July 1, 2022

কবি নজরুলের ভাবনায়  স্বদেশ ও বিশ্ব

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড.শ্রাবণী সেন

অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709

বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম কবিব্যক্তিত্ব ও রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রভাবমুক্ত নজরুল ইসলাম শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপেই স্মরণীয় নন, তিনি বাংলার  অন্যতম কবি, গণকবি। তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার কাব্যিক রূপায়ণ তাঁকে ঐতিহ্যচেতনার কবি, স্বদেশচেতনার কবি, সমাজবাস্তবতার কবিরূপে চিহ্ণিত করেছে। তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক মতাদর্শ, সাম্যবোধ, বিশ্বপ্রেমিকতা ও আর্ন্তজাতিক চেতনা তাকে আধুনিক কালের  সমাজজীবনে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরূপে চিহ্ণিত করেছে।

নজরুল ইসলামের কবিতায় বিশ্ববোধ, আর্ন্তজাতিক চেতনা জাগ্রত হয়। তাঁর কবিতায়, গানে যে মানবপ্রত্যয়, সাম্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা লক্ষ্য করা যায় তাকে কবির আর্ন্তজাতিক বোধের ও উপলব্ধির প্রকাশ বলা যেতে পারে। অন্ন-বস্ত্রের স্বাধীনতা তাঁর কাছে জীবনের মৌলিক প্রোয়জন বলে পরিগণিত হওয়ার  মূলে রয়েছে  সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাব । তিনি ঘোষণা করেন –

‘গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’

রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন,  শ্রমিক-মালিক, সাহেব-কুলি ইত্যাদির সমাজ সৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের রূপ । সামাজিক শোষণর দ্বারা নিপীড়িত ও অপমানিত মানুষের অমর্যাদা, সমগ্র বিশ্বাসীর মধ্যে যারা অপমানে অবনত তাদের সম্পর্কে কবিচিত্ত ছিল সমবেদনায় উদ্বেলিত-

একজনে দিলে ব্যথা

সমান হইয়া বাজ সে বেদনা সকলের বুক হথা।

একের অসম্মান

নিখিল মানবজাতির লজ্জা – সকলের অপমান।

এই দীনদরিদ্র, উপেক্ষিত ও অবহেলিত মানুষ – যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কি ভারতে কী বিশ্বের অন্যান্য দেশে শোষণ, বঞ্চনা ও সীমাহীন অত্যাচরের শিকার হয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সান্ত্বনার ও সংগ্রামশীল হওয়ার  বার্তা দিয়েছেন বিদ্রোহী কবি। স্বদেশের কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা ব্যক্ত করেছেন তাঁর ফররিয়াদ কবিতায় –

জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়,

সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।

মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,

মাটির মালিক তাহারাই হন –

যে যত ভণ্ড ধরিবাজ আজ সেই তত বলবান।

নজরুল যে সংগ্রামশীল জাতিয়তাবাদের প্রতি আস্হাশীল ছিলেন তার প্রেরণা লাভ করেছিলেন বাংলার  নেতৃবৃন্দের বৈপ্ললবিক চিন্তাভাবনা ও রাষ্ট্রীয় কর্মোদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে। ১৯০৫ খ্রীঃ যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী  আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৯২১ খ্রীঃ রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও সমসাময়িক অন্যান্য কবিতার মধ্যে দিয়ে নজরুল হিন্দু -মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে  সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূরীকরণের জন্য এক ঐতিহাসিক অকুণ্ঠ প্রয়াসে ব্রতী হন। নজরুলই সর্বপ্রথম কবি-সাহিত্যিক, যিনি তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণস্বাধীনতা দাবি করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় যদি পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধার মনোভাব বর্জন করতে না পারে তা হলে ভারতের কল্যান উন্নতি এবং স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। কবি বলছেন-     

“মুক্তির লাগি মিলনের লাগিআহুতি যারা দিয়েছে প্রাণ,

হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরাগাহিয়া তাদের বিজয়গান।”

