জয়ন্তী মন্ডল

বিশ শতকের নারীর রূপকথার মতো লড়াইয়ের গল্প। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বাংলার সুবাসিনী মিস্ত্রী তার শক্ত দুটি হাতের মুঠিতে ধরলেন ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার। মাত্র দুবছর আগে পদ্মশ্রী পেলেন সুবাসিনী। বয়স আশি পেরিয়েছে। কিন্তু মনে সাহসের অন্ত নেই। এখন সুবাসিনী মিস্ত্রীর নাম জগৎ জুড়ে। বলিউডের তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া মুম্বাইয়ের এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সুবাসিনীর হাত ধরে বলেছিলেন ‘আপনার হাত টুকু ছুঁয়েই আমার তৃপ্তি’। ছিয়াত্তর ছুঁইছুঁই সুবাসিনী দেবী দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে একটুও ক্লান্ত হননি। লক্ষ লক্ষ মেয়েকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখালেন। সেই কবে চার ছেলে মেয়েকে রেখে ডায়েরিয়ায় চলে গেলেন দিনমজুর স্বামী। নিঃসহায় অবস্থায় পথ চলা শুরু হল। ঘোমটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে শুরু হলো নতুন লড়াই। প্রথমে ভিক্ষে, তারপর মাটি কাটা, তারপর চারবেলা বাড়ি বাড়ি কাজ। এরপর শুরু হল হাটে সবজি বিক্রি। কত কি যে করলেন একটা জীবনে।
কিন্তু সিদ্ধান্তে অচল। স্বামীর মত যেন আর কেউ এমন অকালে চলে না যায়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা একটা হাসপাতাল করতে হবে। দুহাতে পাল্লা দুটো শক্ত করে ধরে সবজি বিক্রি করে চলেন। একদিন সেই সবজি বিক্রির টাকা তুলে দিলেন মানুষের বাঁচার আশ্রয় হাসপাতাল গড়তে। এসব যেন রূপকথা।
ঠিক এমনই প্রায় এক যুগ আগে আর এক নারীর কথা মনে পড়ে যায়। হৈমবতী সেন। আরেক নারী লড়াইয়ের কান্ডারী। উনিশ শতকের শেষ লগ্নে ১৮৯৪ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল থেকে ডাক্তারি পাশ করে হুগলির ডাফরিন হাসপাতালে যোগ দেন। অবশ্য ক’বছর আগেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রথম মহিলা ডাক্তার হয়ে বাংলায় জনপ্রিয়।
তবে বাল্যবিধবা হৈমবতী সেন এর ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম। বাংলা তখনো কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে। বাল্যবিধবা হৈমবতী নানা দুঃখের বৈতরণী পেরিয়ে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেলেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় পাঁচটা মেডেল নিয়ে পাশ করলেন। তারপর হৈমবতী যোগ দিলেন হুগলীর ডাফরিন হাস্পাতালে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা করেন। অবশ্য তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে ডাক্তারের মর্যাদা দেননি। তাঁদের ভাষায় তিনি শিক্ষণ প্রাপ্ত দাই মাত্র। হৈমবতী অবশ্য এসব কথায় কান দেননি। তিনি নীরবে নিজের দায়িত্ব পালন করে একদিন হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় ‘ডাক্তারদিদি’। সেই উনিশ শতকের যুগেও হৈমবতী দেখিয়েছিলেন সাদা থান শেষ কথা নয়। সাদা থান থেকে অ্যাপ্রন তৈরি করা হয়। ইচ্ছে আর মনের জোর থাকলে ভাগ্যের চাকাটা একেবারে উল্টে দেওয়া যায়।
এ যুগের মেয়েদের কাছে এসব যেন গল্প কথা। আজকের নারীরা অনেক বেশি শিক্ষিত। ‘কন্যাশ্রী’র মতো কিছু প্রকল্প একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদেরও কিছুটা শিক্ষার আঙিনায় আনতে সক্ষম হয়েছে ঠিকই। তবু তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষা নিতে যাওয়ার সংখ্যা কম। তবে পরিসংখ্যান বলছে গত এক দশকে সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে একটা ক্লাসে তিনজন মেয়ে থাকত এখন সেখানে একটা ক্লাসে থাকে পঁচিশ-তিরিশ জন মেয়ে। তেমনি সামাজিক কাজে, রাজনীতিতেও মেয়েরা বেশ সক্রিয়। যা চোখে পড়ার মতো। এখন মেয়েরা একা দল বেঁধে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। কেউ কেউ বলেন, এ যুগের মেয়েরা বড্ড বেশি ক্যারিয়ারিস্ট। পড়াশোনা শেষ করেই নামিদামি কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরিতে ঢুকে পড়ে। একজন শিক্ষিত নারী স্বনির্ভর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে ওঠে আত্মপ্রত্যয়ী। আশপাশের নানা সমালোচনা উপেক্ষা করে ঝড় তুলে দেয় নিজের কর্ম ক্ষেত্রে। কারো মতে আজকের ছেলে মেয়েদের দায়-দায়িত্ব কম তাই তারা এত বেশি নিজের তৈরি স্বপ্নের জগতে পাড়ি দিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পিছপা হয় না। ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম।
