নাচনি : ছিন্ন জীবন ছিন্ন মন – সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘রসিক’ উপন্যাস অবলম্বনে একটি আলোচনা
ধৃতি সিনহা
Assistant Professor
Barasat Subhas Chandra College of Education
জীবনের চলতি পথের বাঁকে যারা হারিয়ে গেছে, তারা এ সমাজের কেউ নয়। অদূর অতীতের দেবদাসী হোক বা নবাব হারেমের বন্দি – সমাজের মূল স্রোতে তাদের আর ফেরা হয়নি। মানুষ নয়, নিছক এক ব্রাত্য সম্প্রদায় হয়ে তারা থেকে গেছেন। নাচনিও সেই ধারার অন্য নাম। রাঢ় বাংলার বহু শতাব্দী প্রাচীন এই গোষ্ঠী উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে রাজদাসীর। সময়ের বিবর্তনে রাজদাসী থেকে স্বদাসী – নামের বদল ঘটেছে কেবল। শোষিতের তকমা ঘোচেনি। সীমাহীন দারিদ্রই তাদের ঠেলে দেয় এই পথে। শিল্পী হিসাবে মেলেনা কোনো কদর। লালসা ভরা চোখ তার যৌবন দেখে শুধু – রক্ষিতা হয়েই তার জীবন কাটে। মঙ্গল কাব্যের ‘বেহুলা নাচনী’র মতো স্বর্গপ্রাপ্তি তাদের ঘটে কিনা তা অজানা। তবে মৃত্যুর পর পায়ে দড়ি বেঁধে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার বিধান অবশ্যই সমাজ অনুমোদিত। ঝুমুর গানের অনুষঙ্গে রসিকের সাথেই চিনে নেওয়া যায় তার নাচনিকে। তারা অরক্ষণীয়া নন। রসিক ছাড়া তাদের গতি নেই ! ছায়া মানবীর মতই তাদের জীবনধারণ। মঞ্চে রসিকের পাশে নাচনি – এই একমাত্র সত্য তাদের জীবনে। সিঁদুরে রাঙানো সিঁথি কিন্তু সে কুলের বউ নয়, হেঁশেলের হাঁড়ির অধিকার নেই তার। ‘ভাতের বউ’ নয় তবু তার গর্ভে আসে রসিকের সন্তান। ভূমিষ্ঠ হলেই তারা শুধু ‘নাচনীর বেটা’ বা ‘নাচনীর মেয়্যা’! এই নাচনি জীবনের বিবিধ টানাপোড়েন, বঞ্চনা, বেদনার এক আলেখ্য রচনা করেছেন লেখক শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর রসিক উপন্যাসে। কেবল নাচনির নয়, রসিকের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণেও তিনি যত্নবান। উপন্যাসটির জটিল ঘটনাক্রমের মধ্যে Gender Politics বা লিঙ্গ রাজনীতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানভূমের লোকায়ত সংস্কার, লোকজীবনের নির্যাস উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে। ঝুমুরের বিখ্যাত পদগুলি উপন্যাসে ব্যবহারের ক্ষেত্রে লেখক অদ্ভুত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। লোকভাষার যথাযথ ব্যবহারে চরিত্রগুলি বাস্তবোচিত হয়ে উঠেছে। ঘটনার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে লেখক তুলে ধরেছেন নারীর জীবনসমস্যার বিবিধ আঙ্গিক। নাচনি জীবনের কঠোর সত্যকে নির্মম ভাবেই তিনি উপস্থাপিত করেছেন। উপন্যাসের শেষেও কোনো সোনালি দিনের আভাস দেননি তিনি। বরং তুলে ধরেছেন সেই সত্যকে যা বহু শতাব্দী ধরে একভাবে চলে আসছে। Sexual Politics এর আধারে নাচনির আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলাই আলোচ্য প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী…’ – অমরার উর্বশী – তার নম্রনেত্রপাত, হিল্লোল, মদির গন্ধ সৃষ্টি করে আবেশের। তার নূপুর নিক্কনে আনন্দযজ্ঞের আবাহন। নন্দনকাননের উর্বশীকে জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা তাই অর্থহীন। কিন্তু কবি যখন তাকে দেখেন কোলাহলমুখর কুৎসিত নগরের ভিড়ে – তার চোখের কালিতে লেখা থাকে লাঞ্ছনা পীড়িত জীবনের কথা। চাহিদা-জোগানের হিসাব মেলাতে নষ্ট হয়ে যায় কত শৈশব, মিথ্যে প্রতিশ্রুতির জালে আটকা পড়ে কত নিরূপায় শরীর যায় বিকিয়ে, সামাণ্য কিছু টাকার জন্য বাবা-মা বেচে দেয় তাদের সন্তানকে। লিঙ্গ-বৈষম্যের এই দুনিয়ায় কন্যাভ্রূণ হত্যা আজও রমরমিয়ে চলছে। বহু সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান – চেষ্টার বিরাম নেই। তবু বিকৃত মানসিকতার দুর্ভেদ্য অন্ধকার পেরিয়ে পৌঁছন যাচ্ছেনা অভীষ্ট লক্ষ্যে। আজও দেবদাসী, রাজদাসী, স্বদাসীর উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছে নারী। তারা কেউ কুলবধূ নন – সমাজের প্রান্তবাসিনী। পশ্চিম বাংলার তেমনি এক প্রান্তবাসিনী সম্প্রদায় নাচনি। পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া জেলার সাংস্কৃতিক বাতাবরণে লোকায়ত চেতনার ছাপ রয়েছে ব্যাপক ভাবে। ভাদু, টুসু, করম, ঝুমুরকে সঙ্গী করে দাঁড়, নাটুয়া, ছৌ – সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে লীন হয়ে রয়েছে। নাচনি নৃত্যও এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রসিকের ঝুমুর গানের তালে নাচনির পদসঞ্চার। নাচনি কথার অর্থ শ্রীভুক্ত মাহাতোর ব্যাখ্যায় –
“যে মেয়ে নাচ পরিবেশন কালে মাত্র নাচের ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, সেই দিকে মন প্রাণ রেখে জন্ম সম্বন্ধ ত্যাগ করে ঈশ্বরীয় সম্বন্ধে আবদ্ধ হন তাকে বলে নাচনি।“
উল্লেখ্য নাচনির সংজ্ঞায় নৃত্যের প্রতি তার অনুরাগ এবং অধ্যবসায়কেই গুরুত্ব দিয়েছেন শ্রীভুক্ত মাহাতো।
অন্যত্র –
সুরেলা ঝুমুরের কন্ঠে আর পায়ে নৃত্যের ঝংকারে মুখরিত নূপুর নিয়ে যে মেয়েরা সাবেকি মানভূম এবং ছোটনাগপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে নাচ-গান-কৌতুকের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তারা নাকি এ অঞ্চলের ‘নাচনি’।
সাবেক মানভূমের এই নাচনি ও রসিক সম্পর্কের বিভিন্ন আঙ্গিককে ফুটিয়ে তুলেছেন শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর রসিক উপন্যাসে। এর পাশাপাশি নাচনি মনস্তত্ত্বের এক সুনিপুণ বিশ্লেষণ তিনি করেছেন। উপন্যাসটির ‘চরিত্র চিত্রশালার’ বহু মুখের ভিড়েও আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় বিজুলি-পান্ডবকুমার-ধ্রুবকুমার-কুসমির বৃত্তটিকে। সমান্তরালে বয়ে চলেছে তরণীসেন-দুলালি-বদনচন্দ্রের সম্পর্কের জটিল রসায়ন। উপন্যাসে প্রভঞ্জন ও মঞ্জুরাণীর কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রসিক-নাচনির সম্পর্ক। অন্ধ প্রভঞ্জনের নাচনি প্রেম ভিক্ষা করে তরণীসেনের কাছে – শুধু প্রেম নয়, সম্পর্কের এক জটিল সমীকরণ ছায়া ফেলে যায় ভীম মাহাতো-লতার জীবনে, মুহূর্তের জন্য। রসিক-নাচনির সম্পর্কের এক ব্যতিক্রমী আঙ্গিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে ব্রজরাম-সরস্বতীর কাহিনীতে। লেখক শোনান বিগত যৌবনা ‘মানভূমের বুলবুল’ নিশারাণী নাচনির নতুন রসিকের কথা। নাচনি জীবনের বিভিন্ন পরতের মতো রসিক মনের নানাবিধ স্তরকেও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন লেখক। কখনো সে পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী কেবল এক সত্তা, কখনো তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃত এক ‘মানুষ’ কে। রসিক এর পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে শ্রী সুনীল সাহার কথায় –
সাধারণ কথায় যে রসের অধিকারী সেই তো রসিক। যারা কৃষ্ণতত্ত্বে বিশ্বাসী তাদের কাছে কৃষ্ণই একমাত্র রসিক। সামন্তদের মধ্যে যারা নাচনীদের ভরণপোষণ করত তাদের মধ্যে অনেকে রসিক হয়ে নাচনীদের দক্ষতা ও রূপলাবণ্য তথা যৌবন ভোগ করত। …অনেক ভূস্বামী আবার নিজেদের অধিকার বা প্রভাব দেখাবার জন্য নাচনীদের সঙ্গে নাচে-গানে বা বাদ্যে অংশ নিত রসিক হয়ে।