নজরুল ইসলামের গান ও কবিতায় স্বদেশের বন্দনা ও বর্ণনা আছে। কিন্তু তা কোথাও নিছক আবেগ বা অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর দেশপ্রেম ও স্বজাত্যপ্রীতি জাতীয়তাবোধের পটভূমিকায় বিকশিত হয়েছে। দেশপ্রেমের আবেগকে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খা, মুক্তি কামনাকে ও স্বাধীন হওয়ার বাসনাকে তাঁর কবিতায় গানে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কাছে দেশপ্রেম ছিল মানুষের ব্যথা-বেদনাকে অঙ্গীকার করে নেওয়া। সেইজ্যই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল- ‘স্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি।’ এই অসহায় দুঃখী  মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে, চির-রহস্যের অবগুণ্ঠন মোচন করবে, এই ধূলার নীচে স্বর্গ টেনে আনবে। এ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি।’

বাংলার জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের সময় রচিত নজরুলের কোরাস গান  যৌথসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ দিক খুলে দিয়েছে। জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ও মুক্তিসংগ্রামস্পৃহা এই সব গানর মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’,’আমরা শক্তি আমরা বল’,’এই শিকল পরা ছল’ ,’কারার ঐ লৌহ কপাট’ প্রভৃতি গানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুতীব্র স্বাধীনতা স্পৃহা প্রকাশিত হয়েছে।

দেশকে স্বাধীন করাই ছিল নজরুলের ব্রত। সৈনিক জীবনের নির্মম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, ব্রিটিশ রজশক্তির বিরুদ্ধে বাংলার সাহিত্য – আকাশে আবির্ভূত হলেন প্রজ্জ্বলিত ধূমকেতুর মত। মুক্তি আন্দোলনের একজন জনপ্রিয় পতাকাবাহী হয়ে দাঁড়ালেন নজরুল। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারত জেগে উঠলে আন্দোলনের আহ্বানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক কৃষক ও মজুর। দ্বিজেন্দ্রলাল, সত্যেন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি তরুণ মনে উৎসাহের তরঙ্গ নিয়ে  এল নজরুলের গান –               

চল্ চল্ চল্

উর্দ্ধ গগনে বাজ মাদল

নিম্নে উতলা ধরণীতল

অরুণ প্রাতের তরুণদল

চল্ রে চল্ রে চল্।

নজরুল চেয়েছিলেন দুটি সম্প্রদায়ের  বিভেদ-বিদ্বেষের অবসান, চেয়েছিলেন পারস্পরিক সম্প্রীতি। তিনি  যেন সমগ্র ভেদ-বিভেদ-কলুষিত ভারতের মধ্যে এবং হিংসা হানাহানি -বিধ্বস্ত ভারত জনজীবনের মধ্যে প্রদীপ্ত আধ্যাত্মিকতার অনির্বাণ বহ্ণি। মানুষ-মানুষ-মানুষ: ধর্মীয় সংকীর্ণতা নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প নয়, আগামী দিনে চলার পথ মানব-হদয়-বন্ধন-দেশের জনজীবনে ঐক্য-

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

  কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মা’র।     

স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামমের সঙ্গে একসূ্ত্রে গ্রথিত করে তিনি লিখেছেন -“আজ যখন বিশ্ব মুক্তির  জন্য, শৃঙ্খল ছিঁড়িবার জন্য উণ্মাদের মতো সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিতেছে, স্বাধীনতা যজ্ঞের হোমানলে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দলে দলে আসিয়া নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়াইয়া দিতেছে, তাহাদের মুখে শুধু এক বুলি  মুক্তি মুক্তি মুক্তি! হস্তে তাহাদের মুক্তির বিষাণ, শিয়রে তাহাদের মুক্তির তৃপ্তি ভরা মহাগৌরবময় মৃত্যু।” স্বাধীনতাপ্রিয় সংগ্রামী মানুষের তথা মুক্তিকামী বিশ্বমানবসমাজের প্রবল অভীপ্সা প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের কবিতায়-

আমি ধূর্জটি,আমি এলোকেশে ঝড় অকাল -বৈশাখীর

আমি বিদ্রোহী,আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ববিধাত্রীর।

বল বীর-

চির-উন্নত মম শির।

দেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধে আত্মবলিদানে স্মরণীয় বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে জানিয়েছেন অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা –

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল  যারা জীবনেরজয়গান,

আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা,দিবেকোন্ বলিদান?…..

