July 1, 2022

ধর্মের নামে হত্যার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নাটক ও নাটকের গান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

দেবাশিস মণ্ডল

রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকিপ্রতিভা, বিসর্জন নাটকে ধর্মীয় ভাবাবেগের দৈন্যতা ও সংকীর্ণতা থেকে সত্য ও মানবতার উত্তোরণ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি এই দুটি নাটকের কাহিনীর মধ্যেই চিরাচরিত শিক্ষা ভাবনা ও মিথ্যাচারের রূপকে তুলে ধরেছেন। আর শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে প্রগতির।  একবিংশ শতকেও এই নাটকগুলি খুবই প্রাসঙ্গীক বা সমকালীন। এখনো ধর্মের নামে সারা দেশ জুড়ে এমনকী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে মিথ্যাচার, রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। সেখানে মানবিকতা সম্পূর্ণ বিপন্ন। বাংলাদেশের ছায়ানটের সভাপতি ও রবীন্দ্র গবেষক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘’ধর্মতন্ত্রীরা প্রবল হয়ে উঠে ধর্মকে দলিত করছে আজ। হিংসার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিশ্বের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তারা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। সমগ্র বিশ্ব আজ মূলুবোধের সংকটে-জর্জরিত। মানুষকে আজ মানসসম্পদে ঋদ্ধ হতে হবে। বাংলার কি-নাগরিক কি-লোকসাহিত্যে মহৎপ্রাণ কবিরা যে সব কথা বলে গেছেন, আজ তা স্মরণ করতে হবে। আস্থা রাখতে হবে তার ওপর। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। তাহার উপরে নাই’—চণ্ডীদাসের এই বাণী থেকে শক্তি সঞ্চয় করা জরুরি। লালন-ও গেয়েছেন—‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার, মানুষগুরু নিষ্ঠা যার’। নজরুল আবার ধর্মের চেয়েও বড়ো করে দেখেছেন মানুষকে, বলেছেন—‘মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো’। অধর্মাচারী হিংসার কবল থেকে মুক্ত হবার জন্য মানুষকে আজ সত্যধর্ম আর যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে। এই হচ্ছে আমাদের অস্ত্র’’।[i]

রবীন্দ্রনাথ নাটকগুলিতে সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন মানুষকে এবং মানবিকতাকে। সমাজের মধ্যে যা কিছু অন্ধ, ঘুণ ধরা,  আবর্জনাময়, কর্দমাক্ত, পচে যাওয়া বা গভীর পাঁকে নিমজ্জিত, যাকিছু মানবিকতার বিরুদ্ধে সেই সব কিছুকেই তিনি তাঁর লেখার মধ্যে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। নাটকের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে ঘাত প্রতিঘাতে, সংলাপের বহুমুখীতায় আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজেছেন। বিসর্জন, রক্তকরবী, অচলায়তন’ তাসের দেশ, পরিত্রাণ, মুক্তধারা ইত্যাদি নাটকগুলি রবীন্দ্রনাথের এক একটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। নাটকগুলিতে সমাজের একেকটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিককে বর্ণনা করেছেন। শোষণ, বঞ্চনা, হিংস্র ও অমানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য তিনি যারপরনাই সচেষ্ট হয়েছেন। নাটকগুলির চরিত্র চিত্রায়ন, সংলাপ, ঘটনা পরম্পরার মধ্যেদিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও মানবিক রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি করে চেনা যায়। অন্য কোন শিল্প বা সাহিত্য মাধ্যমে তিনি হয়তো এত বেশি করে ধরা দেননি। ধর্মের দোহায় দিয়ে হত্যার নাটক বাল্মিকী প্রতিভা ও বিসর্জন। এই দুটিতেই গান বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় হত্যার বিরুদ্ধে গান লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন। এই আধুনিক যুগেও এই হত্যাকারীরা রয়েছে বলে তিনি এই সব লেখায় বারে বারে উল্লেখ করেছেন।

         একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে

                       রাজার দোহাই দিয়ে 

                 এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,

                 মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি–

                       ঘাতক সৈন্যে ডাকি 

                       ‘মারো মারো’ ওঠে হাঁকি ।[ii]

পুণশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘মানবপুত্র’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,

 …… সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা

           ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে,

    তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে,

        তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে

           পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন্যকে–

               বলছে “মারো মারো’।[iii]

নাটকে সংলাপের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে গানগুলিকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। কোথাও অনর্থকভাবে বা অপ্রয়োজনে গান ব্যবহার করা হয়নি। সব জায়গাতেই গানগুলি অনেক বেশি অর্থ ও বার্তা বহন করেছে। বিশেষ করে নাট্য চরিত্রের অন্তর্ভাবটিকে প্রকাশ করার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বা মাধ্যম গান। যেকোন চরিত্র গানে গানেই নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে। তার আবেগ, মনের অনুভুতি, দার্শনিক সত্বা গানের মতো আর কিছুতেই অত ব্যাপক সাড়া পায় না। আর তাই হয়েছে নাটকের অনেক গানে। যার ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি নাটকই হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অত্যন্ত উন্নত, মানবিক, কালোত্তীর্ণ ও ধ্রুপদী।

ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সমাজের মধ্যে আঁকড়ে রাখা ধর্মের নামে পৈশাচিক নৃসংসতা এবং নিরর্থক অমানবিক দৃষ্টিকোণগুলিকে তিনি বেশকিছু নাটকের মধ্যে হাজির করেছেন। আর এই পৈশাচিক নৃশংস ও মিথ্যাচারকে দূর করার জন্য নাটকীয় সংলাপ এবং গানের মধ্য দিয়ে এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ বিকশিত রূপকে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। বাল্মিকীপ্রতিভা ও বিসর্জন নাটক দুটিতে ধর্মের নামে পৈশাচিক উন্মত্ততা ও অমানবিকতার আচরণকে ধিক্কার জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরিত্রগুলির উত্তোরন ঘটিয়েছেন নাটক গুলিতে। বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ধর্মীয় আড়ম্বর যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে সত্যের আর কোন অবশেষ পড়ে থাকে না। শুধু থাকে আড়ম্বর, হিংসা, উন্মত্ততা।

ধর্মপ্রচার নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অনেক সময়ে মানুষ যাহাকে উপায়রূপে আশ্রয় করে, তাহাকেই উদ্দেশ্যরূপে বরণ করিয়া লয়, যাহাকে রাজ্যলাভের সহায়মাত্র বলিয়া ডাকিয়া লয়, সেই রাজসিংহাসন অধিকার করিয়া বসে। আমাদের ধর্মসমাজ রচনাতেও সে বিপদ আছে। আমরা ধর্মলাভের জন্য ধর্মসমাজ স্থাপন করি, শেষকালে ধর্মসমাজই ধর্মের স্থান অধিকার করে। আমাদের নিজের চেষ্টারচিত সামগ্রী আমাদের সমস্ত মমতা ক্রমে এমন করিয়া নিঃশেষে আকর্ষণ করিয়া লয় যে, ধর্ম, যাহা আমাদের স্বরচিত নহে, তাহা ইহার পশ্চাতে পড়িয়া যায়। তখন, আমাদের সমাজের বাহিরে যে আর-কোথাও ধর্মের স্থান থাকিতে পারে, সে-কথা স্বীকার করিতে কষ্টবোধ হয়। ইহা হইতে ধর্মের বৈষয়িকতা আসিয়া পড়ে। দেশলুব্ধগণ যে-ভাবে দেশ জয় করিতে বাহির হয়, আমরা সেই ভাবেই ধর্মসমাজের ধ্বজা লইয়া বাহির হই। অন্যান্য দলের সহিত তুলনা করিয়া আমাদের দলের লোকবল, অর্থবল, আমাদের দলের মন্দিরসংখ্যা গণনা করিতে থাকি। মঙ্গলকর্মে মঙ্গলসাধনের আনন্দ অপেক্ষা মঙ্গলসাধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড়ো হইয়া উঠে। দলাদলির আগুন কিছুতেই নেবে না, কেবলই বাড়িয়া চলিতে থাকে। আমাদের এখনকার প্রধান কর্তব্য এই যে, ধর্মকে যেন আমরা ধর্মসমাজের হস্তে পীড়িত হইতে না দিই’।[iv]  

রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক বাল্মিকীপ্রতিভাতে উত্তোরন হয়েছে দস্যু বাল্মীকির। সে প্রাজ্ঞ বাল্মীকী হয়ে উঠেছে। নব চেতনায় সে এক পূর্ণাঙ্গ উন্নত মানুষ। বিসর্জন নাটকে জয়সিংহের  আত্মত্যগ রঘুপতির ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রঘুপতির বোধদয় হয়েছে। সে সকল অহমিকা আর মিথ্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বলেছে,   

পাষাণ ভাঙিয়া গেল–জননী আমার

এবারে দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!

জননী অমৃতময়ী![v]

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির মধ্যে বাল্মিকী প্রতিভা তার প্রথম নাটক। এখানে নাট্য কথাকে গানের সূত্রে মালা গাঁথা হয়েছে। বাল্মিকীপ্রতিভা নাটকের সূচনায় লেখা হয়েছে, বাল্মিকীপ্রতিভাতে দস্যুর নির্মমতাকে ভেদ করে উচ্ছ্বলিত হলো তার অন্তর্গুঢ করুণা। এইটাই ছিল তার স্বাভাবিক মানবতা, যেটা ঢাকা পড়েছিল তার অভ্যাসের কঠোরতায়। একদিন দ্বন্দ্ব ঘটলো, ভিতরকার মানুষ হঠাৎ এল বাইরে। রামায়ণের বাল্মিকী একদিন ছিল ভয়ানক বড় দস্যু। রবীন্দ্র রচনায় এই বাল্মীকির কাজকর্মে অভিজ্ঞতায় নানা সংঘাত দেখা দিয়েছে। নানা বাদ-প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে ভিতরে বাইরে। হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ার বিরুদ্ধে বাল্মীকির কন্ঠ থেকে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। প্রতিবাদ তার অন্তরে বাহিরে। শেষ পর্যন্ত অহিংসা ও সত্যের জয় হয়েছে। নাটকটিতে যদিও ধর্মীয় অনাচার অপেক্ষা বাল্মীকির মানবিক উত্তোরন কে অনেক বেশি করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই নাটকটিতে রয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং অমানবিক নির্মম আচরণ। যা সমাজের মধ্যে নানাভাবে প্রকটিত হয়ে থাকে। বাল্মীকির উত্তরণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ এই চিরাচরিত অন্যায়কে পরাস্ত করেছেন মানবিকতার জয় গান দিয়ে। ধর্মের নামে হত্যালীলা লুট সর্বস্বতা কখনোই বড় ও চিরস্থায়ী হতে পারে না। মিথ্যাচারে ভরা ধর্মীয় উন্মাদনা অপেক্ষা জীবন ও মানুষ শ্রেষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