উপন্যাসের শুরুতে লেখক রাঙ্গুডি গ্রামের রসনাবালার সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন। রসনাবালা নাচনি নয়, কেবলমাত্র একজন মা, যে পেটের দায়ে বিক্রি করেছে তার কিশোরী মেয়ে বিজুলিবালাকে। শৈশবে বিবাহিত মেয়েকে মাত্র কিছু টাকার জন্য সে তুলে দিয়েছে পশুর অধম ভরত সর্দারের কাছে। রীতিমতো পরিকল্পনা করে মেয়ের অজান্তে তাকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের পথে। তাই হয়তো সে কোনো দিনও ক্ষমা করতে পারেনি তার মাকে। ঔপন্যাসিক বিজুলিবালার ভাগ্য জুড়ে দেবেন পান্ডবকুমারের সাথে। তাই ভরত সর্দারের বন্দিনীকে উদ্ধার করতে জঠু সহিসের সাথে বন্ধুপুত্র পান্ডবকুমারের যোগদান খুব কাকতালীয় মনে হয়না। এর পাশাপাশি উপন্যাসে দেখা যায় তরণীসেনকে, যার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য নাচনির রসিক হওয়া। তার গুরু প্রভঞ্জন। স্ত্রী দুর্গারাণী ও নাচনি মঞ্জুরাণীকে নিয়েই প্রভঞ্জনের সংসার। মঞ্জুরাণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক তথা রসিকের সাথে নাচনির সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কথায় –
…ই জীবন মরণের মাঝেই ত রসিক লাচনী বসত কইরছেন। উয়ার বাইরে যাবার জ আছ্যে? …হঁ পিরীতি। সকল কথার সার কথা বাপ। ই কথাটি ভুইললে রসিক জনম বিরথা। …রসিক লাচনী কন সাধারণ মানুষ লয় ই কথাটি ভুইললে চইলবেক কেনে। …উয়ারা দ্যাবতা আর মানুষের মাঝামাঝি। উয়াকে বল্যে কিন্নর কিন্নরী। …লাচনী হছেন রসিকের সাধন সহচরী। তার সাথেই রসিকের জীবন মরণ, রমণ, লাচন গায়ন সব কুছু। (পৃ – ৫৭)
প্রভঞ্জনের ব্যাখ্যায় যুবক তরণীসেন মুগ্ধ। অন্যদিকে নাচনি মঞ্জুরাণীও ভোগ করতে চায় তরণীর দেহ-সুখ। রসিক প্রভঞ্জনের অন্ধ দুই চোখ মঞ্জুরাণীর সৌন্দর্য দেখেনি। অতৃপ্তির সেই বোধ থেকেই সে কাছে পেতে চেয়েছে ‘চক্ষুষ্মান’ তরনীকে। কারণ সে জানে – ‘রসিক লাচনীর জীবনে ত উ আনন্দটিই সার কথা।‘ তবু এক নিখুঁত অভিনয়ে নাচনি মঞ্জুরানী রসিক প্রভঞ্জনের সঙ্গে মঞ্চ মাতিয়ে তোলে। রসিক একাধারে নাচনীর প্রাণ, পরিচালক এবং গুরু – এই তত্ত্ববাক্য মেনে নিয়েই আসরে নামার আগে ‘চুম্বন, প্রণাম ও নিবেদনের তিন প্রস্থ ক্রিয়াকর্ম’ – পালন করে নাচনি আসরে নামে। আসরে নাচনি কেবলমাত্র একজন শিল্পী। মঞ্জুরানীও তার ব্যতিক্রম নয়। মঞ্চের নাচনি মঞ্জুরানীর সাথে ‘প্রভঞ্জনের সংসারে কুটনোবাটা করা, জমিতে বাগাল দেওয়া মঞ্জুরানীর’ তফাৎ অনায়াসেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ! দক্ষ অভিনেতার মতো সে মঞ্চ মাতিয়ে তোলে আর ঘরে সেবাদাসীর ভূমিকায় নিজের কাজ করে চলে নির্ভুলভাবে।
দরবার নর্তকীদের অবস্থান্তরের কোনো এক পর্যায়ে নাচনিদের পথচলা শুরু হয়েছিল বলে মনে করেন কোনো কোনো সমালোচক। ক্রমে মানভূমের জমিদার বা অবস্থাপন্ন গৃহস্থেরা নাচনির ভরণ পোষণ করতে শুরু করে। নাচনি রাখার মধ্য দিয়ে সমাজে এক ব্যক্তিবিশেষ হয়ে ওঠার মনোভাবও এক্ষেত্রে কাজ করে। আলোচ্য উপন্যাসে যুবক তরণীসেনও নাচনি খুঁজে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সমাজে গণ্যমান্য ব্যক্তি হতে চায়না সে, নিজেকে কেবল নাচনির রসিকের আসনে দেখতে চায়। গুরু প্রভঞ্জনের সাথে মঞ্জুরানীর সম্পর্কের ছন্দের দোলা লাগে তরণীর মনে। তিন কুড়ি টাকায় ডোমের ঘরের মেয়ে মালতীকে বায়না করে আসে তন্তুবায় ‘কুলতিলক’ তরণীসেন। এক খন্ড পাথরকে ঘষে মেজে হীরে করে তুলবে – এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই মালতীর মতো এক মেয়েকেই সে গ্রহণ করবে, যার কাছে নাচ এবং গান – এই শব্দ দুটোর আলাদা কোনো অর্থই নেই, পেটের খিদে মেটাতেই মায়ের (বিরলার) কথা মতো তার এপথে আসা। মালতীর মতোই বিজুলিবালা। তবু তফাৎ অনেক। রসনাবালা মেয়েকে ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে এক নরপশুর কাছে, অন্যদিকে বিরলা এক তরুণ ‘রসিকের’ হাতে তুলে দিতে চেয়েছে তার মেয়েকে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দুটি ক্ষেত্রেই, তবু তুলনামূলক ভাবে বিরলাকে মানবিকগুণ সমন্বিত করে বর্ণনা করেছেন লেখক। তরণীর আচরণেও সেই মানবিকতা বোধই প্রবল হয়ে উঠেছে বারে বারে। পরিবারের শাসন অগ্রাহ্য করে সে পারেনি ডোম জাতির মেয়ে মালতীকে নাচনি হিসাবে ঘরে জায়গা দিতে। ডোমের চেয়ে সমাজে অনেক উঁচুতে তন্তুবায়ের অবস্থান! ঘরে বউ আসার আগে নাচনি রাখার সামাজিক নিষেধকে অবহেলা করার সাহস নেই তন্তুবায়েরও। অতঃপর কংসাবতীর তীরে দাঁড়িয়ে তরণীসেন ফিরিয়ে নেয় তার কথা। তবে পাপের জরিমানা স্বরূপ আটকুড়ি টাকা সে তুলে দিতে চায় বিরলার হাতে। কিন্তু প্রতিবাদ করে মালতী –
