আমার ভুবন : জন্মশতবর্ষে মৃণাল সেনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ
ড: প্রতীতি প্রামাণিক দে গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ সঙ্গীত বিভাগ – ৯ ৪৩৩৩০৮ ১২০
চলচ্চিত্র নামক আধুনিক শিল্প মাধ্যমটিই শুধু নয়, যে কোন শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রে দেখা গেছে শিল্পীর শিল্পবোধ ও জীবনবোধ দুয়ের সমন্বয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছায়া তাঁদের সৃষ্টিতে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর অর্জিত শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রে বিকল্প ধারার ছবি বহুকাল থেকেই গুণীজনদের দ্বারা সমাদৃত হয়ে আসছে । বিশেষ কোন ছবি মুক্তিলাভ করলে তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা পর্যন্ত ঘটেছে । এই আলোচনা বা সমালোচনাগুলির নেপথ্যে রয়েছে শহরের ফিল্ম সোসাইটিগুলির বিশেষ অবদান। সেইসব সমালোচকরা যাঁরা একাধারে চলচ্চিত্রকার ও সমালোচক, সাহিত্যস্রষ্টা ও সমলোচক বা শিল্প-শিক্ষা-গবেষণার মতো নানা শাখায় বিচরণ করেন ।মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের দর্শনটাই ভিন্ন । তার তৈরি চলচ্চিত্রে কোন গল্প থাকে না, স্টোরিলাইন থাকে না । সিনেমার নিজস্ব যে একটি ভাষা আছে সেটা নিয়ে তিনি অনেক বেশী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন । তাই তাঁর ছবিতে ভালো অভিনয় হয় সবই হয় কিন্তু সিনেম্যাটিক ভাষাটা তাঁর ছবিতে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে ব্যবহৃত হয় । তাঁর ছবি খুব টেকনিক্যালি স্ট্রং । তিনি নিজেও ছবি তৈরি করার সময় টেকনিক্যাল দিকটা নিয়ে খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করেন।মৃগান সেনের ছবিতে সম্পাদনার কাজে। ছবির অন্যান্য দিকগুলি তৈরির কাজে একটা এনজয় করার মতো ব্যাপার থাকে । তাঁর ভাবনাচিন্তার সাথে আঙ্গিক দিকটি ভীষণভাবে মিলে যায়। অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব ষ্টাইলে সিনেমার একটি আলাদা ধারা তৈরি করতে পেরেছেন । তাঁর ছবিগুলিতে সমকালীন সময় প্রতিফলিত হয়েছে নানা আঙ্গিকে । সত্যজিৎ রায় – ঋত্বিক ঘটক ছাড়াও বাংলা ছবিতে সঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি তৃতীয় ধারা বহমান। আর এই ধারায় অগ্রণী পুরুষ হলেন মৃণাল সেন। তিনি তাঁর প্রথম পর্বের চিত্রপরিচালনায় সঙ্গীতকে যতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন, পরবর্তীকালে চিত্রভাবনা পরিণত হওয়ার সুবাদে তাঁর ছবিতে সঙ্গীতের ব্যবহার আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। তাঁর ছবিতে সঙ্গীত প্রয়োগ অত্যন্ত সংযত ও পরিণত 1আমার ভুবন :-মুক্তি – ২০০২প্রযোজনা- পি. ভি. গুপ্তাকাহিনী – আফসার আহমেদঅভিনয় – নন্দিতা দাস, কৌশিক সেন, শাশ্বত চ্যাটার্জি, বিভাস চক্রবর্ত্তী, অসিত বসু, অরুণ মুখার্জিসঙ্গীত পরিচালনা – দেবজ্যোতি মিশ্রমৃনাল সেনের এই ছবির শুরু সুভাষ নন্দীর একটি ষ্টীল ফটো দিয়ে । পর্দার মাঝখানে সাদা কালোয় খালি গায়ে ইজের পরা বছর সাত- আটের এক কিশোরীর ছবি । কোলে বছর দুয়েকের আর একটি বাচ্চা । অনাহার ক্লীষ্ট শরীর, ক্ষুধায় কান্ত মুখ নির্বাক বিহ্বল চোখ, আবহে পরপর বিস্ফোরণের শব্দ । কাট করে পর্দায় ভেসে ওঠে আকোর ওপর জ্বলজ্বলে সাদা অক্ষর – ““ পৃথিবী ভাঙছে · পুড়ছে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে 1তবুও মানুষ বেঁচে বর্তে থাকে মমত্বে ভালোবাসায় সহমর্মিতায় ।এরপর কয়েকটি দৃশ্যে ধরা পড়ে গ্রামবাংলার গন্ধ । অঞ্জন দত্তের নেপথ্য ভাষণে পরিচালক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন চরিত্রদের সঙ্গে – কাহিনীর মধ্যে কখন দর্শক প্রবেশ করেছেন তারা তা বুঝতেও পারেননি । কায়রো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসাবে মৃণাল সেন ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসাবে নন্দিতা দাস পুরস্কৃত হন । বিজ্ঞানের সাথে যেমন সমাজের নিবিড় সম্পর্ক তেমন চলচ্চিত্রের সঙ্গেও । চলচ্চিত্র আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির বড় অবদান এবং সাহিত্যকলার মত বিজ্ঞানও সংস্কৃতির অঙ্গ । মৃণাল সেন পরিচালিত এই ছবিটিতে তিনি ফিরে গেছেন সনাতনী মূল্যবোধে । একেবারে সহজ সরল প্রকাশ ভঙ্গীমায় । ছবি দেখতে বসে এই সরলতায় দর্শক আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিন্তু এই সরলতা বর্তমান সময় থেকে বিচ্ছন্ন নয়। বলা যেতে পারে এই ছবিটিকে সমকালীন পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখলে তবেই এই ছবিটির গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় ।