পুজোর বলি হিসাবে নর হত্যা, প্রানী হত্যা, লুটপাট এসব ধর্মের ভন্ডামীর মধ্যে অনেকরকম ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বাল্মীকির মত অনেক মানুষের ভিতরের মানুষ অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারনে। যাদের উত্তরণ ঘটেনি বা ঘটার অবকাশ হয়নি তারা এইসব হত্যায় মেতে থাকে এবং দেবীকে খুশি করার নামে নিজেদের পৈশাচিকতাকে স্বীকৃতি দেয়। এ এক নির্মম ঐতিহ্য। সমাজে এই হত্যালীলা আজো ঘটে। কোথাও ডাইন প্রথায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মানুষ হত্যা, কোথাও প্রতিমাকে খুশী করার নামে পশু বলি। নরবলীও হয় কোথাও এখনো। এখনো এই কুপ্রথা ও সমাজের বীভৎসতা রবীন্দ্রনাথের মত এমন করে এর আগে কেউ এই সত্যগুলিকে এত সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারেননি বা ধরেননি। যদিও বাল্মিকী রামায়ণের মূল রচনায় দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হয়ে ওঠার বর্ণনায় এই আখ্যানটি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেই বাল্মিকীকে নৃত্যনাট্যের একটি চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করেছেন এবং বনদেবীর বিলাপ সংলাপ ও মানবিকতাবোধকে পাশাপাশি উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে এক অপূর্ব নৃত্যনাট্য রচিত হয়েছে।

ডাকাতদলের রয়েছে ক্ষমতা বজায় রাখা, আধিপত্য বিস্তার এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য দৃঢ় প্রচেষ্টা। তাদের কাছে জীবনের বা প্রাণের অস্তিত্বের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। চিরাচরিত প্রথা মেনে এক ধর্মের ধ্বজা কে সামনে রেখে নিজেদের উদ্দামতার উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করা, আর রাশি রাশি সম্পদ সংগ্রহ করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এখানে রবীন্দ্রনাথ ডাকাতদলের উদ্দামতা কে গানের মধ্যদিয়ে উপস্থাপন করেছেন।

কালী কালী বলো রে আজ–

বল হো, হো হো, বল হো, হো হো, বল হো–

নামের জোরে সাধিব কাজ–

হাহাহা হাহা হাহাহা হাহাহা!

ঐ ঘোর মত্ত করে নৃত্য রঙ্গমাঝারে,

ঐ লক্ষ লক্ষ যক্ষ রক্ষ ঘেরি শ্যামারে,

ঐ লট্ট পট্ট কেশ, অট্ট অট্ট হাসে রে–

হাহা হাহাহা হাহাহা!

আরে বল্‌ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়–

জয়, জয়, জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়–

আরে বল্‌ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!

আরে বল্‌ রে শ্যামা মায়ের জয়!

বিশ্বের সর্বত্র এই রকম নানা শক্তিধরেরা আছে। তারা আধুনিকতা ও মানবিকতাকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে ধর্মের ধ্বজা ধরে আপন শক্তি প্রয়োগ করে তাকে ব্যবহার চলেছে।  আর তা’শুধু মাত্র নিজেদের ক্ষমতা এবং দাম্ভিকতা কে জাহির করার জন্যই। তার সঙ্গে এই লুটেরাদের জীবনবোধের কোন পার্থক্যই চোখে পড়ে না। বিভিন্ন নাটকে রবীন্দ্রনাথ এই সংকীর্ণতা লোভ ও বীভৎসতা প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়েছেন। বাল্মিকী প্রতিভা নাটকের কয়েকটি গানে ক্ষমতালোভী ডাকাত দলের বেশ কয়েকটি গান রয়েছে যেখানে তাদের দাম্ভিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

‘এনেছি মোরা এনেছি মোরা, 

রাশি রাশি লুটের ভার 

করেছি ছারখার।

কত গ্রাম পল্লী লুটেপুটে করেছি একাকার’।

রবীন্দ্রনাথ শুধু লুঠ ও হত্যাকেই শেষ কথা বলে মেনে নেননি। হিংস্রতার অবসান ঘটিয়েছেন। জয় করেছেন যা কিছু পরমার্থ, সত্য ও সুন্দরকে। তিনি লক্ষ্মী অপেক্ষা জ্ঞান ও বিদ্যাকেই জয়ী করেছেন। উত্তোরন ঘটিয়েছেন সত্য ও মঙ্গলকে। এটা প্রতিষ্ঠা করতেই নৃত্যনাট্যে সরস্বতীর আগমন ঘটেছে। লক্ষ্মী বাল্মিকীকে ধনসম্পদের প্রলোভন দেখিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। বাল্মীকি ও বনদেবীদের করুণ প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে পুণরায় আবির্ভূত হয়েছে সরস্বতী। বাল্মীকি সঙ্গীতের মাধ্যমে তার বন্দনা করেছে। সরস্বতী গানে গানে তার উত্তর দিয়েছে।