“…উ আটকুড়ি টাকা ফিরায়েঁ দে। আর বায়নার তিনকুড়ি টাকা ধার। আমি উটি গতরে খাট্যে শোধ করব্য।… মালতী অপরিচিত গলায় বলে চলে, তন্তুবায়ের মড়া যেমুন ডমে নাই ছোঁয় তেমুন টাকাও হাথে লেয় না। উ টাকায় মুখে লাথ মারি। ফেল্যে দেঁ মা, ফেল্যে দেঁ।“ (পৃ – ২৫৯)
বয়স, জাতি বা লিঙ্গ ভেদে আত্মাভিমান বোধের হেরফের হয়না। মালতীর প্রতিবাদে তারই প্রকাশ। আত্মমর্যাদায় নিরিখে তন্তুবায় ডোমের কোনো ভেদ নেই। তবে এই আত্মাভিমানের সাথে জড়িয়ে থাকে একটি কোমল মনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। শুধু মালতী নয়, তরণীসেনের স্বপ্নও ভেঙে গেছে। বিবাগী হয়ে সে ঘুরেছে পথে পথে –
আর না লাগিবে ভাল মনের মানুষ চলে গেল
যেমন সাজানো ফুল একটি গেল ঝরিয়ে
কেমনে হায় ধৈরজ ধরি-
উদাসী মনের বেথা দুদিনের কত গাঁথা
যেমন পিয়াসী পরাণে ছিল বারি রে –
জীবনে কি হবে দেখা কি আছে মিলনে লেখা
যেমন ঘন বনে হারায় শুক সারীরে… (পৃ – ৩২৬)
মনের মানুষ অধরাই থেকে যায় – দুলালীকে কেন্দ্র করে বদনের সাথে তরণীসেনের বিবাদও মিটে যায় দুলালীর অন্তর্ধানের মধ্য দিয়েই। শূন্য হৃদয় শূন্য জীবনই যেন তরণীর একমাত্র ভবিতব্য –
…কালো রাত্রির নদী স্রোতে তার গভীর ছায়া আঁকা হচ্ছে। আঁকা হচ্ছে চিরকালীন অনন্ত বিরহের ছায়াছবি। তরণীসেন কান পেতে শোনে, কংসাবতীর স্রোতে স্রোতে একখানি গীতের অসমাপ্ত আখর নির্জনে বয়ে চলেছে, …যে জন রসিক হয়, অবশেষে দরশন পায় … অবশেষে দর্শন। (পৃ – ৬৪৩)
মাহাতো পরিবারের তিনপুরুষের (ভীম মাহাতো-ধ্রুবকুমার-পান্ডবকুমার) রসিক ট্র্যাডিশন আলোচ্য উপন্যাসের অন্যতম প্রাপ্তি। রসিক মনের বিভিন্ন পর্যায় – আনন্দ, বিদ্বেষের পাশাপাশি অনুতপ্ত মনের পরিচয়ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রসিক ভীম মাহাতো শেষ বয়সে এসে অনুভব করেছে –
“…তকে দেখ্যে আজ আমি ধ্রুবকুমারের মা জননীকে চিনহে লিল্যম। বুঝল্যম মরদ যখুন লাচনীকে লিয়েঁ ঘরে দুয়ার দেঁয় তখন উয়ার পরিবার বাইরেঁ বস্যে কেমুনতর মানুষের ধম্ম পালন করে।“ (পৃ – ৩৫৯)
পাশাপাশি চিনে নেওয়া যায় ধ্রুবকুমারকে – তার রসিক জীবনের খ্যাতি যখন অস্তাচলে তখন এক অসম প্রতিযোগিতা শুরু করে ছেলে পান্ডবকুমারের সাথে। নাচনি কুসমিকে ব্যবহার করে বিষিয়ে দিতে চেয়েছে ছেলের মন। শুধু তাই নয় লালসা মেটাতে চেয়েছে ছেলের নাচনি বিজুলিবালাকে ভোগ করে। সেই বিজুলিবালা’ যাকে, ভরত সর্দারের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছে পান্ডবকুমার। নতুন রসিকের কাছে সে আদরের ‘ঝুমর’। তবু অতীত দিনের ভয়াবহ স্মৃতি তার মন থেকে মুছে যায়না কিছুতেই – চেতন-অবচেতনে দুটো রোমশ হাতের অস্তিত্ব তাকে পীড়া দেয়। রসিক পান্ডবকুমারের ভালোবাসাও তার মন থেকে মুছে দিতে পারেনা সেই ভয়াবহ দিনের স্মৃতি। ভরত সর্দার কখনো হানা দেয় স্বপ্নে কখনো বাস্তবে পান্ডবকুমারের বাবা ধ্রুবকুমারের রূপ ধরে। –
…খিপ্র বাঘের মতন ধ্রুবকুমার বুঝি শেষবারের মতন ঝাঁপ দিল বিজুলিবালার শরীর তাগ করে।… বিজুলির মুখের উপর কয়েক ফোঁটা লালা নাকি ঝাঁজালো বিষ পড়ে। … ধ্রুবকুমার তার শরীর খামচাতে খামচাতে বলে, তর পেটে ভরত সর্দার আছ্যে, পান্ডবকুমার আছ্যে। ত ই ধ্রুবকুমার কি দষ কইরল শুন্যি। তিনজনার ত্যাজ মিল্যে তর অ্যাকটি কিষ্ট অবতার বিটা হবেক। কে অ ই কথা জাইনবেক নাই। (পৃ – ৬৩৬)
বিজুলিবালা একজন নাচনি, কুলের বউয়ের সাথে তার পার্থক্য বারে বারেই উঠে এসেছে উপন্যাসে নানা প্রসঙ্গে। কখনো ধ্রুবকুমার অক্লেশেই বলে দেয় কুসমিকে –
“…লাচনী কারঅ মা লয়, পরিবার লয়, বিটি লয়।…বিটি ছেল্যা, বিটি ছেল্যা। উটি বাদে লাচনীর আর কনহ হিসাব নাই।…লাচনীর লেগ্যে সমসারে অ্যাকটিই ধম্ম। উয়ার রসিকের মান রাখা।“ (পৃ – ৪০২)