স্বাধীনতা -সংগ্রামীদের উদ্দেশ্যে কবি  অগ্রসর হবার আহ্বান  জানিয়ে বলেছেন –             

                              কারার ঐ লৌহ কপাট

ভেঙে ফেল, কররে লোপাট

রক্ত জমাট

শিকল পূজার পাষাণ বেদী।

নজরুল  হিন্দু নন, আবার ঐস্লামিকও নন – তিনি মানবতাবাদী। ঊনিশ শতকের  নবজগরণের মানবতাবাদমূলক ধারার অন্যতম পূজারী। ধর্ম ও জাতীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর মত প্রকাশ করলেও  তিনি ধর্ম ও যুক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্ট করছেন এবং ধর্মকে সম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল মুক্ত করে উদার পটভূমিকায় আনতে চেয়েছেন। সমন্বয়বাদী মনোভাবের দ্বারা নানা সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রয়াসী হয়েছেন।

নজরুল  শুধু দেশপ্রেমিকই ছিলেন না,ছিলেণন বিশ্বপ্রেমিকও। নজরুল বিশ্বাস  করতেন যে ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবন বিকশিত হলেও তার মানসিক উদ্বোধন, বিবর্তন ও পরিণতি ঘটে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে। মানুষের মহত্তম বিকাশ ঘটে সংস্কৃতি জগতে। আর সেই সংস্কৃতির জগৎ  হল আর্ন্তজাতিকতার সংস্কৃতির জগৎ ।

নজরুলের কবিতার মূল সুর সাম্যবাদ ও মানব প্রত্যয়ের সুর। নজরুলের কবিতার মৌল উপাদান শ্রেণীসচেতনতা ও সাম্যচেতনা তার মর্মমূলে রয়েছে আর্ন্তজাতিকতাবোধ। তার আর্ন্তজাতিকতার সর্বোত্তম  প্রকাশ,  ‘অন্তর-ন্যাশ্যানাল সঙ্গীত’-এ। নজরুল ইসলাম  ইন্টারন্যাশ্যানাল  সঙ্গীতের নাম দিয়েছেন- ‘অন্তর-ন্যাশ্যানাল সঙ্গীত’। এই গানের মধ্যে দিয়েই মজুর শ্রেণীর আর্ন্তজাতিকতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠেছে। সারা দুনিয়ার মজুর শ্রেণীর মধ্যে  যে একটা সংঘব্ধতা আছে  তাও প্রকাশ পায় এই গানের মধ্যে দিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় এ গানটি গাওয়া হয় একই সুরে। বাংলায় আর্ন্তজাতিক সঙ্গীতের প্রথম অনুবাদ করেছেন নজরুল। মুজফফর আহমেদের অনুরোধে ‘ইন্টরন্যানাল’ সঙ্গীতের অনুবাদ করেন-

জাগো…..

জাগো অনশন বন্দী, ওঠরে যত

জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্য হত

যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি,

হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী…..

নজরুল তাঁর সাহিত্যে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কতি, সাহিত্য দর্শন, দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতা-সংগ্রাম চিন্তা, ভারতীয়ত্ব এবং বাঙালীয়ানাকে এমন ঐক্যসূত্রে বেঁধেতুলছেন যার কোন তুলনা আমাদের দেশে নেই।

নজরুল বাঙালী-আত্মার বাণীমূর্তি। তাঁর কথা-

“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু- মুসলমান

মসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রণ।।”

তিনি আবহমান ভারতবর্ষীয় উদার বিশ্ববোধ ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির যোগ্য বাণীবহ -বিশ্বে বহুসম্প্রদায়ের কাঙ্খিত ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কবি-মনীষী।

তথ্যসূত্র

১। ড. সুশীল কুমার গুপ্ত -নজরুল চরিত-মানস।

২। কল্পতরু সেনগুপ্ত – নজরুলগীতি অন্বেষা।

৩। মধুসূদন দত্ত – নজরুল কাব্য পরিচয়।

৪। আব্দুল আজীজ আমান – নজরুল পরিক্রমা।

৫। ব্রক্ষ্মমোহন ঠাকুর – বাংলা নাটকে নজরল ও তার গান।