‘দীনহীন বালিকার সাজে,

এসেছিনু এ ঘোর বনমাঝে,

গলাতে পাষাণ তোর মন –

কেন বৎস, শোন্, তাহা শোন্।

আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান,

তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।

যে রাগিনী শুনে তোর গলেছে কঠোর মন,

সে রাগিনী তোর কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।

……………………………………………

বসি তোর পদতলে কবি-বালকেরা যত

শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত।

এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার

যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার’।[vi]

তখনো বাল্মীকীর উত্তোরন পর্বের প্রকাশিত রূপ ফুটে ওঠেনি। ঘটনা পরম্পরায় তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুনভাবে। ব্যাধ, ক্রৌঞ্চ যুগলকে বধ করার জন্য উদ্যত হলে বাল্মীকি গেয়েছে-

থাম্‌ থাম্‌! কি করিবি বধি পাখীটির প্রাণ!

দুটিতে রয়েছে সুখে, মনের উলাসে গাহিতেছে গান!

প্রথম ব্যাধ গেয়েছে-

রাখ’ মিছে ওসব কথা, কাছে মোদের এস নাক হেথা,

চাই নে ওসব শাস্তর-কথা, সময় ব’হে যায় যে ।

বাল্মীকি পুণরায় গেয়েছে-

শোন শোন মিছে রোষ কোরো না![vii]

ব্যাধ তার কথায় কর্ণপাত না করেই বান নিক্ষেপ করেছে। একটি ক্রৌঞ্চকে বধ করেছে। আর সেই মুহূর্তেই বাল্মীকির কন্ঠে নিসৃত হয়েছে সেই অমোঘ বানী –

‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্‌’।[viii]

এভাবেই বাল্মীকি পরিণতি পেয়েছে। মানবিক উত্তোরনের ঘটেছে তার।

বিসর্জন নাটকে গানের সংখ্যা কম। কিন্তু প্রতিটি গানেই নাটকের ভিতরকার মূল সত্যটি উদ্ভাসিত হয়েছে। নাট্যগুনে সমৃদ্ধ করে পূর্ণতা দিয়েছে এই গানগুলি।

রবীন্দ্রনাথ অনেক পূর্বরচিত গান নাটকে ব্যবহার করেছেন, আবার নাটকের প্রয়োজনেও অনেক গান রচনা করেছেন। বিসর্জন নাটকের গানগুলি তিনি নাটিকের প্রয়োজনেই রচনা করেন। রবীন্দ্র নাটকের ধারা বর্ণনায় আল্পনা রায় চৌধুরী লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের নাটকের ধারাটি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে নাটকে গানের ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর সচেতন পরিকল্পনা ছিল এবং সে পরিকল্পনা নাট্যগঠনের সঙ্গেই যুক্ত। কথায় যে ভাব প্রকাশ করা যায় না, যে পরিবেশ নিছক সংলাপে গড়ে ওঠে না, তারই জন্য নাটকে এসেছে গান।”[ix]

রবীন্দ্রনাথের ২৯ বছর বয়সে বিসর্জন নাটকটি রচনা করেন। বাংলা সাল ১২৯৭, ইংরাজী সাল ১৮৯০। এটি ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৭/ইংরাজী ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

নাটকের যে গানগুলি হল –

১। ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ডু বেয়ে’।

এই গানটি ‘১ম সংস্করণের পর বর্জিত, যদিও ১৩৩০ সালে কলকাতায় অভিনয়ের সময় গীত হয়। আদৌ রবীন্দ্রনাথের রচনা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে’।[x] 