কখনোবা পান্ডবকুমারের স্ত্রী লতা তার কথায় স্পষ্ট করে তোলে এই বিভেদের জায়গাটি –
…আমি আর উ এক লই। আমি তুমার বিটার বিহা করা কুলের বউ। আর উ বিটিছেল্যাট লুঠে আনা নাচনী। …লতা বলে যায়, আমার হাথের অন্নজলে ই সমসারের কনহ বারণ নাই। আর উ নাচনী বিটিছেল্যাটি হেঁশেলের হাঁড়ি ছুঁত্যে পাইবেক নাই। …তুমার বিটা আমার মরদ। আর উ বিটিছেল্যাটির রসিক। উয়ার সাথে আমার মরদের লাচা গানা রভিনয়ের সম্পক্ক। (পৃ – ৩৮৯)
নাচনি জীবনের এই ধ্রুব সত্য – কুলের বউ নয় সে, সমাজের চোখে পতিত, রসিকের সংসার সে আগলে রাখলেও রসিকের কাছেও তার মান নেই। তার হাতে বাড়া ভাত রসিকের মুখে তোলা মানা। ব্যতিক্রম ব্রজরামের মতো কিছু মানুষ, যারা নাচনিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করতে পারে সহজেই।
যে নাচের সুত্রে রসিকের সাথে তাদের যোগ, শিল্পিমহলে সেই নাচেরও কদর মেলেনা। ত্রিবিধ বন্দনা অর্থাৎ আসর বন্দনা, গুরু বন্দনা এবং দর্শক বন্দনা দিয়ে নৃত্য আরম্ভ হলেও তাদের শরীরের আবেদনই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। তাদের পোষাকের বর্ণচ্ছটাই দৃষ্ট আকর্ষণ করে, দর্শকের চোখ কোনো শিল্পীকে দেখেনা, দেখে শুধু একটি নারীর শরীর। আলোচ্য উপন্যাসেও তার প্রমাণ মেলে –
…আলোর সীমানার বাহিরে আবছা ঐ মুখগুলি শুধু গদগদ বিস্ময়ের নয়। ঐ মুখগুলি দারিদ্র্যের, অনটনের, লোভের, দুঃখ-সুখের, লালসা এবং অপমান মাখানো। বন্দনাগান গেয়ে চলা ঐ কিন্নরীর রঙিন মুখের চেয়ে তাদের সতর্ক সন্ধান তার চিকন ভেলভেটের আড়ালে টাইট বডিজ বাঁধা অনম্র বুকের দিকে। মানুষ অপেক্ষা করছে কখন এই চিরাচরিত বন্দনার ভ্যানতাড়া শেষ হয়ে ঝুমুর গানের নাচনী ঘুরে দাঁড়াবে। নৃত্যের কূটকচাল – অঙ্গহার, করণ, স্থান, চারী ইত্যাকার তত্ত্ব মানুষ জানেনা। তারা জানে সুরের গতিপ্রকৃতি আর তালের সমে ফাঁকে নাচনীর চরণ সংঘাত, নীতম্ব পীড়ন আর সমুদ্র উথাল বুকের লাস্যময় উত্থান পতন কেমনতর। (পৃ – ১৩২)
বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিতেও নটী নৃত্যের বর্ণনায় তাদের অঙ্গরাগ, বেশভূষার সাথে কামনা জর্জরিত দর্শকের প্রসঙ্গটিও বারে বারে উঠে আসে। ধর্মমঙ্গলকাব্যে নটী সুরিক্ষার অনুরাগীগণের অবস্থা বর্ণনা করে কবি বলেন –
‘পাগল হইয়া কেহ রয় কাছে কাছে।
তাল মান গানেতে নাচায় কেহ নাচে।।
তাম্বুল যোগায় কেহ কেহ চাপে পা।
কেহ কেহ চামরে করিছে মন্দ বা।।
নারীর দেহ সৌন্দর্য, তার লাস্যই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। স্বর্গের নটীর মতো মর্ত্যের নাচনীদের স্তাবকতা করেনা কেউ। বরং সমাজের চোখে তারা পতিত। ধনী গৃহস্থের বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে মেলাপ্রাঙ্গন – টাকার বিনিময়ে তারা নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। প্রাপ্ত অর্থ তুলে দেয় রসিকের হাতে। যে সামন্ত প্রভুরা নাচনীদের ভরণপোষণ করত, আজ তারা অতীত। তাদের সাথেই গত হয়েছে নাচনি নাচের সুদিন। আজ তারা সখে নয়, বলা যায় রসিকের সংসার প্রতিপালনের জন্য নাচে। সে ক্রীতদাসের মতো। নগদ অর্থমূল্যে তাকে রসিক কিনেছে বা অরক্ষণীয়াকে রক্ষা করে ঘরের কোণে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রয়োজন ফুরোলে কখনো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে কখনোবা জোড়া নাচনিও রেখেছে! স্ত্রীয়ের পাশাপাশি নাচনি প্রতিপালন একরকম ট্র্যাডিশনের মতো। প্রসঙ্গত কেট মিলেটের উক্তির মধ্য দিয়েই সমাজের এই দ্বিচারিতাকে আরো স্পষ্ট করে চিনে নেওয়া যায়। সেক্সুয়াল পলিটিক্স গ্রন্থে তিনি জানাচ্ছেন –
“Because of our social circumstances, male and female are really two cultures and their life experiences are utterly different.”