আমরা তো দেখি বাংলার একটা মেয়ে জার্মানির একটা কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে জার্মানিতে বসে ভারতে থাকা মা-বাবাকে ট্রেনে বা প্লেনের টিকিট কেটে দিচ্ছে চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোরে ডাক্তার দেখানোর জন্য। এমনকি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পর্যন্ত করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয় সব ডকুমেন্ট। আজকের মেয়েরা নিজেদের দায়িত্ব যেমন নিজেরাই নিয়েছে, পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব পালন করতেও পিছপা হয়না তারা। আসলে আজকের মেয়েরা নিজেদের দুর্ভাগ্যের চাকাটা পাল্টে দিতে বদ্ধপরিকর।
ছেলেরা যা পারে এ যুগের মেয়েরা পারেনা এমন কিছু নেই। এমন খুব কম জিনিসই আছে যা মেয়েরা পারেনা। ট্রেন চালানো থেকে প্লেন চালানো এখন মেয়েরা সবই পারে। সেই সঙ্গে সমানতালে ছেলেদের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতেও তারা সক্রিয়। ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে যেমন মেশে। আবার রাত করে বাড়ি ফিরতেও ভয় পায় না। এটা বিশ্বায়নের একটা অন্যতম কারণ।
তবু প্রতিবন্ধকতা অনেক। এখনো নির্জন পথে হেঁটে যেতে ভয় পেতে হয় মেয়েদের। এখনো একটু রাত হলেই মা, বাবা, স্বামী, সন্তান দুশ্চিন্তা নিয়ে বারবার ফোন করেন। একুশ শতকেও ঘটে সামসাবাদ, কামদুনির মতো ঘটনা। আজও কাগজ খুললেই চোখে পড়ে পণের দাবি না মেটায় বধূহত্যা। তবে সেটা কি ভারত উন্নতশীল দেশ বলে! প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মত যদি নারীদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হত, তবে হয়তো শত শত নারী এত অত্যাচারের শিকার হতো না।
এছাড়া এখনো মেয়েদের নিজেদের মনের কিছু মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। মেয়েরা সে দিক থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে। তাই তো একটা চাকুরিরতা মেয়ে চাকুরী করা পুরুষকে স্বামী হিসেবেই নির্বাচন করতে চায়। আবার চাকুরে মেয়ে তুলনায় কম রোজগেরে ছেলেকে বিয়ে করলে আত্মীয় স্বজন থেকে পাড়াপড়শি পর্যন্ত নাক তুলতে দ্বিধা করে না। অনেক মেয়েকে চোখে পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার সময় দানের ঘড়া থেকে নতুন সংসারের ফ্রিজটি পর্যন্ত উৎফুল্ল চিত্তে বাবার জমানো সঞ্চয়ের টাকায় কিনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। আসলে শিক্ষায়, স্বাধীনতায় এগিয়ে থাকলেও মেয়েদেরো সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। শুধু গানে কবিতায় নয়, দরকার হাতে কলমে নিজেদের সচেতনতা বাড়ানো।
২০১৯ এ আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ‘উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর অধিবেশনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যক্তিত্বময়ী নারীরা অংশ নেন। ভারতের প্রতিনিধি প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বলেন তিনি ইউনিসেফের গুডউইল অ্যাম্বাসাডার থাকার সময় দেখেন প্রথম বিশ্বের নারীদের অবস্থাও খুব সুখকর নয়। এমন অবস্থায় ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ নারীদের অবস্থা যে আরো খারাপ হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু আশার কথা এ যুগের মেয়েদের যে যতই ক্যারিয়ারিস্ট ভাবুক একুশেও মেয়েরা সমাজের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে, স্লোগান তোলে। ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নানা দিক থেকে হাজারো তোপ সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও স্লোগান তোলে ‘হোক কলরব’।