২। আমি একলা চলেছি এ ভবে, আমায় পথের সন্ধান কে কবে। ভয় নেই, ভয় নেই–

    যাও আপন মনেই। অপর্ণার গান।

৩। উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে’ – পঞ্চম দৃশ্যে হারুর গান।

৪। ওগো পুরবাসী – অপর্ণার গান।।

৫। “আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে’’ – দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে জয়সিংহের গান।

৬। থাকতে আরতো পারলি নে মা (সমবেত)– ভৈরবী, একতাল।

 নাটকে রানী গুণবতীর আবির্ভাব হয়েছে দ্বিতীয় দৃশ্যে। সন্তান লাভের জন্য মানত করতে দেবীর মন্দিরে এসেছেন। সে সন্তানহীনা। তাই সন্তানের আকাঙ্ক্ষা তার ভেতর প্রবল রূপ পেয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতের সামনে তিনি মানত করেন, ‘করিনু মানত, মা যদি সন্তান দেন/বর্ষে বর্ষে দিব তাঁরে একশো মহিষ, তিনশত ছাগ।’[xi]

সহায় সম্বলহীন অপর্ণা। তার একমাত্র সন্তান স্নেহে বেড়ে ওঠা ছাগ শিশুকে মন্দিরে দেবীর সামনে হত্যা করা হয়েছে। রাজার কাছে সুবিচারের জন্য হাজির হয়েছে সে। দেবীকে সম্বোধন করে অপর্ণা বলেছে,

‘মা, তুমি নিয়েছ/কেড়ে দরিদ্রের ধন। রাজা যদি চুরি

করে, শুনিয়াছি নাকি আছে জগতের/রাজা- তুমি যদি চুরি করো, কে তোমারে/করিবে বিচার।’[xii]

এই নাটকে গানের সংখ্যা কম। অপর্ণার কণ্ঠে প্রথম গান ‘আমি একলা চলেছি এ ভবে, আমায় পথের সন্ধান কে কবে। ভয় নেই, ভয় নেই–/যাও আপন মনেই’। এই গানে নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক দর্শন সামনে এসেছে। অপর্ণা ভিখারিনী। তার কণ্ঠে দুটি গান রয়েছে। প্রথম গানে অপর্ণা তার জীবনের একাকীত্ব কিন্তু নির্ভিক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তার পথের দিশা দেখানোর কেউ নেই। নির্ভিক চিত্তে তার মধুকরের মতোই ছুটে চলা। নাটকটিতে অপর্ণা দেবীর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। রঘুপতি দেবীর মুখ পিছন ফিরিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে অগোচরে থেকে দেবীকে সামনের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে অপর্ণা। অপর্ণা মানবিক। নির্মম হত্যা লীলা বন্ধের জন্য গোবিন্দ মানিক্যর ঘোষনার পাশে থেকেছে সে। বলিষ্ঠ ও নির্ভিক ভূমিকা রয়েছে তার। সে গেয়েছে ‘ভয় নেই ভয় নেই/ যাও আপন মনে ফুলের সৌরভে’। অপর্ণার কণ্ঠে দ্বিতীয় গানে অভিজাতদের বিশাল বৈভবের মধ্যে ভিখারিনী অপর্ণার চরম হতাশাপূর্ণ জীবনের নির্মম বৈষম্য উন্মুক্ত হয়েছে। জীব হত্যার মধ্যেকার পৈশাচিকতার সঙ্গে দরিদ্রের প্রতি বঞ্চনা উপেক্ষা আর অভিজাত হত্যা লীলার তাণ্ডব ও উল্লাসের মধ্যে তুলনায় এক পরিণত নাট্যবোধের ছবি ফুটে উঠেছে।