এই ভিন্নতার কারণেই প্রভঞ্জন, পান্ডবকুমার, ভীম মাহাতোর মতো শত শত রসিকের ঘরের বউ হাসি মুখে মেনে নিতে বাধ্য হয় অন্য নারীর উপস্থিতি। আর দুলালীর মতো মেয়েরা যারা স্বেচ্ছায় চলে যায় অন্ধকারের পথে! সুন্দর গৃহস্থ যাদের টানেনা, দেহব্যবসাকে বেছে নেয় সখে কখনোবা দায়ে পড়ে – সমাজে তারাও পতিত। আলোচ্য উপন্যাসে দুলালীর জটিল মনস্তত্ত্বের দিকেও লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন। দেহোপজীবিনী থেকে নাচনি হতে চেয়েছে সে। বহুগামিতার পথ ছেড়ে সে থিতু হতে চেয়েছে রসিকের সংসারে। তঞ্চকতা করেছে নিজের স্বামীর সাথে। অন্ধকার গলির পথে স্বেচ্ছায় পা বাড়ালেও কোন অভাববোধের তাড়নায় বার বার পথ বদলেছে। তার অশান্ত মন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে স্বামীর সংসার থেকে কখনো মায়ের কাছে, কখনো দেহ-ব্যবসার বাজারে কখনোবা প্রভঞ্জনের বাড়ির আঙিনায়। নাচনি হওয়ার জন্য সে তালিম নিতে চায়। সে ছাড়তে চায় পুরানো জীবন। কিন্তু কলঙ্কিত সেই জীবনের কালি লেগে থাকে তার আচরণে, স্বভাবে, ভাব-ভঙ্গিমায়! তাই প্রভঞ্জনের স্ত্রী দুর্গা আগলাতে চায় তার ছেলে বদনকে, যে দুলালীকে অহরহ কুপ্রস্তাব দিয়ে চলে। তবু দুলালীই দোষী। তার কারণ খুঁজতে গেলে সমাজে নারী-পুরুষের প্রতি আচরণের বৈষম্যকে দায়ী করা যেতে পারে। আরো স্পষ্ট করে কেট মিলেট জানান –
“Prostitution is really the only crime in the penal law where two people are doing a thing mutually agreed upon and yet only one, the female partner, is subject to arrest.”
এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়না! দুলালী বদনের মতো তরণীসেনের প্রতিও আকৃষ্ট। ভগ্নহৃদয় তরণীসেন মালতীর অভাব পূরণ করতে চেয়েছে দুলালীর মধ্য দিয়ে। বদন ও তরণীসেন – দুই পুরুষের মধ্যে থেকে দুলালী শেষ পর্যন্ত বেছে নিতে পারেনি – প্রভঞ্জনের সংসার থেকেও সে পালিয়েছে রাতের অন্ধকারে, ভীষণ দুর্যোগ মাথায় নিয়ে। গন্তব্য সে জানেনা, পাঠকও জানতে পারেনা তার শেষ ঠিকানা –
‘বাতাসের হু হু দুলালীর কানে কানে প্রশ্ন করে, কোথায় যাবি মেয়ে? কোথায়?
দুলালী দম নিতে নিতে জবাব দেয়, জানিনা তো।“ (পৃ – ৬৩৮)
ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব ভক্তিবাদী আন্দোলনের কালপর্বে ঝুমুর গানের যে নতুন রূপ বিকশিত হয় সেই ধারাকে সজীব রেখেছেন গ্রাম্য কবি, রসিক, নাচনি সম্প্রদায়। আলোচ্য উপন্যাসটিকে ঝুমুর গানের সংকলন বললেও অত্যুক্তি করা হয়না। প্রবাদপ্রতিম ভবপ্রীতানন্দ ওঝা থেকে শুরু করে জগৎ কবিরাজ সহ আরো অনেক খ্যাতনামা কবির পদ প্রসঙ্গত আলোচনা করেছেন লেখক। ভবপ্রীতানন্দ যখন বলেন –
যোগী রূপমে হে পরকাশ শ্যাম চলে রাধাকে পাস
ডিমি ডিমি ডিমি ডমরুকো তাল।
হে রাধাজী ছাড়ো মান এ হি শিঙ্গামে দেতা তান
মাফ করো মেরা দোষ।
দাস সমুঝকে ছাড়ো রোষ।।
ইসি তরফ চলতে ঘনশ্যাম যা পঁহুছে রাধাকে ধাম
যাঁহা প্যারী সখীয়নকে সাথ।
কহতথি মাধবকা বাত।।
দূরসে আতে যোগীরাজ দেখো সখীন সমাজ
উসি তরফ সব দেতা ধ্যান
ভবপ্রীতাকে শ্যামগুণগান। (পৃ – ৪৭৩)
তখন তার পদের দার্শনিকতা পাঠককে মুগ্ধ করে, বিদ্যাপতির সাথে তার সাদৃশ্য বোধ হয়। এর পাশাপাশি ঝুমুরের অন্যান্য পদের উল্লেখও উপন্যাসে পাওয়া যায় –
ঝিঙাফুল লিলেক জাতি কুল গো
পিরিতি হল শূল
এমন জানলে কালার সাথে
কে পাতাথ ফুল গো … (পৃ – ৩৮৪)
এমনকি ভিখাম্বর গ্রহাচার্যের কন্ঠে ঔপন্যাসিক শুনিয়ে দেন বিখ্যাত কবি দুর্যোধন দাস রচিত ‘সাঙ্কেতিক ঝুমুর’ এর কলি –
পাঁচে পঞ্চগুণ সিন্ধু বিন্দু দেল
তিথি তিথি তায় হরণ গেল
এই বলি গিরিধারী চলি গেলা মধুপুরে
আর না আওল ফিরি – (পৃ – ৫১১)
