্ত বললেন, জঙ্গলে । চাঁদনি রাতে আমার নতুন বউয়ের হাত ধরে আমি নীল- গাইয়ের দলকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকব । চাঁদ ডুবে গেলে, নীলগাইরা থেমে গেলে, নরম ঘাসের মধ্যে আমরা শুয়ে পড়ব । শালফুলের মধ্যে মুতুরী, শিয়ারী আর গিলিরি লতার ঝোপের আড়ালে আমাদের ফুলশয্যা হবে ।’’ ১৫
স্বাস্থ্যচেতনা – বিবিগড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করে আসা কন্দ সম্প্রদায়ের চিকিৎসার জন্যে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার তেমন কোন ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় না । তাই, তারা জঙ্গলের বিভিন্ন গাছ-গাছড়াকে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করতে বাধ্য হয় । সেদিক থেকে তারা যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন । তারা জানে, বাইগবা গাছের ছালের রস লাগালে দাঁত ব্যথা সেরে যায় । তাই, চন্দনীর বিয়েতে আমন্ত্রিত কথকের দাঁতে ব্যথা শুরু হলে চন্দনী পরামর্শ দেয় –
“লঙ্কা ক্ষেতের বেড়ার ধারে জঙ্গলের কাছে বাইগবা গাছ আছে । বাইগবা গাছের ডাল ভেঙে তার রস লাগালেই ব্যথা সেরে যাবে ।’’ ১৬
ভেরেন্ডাকে উড়িয়াতে বাইগবা বলে । চন্দনীর পরামর্শ অনুসারে বাইগবা ছালের রস কথকের আঙুলে লাগালে কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা কমে যায় । দরিদ্র, অশিক্ষিত কন্দমেয়ে চন্দনীর এরূপ স্বাস্থ্যচেতনা পাঠকের মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে ।
ধর্মবোধ – উড়িশ্যার খন্দমাল অঞ্চলের কন্দ সম্প্রদায় ধর্মভীরু মানুষ । একাধিক দেবদেবী তাদের হাতে পূজিত হয় । তাদের উপাস্য দেবদেবীদের তালিকায় পাওয়া যায় টানা পেনু, ডারেনি পেনু, কাটি পেনু, এস পেনু, সারু পেনু, মউলি প্রমুখ দেবদেবীর নাম ।
“টানা পেনু আর ডারেনি পেনু একই দেবী । তিনি হচ্ছেন গ্রামের রক্ষয়িত্রী । প্রতি গ্রামের পাশে এই দেবীর পাথরের ঠাঁই থাকে । ডারেনি পেনুর প্রেমিক টারেরী পেনু এবং ডারেনি পেনুর ভাই ম্রিভি পেনু । এই ম্রিভি পেনু খুব প্রয়োজনীয় দেবতা, কারণ রাজার চেয়ে যেমন তার দেওয়ান প্রভাবশালী, তেমন ডারেনি পেনুর ভাই ম্রিভি পেনু । তার মাধ্যমেই যত বলি, পুজো, আর্জি আবদার করতে হয় ।’’১৭
কন্দদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর দেবতা মউলি । সাধারণত তারা এই দেবতার পূজা করতে ভয় পায় । এমনকি, যেখানে মউলি দেবতা থাকেন, তার ধারে-কাছে তারা যায় না । আমোদ-প্রমোদ – আলোচ্যউপন্যাসে কন্দ সম্প্রদায়ের আর্থিক দুরবস্থার যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় তাদের আমোদ-প্রমোদের কথাও । তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে ‘মেরিয়া-বলি’র দিনটা ছিল যেন একটা মহোৎসবের ব্যাপার । বলির পূর্বে সকলে মিলে ঢাক, ঢোল, করতালের মধ্য দিয়ে মনের আনন্দে নাচ-গান করত। পরবর্তীকালেওগাঁয়ে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হলে, তারা একই ভাবে সমবেত হয়ে মদ্য-মাংস ভোজন করে নাচ-গানে মত্ত হত । চন্দনীর বিয়ের রাতে কন্দ সম্প্রদায়ের পুরুষ ও নারীদের দেখা যায় মদ্য-মাংস খেয়ে এরকমই নাচ-গানে মত্ত হতে ।
সুতরাং, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘পারিধী’ উপন্যাসে কন্দজীবন ও সংস্কৃতি অনুসন্ধানের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হয়ে আমরা বলতে পারি, বহির্বঙ্গীয় অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন যথেষ্ট অভিজ্ঞ । দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এই ধরনের উপন্যাস রচনা করেছেন । খন্দমাল অঞ্চলে বসবাস করে আসা কন্দ সম্প্রদায়ের বাসস্থান, খাদ্য, সামাজিক বিশ্বাস ও সংস্কার, ধর্মবোধ, স্বাস্থ্যচেতনা ইত্যাদি দিকগুলি যেভাবে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য । বহির্বঙ্গীয় গ্রামীণ জীবনের রূপায়নে তাঁকে অদ্বিতীয় বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না ।
তথ্যসূত্র
১। বুদ্ধদেব গুহ, ঋভু, চতুর্থ খণ্ড একত্রে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ – ১১৫ ।
২। বুদ্ধদেব গুহ, ‘পারিধী’, দ্র বুদ্ধদেব গুহ, ‘বারোটি উপন্যাস’, কামিনী প্রকাশালয়, কলকাতা, ২০১৫, পৃষ্ঠা – ৪৪
৩। তদেব, পৃ- ৩০
৪।তদেব, পৃ- ৪৭
৫। তদেব, পৃ– ৬৪
৬। তদেব, পৃ – ৬৫
৭। তদেব, পৃ – ২২
৮। তদেব, পৃ – ২৬
৯। তদেব, পৃ – ৬৩
১০। তদেব, পৃ – ৬৩
১১। তদেব, পৃ- ২৯
১২। তদেব, পৃ- ৪২
১৩। তদেব, পৃ- ৪৮
১৪। তদেব, পৃ- ৫০
১৫। তদেব, পৃ- ৬৩
১৬। তদেব, পৃ- ৬৫
১৭। তদেব, পৃ- ২৯
……………………………………………………………………