‘রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিসত্তাকে অহং আর ব্যক্তির ভিতরের অর্থাৎ অন্তর্গত সত্তাকে বলেছেন আত্মা। তুলনা দিয়েছেন, ব্যক্তিসত্তাকে যদি বলি প্রদীপ, তো আত্মা হচ্ছে তার শিখা। অন্তর্গত সত্তার কথা রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-গানে ফিরে ফিরে এসেছে। গানের দৃষ্টান্ত দিই, যেখানে অন্তর্বাসী সত্তাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি—

মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে

একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে—

প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।।

অন্তর-সম্পদই মানুষকে মহৎ করে। আর অন্ধ ধর্মাচরণে ব্যক্তি হয়ে পড়ে অহংপ্রবণ, যেমন আমরা দেখেছি কাব্যনাট্য ‘বিসর্জনে’ রঘুপতির আচরণে। অপরপক্ষে জয়সিংহ মানবিক বিশ্বাসে স্থির থেকে প্রাণ দিয়ে প্রেমের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করে। তখন রক্তপায়ী দেবী মূর্তিকে পরিহার করে মহৎ মানব-আত্মাকেই পুষ্পার্ঘ্য দেন কবি। ঘোষণা করেন, প্রেমধর্ম দীক্ষিত মানুষই আকাঙ্ক্ষিত মনুষ্যত্বের ধারক’।[xiii] ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথের। সেই পরম ঈশ্বর কোণ পুতুল বা পাথরের মূর্তি নয়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, প্রকৃতি ও মানবাত্মার মধ্যেই সেই পরম ঈশ্বরের অস্তিত্বকে খঁজে পেয়েছেন তিনি। নিষ্কলুষ শুভ্র মনের ভিখারিনী অপর্ণাকেই দেবীর মানবী রূপে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছে রঘুপতি। তার শেষ সংলাপে নাটকের মূল সত্যটি উঠে এসেছে। সে স্বীকার করে নিয়েছে পাথরের মূর্তির জন্য রক্তক্ষয় নয়। মানবী রূপের মধ্যেই রয়েছে প্রত্যক্ষ প্রতিমা।  

পাষান ভাঙ্গিয়া গেল – জননী আমার

এবার দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!

জননী অমৃতময়ী!  

তথ্যসূত্র


[i] https://www.prothomalo.com/opinion/column/‘সবার-উপরে-মানুষ-সত্য-তাহার-উপরে-নাই’/

[ii] Rabindranath Tagore – Songs – আনুষ্ঠানিক সংগীত – একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে (ekdin jara merechhilo tare giye) (tagoreweb.in)

[iii] Rabindranath Tagore – Verses – পুনশ্চ – মানবপুত্র (manabputro) (tagoreweb.in)

[iv] https://advocatetanmoy.com/2020/07/12/dharma-prachar-rabindranath-thakur/

[v] বিসর্জন- পঞ্চম অঙ্ক- চতুর্থ দৃশ্য, ৮৪ | রবীন্দ্র রচনাবলী (nltr.org)

[vi] balmiiki protibha by Rabindra Nath Tagore (iopb.res.in)

[vii] balmiiki protibha by Rabindra Nath Tagore (iopb.res.in)

[viii] পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) – বিশ্বভারতী.pdf/২৮৪ – উইকিসংকলন একটি মুক্ত পাঠাগার (wikisource.org)

[ix] সুচিত্রা মিত্র ও সুভাষ চৌধুরী সম্পাদিত রবীন্দ্রসংগীতায়ন, পৃ ১৫০

[x] Lyrics and Data (gitabitan.net)

[xi] ধর্মীয় উগ্রবাদ ও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ (jugantor.com)

[xii] RBVBMS_134(i) :: Manuscript of Rabindranath Tagore :: Bichitra Tagore Electronic Hypertext Project :: School of Cultural Texts and Records (jdvu.ac.in)

[xiii] https://www.prothomalo.com/opinion/column /মানুষের-ধর্ম-রবীন্দ্রনাথ-ও-সমকালীন-প্রাসঙ্গিকতা/ [মানুষের ধর্ম: রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা নিবন্ধে সন্‌জীদা খাতুন]