‘কবির সেরা পাতকুম’ এর পঞ্চরত্ন অর্থাৎ রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, দুর্যোধন দাস, দীনা তাঁতি, উদয় কবি এবং গঙ্গাধর ঘোষের সাথেও পাঠকের পরিচয় ঘটে। সর্বোপরি উপন্যাসটিতে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ প্রয়োগে পাত্র-পাত্রী, যাবতীয় ঘটনা নির্দিষ্ট অঞ্চলকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সাথে এক হয়ে গেছে।
গৌড়বঙ্গের দেবদাসী গ্রন্থে স্বনামধন্যা লেখক মহুয়া মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন বহু নাচনির কথা। সুখদা বালা দেবী, সোমবারি সহিস, বিমলা দেবীর মতো আরো অনেকের পাশাপাশি বিশেষ ভাবে জানিয়েছেন সিন্ধুবালা দেবীর কথা। নাচের দক্ষতার জন্য তাকে বলা হত ‘ছোটনাগপুরের বুলবুল’। ছেলেবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে মামারবাড়িতে তার বেড়ে ওঠা। জমিদারের দ্বারা অপহৃতা হয়েও ভাগ্যের জোরে মহেশ্বর মাহাতো ওরফে চেপু মাহাতোর ছত্রছায়ায় নাচনী হয়ে ওঠা এবং স্ত্রীয়ের মর্যাদা লাভ। যদিও নিজের নাচনি পরিচয়ের থেকেও ঝুমুর গানের শিল্পী হিসাবেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মানে। আলোচ্য উপন্যাসেও দেখা যায় বর্ষীয়ান নাচনি নিশারানীকে। বিজুলিকে এসেছে তার আশীর্বাদ নিতে। নাচনি হিসাবে প্রথমবার মঞ্চে ওঠার আগে ভীম মাহাতোর নির্দেশে পান্ডবকুমারের সাথে সে বাঘমুন্ডিতে এসেছে নিশারানীর আসর দেখতে। শিক্ষা নিতে। সুমিষ্ট কন্ঠ ও নৃত্যের জন্য নিশারানী ‘মানভূমের বুলবুল’ নামে আখ্যাত। বিগত দিনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল তাঁর চেতনা –
“…পঞ্চকোট কাশীপুরের রাজা আমায় ভাদুমণি বইলতেন। আমি না গেল্যে দুর্গাপূজার বোধন হবেক নাই। কনহ আচার অনুষ্ঠান রাজা আমাকে বাদ দিয়ে ভাইবতে পারথেন নাই।“ (পৃ – ৫৪৪)
শোনাতে ভোলেনা কলকাতার রবীন্দ্রসদন মঞ্চে রাজ্যপালের পরিয়ে দেওয়া উত্তরীয়র কথা। নিশারানীর পরিস্থিতি খুব মিলে যায় সিন্ধুবালা দেবীর সাথে। পুরুলিয়ায় তিনি রাজ্যপালের দ্বারা পুরষ্কৃত হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষে পেয়েছিলেন ‘রায়মঙ্গল শ্রদ্ধাঞ্জলি’। নিশারানী জীবন রসের রসিক। বয়সে অনেক ছোট বোকা কুমারকে সে বেছে নিয়েছে সাথি হিসাবে। রসিকের মৃত্যুজাত বিরহবোধকে পাথেয় করেই সে জীবন কাটাতে চায়না। অন্তর্গত বিরহকে অন্তরে রেখে যৌবন উত্তীর্ণ এই ‘বুঢ়ি’ নাচনি তখনো মঞ্চে ঝুমুরের সুর তোলে। বিজুলিবালা ভাবে –
…সত্যই কি ঐ শীর্ণ আড়ার ভিতরে একটি পাথর পাথর বুক রয়েছে। সত্যই কি ঐ কোটরবন্দী অথচ টানা টানা চোখ দুখানি সর্বদাই বিরহ নামে সেই রহস্যজনক ভাবে মশগুল। ঐ বৃদ্ধা যখন আসরে নামবে তখন কি তার হতশ্রী আকার ভেদ করে কোনও নবীনা উঠে আসবে? বিরহ কি মানুষের বয়স ভুলিয়ে দেয়? (পৃ – ৫৪৭)
তাই হয়তো বোকা কুমারের হাত ধরে আরো একবার বাঁচার চেষ্টায় নিশারানী মরীয়া! বিজুলিবালার মনেও পান্ডবকুমারের জন্য বিরহবোধ জাগে। প্রোষিতভর্তৃকার মত সেও চেয়ে থাকে পথের দিকে। অপেক্ষা প্রিয় মিলনের। স্বপ্নের ঘোর কেটে যায় ধ্রুবকুমারের কলুষ স্পর্শে। ‘লাচনী কার মা লয়, পরিবার লয়, বিটি লয়’ – এই যাদুমন্ত্রেই নাচনিকে ভোগ করার পথ যেন সহজ হয়ে যায়। সমাজের বিধানকে হাতিয়ার করে এখানেও Body Politics এর খেলাই চলতে থাকে রসিক-নাচনি নামের আড়ালেও। মানভূমের সংস্কৃতিতে নাচ, নাচনী ও নাগর – এর নাম একসাথেই উচ্চারিত। মঞ্চে একসাথে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে থাকে দুস্তর ব্যবধান। রসিকের কল্যাণে সিঁথিতে সিঁদুর দিলেও তার জোর নেই, গর্ভের সন্তান শুধুই ‘নাচনীর বেটা’ বা ‘নাচনীর মেয়্যা’। ব্যাভিচার, অপমান সহ্য করে পড়ে থাকতে হয় ঘরের কোণায়!