এই ছবিতে পরিচালক একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। মম চিত্তে নিতি নৃত্যে । এই গানটি প্রয়োগের সময় প্রথমবার তিনি একটি রেডিয়ো ব্যবহার করেছেন । রেডিয়োর শখ বলে গল্পের নায়ক মেহের একটা ট্রানজিষ্টর সেট কিনে এনেছে । কিনে এনেছে তার পরিবারের জন্য আরোও কিছু শখের টুকিটাকি জিনিস । বাড়িতে ঢোকার মুখেই চালিয়ে দেয় রেডিয়োটি । গান বেজে ওঠে- ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে । সম্পূর্ণ পরিবারের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তাদের সকলের আনন্দ, আবেগ, বিস্ময় যেন একসঙ্গে কথা বলে ওঠে । এ এক অপূর্ব দৃশ্যায়ন । এখানে শুধুমাত্র গানের চিত্রায়নই নয়, ধ্বনি সঙ্গীত, শরীরি ভাষা ভিতরের আবেগ অনুভূতিকে বাইরে নিয়ে আসে । এই গানটিতে যে অবারিত আনন্দের উদ্ভাস ধরা পড়ে পরিচালক তাকেই মেলাতে চেয়েছিলেন মেহেরের আচরণের সঙ্গে। মেহের সখিনাদের জীবনে এই অবারিত আনন্দের ক্ষণিক স্পর্শটুকুকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন পরিচালক এই গানটি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। যে মুহুর্তে এক গরীব চাষী তার স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পারে মহার্ঘ্য উপহার, সেই উপহারই ফেটে পড়ে মায়াবী জাদুকরী সঙ্গীতের বিস্ফোরণে । ওই সামান্য মুহুর্তে উত্তীর্ণ হয় রবীন্দ্রনাথের অসামান্য বিশ্বছন্দ কল্পনার ধ্বনিতরঙ্গে বাস্তব উত্থিত হয় বাস্তবোত্তরের কল্পসম্ভাবনায় ।সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের স্মৃতিচারণা থেকে দেখা যায় গানটা তিনি ভেবেছিলেন শুধুমাত্র রেডিয়োতে শোনা যাচ্ছে এমনভাবেই প্রয়োগ হবে । তবে এই প্রয়োগ অতি সাধারণ হত । কিন্তু মৃণাল সেনের প্রয়োগের ভাবনায় গানটি ঠিকরে বেরিয়ে এসে জীবনের সাথে যোগ দিল। আমাদের জীবনের সঙ্গে চোখ মেলে দেখা বা চোখ বন্ধ করা জেমন প্রতি মুহুর্তে জড়িয়ে রয়েছে এই গানটাও সেরকম জন্ম- মৃত্যু- ভালোবাসা সবকিছুকেই আমাদের সামনে স্তরে স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। দুটি জায়গায় গানটি ব্যবহৃত হয়েছে । একেবারে শেষে ছন্দটা কেটে গিয়েছে। এটা চিত্র পরিচালকের ভাবনা । এই গানটিতে কণ্ঠদান করেছেন শ্রীকান্ত আচার্য্য। ছবির অনুষঙ্গ ধরেই গানটি এসেছে। তবে সঙ্গীতটি এই ছবিতে একটু বেশীই প্রাধান্য পেয়েছে ।এক্ষেত্রে একটি বিষয় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য । সত্যজিৎ রায় তাঁর চারুলতা ছবিতেও এই গানটি ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু দুটি গানের দৃশ্যানুযায়ী ব্যবহার সম্পূর্ণ বিপরীত । চারু ও ভুপতির হাত শূনো থেমে যাবে, মিলবে না কোনদিন, যেন হৃদয়ের মিলন হয়, কেবল সাংসারিক স্থিতি । ‘নষ্টনীড়ে’র ভূপতি ভাবতে পারে না যে তার স্ত্রী তার চোখের সামনে পরপুরুষের স্মৃতি নিয়ে দিন কাটাবে । চারুলতায় এই গানের মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র ব্যবধান সূচিত হয়েছে। কিন্তু ‘আমার ভুবনে ভালবাসার জগৎ উন্মোচিত। সখিনার প্রাক্তন স্বামী নুর স্ত্রীকে হৃদয়ে প্রথম স্থান দিলেও সখিনাকে ভুলতে পারে না । বিপরীতভাবে সখিনাও ভুলতে পারে না নূরকে । নূরের সঙ্গে সখিনার দ্বিতীয় স্বামী মেহেরের অহি-নকুল সম্বন্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু আমার ভুবনের নিয়ম তা নয় । এখানে বালবাসা হৃদয়ের মণিকোঠায় জমা হয়ে থাকবে কিন্তু প্রকাশ্যে দেখা দেবে না । এই গানটিই আবার ছবির উপসংহারে আরোও ব্যঞ্জনাময় হয়ে ফিরে আসে । তাই ‘আমার ভুবনে’র এই সারলা দর্শকদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে আছে ।