আলোচ্য উপন্যাসে এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় ধ্রুবকুমারের নাচনি কুসমিকে। বিজুলিবালাকে বাঁচাতে যে অন্তত একবার ধ্রুবকুমারের মুখোমুখি হয়েছে। নাচনিজীবনের সারকথা উপন্যাসের শেষে তার মুখেই লেখক শুনিয়েছেন –
“…ন বিটি ন! লাচনী কার মা লয়! ই সমসারে লাচনী কনহ মানুষ লয়! উ অ্যাকটি মানুষের পারা পাথরের ঢেলা। পাথর, পাথর…। মানুষ লয়, পাথর…” (পৃ – ৬৩৬)
কুসমির লাশ ভেসে উঠেছিল নদীতে। হত্যা নয়, আত্মহত্যা। রসিকের পরিবারের নিয়ম নেই মৃতদেহ ছোঁয়ার, এমনকি নাচনি মারা গেলে দুফোঁটা চোখের জলও গড়ায়না যেন – সমাজের এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যম্ভাবী! প্রহ্লাদ ডোম এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। তার একার হরিধ্বনিই যথেষ্ঠ। রসিক পরিবারের অশৌচ নেই, কোনো নিয়মও নেই। বিজুলিবালা একমাত্র সঙ্গী প্রহ্লাদের। পায়ে দড়ি বেঁধে নদীর কাছে ফেলে আসা –
…কুসমি চলে যাচ্ছে নদীর টানে টানে। প্রহ্লাদের হাতের দড়ির অন্য প্রান্ত তার একখানি পায়ে বাঁধা। সেই আলতা পরা পা উঁচু হয়ে আছে। আর একটি পা মাটিতে। কুসমি এগিয়ে চলেছে মাটি কামড়ে, মাটির দোলায় চড়ে। …সেই মাটি কামড়ে চলে যাওয়ার অন্তরালে এখন এক নূতন সুরের সূত্রপাত হয়েছে। …কুসমি নব-নূতন আনন্দের গানের ভিতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নদীর দিকে।
বিজুলি দূরে দাঁড়িয়ে এই অনির্বচনীয় চলে যাওয়া দেখে। দেখতে দেখতে সে টের পায় কমে আসা আলোয় ঐ আকাশমুখী মুখ একবার বিজুলিবালা আর একবার কুসমি হচ্ছে। একবার কুসমি আর একবার বিজুলিবালা…।
(পৃ – ৬৪৯)
খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই মনে পড়ে যায় দেবদাসীদের বিষময় পরিণতির কথা। শ্রীপান্থ ‘দেবদাসী’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন –
…দেবতা যখন মনে করেন তার বিশেষ দুবোয়া পত্নীটির রূপ-গুণ আর আগেকার মত নেই, তখন তিনি তাদের বিদায় করে নতুন দাসীর সন্ধান করেন। পুরোহিতেরা লোহা পুড়িয়ে মেয়াটির উরু ও বুকে দুটি চিহ্ন এঁকে দেয়। সেগুলো প্রভু বেঙ্কটেশ্বরের শীলমোহর।… ভিখারীর বেশে পথে পথে ভ্রাম্যমাণ সে দাসীর নাম তখন – কলিযুগলক্ষ্মী। …এই দরিদ্র মেয়েটির যেদিন শেষ নিঃশ্বাস পড়ে সেদিন তার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলবার কেউ নেই। কেননা, যে মরেছে সে দেবদাসী নয়, তার বুড়ো মা। কথায়ই বলে- দেবদাসীর মা যেদিন মরে মন্দিরে সেদিন ঢাক বাজে, আর দেবদাসী যেদিন মরে মন্দির সেদিন কাঁদে।
দেবদাসী এবং নাচনি – জীবনধর্মের সাযুজ্যে তারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হলেও দেবদাসীদের নৃত্যশৈলীর যে কদর, নাচনি নাচের সেই কৌলিন্য নেই। নাচনি সম্প্রদায় যেমন সমাজে অন্ত্যেবাসী, তেমনি তাদের নৃত্যকেও অপাঙক্তেও করে রাখা হয়েছে। অন্যান্য লোকনৃত্যের পাশাপাশি নাচনি নৃত্যের কথা বিশেষ উচ্চারিত হয়না। কাহিনী প্রধান ছৌ নৃত্যের যে কদর, সঙ্গীত প্রধান নাচনি নৃত্যের সেই জায়গা কোনো কালেই গড়ে ওঠেনি। গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতাকেই নাচনি নাচের উপজীব্য মনে করা হয়ে থাকে। তাই একটা নির্দিষ্ট স্তরেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে নাচনি নৃত্য। সামাজিকভাবেও তাদের উত্তরণের পথ নেই। ঝুমুর গান বা রসিকের সূত্র ধরে কৃষ্ণনাম এই আবহে উচ্চারিত হলেও নাচনি পতিত! তারা অন্ধকারের যাত্রী। রসিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে নাচনি জীবনের স্বরূপই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গ্রন্থঋণ
বাংলা-
মুখোপাধ্যায়,সুব্রতঃরসিক,আনন্দ পাবলিশার্স,১৯৯১,কলকাতা
মুখোপাধ্যায়,মহুয়াঃগৌড়বঙ্গের দেবদাসী,এন।ই।পাবলিশার্স,২০০৪,কলকাতা
সেনগুপ্ত,শক্তিঃলোকায়ত মানভূম, অন্তরাল,১৪০৭,কলকাতা
ঘোষ,চৈতালীঃভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য এবং ছৌ ও বাংলার লোকনৃত্য,২০১১,কলকাতা
ইংরাজি-
Millett,Kate,Sexual Politics,1st Bllantine Books de.Ballantine,1974
Mobile no – 9051655145Email ID- Sinha.dhriti@gmail.com